মেঠোসুর কলরব : আবহমানের উৎসব || রূপকার

মেঠোসুর কলরব : আবহমানের উৎসব || রূপকার

শেয়ার করুন:

 

উৎসবে সব রকমের মানুষের অংশগ্রহণ লাগে। একজন আরেকজনকে প্রভাবিত করতে গেলে শিক্ষা, লোকশিক্ষার জায়গাগুলো থাকতে হয়। লোকমানুষ দৈনন্দিন জীবনাচারে প্রাণ হারিয়ে এখন অনেকটাই বেপথু। অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থান শতভাগ জনগণকে দেয়ার পুরো সক্ষমতা এখনো আমাদের বাস্তবিক অর্থে তৈরি হয়নি। তারও তো যন্ত্রণা আছে। এসব যন্ত্রণা প্রশমিত করার গান লাগে। ঘুরে দাঁড়াবার, প্রেমে বাঁচবার, বাঁচাবার লালিত স্বপ্ন লাগে। আজ যা হয়নি আগামীদিনে হবে — এইসব স্বপ্ন, দ্রোহ দেখানোর মানুষ শিল্পসমাজে সবদিক থেকে আদরণীয়। বাস্তবে তা কতটুকু? শিশিরবিন্দু দূরে দেখা যায়, কাছেও। দু-রকমের অনুভূতি। মানুষ চিরকাল প্রেমিক-অপ্রেমিক, অনুরাগ-বিবাগী ভরপেট খাবার আগে-পরে গানআশ্রয় পেতে চায়। যে-আশ্রয় শুধু সুখানুভূতি নয় কখনো কখনো সুন্দরের দিশা, কখনো কখনো অন্ধকারে আলোজ্বলা শক্তি।

ইতিমধ্যে গানবাজনা কমেছে। কোভিড পরবর্তী অন্য এক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। নৈতিক-অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলে অনেকেই নাজেহাল, কেউ কেউ পরিণতি ঠেকাতে জীবনপণ সংকটে।

মেঠোসুরের যাত্রাপথে কোলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম

‘সুরমানদীর গাঙচিল তুমি মোদের বাড়ি এসো
শঙ্খচিলের কণ্ঠ তুমি ভাটির সুরে কোয়ো।’

‘বুধালয়’ আমার বাসা। ভারতীয় নাকতলা অঞ্চলে থাকি। উড়তে উড়তে একবার পৌঁছে গিয়েছিলাম সিলেট, সুনামগঞ্জ। সাময়িক আলাপ, পরিচয়। হারমুনিয়াম-দোতারা, এই করতে করতে দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠছিল বিমানদার সাথে। এরপর আরো দু’তিনবার একরাশ উত্তেজনা নিয়ে মাইলের পর মাইল পার করে পৌঁছে গেছি ‘মধুশহীদ—৪২’-এর ঠিকানায়। জয়কলসের কুয়াশামাখা শীতল ভোরে লালভাইয়ের অপেক্ষা, দাদা এখনি পৌঁছে যাবেন!

‘কত আশা বাসনার পরে বন্ধুকে তুই পাবি রে মন,
কি দিয়ে ধুয়াবি তার পদ্মচরণ’—
বিমানদারা কোলকাতা আসছেন।

এই লেখায় কিছুটা ওলটপালট করে ‘মেঠোসুরের যাত্রাপথে কোলকাতা থেকে ঝাড়গ্রাম’ নির্মাণ করা। দেশ-কাল-সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে কোথাও এক হয়ে ওঠার স্বপ্নে ভরা।

বিমানদার এর আগে একবার আসার কথা ছিল বুধালয়ে। আমার বাবা অচিন্ত্যময়ের লেখা গণসংগীতের বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। শেষমেশ পারেননি। বইটি বাংলাদেশ, সিলেট মিনতি প্রকাশনী  থেকে প্রকাশ হয়েছিল। ‘গণগীতি পঞ্চাশ’ বইয়ের প্রকাশক তিনি। বাউলশিল্পী লাল শাহ ও আনন্দ গ্রাফিক্সের গ্রাফিক্সডিজাইনার মুমিনের মাধ্যমে কাজটি আলোর মুখ দেখেছিল। পূর্ণাঙ্গ বই প্রস্তুতকরণে শান্তিগঞ্জের দুলন তালুকদারও এই কাজটিতে নানাভাবে সহযোাগিতা করেছিলেন।

বাউলশিল্পী লাল শাহ একবার একাই এসেছিলেন বুধালয়ে। পাশাপাশি দেখে গেছেন ঝাড়গ্রাম। বারবার দেখার ইচ্ছেতে আমি তাদের সাথি হয়েছিলাম। সঙ্কল্পে—মেঠোসুর। ওদুদভাই (এম এ ওয়াদুদ), শীতনবাবু (শীতন কান্ত দাস), লাল বাউল, বিমানদা আর আমি রূপকার। সাথে একটা দোতারা, ডুবকি, মন্দিরাও সবসময় সঙ্গী। দেখা যেত, আমাদের গন্তব্যে ঠিক একটা হারমুনিয়ামও কীভাবে যেন পৌঁছে গেছে। সুরমা-সুনামগঞ্জের পরশে তার বেলোয় ভেসে চলত —

‘কই যাও রে ভাটিয়াল নাইয়া
ললিত সুরে গাইয়া গান’

লালভাইয়ের কণ্ঠে, ওদুদভাই হারমুনিয়ামে, বিমানদা কখনো দোতারা, কখনো মন্দিরায়, আর ডুবকিতে শীতনবাবু। আমি সুযোগ পেলেই দোতারা কি সারিন্দা হাতে বসে পড়তাম।

পেশাদার এক নাবিক আমি। কখনো কখনো দূরলগ্ন, বিচ্ছিন্নতার আবর্তে থাকলেও আমার বাবা-মা দু’জনাই ততোধিক সামাজিক। সাংস্কৃতিক সেবায় তারা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। সেবায় তাদের উত্তেজনাও কিছু কম নয়। বাবার আলোকসংগীতের মহড়ায় উপস্থিত থেকে বিমানদা, লালভাই একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করলেন। আমিও তাতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। মা-র অনন্য আন্তরিতায় চালানো শিল্পকলা, সাংস্কৃতিক বিষয়ক কার্যক্রম — ‘অরূপরতন চারুকলা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠানে একদিন সন্ধ্যায় ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। ওপার-বাংলার কিছু কথা কিছু গান মূলত বিমানদাদের কেন্দ্র করেই। ধামাইল শোনালেন, শোনালেন কবি ও অনুবাদক জাহেদ আহমদ ভাইয়ের বেশ কিছু গান, কবিতা। প্রত্যেকেই তা উপভোগ করলেন।

একদিন ওয়েস্টবেঙ্গল আর্ট কলেজে, অভীকবাবুর আমন্ত্রণে, আমরা ‘মেঠোসুর’ ব্যানারে আমাদের গান মঞ্চস্থ করলাম। সাথে সর্বক্ষণ ছিলেন রুনাদিদি। উনি লালভাইয়ের বিশেষ অনুরাগী, ভক্ত। বিমানদার সাথে ফোনে যোগাযোগের সূত্রে বুঝতে পারছিলাম মেঠোসুর কার্যক্রমের সার্বক্ষণিক খবরাখবর রাখছিলেন লন্ডনপ্রবাসী সংগীতশিল্পী ও সংগঠক আঁখি দে। তখন তিনি ভারতে। কোলকাতার নানা জায়গা পরিভ্রমণ করছিলেন। সমস্ত আয়োজন, পরিবেশনার খবরাখবর রাখছিলেন। চাইছিলেন অনুষ্ঠানে থাকতে কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি।

কলকাতা সরকারি আর্ট কলেজে যখন অনুষ্ঠানের জন্য যাই তখন বেশ খানিকটা সময় আমাদের হাতে ছিল। আমরা ঠিক করলাম পাশেই জাদুঘর, জাদুঘর দেখে আসা যায়। টিকিট কেটে ঢুকতে গেলে, টিকিটচেকার আমাকে জিজ্ঞাসা করলো — ‘আপনারা কি বাংলাদেশি? ফরেনারদের টিকিট আলাদা’। যা-ই হোক, আমাদের আর ভারতীয় জাদুঘর দেখা হলো না। দিদি আমাকে অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন, এক সন্ধ্যায় ওনার বাড়িতে গানের আড্ডা যেন কোনোভাবেই বাদ না পড়ে।

আমরা গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। রুনাদিদির পরিচিত মহলের সাথে আমরাও পরিচিত হলাম। এসেছিলেন পল্লব ভট্টাচার্য, উনি ভারতীয় ডাকবিভাগে পোস্টমাস্টার পদে কর্মরত। এছাড়াও উনি একজন সংগীতগুণগ্রাহী, আবৃত্তিকার। বিভিন্ন ক্লাব এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। এসেছিলেন ড. মনোজিৎ দাস। উনি রামকৃষ্ণ মিশন নরেন্দ্রপুর শাখার যোগাবিভাগের অধ্যক্ষ, একজন পেশাদার গিটারবাদক। উনিও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত, পাশাপাশি একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। খুব সুন্দর এক সাংস্কৃতিক আড্ডা, সন্ধ্যা আমরা উপভোগ করলাম সক্কলেই।

ক্ষণিকের বিশ্রাম, একটু বাতাস, প্রকৃতি দেখে লালভাই বলে উঠলেন — ‘আমাদের হাওর’, ‘হুগলীর হাওর’। কোলকাতা, পাশ্ববর্তী অঞ্চল কিছুটা ঘুরে বেড়ানোর পর আমাদের গন্তব্য ঠিক হয়েছিলো হুগলী জেলার ধনিয়াখালি। যাত্রাপথে ক্ষণিকের বিশ্রাম, এক ধানকাটা জমিতে বসে। শীতনবাবু এবার গভীর অনুরাগে গান ধরলেন —

‘রসের ফুল ফুইটাছে গো, প্রেমের বাগানে
দয়াল মুর্শিদ বিনে প্রেমের তালা খুলব কেমনে?’

এই শীতনবাবু সুনামগঞ্জ-সিলেটের সুনামধন্য মানুষ। এখন সিলেটে অবস্থান করেন। মূলত বৃহত্তর সিলেটের আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। পিতা উস্তাদ নিশিকান্ত দাস যাত্রাশিল্পী ও হারমুনিয়াম বাজানোর মাস্টার হওয়ায় ছেলেবেলা থেকেই গানের সাথে বেড়ে ওঠেন শীতন। মা মালতি রাণী দাস। তিনিও নানা ধরনের ব্রতের গান, ধামাইল পরিবেশনে অনন্য। শীতনবাবু গড়ে তুলেছেন পিতার নামে শিল্পীসংগঠন ‘উস্তাদ নিশিকান্ত দাস শিল্পীগোষ্ঠী’। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তিনি। প্রতিবছর সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বাউলশিল্পীদের নিয়ে আয়োজন করেন গানের অনুষ্ঠান। অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের অতিথি সহ লন্ডন, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের শিল্পীরা। ইতিমধ্যে বেশকিছু ধারণকৃত গানের অডিও-ভিডিও অ্যালবাম তাঁর রয়েছে। গানের পাশাপাশি নিপুণ অভিনয়শিল্পের সাথে জড়িত শীতনবাবু লিখেছেন বেশকিছু গান, রম্যনাটকও। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী শীতনবাবু একাধারে যেমন গায়ক, তেমনি তাঁর সহজাত শিল্পীপ্রতিভার কোনো অঙ্গকেই বিচ্ছিন্ন করা যাবে না, সম্পূর্ণ মানুষটি একাধিক শিল্পী। আমি থেকে ‘আমি’ ক্রমশ বেরিয়ে এসে ‘আমরা’ হয়ে উঠছিল। আমাদের দলে শীতনবাবু সমানে দিয়ে গেছেন তাঁর অফুরন্ত হাসির রসের ভাণ্ডার, হাসির ছড়া, কী মিলেটারির মার্চপাস্ট! যা মনে করলে, কোনোদিনই আমরা না হেসে থাকতে পারব না। তাঁর সুমধুর কণ্ঠস্বর, হারমুনিয়াম, ডুবকি, আমাদের ঘিরে এক বলয় সৃষ্টি করে রাখত সবসময়।

মেঠোসুরের ‘যাত্রাপথে আনন্দগান’ একটি দলের জন্ম দিয়েছিল, যার নাম রাখা হয়েছিল ‘বিশ্বদল’। তাতে কখনো নাট্যনির্মাতা, প্রশিক্ষক, সম্পাদক, কোলকাতা সরকারি আর্ট কলেজে যিনি আমাদের যুক্ত করেছিলেন অভীক ভট্টাচার্য তবলায় সঙ্গত করে দিলেন, অন্য এক অনুষ্ঠানে ঝাড়গ্রামের রামুদা ঢোল নিয়ে বসে পড়লেন। এ এক মুক্ত পরিসর, তার কোনো সীমানা নেই।

ধনেখালির নবকুমারবাবুর কথা হয়তো কেউ কেউ শুনে থাকবেন। পরবর্তী গন্তব্য স্থির হল হুগলী জেলার ধনেখালির গ্রাম সমসপুর। নবদার আমন্ত্রণে আমরা ‘বিশ্বদল’ হাজির হলাম নবদার বাড়িতে। নবদা এক সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করেছিলেন। আমরা ওনার সাথে গ্রাম পলাশীর নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের ৭৫তম বর্ষ উদযাপনের এক সান্ধ্য মহড়ায় এসে উপস্থিত হয়েছিলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পার্থবাবুর সুদীর্ঘ ৪০ বছরের একনিষ্ঠ কর্মজীবনের অবসর ঠিক করা হয়েছিল সেই দিনেই, অর্থাৎ একই দিনে জন্মের প্রেরণা ও একই দিনে বিদায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুষ্ঠানের দিনে গিটার নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম, ততদিনে বিমানদারা বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন।

পার্থবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন — ‘আপনার দেশের খবর ভালো তো’? বাকি বন্ধুদের কথাও জানতে চেয়েছিলেন। ঐ দিনের অনুষ্ঠানটি নিছকই অনুষ্ঠান ছিল না। আমরা সকলে দেখলাম মহড়া, নবদার পরিচালনায় গীতিআলেখ্য — ‘চড়কডাঙার স্কুলের কথা’। সেই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকেরা যাদের নিত্যদিন কাটে রান্নাঘরে, কি চারপায়া টেবিলের কানায়-কোনায়। আপন হতে তারা বাহির হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। গানে গলা মিলিয়েছেন, তাতে বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে বলে রাখি — গীতিআলেখ্যটির মূল রচয়িতা হলেন নবদা। বিষয়বস্তু, ‘বিদ্যালয়ের বাতিকে জ্বালালে নিজ হাতে, কারা তাকে বহন করে নিয়ে চলেছে দু’হাতে আগলে রেখে’। দীর্ঘ ৫ মাস তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনুষ্ঠান একেবারে দোরগোড়ায়। অংশগ্রহণকারীদের চাপা উত্তেজনা, নবদার প্রশিক্ষণ, অমন সুন্দর গ্রামীণ পরিবেশে পরিষ্কার, পরিপাটি একটি বিদ্যালয়। মহড়াশেষে বিমানদা শোনালেন ব্রতচারী গান, শীতনবাবু শোনালেন ভাটিয়ালি। শীতনবাবু তাঁর পিতা উস্তাদ নিশিকান্ত দাসেরও একটি গান গেয়েছিলেন।

লাল বাউল আগে যখন একা একবার ভারতে এসেছিলেন, তখন তাঁর শারীরিক কোনো অসুস্থতা ছিল না। এবারে ভারতে আসার আগে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাঁর কাঁধ ও হাতে গুরুতর চোট আসে। সার্জারি করে প্লেট বসাতে হয়। এ-যাত্রায় দেখলাম আগের মতো হারমুনিয়াম বাজাতে পারছেন না। তবুও চেষ্টার কমতি নেই।

ওদুদভাই, শীতনবাবু, লালভাই, বিমানদার কণ্ঠে দুইরাত কিছু গান রেকর্ড হলো ‘কণ্ঠ কও’ স্টুডিওতে। আসলে কিছু মুহূর্ত ধরে রেখে যাওয়ার চেষ্টা। এভাবেই দিন ক্রমে শেষ হয়ে আসছিল। তবু কোথাও যেন বিদায়বেলার আগমনীর সুর ভেসে আসছিল। ওদুদভাই আর শীতনবাবুকে বিদায় নিতে হলো। তারা সিলেট, সুনামগঞ্জ ফিরে গেলেন। আমরা তিনজন ভোররাতে বাসে তুলে দিয়ে তাদের বিদায় জানালাম।

এবারে আমরা তিনজন। পরবর্তী গন্তব্য ঝাড়গ্রাম। শালবন, মহুয়ার দেশ, মাতালিয়া ঝুমুর, মকর পরব। যদিও মকর সংক্রান্তিতে থাকা হবে কি না তখনো ঠিক হয়নি। আমাদের যাত্রাপথের মকর পরবের রাত কিছু বেশিই স্মৃতিময়। প্রায় সারারাত আমরা গান ধরে ছিলাম। পার্থদার বাড়ির উঠোন হঠাৎই অপূর্ব আবির-আল্পনায় রাঙিয়ে দিলো। অপূর্ব কাজ! শতরঞ্জি পাতা হয়ে গেল। প্রতিবেশিরা সহ দূরদুরান্তের নানা শ্রেণিপেশার সংগীতপিপাসু বন্ধুরা সবাই একে একে উপস্থিত হয়ে উপভোগ করলেন বিশ্বদলের পরিবেশনায়, আনন্দগানে মেঠোসুর। শিশুশিল্পী ত্রিনয়, তিয়াশার পরিবেশনাও মনে রাখার মতো। রামুদা হঠাৎ ঢোল নিয়ে বসে গেলেন আমাদেরই সাথে। পাকাদা, অমিতদা, পচাদা, মিতাদি, মাস্টার মহুল, মিস আঁখি, কাকলিদি, অপু, রকিদা, অরিন্দমদা, দেবলীনাদি, আমরা সকলে মিলে অনেক গান গেয়েছিলাম। মূলত সেই রাত ছিল মকর পরবের ধামসা মাদলের রাত এবং ঝাড়গ্রামে আমাদের অবস্থানের শেষ রাত। দিনে বিমানদাকে নিয়ে দোতারায় ক্ষণেক্ষণে গাইছিলাম—

‘মকর পরবে, মদনা ছোড়া ধামসা বাজাইঞ্ছে’।

এই অনুষ্ঠানে স্থানীয় কয়েকজনও সুন্দর নৃত্য, কথাবার্তা, সংগীত পরিবেশন করেন। পার্থদা-মিতাদির বিস্তৃত উঠানে হয়েছিল লোকগানের এই অনিন্দ্য আসর। যেন পূতপবিত্র, স্থির হয়ে সকলে গান শুনতে-গাইতে বসা। এপার-ওপার বাংলার সাংস্কৃতিক মিলনমেলা, পরব। আপ্যায়নপর্ব তো ছিলই পরে সারারাতব্যাপী খানিকটা মাতাল-মহুয়া পরব। মনে হলো — আমাদের অপূর্ব অপু, স্মৃতিগন্ধ্যা নীলকণ্ঠ বারেবারে গাইবে এ রাত্রির অনুপম গান।

কালকে কোথায় চিল্কিগড়, কি কোথায় শালবনী? কোথায় সেই বাঁশতলা কোকিল সবরের বাড়ি। মনে থাকবে সেই একদিন পায়ে হেঁটে আমরা ঝাড়গ্রাম সফর করেছিলাম। সাঁওতাল ডিহি অঞ্চলের মোরাম রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে বিশ্বদল  তার মেঠোসুর পরিবেশনা করেছে। ঝাড়গ্রাম থেকে রওনা দিয়ে পরে আমরা চিল্কিগড় থেকে শালবনী হেঁটে গিয়েছিলাম। শালবনীতে আমরা ঝুমুর শুনেছিলাম হাবুদার গলায় — মাটির ঘর, দোতালায়। সেখানে আরো সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধারা ছিলেন। রাঢ় অঞ্চলের ঝুমুর নিয়ে কাজ করার আমন্ত্রণও পেলাম আমরা। হাবুদা, পার্থদাদের অমায়িক সঙ্গ, সেবা, ভালোবাসা, ঋণ নয়। অপেক্ষার আবার এক উত্তেজনার। নাইন্দার মাঠেঘাটে, সুরমার বালুচরে, বন্ধুর বাসনায় বাসনায়।

অফুরন্ত শালবনী আমাকে একটু বাতাস ধার দিলো, দু’হাত পেতে তা নিলাম — এই হলো আমার পুঁজি। আমি আগে থেকেই চিনতাম, বিমানদাদের সাথে শঙ্খ পরিচিত হলো। সেও কোলকাতা ফিরছে। তার নাটকের দলের ঘরোয়া বার্ষিক মিলনউৎসবে আমাদের সাথে নিয়ে গেল হালিশহর। ওদের এই মিলনউৎসবের ফুটবল খেলা আমায় বেশ আকৃষ্ট করেছিল। বিমানদা আর আমি মাঠে নেমে পড়েছিলাম। বিকেলের খেলার পরে, আকাশের বাড়ির ছাদে সন্ধেবেলায় একে একে বাকি বন্ধুদের সাথেও আমাদের আলাপ হয়। তথাগতর শাস্ত্রীয় সংগীত আর আকাশের গিটার আমরা সবাই মিলে উপভোগ করেছিলাম। ঐদিনও কবি, লেখক জাহেদভাইয়ের বেশকিছু গান আমরা গেয়েছিলাম। উপভোগ আর মাঝে মাঝে বিকেলের কসরতের খানিক ক্লান্তি চোখে-মুখে হালকা ঝিমুনি-ঝিলিক দিচ্ছিল!

মনে আছে, আমরা এর আগে হালিশহর এই পরিক্রমায়ই আরো একবার গিয়েছিলাম। তীর্থকাকুর বাড়ির খিচুড়ি উৎসবে। আমার সেবার প্রথম যাওয়া। এক মেলায় উনার সাথে আলাপ হয়। উনার নাটকের দল ‘আবহমান’। জার্মান নাটক ‘Ich lieb dich’-এর অনুবাদ ‘ভালোবাসি’ নাটকে আমি সারিন্দা, গিটার বাজিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম ‘আবহমান’ দলের হয়ে। সেই থেকে যাতায়াত শুরু। তাঁর বাড়ির ছাদে খাওয়া হবে খিচুড়ি, সাথে গানে আড্ডায় মিলে এক পরিপূর্ণ ঘরোয়া সম্মিলন। যেন ঠাঁই হচ্ছিল না বড় পরিসরের ঘরে। সেখানেও বিশ্বদল  পরিবেশনা করেছিল ব্রতচারীসংগীত, ভাটিয়ালী, রাধারমণগীতি। তীর্থকাকুর সাথে আমাদের বাক্যালাপ হয় সিলেটি ভাষায়। ফেলে-আসা ছেলেবেলা, জীবনের স্মৃতিবিজড়িত আলাপের অধিকাংশটাই আমি বুঝতে পারিনি। আমি এখনো সিলেটিভাষা রপ্ত করে উঠতে পারিনি।

গুনতে গুনতে প্রায় দুই সপ্তাহের পরিক্রমা একদিন শেষ হলো। শীতনবাবু আর ওদুদভাই আগেই ফিরে গিয়েছিলেন তাদের দেশে। আটাশ দিনের ভিসা মেয়াদে ছাব্বিশদিন কাটিয়ে এবারে বিমানদারাও ফিরে যাবেন। অবশ্য গাঙচিলেদের কোনো ভিসা লাগে না। মনপাখি চাইলেই পৌঁছে যেতে পারে মহুয়ামাতাল বিকেলের সেই লোধা সবরদের গাঁয়ে। পাথুরিয়া লালমাটির পথ পেরিয়ে সে পৌঁছে যেতে পারে বহুদূর। হুগলীর ধানখেত উড়াল দিয়ে হয়তো ক্ষণিকের বিশ্রাম বুধালয়-এর কাঁঠালগাছটার মাথায়। আবার ভেসে পড়া নীল আকাশে। আমাদের বাধা আছে, বেড়া আছে — আমরা উড়তে জানি না। তবুও তো ভেসেছি নাইন্দার টলমল জলে, জয়কলস, উজানীগাঁও, কি মধুশহিদের আঙিনায়।

বিমানদারা আবার শিগগিরই আসছেন। খুব শিগগিরই আবার সেই উন্মাদনা, উত্তেজনা। মনের ক্যানভাসে দিগন্ত নীল। উন্মুখ ভারতবর্ষ অপেক্ষায়।

ফেইসবুকে মেঠোসুর
ইউটিউবে মেঠোসুর


গানপারে মেঠোসুর

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you