আনসেন্সর্ড আনপ্যাটার্নড

আনসেন্সর্ড আনপ্যাটার্নড

অনেক অনেক কাল আগের কথা। হাজারতেরোর দিকে, টু-থাউ-থার্টিন হবে, একটা আন্তর্জালিক বাংলা ম্যাগাজিনে নেত্রপাত করি। নেত্রপাত? হ্যাঁ, নেত্রপাত, এক্স্যাক্টলি। নিউজফিডে ভেসে আসা বাংলা ওয়েব-কন্টেন্টগুলা বাছাবাছি ছাড়াই নিরীক্ষণ করতাম সেই সময়টায়। সাইটের ইন্টার্ফেইস নজর কাড়লে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি বিষয়বিত্তান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক সাইটের সঞ্চালক। মূলত সাহিত্যসাইট হলেও কন্টেন্টবৈচিত্র্য নজরকাড়া। সাহিত্যের গাম্ভীর্য ধরে রেখেও ওয়েবপত্রিকাটি কিছু নতুনতা আনতে পেরেছিল। পরে এইটা আর কন্টিনিউ করে নাই। কিন্তু পত্রিকার নাম — বা, সঞ্চালকের — উল্লেখ করা আজ আর অত জরুরি নয়। দেখতে পাই, সিরিয়াস সাহিত্যিক প্রবন্ধ ও ইন্টার্ভিয়্যু প্রভৃতির সঙ্গে বেশকিছু পর্নোগ্র্যাফিশিল্পীর উপর ফিচার, অনূদিত সাক্ষাৎকার, ইত্যাদি। আশ্বস্ত হই বাংলা লেখালেখিটা সাবালক হতে পেরেছে ভেবে। একটু চোখ বুলিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করি, জিনিশটা আলাপের মতো করে তুলতে পারেন নাই ক্রিয়েটর মশাই। ক্লিকবেইট কথাটা হাজারতেরোর ওই সময়ে সেভাবে চালু হয় নাই স্বীকার করি, কিন্তু লক্ষণবিবেচনায় সাইটের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ফিচারপ্রবাহ শুধুই ক্লিক পাবার নিমিত্তে আপ্লোড করা তা বোঝা যাচ্ছিল।

পর্নোগ্র্যাফিশিল্পীদের ইন্টার্ভিয়্যু আছে দেদার, অনুবাদ করে নেয়া কাজেই ডিফিকাল্ট কিছু নয়, খুঁজেপেতে অ্যানালিটিক্যাল লেখাও তৈরি করা সম্ভব গোটা পর্নইন্ডাস্ট্রি নিয়া। আর এইসব ব্যাপার তো অনেকটা ট্যাবুমুক্ত বলা যায় এখন; অন্তত গত দশকের আগে যেমনটা রাখঢাক ছিল, বর্তমানে সেই সিলসিলা নাই তো মনে হয়। এইটা খারাপ না, ঢাকনাহীনতা, যা আছে তা নাই বলার ভান করা মারাত্মক ক্ষতিকর। অতএব, ধরা যাক, ওই পর্নইন্ডাস্ট্রির একদা আর্টিস্ট যিনি পরবর্তীকালে মেইনস্ট্রিম বলিউডে কাজ শুরু করেন এবং নিজের একটা জায়গাজমিন করে নিতে তাকে বেশি বেগ পোহাতে হয় না। সানি লিয়ন সমাজ-সভ্যতার জন্য শুভ না অশুভ তা জানি না, তা জানাবেন সমাজতাত্ত্বিকেরা, সানি লিয়ন লইয়া আলাপালোচনা ব্যাপারটা সার্বিক বিচারে শুভ বলেই আমার অপিনিয়ন। অতএব, এ নিয়া ভাববেন বৈকি লেখকেরা, ভাববেন এবং যুগপৎ লিখবেনও জরুর, ঢাকঢাক-গুড়গুড় করবার তো কোনো অর্থ হয় না। ভাবছেনও তো, দুনিয়াজুড়ে, হয়তো বঙ্গসমাজে রামতনু লাহিড়ির তৎকালিনতা বা শিবনাথ শাস্ত্রী কি ত্রৈলোক্যনাথের নৈতিকতাশাসিত নন্দনমান থেকে বেশি-একটা আগাতে পারি নাই আমরা। তা-বলে থেমেও তো নেই, নিত্যি আগাচ্ছিই তো, বটে। এখানে একটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একজন পর্নোগ্র্যাফিশিল্পীকে নিয়া লিখতে গিয়া আপনি যদি লেখাটারে সাংবাদিকী রচনার বাইরে দাঁড় করাইতে চান, চ্যালেঞ্জটা সেখানেই।

ঠিক একটা না, চ্যালেঞ্জ অনেক। প্রথমত সম্ভোগপ্রবৃত্তি থেকে লেখককে একধরনের মুক্ত থেকেই তো লেখাটা টানতে হবে, না-হলে সেইটা আবার আরেকটা পর্নোগ্র্যাফিই তো হয়ে দাঁড়াবে; এখন যদি বলেন যে পর্নোগ্র্যাফি হইলেও মন্দ হয় না, তা হয়তো হয় না, কিন্তু সমস্যা একটা আছে। কবিতার আলোচনা করতে যেয়ে ফের একটা কবিতাই লিখবেন কি না আপনি, ঠিক এই সিদ্ধান্ত নিতে তো গড়িমসি করার কথা না। আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ্য, পর্নোছবিচিত্রে অংশগ্রাহী অভিনয়কারী-কলাকুশলীদের নিয়া আলাপ চালাতে গিয়া তাদের ব্যক্তিমর্যাদা ক্ষুণ্ন না-করার দিকে কড়া নজর রাখা। যারা কলাকুশীলব — পর্নোগ্র্যাফিয়ার — তাদেরে শিল্পী বা আর্টিস্ট বলবেন কি না, বললে কেন বলছেন অথবা না-বললে কেন নয়, এই নিয়া মীমাংসা সেরে নিতে হবে লেখার শুরুতেই। ট্র্যাডিশন্যাল নীতিনৈতিকতা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, এইটা ওভারকাম করা একটা কাজ। কঠিন হবে না, আমি নিশ্চিত, কারণ বৈচিত্র্যসন্ধানী লিখিয়ে ও লেখক তো বর্তমানে দেখা যাচ্ছে দিকে দিকে।

এইটা একটা আশার দিক। অনেক বেশি বিচিত্রগামী লেখালেখি হচ্ছেও তো দেখতে পাই। ইদানীং একজনের টুকটাক লেখা পড়ছি কিছু, পর্নোগ্র্যাফি নিয়া ইন্টারেস্টিং একটা ওয়েতে গোটা যাপন ও সিস্টেমের একটা আলাদামাত্রিক বীক্ষণ হাজির করার পথ খুঁজে পেয়েছি ইনার লেখা হাতাইতে যেয়ে, হেজিমোনি আর আগ্রাসন, সেইটা প্যাট্রিয়ার্কি হোক অথবা অ্যাকাডেমিয়া, রিলিজিয়ন হোক বা কমিউনিয়ন, যা-কিছুই তিনি দেখছেন ও দেখাচ্ছেন সব ড্যাশিং একটা ভঙ্গিতে, স্লাভো জিজেক নাম তার। মস্ত দার্শনিক তো তিনি, জিজেকের কথা বলছি, জীবিত, বহুমাত্রাবিস্তারী বীক্ষণ তার, আমি খুঁজে খুঁজে কেবল ওইসব লেখা বা লেখাংশ বার করে রেখেছি ও দেখছি যেসব জায়গায় জিজেক পর্নোগ্র্যাফিকে টেক্সট হিশেবে রেখে নিজের দেখাটা সারছেন। কোনো-একদিন এই পাঠের আনন্দ ও উত্তেজনা হাজির করার তৌফিক হবে এমন দুরাশা তো করিই।

কিন্তু মনে পড়ে, আমাদের এখানে বিদ্বৎসমাজ পর্নোগ্র্যাফিচিত্রবস্তু লুকিয়ে দেখার বিষয় মনে করলেও ঠিক প্রকাশ্যে এর কোনো পজিটিভ হাজিরা রাখেন না তাদের পাণ্ডিত্যালাপে, একজন ব্যতিক্রম পেয়েছিলাম, তিনি প্রয়াত ও চিরজীবিত আখ্যানকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ইতিউতি কিছু সাক্ষাৎকারে অ্যাক্নোলেজ করেছিলেন তিনি বিষয়টাকে, এইটাও অনুধাবনের ন্যায় একটা সিগ্নিফিক্যান্ট টেক্সট হইতে পারে যে সেই স্বীকৃতি তিনি দিয়েছিলেন। আনু মুহাম্মদ প্রমুখ তখন একটা পত্রিকা বার করতেন ‘নতুন পাঠ’ নামে, ততদিনে লেখকশিবির স্তিমিত হয়ে গিয়েছে, সেইখানে এতদবিষয়ক ইশারা পেয়েছিলাম মনে পড়ে, কিংবা শাহাদুজ্জামানের নেয়া আলাপচারিতাটায় এর ইঙ্গিতও দুর্নিরীক্ষ্য নয়। ইনহিবিশন ছিল না তার — আখতার ইলিয়াসের — এইসব নিয়া খামাখা। কাজেই জিনিশটা ভাবনানুশীলন ও অনুধ্যানসংলগ্ন করে নিতে মর্মত কোনো বাধা আমি তো দেখি না। যা-হোক, সুবিমল মিশ্র তো পর্নোগ্র্যাফিকে ব্যাপক কাজে লাগায়েছেন তার ফিকশনের আখ্যানভাগে, একটা সময়ে এসে ন্যারেশনের পর ন্যারেশন পিনেড-আপ পর্নোপত্র চোলাই দিতে লেগে গেলে কেমন উপরচালাকি মনে হতে শুরু করে আমার কাছে, পরে ছেড়ে দিয়েছি সুবিমলপাঠ।

তো, কথা সেইটাই, পর্নোগ্র্যাফি নিয়া ভালো প্রবন্ধ রচনা করে ওঠা সম্ভব। ভাষার আওতা বাড়বে বৈ কমবে না তাতে, এবং গদ্যগঠনটাও অনেক সর্বগ্রহিষ্ণু হবে, এইটা হওয়া আমাদের দরকার তো। রবিজীবনের দেশে আমাদের বাংলাগদ্য আজোবধি ঠাকুরগন্ধা ব্রাহ্মসমাজমুখো শুদ্ধশুচিস্নিগ্ধ মুনিঋষি ভাবখানা প্রাণপণ ধরিয়া রাখিতে চায়। এইটা খসানো দরকার। সানি লিয়ন নিয়া বাংলায় লিখলে বাংলারই লাভ তো। তবে লেখকের তাতে লাভ হবে এমন গ্যারান্টি দিতে পারাটা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। সানি ইত্যাদি নিয়া লিখলে সময়মতো সমাজ বলবে, “তা, পাত্র খারাপ না, ভালোই, মদগাইঞ্জা খায় না, পেঁয়াজ দিয়া চানাচুর কদাচিৎ, গোমাংশ ঈদেচান্দে এট্টুআট্টু, তয় দোষের মইধ্যে দোষ হইল গিয়া, পাত্র সানি লিয়ন লৈয়া লেখে!” একজন প্যাশনেইট গদ্যকারের কী আর লোকের কথায় কান দিলে চলে?

এজরা পাউন্ড তো কবিদেরে বেশ উপদেশ বিলিয়েছিলেন, কবিতা লিখিবারে যেয়ে কি করতে হবে সেইদিকে না নির্দেশ করে এজরা পাউন্ড কবিদের কোন কোন কম্ম করা হারাম সেই নিষেধাজ্ঞা প্রচার করেছিলেন। কবিদের অনেকেই দেখেছি সেই ডোন্ট বাই এজরা পাউন্ড  খুব ভ্যালু দেন, কেন যে কে জানে; কবি কেন পরামর্শ শুনবে, হোক-না তা না-করার বা করার, করতে বললে না-করবে এবং না-করতে বললে করে দেখায়ে দেবে এজরা পাউন্ডদিগেরে যে দ্যাখো করা যায়। এ না-হলে কী আর কবি, বলেন! তবে এমনকিছু পরামর্শ যদি গদ্যলিখিয়েদেরে দিয়া যাইতেন পাউন্ড, তো কাজের কাজ করতেন মনে হয়। কেননা গাদ্যিকের তো করণীয় ও অ-করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ও প্ল্যান থাকা প্রারম্ভেই জরুর। একটা গদ্য তো, ধরেন টুটাফাটা নিবন্ধ-প্রবন্ধ যা-ই-হোক, প্রচুর সময় খসায়ে নেয় আপনার ঝোলা থেকে। এর-উপর তো আপনার প্রায়োরিটিলিস্ট নেই-নেই করেও একটা থাকে, একটু শখ-আহ্লাদও তো থাকে বেচারা কলুর বলদ গদ্যমজদুরদের, তা খালি কী কবিদেরই শখ-আহ্লাদ থাকবে, গদ্যবোবাদের থাকতে নাই আহ্লাদী হৃদয় ও শখের শরীর প্রসাধন!

তো, সব তো করা যাবে না একজনমে, নিজেকে দেয়া নিজের প্রারম্ভিক কাজগুলোও তো করা আজও বকেয়া, সেইসব করার ফোকরে মন যদি চায়, শরীর ও সময়সঙ্গতি সায় দেয়, এবং আল্লা চাহে তো, অনেককিছুই করা যায় এমনিতে। যে-কোনো প্রসঙ্গ হোক, যদি তা মানবসংসারে অ্যাভ্যাইল্যাবল বাস্তবতা হয়, জনসমক্ষে তা নিয়া আলাপ না-করাটা আরেক অসভ্যতা। তা, আমাদের আপত্তি নাই, আমরা সারাদিনে একটাও অসভ্যতা না করতে পারলে হাঁসফাঁস লাগে। — জাহেদ আহমদ ২০১৩


বিচিত্র গদ্যের গানপার  

COMMENTS

error: