নব্বইয়ের দশক, প্রমিথিউস, নূর হোসেন ও বঙ্গজাগৃতি || বিপ্লব

নব্বইয়ের দশক, প্রমিথিউস, নূর হোসেন ও বঙ্গজাগৃতি || বিপ্লব

(জন্মানোর পর থেকেই সংগ্রামকে বুকে চেপে যার জীবন হয় শুরু, সেই নূর হোসেন। এই নূর হোসেনকে চলতে দাও উদ্দাম গতিতে, উড়তে দাও শান্তির পায়রার মতো আর মিছিল করতে দাও বজ্রকণ্ঠে। এই নূর হোসেনকে কোরো না কোনো ব্যক্তির কিংবা কোনো গোত্রের কিংবা কোনো গোষ্ঠীর। নূর হোসেন আমার বাংলা মায়ের দীপ্ত কণ্ঠে জ্বলে-ওঠা এক অতন্দ্র প্রহরী)

যে-ছেলে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে
ঢাকার রাজপথ রাঙিয়ে যায়
যার কথা মিশে আছে বাংলার দিকে দিকে
সৃষ্টি হয়েছে এক ইতিহাস
যুদ্ধ জয় করে দিয়ে যায় ঘরে ঘরে
নতুন স্বপ্ন-আঁকা শতাব্দী
মিছিলের তালে তালে বজ্রকণ্ঠে বলে
জিরো পয়েন্ট আমি সংগ্রামী
সে-বঙ্গবীর নূর হোসেন তুমি।।

তোমার মৃত্যু যেন মৃত্যু হলো না
ছড়িয়ে পড়লে তুমি শিখা হয়ে
আবার নতুন করে প্রমাণ করে দিলে
শক্তির অবিনাশিতাবাদকে
বাংলার আকাশে উঠেছে সূর্য
সে-তো হায় ওগো বীর তোমারি কারণ
মোদের প্রতিটি কাজে যুগে যুগে রয়ে যাবে
তোমার একেকটি প্রতিফলন
ও বঙ্গবীর নূর হোসেন শোনো।।
কথা ও সুর : বিপ্লব ।। ব্যান্ড : প্রমিথিউস

’৯০-এর গণ-আন্দোলনে নূর হোসেনের মহান আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিয়ে চির-অম্লান করে রাখার জন্যই প্রমিথিউসের প্রয়াস ‘নূর হোসেন’ গানটি।

নূর হোসেন গানটি একটু ভিন্ন ধাঁচের গান। আমাদের এই নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না ’৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা আদায়ের প্রতিবাদমুখর সেই দিনগুলো বাস্তবিক কি-রকম ছিল, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শহিদদের আত্মত্যাগের মহিমা কতটা সাহসিকতাপূর্ণ ছিল। তাই ’৯০-এর গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটা আমাদের কাছে একটা মডেল হয়ে দাঁড়ায়, যার মাঝে সেই ’৭১-এর প্রতিবাদমুখর দিনগুলোর একটা ছোঁয়া পাওয়া যায়। ড. মিলন, নূর হোসেন — এদের আত্মত্যাগ স্মরণ করিয়ে দেয় সেই ’৫২-র ভাষা-আন্দোলন আর ’৭১-এর স্বাধীনতা-সংগ্রামে সমস্ত জাতির স্বার্থ রক্ষার্থে জীবনদানকারী শহিদদের কথা।

’৯০-এর আন্দোলন যেন ছিল নবপ্রজন্মের কাছে আরেক ’৭১। ’৫২-র ভাষা-আন্দোলনে শহিদদের নিয়ে অনেক গান লেখা হয়েছে, কবিতা ছাপা হয়েছে, উপন্যাস লেখা হয়েছে; লেখা হয়েছে ’৭১-এর স্বাধীনতা-সংগ্রামে শহিদদের নিয়ে, রচিত হয়েছে কত-না নাটক, সিনেমা, আরো কত-কী! কিন্তু ’৯০-এর আন্দোলনে শহিদ-হওয়া নূর হোসেনদের নিয়ে কি হয়েছে, কতটা হয়েছে? গণতন্ত্র রক্ষার জন্য, সবার দাবি আদায়ের জন্য যে-মানুষগুলো তাদের নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে শহিদ হলো তাদের নিয়ে কেউ তো তেমন গান লেখেনি, সিনেমা করেনি। বরং নূর হোসেনের শহিদ হওয়ার পর কতিপয় রাজনৈতিক দল দাবি করল নূর হোসেন তাদের দলের লোক, এই নিয়ে কত বাকবিতণ্ডা। নূর হোসেনের এই মৃত্যুকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা শুরু হলো।

নূর হোসেনের এই আত্মাহূতি-যে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত জাতির কল্যাণের জন্য তা ভাবা হচ্ছিল না। তাই নতুন প্রজন্মের সামনে নূর হোসেনের এই আত্মত্যাগের মহিমাকে স্বতন্ত্র এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তুলে ধরার জন্য প্রমিথিউসের নূর হোসেন গানটি।

’৯২-এর ১৬ ডিসেম্বর রমনার শতায়ু অঙ্গনে এর প্রথম শো হয়। মেলে ব্যাপক সাড়া। অবশেষে অডিও আর্ট স্টুডিওতে অ্যালবামের জন্য রেকর্ডিং কমপ্লিট করে ’৯৩-এ রিলিজ হয় গানটি।

 

  • প্রমিথিউস ব্যান্ডের লিড ও ভোক্যাল বিপ্লব ‘নূর হোসেন’ গানের এই জন্মকথা জানিয়েছেন ২০০০ খ্রিস্টাব্দে এম. এস. রানা ও রাসেল আজাদ অনুলিখিত একটি ফিচার-আর্টিকেলে। এইটা ছাপা হয়েছিল তৎকালীন জনপ্রিয় বিনোদনম্যাগাজিন পাক্ষিক আনন্দভুবন-এর ঈদসংখ্যায়। গানপারে প্রকাশকালে বিপ্লব কর্তৃক ব্যক্ত কথাগুলোর একটা বাড়তি শিরোনাম (‘নব্বইয়ের দশক, প্রমিথিউস, নূর হোসেন ও বঙ্গজাগৃতি’) জুড়ে দেয়া হয়েছে শুধু। রচনাংশটুকু প্রথম প্রকাশের স্থান ও কাল : আনন্দভুবন, বর্ষ ৪ সংখ্যা ১৬, ০১ জানুয়ারি ২০০০।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you