মুখস্থ মুজরো ২

মুখস্থ মুজরো ২

চিলেকোঠায় বসা বাদামি বেড়াল বোনে শূন্যে মায়াজাল
ছাইরঙা পেঁচা সেই চোখ টিপে বসে আছে কত-না বছরকাল

বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে সেখানে নেমে আসে চাঁদের আলো
কাউকে চেনো না তুমি তোমাকে চেনে না কেউ সেই-তো ভালো

মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত বাংলা গানের মধ্যে এইটা সাংঘাতিক একটা। দিব্য মুখোপাধ্যায়ের গলার ব্যাপারটাই সাংঘাতিক। পুরো এই গানের সংগীতায়োজন-আবহসৃজন সাংঘাতিকের উপর দিয়া সাড়ে-সাংঘাতিক। এখন, সাংঘাতিক কাকে বলে এবং হাউ-ম্যানি-টাইপ্স্-অফ সাংঘাতিক প্রভৃতির উত্তরের জন্য নোটবই লিখতে হবে। সেজন্যে ম্যালা লোকলস্কর বাংলাবাজারে আছেন। তবে এইখানে, প্রোক্ত পঙক্তিনিচয়ে, লাইনগুলোর সিক্যুয়েন্স রক্ষিত হয় নাই বলিয়া আশঙ্কা। বার্ধক্যে স্মৃতি রিস্কি হয়ে উঠছে এমনিভাবে দিন-কে-দিন। অসুবিধা নাই। আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা / ভালো না হাতের লিখা … তাছাড়া আপনি জীবনারম্ভের কুক্ষণে সেই লাইনগুলো শুনে প্র্যাক্টিস শুরু করে দিয়েছিলেন, পসার হয় নাই বিশেষ তবুও প্র্যাক্টিস পরিত্যাগিলেন না আজও, সুমনপঙক্তি গুটিকয় : খাতা দেখে গান গেয়ো না / উল্টে পাতা যেতেও পারে / পাতাটাতা উল্টে গেলে / হোঁচট খাবে বারে-বারে / যুগটাই দমকা হাওয়ার / হাওয়া দেয় হঠাৎ তেড়ে … ইত্যাদি। ইউটিউবের দুনিয়ায় সার্চ দিলে অ্যাডাম-ইভের আদিম প্রণয়গীতিটাও পেয়ে যেতে পারেন, ড্যুয়েট, খুবই লাভজনক ব্যাপার নিঃসন্দেহে। একটাই লস, মানে লসজনক ব্যাপার একটাই, সেইটা হলো যে ইউটিউবনির্ভর হয়ে গেলে আপনি আপনার প্রথম প্রেমের প্রবর্তনাকালীন সুরস্মৃতিগুলো খুইয়ে বসতে পারেন। অতিমাত্রায় ইউটিউবনির্ভরতা সামাজিক-ও-সাংস্কৃতিকভাবে কেমন অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার, তার একটা ব্যক্তিগত উদাহরণ মুঝে ভেজনে-কো মওকা দো ইয়ার। ঘটনাটা সংক্ষেপে এ-ই যে, আমার পরিচিত এক লোক, বন্ধু বলা যায়, এত ভয়াবহ কোকঅ্যাডিক্টেড, মানে কোকাসক্ত, মানে কোকস্টুডিওমত্ত যে, প্রহরে প্রহরে তিনি ‘ইউরেকা’ হেঁকে আর্কিমিডিসের ন্যায় সিনানখানা থেকে লৌড় দেন অ্যাথেন্সের স্ট্রিট দিয়া। ইনভেস্টিগেইট করতে যেয়ে দেখা যায় যে, না, পানির প্লবতা বা ডেন্সিটি বার করার ফর্ম্যুলা না, কোকস্টুডিও-পাকিস্তানের সিজন সেভেন এপিসোড ফাইভে একটা গান : ‘নদিয়া পার পার করকে’ … ইত্যাদি। দোহাই আল্লা। তা, নিজের স্মৃতিটা আপনি যদি নিয়মিত পুষ্ট করে চলেন সিন্স য়্যুর বিগিনিং ডেইজ, তাইলে এত ইউরেকা-হাঁকা টাওয়েলহারা বাথটাবউপচানো অবাক হইতে হয় না হাজারবার একদিনের ভেতরে, দেখবেন যে য়্যুনিভার্সের সব সুরের সঙ্গেই রিলেট করে উঠতে পারছেন আপনি, সব কথা সব সুর আপন মনে হচ্ছে আপনার কাছে, চেনা-চেনা লাগছে, খালি কোকপাকি সুরেই নিকষিত মধু … হয়তো রোগ অত ভয়াবহ পর্যায়ে যাবে না তখন। তো, সেইটাই। রিলেট করে নিতে পারাটা একটা প্র্যাক্টিস, রক্তে ঠিকমতো রপ্ত করে নিতে দিন আপনার কোলের খোকাটিকে। দেখবেন এর ফলটা দারুণ উপভোগ্য হবে দুনিয়ার জন্য। কয়েকটা বিশেষণবাখোয়াস বানাতে চান যদি আপনার সন্ততিকে, তাইলে আপনি বরং কোনো কোকপণ্ডিতের শরণাপন্ন হউন। ফর য়্যুর কাইন্ড ইনফোর্মেশন, কোকপণ্ডিত এখন কোকাপণ্ডিতের রাজপাট কামরূপকামাখ্যার বাইরে এমনকি বাংলাদেশেও প্রচুর বসে থাকতে দেখা যায়, এদের কোচিং আপনারে দারুণ সমস্ত বিশেষণ শেখাবে : ক্যায়া বাত, ওয়াহ ওয়াহ ক্যায়া গায়া ওস্তাদজি, অভাবিত, অভূতপূর্ব, দুনিয়ায় নির্দ্বিতীয়, বিশ্বে বিরলপ্রজাতি … ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। হ্যাঁ, দিব্য মুখার্জির গানটার মুখ মনে পড়েছে এতক্ষণে : আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি দেখা যায় তোমাদের বাড়ি / তার নীল দেয়াল যেন স্বপ্নবেলোয়াড়ি, তার কাচদেয়াল যেন স্বপ্নবেলোয়াড়ি / সেই বাড়ির নেই ঠিকানা শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি … মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত বাংলা গান ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ অ্যালবামে এইটা পাওয়া গিয়েছিল, গানটার শীর্ষপঙক্তিও ‘আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি’।

  • হিরণ মিত্র চিত্রকর্ম  প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে। লেখা : জাহেদ আহমদ


ভূমিকার পরিবর্তে একটা পাদটীকার ন্যায় ভাষ্য যুক্ত করিয়া রাখতে চাইছি নিবন্ধপ্রবাহ ‘মুখস্থ মুজরো’ প্রত্যেকটা পার্টের সঙ্গে। বেঁটেখাটো কৈফিয়ত গোছের একটা ভাষ্য। পুনরাবৃত্তাকারে এইটা অ্যাটাচ করা থাকবে এর এপিসোড প্রত্যেকটার লগে। এই নিবন্ধপ্রবাহ সংগীতবিষয়ক কোনো কড়া আলোচনা নয়। আদৌ সংগীতগদ্য নয় এই রচনা। নামের মধ্যে একটা নাচাগানাবাজানার আভাস থাকলেও মোদ্দায় এইটা গালগপ্পো। অনুষঙ্গ-উপানুষঙ্গ-অনুপান হিশেবে এইখানে শ্রবণাভিজ্ঞতাগুলা আসবে এবং চলেও যাবে। সে-অর্থে এইখানে রেফ্রেন্সের খোঁজপাত্তা খামাখা। আদতে এইখানে রেফ্রেন্সেস নাই বিধায় রেফ্রেন্স চেকের পরিশ্রম করতে যাওয়াটাই বৃথা। ধারাবাহিক মুক্তগদ্য ধাঁচের রচনা, ব্যক্তিগতিকতায় ভরা বা আবোলতাবোল, আবার অতটা ধারাফারা মান্য করবার বাঁধিধরা নাই কিছু। অনিয়মিত, সবিরত, কখনও সময়ে-সুযোগে একনাগাড় নিয়মিতও হতে পারে। একেকটা পার্টে একটামাত্র অনুচ্ছেদ, পরিকল্পনা আপাতত অতটুকুই। মিউজিক-লতানো গল্পগুলা, গান গাইবার বা গানের সমুজদারিতার গল্পও নয়, গানশোনার আবছা আলাপচারি। স্মৃতিরই রোমন্থন, মুখস্থ মুজরো, সুরাশ্রিত অটোবায়োগ্র্যাফিকতা। — জা.আ.

… …

মুখস্থ মুজরো ১

জাহেদ আহমদ

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you