মুহম্মদ খসরু। অকৃতদার। নাগরিক। পড়ুয়া। লেখক। বংশীবাদক।আলোকচিত্রী। খেরোখাতায় আঁকিবুঁকিকারী। কাল্ট ফিগার। যার সুইসাইড করার কথা। কোনো পরিচয়েই আপনি তারে চিনেন না। চিনবেন না। পরিচয় তো এমনই। সঙ্গে থাকলে স্মৃতি। না থাকলে শুধু অনুভূতি আর কল্পনা।
রগচটা, ক্ষ্যাপাটে মুহম্মদ খসরু, ঘেয়ো রোদে পোড় খাওয়া ঢাকায় বুনেছিলেন কিছু স্বপ্নের চারা। যার একটার নাম সিনেমা। আর সিনেমাই হয়ে গেল এই জিন্দালাশের নাম-পরিচয়। আজকে যখন বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের সুস্থতা নিয়ে আপনে বহুত ঘূর্ণিঝড় তুলছেন জবানে, কিবোর্ডে ঘনায় তুলতেছেন নয় নাম্বার বিপদসংকেত, তখনো আপনে জানেন না, এই যে ভালো ছবি দেখতে পারতে হয়, দেখতে হয়, দেখা দরকার, খারাপ বলে কোনো ছবিকে রিসাইকেলবিনে চালান করে দিতে হয় না—এই বোধ এর উৎপত্তি-বিকাশ কিভাবে ঘটলো ঢাকার কালচারাল সিন্যারিওতে। এই বিন্দুপথ ধরে অতীতের দিকে মুখ করে, ভবিষ্যতের দিকে আগাতে থাকলে আপনে দেখা পেয়ে যাবেন নামহীন-গোত্রহীন এক সিনেমাক্ষ্যাপার। মুহম্মদ খসরুর। বাঙলাদেশের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় সিনেমা আন্দোলনের সংগঠক, কাণ্ডারি। বাঙলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের পুরোধা। নির্মল চলচ্চিত্রের সন্ধানে উন্মুখ মন। সৎ সিনেমার অভিলাষী ভাবুক। আখেরি দম তক। আজকে এই যে, বাঙলাদেশের ভাষায় সিনেমা নিয়ে সমালোচনা, আলোচনা করার কারবার চলে, তার রাস্তা তিনি রচনা করেন। ধ্রুপদী শিরোনামের চলচ্চিত্রের কাগজ সম্পদনার মাধ্যমে। প্রকাশ থাকুক, এইসব ঘটনা ঘটা শুরু হয়ে গেছে ১৯৬৩ সাল থেকে। ধ্রুপদীর শুরু ১৯৬৮ থেকে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী, পরবর্তী কালে সিনেমা যোগাড় করা, হল ম্যানেজ করা, লেখা ও লেখক তৈরি করা সবকিছু তিনি করে গেছেন। একা হাতে নয়। কর্মীদলও তৈরি করেছেন। তরুণী-তরুণদের মনে সৃষ্টিশীলতার বীজ বপন করেছেন শিল্পী এসএম সুলতানের আঁকা পেশীবহুল কৃষকের মমতায়। প্রথম হওয়ার আহ্লাদে ভুগতে থাকা, নিজের ধানখেতে নিজেই আগুন লাগিয়ে দেয়া কৃষকের দেশে মুহম্মদ খসরুও অনেক প্রথমের হকদার। তথাপি, কোনোদিন তা দাবি করেন নাই। চিন্তা, অপেক্ষা আর উপেক্ষা করে কাটিয়ে দিয়েছেন এক নিঃসঙ্গ সক্রিয় দর্শকের জীবন।
যেমন ধরা যাক, প্রথম সিনেমা সমঝদারি কর্মশালার সংগঠক, বাঙলাদেশে জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কত কাঠখড় পুড়িয়ে ইন্ডিয়ার পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের সতীশ বাহাদুরের মতো বিদগ্ধ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে এনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশনের কোর্স করিয়েছেন। ঋত্বিক কুমার ঘটক এবং রাজেন তরফদারের সাথে কাজ কররেছেন। নিজে সিনেমা করতে চেয়েছেন। পারেন নাই। অন্যদের সিনেমা করার উপায় নিয়ে ভেবেছেন। ফিল্ম কো-অপারেটিভ চালু করেছিলেন সমান্তরাল ধারায় চলচ্চিত্র নির্মাণের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে। যদিও, তা বিবিধ কারণে টিকে নাই। প্রয়াত তারেক মাসুদ যথার্থই বলেছিলেন, মুহম্মদ খসরুর ওভারকোটের বিভিন্ন পকেট থেকে বেরিয়ে এসেছেন তাঁর সমসাময়িক প্রায় সব চলচ্চিত্রনির্মাতা।

মসিহউদ্দিন শাকের আর শেখ নিয়ামত আলীর সিনেমা সূর্যদীঘল বাড়ি, মোরশেদুল ইসলামের আগামী ও চাকা, তারেক মাসুদের আদম সুরত, মুক্তির গান এসবই চলচ্চিত্র সংসদের কোলে জন্ম নেয়া নাগরিক প্রাপ্তি। এই উৎসাহ, ব্যঞ্জনার মূল উৎস রূপে কাজ করে গেছেন মুহম্মদ খসরু। বাঙলাদেশে পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের যখন বাম্পার ফলন হতে শুরু করল, সেই সময়েও মুহম্মদ খসরু জায়গায় দাঁড়ায়, যুইতের কথা বলতে ছাড়েন নাই। খিস্তিখেউড় সে তো অনুষঙ্গ মাত্র। আর্টহাউস সিনেমা দেখেন বইলা, নাক সিঁটকান নাই বাণিজ্যিক ছবি নিয়ে। জহির রায়হানের কাজের কদর করতেন। বরং, আর্টের ভড়ং ধরে সিনেমার নামে জালিয়াতি, বাটপারকারীদের বিপক্ষে সবসময় আওয়াজ তুলছেন। ভালো সিনেমার নামে, আর্টের নামে কনফরমিস্ট সিনেমার তরফদারি করেন নাই। যা এখন প্রচুর হচ্ছে, উৎসব-পার্বণে যাচ্ছে। নাম হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, কোনো নিদান মিলছে না যাপিত জীবনের কলহের বা সাহস যোগাচ্ছে না অন্যায়ের বিরুদ্ধের একজোট হবার। কারণ, সিনেমা তো ভালোই হচ্ছে, তবে তা সৎ বা সময়ের সত্য কথন কি না তা স্পষ্ট হচ্ছে না।
মুহম্মদ খসরু (১৯৪৬-২০১৯) আর নাই। মুহম্মদ খসরুর এন্তেকালের মধ্যে দিয়ে সমাপ্তি ঘটে যায় শহর ঢাকার শেষ বোহেমিয়ানের। ক্রমে ওয়ান্নাবি কর্পোরেট হয়ে ওঠা এই সময়, চরাচরে মুহম্মদ খসরুর চলে যাওয়া মনে করিয়ে দেয়, এভাবেই একটা দেশ-জাতি-সময় শুধুই ভালোর চক্করে বে-আক্কেল হয়ে যায়। বা, শুধু প্রতিষ্ঠানমুখী সংস্কৃতি দিয়ে একটি স্বাস্থ্যকর প্রতিষ্ঠান জারি রাখা সম্ভব নয়। দরকার প্রতিষ্ঠানবিরোধী সংস্কৃতিরও।
লঙ লিভ মুহম্মদ খসরু। সেলাম।
ইমরান ফিরদাউস রচনারাশি
গানপারে ম্যুভিরিভিয়্যু
গানপারে মুহম্মদ খসরু
গানপারে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা
- লোককবি তাজউদ্দিন ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 25, 2025
- শাহজালাল শাহপরান গ্রামবাঙলায় গাজির গান || তুহিন কান্তি দাস - November 22, 2025
- আমাদের গ্রামের নাম আমাদের নদীর || কাজল দাস - November 19, 2025

COMMENTS