আরাধ্যজননী

আরাধ্যজননী

গিয়াছিলাম জাহাজঘাটায় একবার। বরিশালে, ভোলায়, একটা কাজে যেতে হয়েছিল। তখন সদরঘাট গিয়া জাহাজে চেপে এরপর ঘোলা পানির রাতভর নদী ডিঙিয়ে এনার্জিবাল্বের চেয়েও নম্র ভোরের আলোয় জেগে নেমেছিলাম গন্তব্যে। ফেরার পথে একই বিবরণ, সংক্ষেপে, সূচনাশীতের নৌরাত্রিজার্নি। ইট ওয়্যজ্ নট ব্যাড অ্যাট অল্। গোটা যাওয়া-আসা রাস্তাবাদ্য সচেষ্ট হলে মেমোরিতে ফেরানো অসম্ভব হবে না হয়তো। তবে এই নিবন্ধগল্পে সেইটা আদৌ প্রসঙ্গ নয়।

গিয়েছিলাম জাহাজঘাটায় এবং দেখেছিলাম নোঙরকড়া ও অন্যান্য দড়িদড়া। আগে দেখেছি স্ক্রিনেই শুধু, ম্যুভিস্ক্রিনে, ইংরেজি সিনেমায় সি-ভ্যেসেল্ এবং ভোয়েইজেস্ তো খুব দেখা যায়। ইজি এক্সাম্পল্ মনে করা যাক, পাইরেইটস্ অফ দি ক্যারিবিয়্যান্ কিংবা ভাইকিংস্ নিয়া আরও অনেকানেক ম্যুভিচিত্র, সমস্ত জলপথের ছবিছায়াগুলোতে আমি বিশেষভাবে এঞ্জয় করি অ্যাঙ্কোর এবং হার্বার এবং মাস্তুল থেকে নেমে এসে ডেক্ ও পাটাতন জুড়ে প্যাঁচানো হুঁৎকো মোটকো-মোটকো দড়িদড়া।

জাহাজঘাটায় গিয়েছিলাম এবং দড়িদড়া দেখেছিলাম, তা কম করে হলেও বছর-ছয় আগে। ছ্যে সালো কি প্যেহলে। এরপরে এই এতগুলো বছরে সদরঘাটে ভিড়েছে এবং সদরঘাট ছেড়েছে কত-না জাহাজ ছোট-বড়-মাঝারি, কিন্তু দড়িদড়া আর স্বচক্ষে দেখা হয় নাই। সিনেমায়, ইংরেজি সিনেমায়, দেখেছি নিশ্চয়। সিক্স ইয়ার্স গ্যন্। স্বচক্ষে ফের জাহাজ নোঙরবাঁধার দড়ি দেখলাম এই-তো সেদিন, হোঁৎকা মোটো, ২০১৫ সনে, ‘জাজ্বা’ (Jazbaa) দেখতে বসে, ঐশ্বর্যার গলায়, মানে অ্যাশগ্রীবায়। ইন্ ফ্যাক্ট, ঐশ্বর্যা আমার ফেব্রিট না বিধায় সিনেমাটা আদৌ দেখতাম কি না সন্দেহ, দড়িচিহ্ন চোখে পড়ে যেতে দেখতে বসেছিলাম। পরে চাইলেও উঠতে পারি নাই দেখা ছেড়ে, এর কারণ অন্য, অ্যাশসার্কাস্ দেখার সুবর্ণ সুযোগটা হারালাম না হাতে দেখার মতো ছবিটবি না-থাকাতে। এছাড়া বাজেভাবে লেখা বই এবং বাজেভাবে বানানো ছবির আমি বিশেষ সমুজদার। ভালো দেখে/পড়ে বোবা হওয়া যায়, বাজে দেখে মুখরা।

Jazbaa Poster

ব্যাপারটা হচ্ছে, ফ্রেম্ ধরে ধরে ক্রল্ করছিলাম, হামাগুঁড়ি দিচ্ছিলাম এলোমেলো ছবিটার এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত, সহসা জাহাজের দড়িদড়া অ্যাশের গ্রীবায়! দেখি কি, একটা ক্লোজ্-আপ্ প্রোফাইল্ শটে হিরোয়িন্ সংলাপ থ্রু করছেন, আর তার গলার ভাঁজগুলো অবিকল সদরঘাটে জাহাজবাঁধার দড়ি! ইয়া মাবুদ! বন্যেরা ফরেস্টে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে, আর নোঙরের দড়িদড়া জাহাজঘাটায়। বিশ্ববিউটির গ্রীবায় হেন হোঁৎকো দড়িদড়া, না না, মানা যায়! কিটস্ যতই বলুন না কেন ‘হোয়্যার বিউটি ক্যানোট কিপ্ হার লাস্ট্রাস্ আইজ্, / অর নিউ ল্যভ পাইন্ অ্যাট দেম্ বিয়ন্ড টুমোরো’ … ‘যেখানে সৌন্দর্য রক্ষা করতে পারে না তার দ্যুতিময় চোখ, / অথবা আজকের প্রেম ক্ষয় হয় আগামীকাল আসার আগেই’ … সময়কীটদষ্ট দুনিয়াবির এই নিষ্ঠুরতা খানিকটা আনরিয়্যাল্ বলেই ভ্রম হয় জেনেশুনেও।

উদয়ন ঘোষ মশাইয়ের একটা আখ্যানের নাম মনে পড়ছিল গোটা ছায়াছবি জুড়ে অ্যাশের প্রেজেন্স দেখতে দেখতে। অ্যাক্টিং আর্টটা অ্যাশের আর রপ্ত হলো না ক্যারিয়ারের এতটা রাস্তা দাবড়িয়ে এসেও। হবে বলেও ভরসা অল্প। থাকার মধ্যে যেটুকু ছিল, শরীরী শোভাগত পরিসংখ্যান, ভাইট্যাল্ স্ট্যাটিস্টিক্স বলেন যেইটাকে আপনারা, তা-ও নৌকা বান্ধিবার দড়িদড়া, হায়! জায়গায় জায়গায় ঈশ্বরদীর গুড়ের মটকা, তাতেও যদি দর্শনার কেরিকোম্প্যানির খাঁটি দিশি হতো, মৌসুমীজির মটকায় যেইটা হয়, আমাদের আরিফা জামান মৌসুমী, কিন্তু অভিনয়ব্যবসায় অ্যাশের চেয়ে মৌসুমী অনেক বেশিই ন্যাচারাল্ এবং চরিত্রানুগ সবসময়। এইটা সাক্ষ্য হিশেবে একান্তই আমার। দায় নিতেছি কান্ধে। এবং মতামত মানে একান্ত বিনে দোকান্ত নয় আমার কাছে। অ্যানিওয়ে। যেইটা বলছিলাম, উদয়নাখ্যানের নাম, ‘মুকুলেশের মা যা হইবেন’, ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনের ‘জাজ্বা’ দেখতে দেখতে কেবল মনে হচ্ছিল, খোদা, আরাধ্যর মা যা হইলেন!

‘চোখের বালি’ দেখেছিলাম, ঋতু অভিনয় আদায় করিয়ে নিতেন, মাখনপোচ পিঠমাঠের ট্রমা কাটিয়ে উঠে মেনেছিলাম ‘বেধবা’ হিশেবে অ্যাশ মন্দ বলা যাবে না। ‘রাভান্’ মন্দ না, বা ‘প্রোভোকড্’, অবশ্য ঋতুপর্ণেরই ‘রেইনকোট’ দেখার ইচ্ছা থাকলেও দেখা আজও হয় নাই, কিংবা শুনেছি ‘গুজারিশ’ নাকি বেশ হয়েছে অ্যাশ সত্ত্বেও। তবে এইটা আদৌ ঠিক হবে কি না বলা জানি না, তা-ও বলেই ফেলি কানের লতি চিমটি কেটে ধরে, ম্যাডাম্-ম্যাডাম্ করেই নিশ্চয় বেচারা ডিরেক্টরদিগের দম যায়, অমিতজির পুত্রবধু বলে কথা, আর বছর-বছর কান্ ফেস্টে রেডকার্পেট তো বান্ধা! বাব্বা! আর তার সঙ্গে যে লারেলাপ্পা ঝালরওয়ালা লাখরুপাইয়ার বর্ণালি ডিজাইনার্স ড্রেস্ থাকে সেই-কথাটা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।

আমার মনে হয় ডিরেক্টর মহোদয় জানতেন উনার টাইটানিক ডুববেই ডুববে। সেই কারণেই-না শাবানা আজমি আর ইরফান খানকে নেয়া। না-হলে এই দুই ক্যারেক্টারে যে-কাউকেই যেত নেয়া, কাস্ট করা যেত উঁচু নৈপুণ্যের এই দুই শিল্পীর চেয়ে একত্রিশভাগ নিচের যে-কোনো অভিনয়কারীকে, এমন কোনো চ্যালেঞ্জিং চরিত্র ছিল না এগুলো যে সেইজন্যে শাবানা-ইরফান জাজ্বায় নিতে হবে। অ্যাশকেন্দ্রিক সিনেমা আগাগোড়া। অ্যাশের কামব্যাকিং ওয়ার্মআপ্। শুরুতেই হিরোয়িন্ যে-এক্সার্সাইজ্ করলেন পর্দা জুড়ে, ব্যাপারটা ডিরেক্টরের রসবোধের প্রাণান্ত পরিচয় হিশেবেই রিডআউট করতে পারি, এইটুকু মহাভারতীয় মুনাফা এই সিনেমা থেকে অ্যাশের এবং অ্যাশভক্তদের। কিছুটা নয়, মাস্ট বি অ্যাডমিটেড যে, বেশ শেইপে আসবেন আরাধ্যজননী এইবার মনে হয়। কেননা ব্যায়ামদৃশ্য ধারণে এনজি শট যদি তিন-চারটেও হয়, ছয়-সাতটা তো হয়েছেই মিনিমাম্, তো গত ছয়বছরে ম্যাডামের এই প্রথম স্বেদ ঝরল বলে মনে হয়। স্যাশ পরার আশা আবারও করতেই পারেন অ্যাশ।

Jazbaa_gaanpaar

চরিত্রটা হারাম দুইফোঁটাও প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নাই ডিরেক্টর মশাই কিংবা অ্যাশ দুইজনের কেউ। জোব্বা পরে চ্যাটাংচ্যাটাং কথা বললেই কি ল্য’য়্যার হয়ে গেছেন মনে করবেন? দুই লোকমা আংরেজি মুখে উঠাইলেই কি মুই গ্লোব্যাল্ হয়ে গেনু? কস্টিয়্যুম্ ওয়েস্টার্ন হলেই কি বিশ্বাস্য হয় যে আপনি ইউনাইটেড কোনো উন্নত বিশ্বফেরতা বিদ্বান? আর মা? সো সোজা? ইয়াম্মি-মাম্মি সাউন্ড গলা দিয়া বাইরাইলেই যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে যেত জননী ভূমিকায় অভিনয়, অ্যাশ তবে এতক্ষণে বাংলাদেশের এফডিসি অ্যাওয়ার্ড বা তারচেয়েও মহদাশয় মেরিল্-পআলো পুরস্কার পেয়ে যেতেন। আর কান্না! কান্না কি এতই সোজা! না, প্রিয়তমা, কান্দন সোজা কম্ম নয়কো। ক্রন্দন সহজ নয়। এরচেয়ে ঢের সহজ ‘ডোলা রে’ কিংবা ‘তাল্ স্যে তাল্ মিলা’ নাচা।

অ্যাশের সিনেমা, তাইলে নাচানাচি তো থাকবেই। ‘ইশক কামিনা’ অ্যাশের সেই দিন কি আর আছে? ‘ক্রেইজি কিয়া রে’? এবং ‘বার্সো রে’ ইত্যাদি? কিন্তু না, ভাই, আগের সেই দিনদুনিয়া আর নাই। কী দিনই-না ছিল ঐশ্বর্যাজির! নাচানাচির চোটে পর্দায় ধুমা ছুটত। বহুকাল আগে অবশ্য বহুকিছুই ছিল। ঘোড়াশালে ঘোড়া হাতিশালে হাতি ইভেন বুড়িগঙ্গায় টাইটানিকটাও। সর্বশেষ রানবির কপুরের সনে ‘অ্যায় দিল্ হ্যায় মুশকিল্’ ম্যুভিতে অ্যাশজিরে একটা হাল্কাপাৎলা নাচের কোশেশ করতে দেখা গেছে, দেখতে সেইটা খারাপ না-লাগলেও ওইটা আদতে নাচ না বলিয়া ঝাপসা তালের হাঁটাহাঁটি আখ্যা দেয়াই ভালো। চুমাচাট্টিটা খারাপ হয় নাই অবশ্য। অথচ ‘বান্টি আউর বাব্লি’ সিনেমায় স্বীয় শ্বশুরজির সনে এই কিছুবছর পূর্বেও ‘কাজ্রা রে কাজ্রা রে’ অ্যাশফ্যানদেরে মেস্মেরাইজ্ করে রেখে গেছিল। তখনও বচ্চনফ্যামিলিতে এন্টার করেন নাই বোধহয়। বিবির সনে অভি ছিলেন অবশ্য ওই আইটেমে, এবং অমিতজির ট্রেডমার্ক ড্যান্সমুদ্রা, রানি ছিলেন হিরোয়িন। দুঃখ কোরো না, অ্যাশড্যান্সভোক্তারা, ভাটির দিকে বেইল যায় বেবাকেরই নিশ্চয় একদিন। দুইয়েকটা গানের সঙ্গে অ্যাশের ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যভরা হাঁটাচলা যারা দেখতে চান না, তাদেরে এই সিনেমা প্রায়োরিটি লিস্টে না-রাখতেই রিকোয়েস্ট করা যায়। একমাঘে যেমন শীত যায় না, মাঘের পরে মাঘ আসে এই পৃথ্বীধামে, নাচেও তদ্রুপ অ্যাশ দিয়া সারাজিন্দেগি হিন্দি ফিল্মিন্ডাস্ট্রির চলে না।

Jazbaa Posterশাবানা আর ইরফান এই সিনেমাতেও যথাভাব ‘অভিনয়হীন অভিনয়’ কাকে বলে এর নজির যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন রেখে গেছেন। অ্যাশ কি শিক্ষাদীক্ষার ধার ধারেন? সন্দেহ হয়। সিনেমাটা এতক্ষণে ভুলেই যেতাম হয়তো। শুধু একটা ডায়লগের জন্য মনে থাকবে এইটার কথা। জাহাজের দড়িদড়া তো স্মর্তব্য, তবে ম্যালা দিন এইসব মনে রাখাও মুশকিল,  হয়তো ঈশ্বর গুপ্ত বা আজকের কোনো রগড়প্রিয় কবিতাসাহিত্যিক হলে ব্যাপারগুলো মহাকাব্যে ট্র্যান্সফার করা যাইত। সংলাপ কোনটা? প্যারাগ্রাফান্তরে বলি।

একেবারে শেষ সংলাপ। শেষ দৃশ্য, শেষ ফ্রেম্, সংলাপ প্রক্ষেপের পরক্ষণেই ক্যামেরা ডিসোল্ভ হবে এবং টাইট্যল্ ক্রেডিটলাইন্স ভাসতে থাকবে একে একে। দেখা যায়, হিরোয়িন্ আপাত বিদায় নিচ্ছেন নিরামিষ সম্পর্কের একদা ক্লাসমেট-কাম্-চিরসুহৃদ বন্ধু হিরোর কাছ থেকে, পেছনে হিরোর সহচর জিজ্ঞেস করছে, “স্যার, ম্যাডামরে এত ভালোবাসেন তবু যাইতে দিচ্ছেন যে!” এর উত্তরে হিরোর আন্ডারটোন্ অভিনয়ের একটা ডায়লগ, “মুহাব্বাত হ্যায় ইস্ লিয়্যে যা-নে দিয়া, জিদ্ হোতি তো বাহু ম্যে হোতি।” ওয়াহ্ ওয়াহ্! ক্যায়া বাত!

Film Title: Jazbaa ।। Released Year: 2015 ।। Genre: Crime thriller ।। Duration: 1h 59min. ।। IMDb Score: 5.8/10 ।। Director: Sanjay Gupta ।। Stars: Aishwarya RaiIrrfan KhanShabana AzmiJackie Shroff  ।। Music Score: Amjad-Nadeem, Arko Pravo Mukherjee

ম্যুভিরিভিয়্যুপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you