ঈদনিবন্ধগুচ্ছ

ঈদনিবন্ধগুচ্ছ

রমজান মাসের মর্তবা, সিয়াম সাধনার ফজিলত, রোজাদারের হক আদায়, সালাত কায়েম ও সংযমহুকুম পালনকালীন কর্তব্য, ঈদের তাৎপর্য ইত্যাদি নিয়া আগে ডেইলি নিউজপেপারের ঈদছুটিপূর্ব আটপাতা সাপ্লিমেন্টে এবং মুটকি ঈদম্যাগাজিনগুলোতে এক-দুইটা বাঁধিগৎ নিবন্ধ থাকত। কোনো চওড়া নামযুক্ত মৌলানা সাধারণত রচনাটা লিখতেন। আজকাল এই কিসিমের নিবন্ধগুলো চোখে পড়ে না। আজকাল অবশ্য দৈনিক পত্রিকা বা ঢাউশ গল্পোপন্যাসকবলিত উৎসবসংখ্যাগুলো সেভাবে দেখাও হয় না। লাইফ চলিয়া গেছে আমাদের চারশ-পাঁচশ বছরের পার। মনে হয় যেন। তবু মনে হয় বাঁধা গতের সেই লেখাগুলো মিস্ করি। ঈদ নিয়া আলাদা নিবন্ধপত্রাদি নিশ্চয় লেখা হয় এখনও। অসংখ্য প্রসঙ্গ, অসংখ্য অনুষঙ্গ আছে ঈদের, রোজার, অজস্র প্রথানুবর্ত ধর্মকৃত্য রয়েছে এখনও যা বাংলা লেখায় আসে নাই। স্মৃতি ও সত্তার সারাৎসার মিশিয়ে এই নিত্যকৃত্যগুলো মুসাবিদা করতে পারলে কতই-না ভালো হতো! হবে একদিন, নিশ্চয়, হবে ক্রমশ। বর্তমানে এই রিপোর্টাজে সেইটা পারা যাচ্ছে না। আপাতত, বর্তমান পাঠবর্তনে, এইটুকুই, নিম্নলিখিত।

সুর
, শৈশব, সেহরি
রাত তো ভোরের তীরবর্তী একেবারে। মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসছে সেহরি খাওয়ার আহ্বান। মুয়াজ্জিনদের স্বর ঘুম-জড়ানো, তন্দ্রামায়ামাখা। রোজার মাসের এই সময়টি, এই সেহরির হাঁকডাক, আরও সুশ্রাব্য সুন্দর ছিল আমাদের ছেলেবেলায়। ছিল অনেক বেশি সুরেলা, গীতল, মেলোডিয়াস। কত স্বরঢঙের  হামদ-নাত গাওয়া হতো, কত জিকির, কত গজল! তখনকার কমজোর প্রযুক্তির ও স্বল্পপাল্লা মাইকগুলো আজকের মতো অত দানবিক আওয়াজের ছিল না। আধো ঘুমে আধো জাগরণে সেইসব সুর আমাদের কানে প্রবেশিত সুধার মতো। আজকাল আর এসবের বালাই নাই। জিহাদে ব্যস্ত হয়তো সবাই আমরা তলে-তলে, সেহেতু সুরের দরকার ফুরায়েছে। কিন্তু সুর ছাড়া কোন কাজটা সম্ভব হয়েছে দুনিয়ায়?

এখন দায়সারা ডাক আসে আশপাশের মসজিদগুলো থেকে, শুনতে পাই, বড়জোর কোরান থেকে ভিনভাষা ও ততোধিক অললিত স্বরে খানিকক্ষণ দুর্বোধ দুইতিন আয়াত আবৃত্তি। ব্যস। সেই ত্রিভুবন-ঝিম-ধরানো সুরের কোরান তেলাওয়াত কই? কিংবা সেই তরুণ মুয়াজ্জিনের কিন্নর কণ্ঠের আর্বি-ফার্সি-বাংলা-উর্দু বয়েত? বর্তমান জমানায় সেহরির ডাকবাক্যগুলো কমন, মেকানিক্যাল, যান্ত্রিক গলা : “সাব হখল! সেহরি খাওয়ার সময় অই গেসে, আফনারা উঠৌক্কা! সাব হখল! এখন রাইত সোয়া-তিনটা, আফনারা উঠৌক্কা! আইজ সেহরির শেষ সময় চাইরটা দুই মিনিট, আফনারা উঠি যাউক্কা!” … ইত্যাদি। কিসের ঝিরিঝিরি বয়েত, কোথায় হামদ-নাত, কোথায় মন-উদাস-করা আশেকি গজলের সুর! জাহানের যত অর্থহীন অন্ধ দৌড়াদৌড়ি আর ফাঁকি-মেকি ফিউটাইলিটির জন্য অপার্থিব অনুশোচনা-জাগানিয়া আমাদের শৈশবের সেই সুকণ্ঠ ক্বারি ও হাফেজি হুজুরদের সুরার্তি ও দরদিয়া আহ্বান কই? এর থেকে একটা জিনিশ আজকাল মনে হয় আমার, যে, সুর আমাদের জীবন থেকে যেন অনেকটাই অন্তর্হিত। অনেকটাই কেন, বলা ভালো, পুরাটাই। জীবনে-যাপনে-কর্মে-ধর্মে এখন সুরের স্থলে অসুরের অধিষ্ঠান প্রকটদৃষ্ট। দরদের জায়গায় এসেছে মরদের মর্দামি। গীত যেখানে শ্রেয়, সেখানে জেহাদি জজবার ঝনঝনানি। মিছেমিছি বাগযন্ত্রের রগ-ফুলানি চিৎকার। দরকার ছিল? অথবা আধসিকি-পরিমাণ ফায়দা হচ্ছে এতে?

এমনকি আজানেও তো অধুনা আর সুর খুঁজিয়া পাই না! আজানের মর্মবাণী যদি হয় আল্লার পানে তার বান্দাদের আগমন স্বাগত জানানো, তবে যে-সুরে এখন আজান ধ্বনিত হয় নিত্য পাঁচ ওয়াক্ত জোরালো হাই-ফ্রিকোয়েন্সি মাইক্রোফোনযন্ত্রে, মনে হয় যেন হুমকিধামকি দিয়া ডাকা হচ্ছে দুনিয়ার যত পাপীতাপীদেরে মসজিদে বাধ্যতামূলক প্রবেশের জন্য। সুর কি ফিরিয়ে আনব না আমরা? সুর ছাড়া কি সম্ভব — সংগীত, ঐকতান, অর্কেস্ট্রা? আর ধর্ম জিনিশটা কি? ডিসিপ্লিনই তো? সংগীতই ডিসিপ্লিন, সংগীতই শৃঙ্খলা। হাসিল করার কথা যাহা সুরে, বেফায়দা গলা-খাঁকারি দিয়া তার তন্ময়তা ভাঙছি। বিলকুল তবে কি সুরের উপর থেকে আস্থা হারাচ্ছি না আমরা? আরেকবার কি ভেবে দেখব, সুরের উপর থেকে আস্থা হারানো মানে কার উপর থেকে এবং কিসের উপর থেকে আস্থা হারানো? সর্বঘটে অসুর যদি, সর্বপ্রহরে সুরবর্জন যদি, কিভাবে এশেক পয়দা হবে? এইসব সওয়াল আমি নিজেরেই ফিরছি করে। কেউ তকলিফ নিও না তোমরা, বারান্দাধারের কাঁটানটে, হে ভোরবেলার পাখিরা!

সুরের
কাহিনি পুনরপি কিংবা চোরের নাশোনা
সুর খুব জরুরি, জীবনে এমনকি মৃত্যুতেও, সর্বক্ষেত্রেই। সুরেই সম্ভব সমাধান, ট্রাবল-শ্যুট, ইক্যুয়েশন মেলানো। অসুরে আর-যা-ই-হোক, অভয়বাণী কখনোই সম্প্রচার সম্ভব নয়। মাভৈ উচ্চারণেও সুর অত্যাবশ্যক। আমরা কেবল ‘গেল…গেল…’ রব তুলি কথায় কথায়, ‘নষ্ট হয়া গেল বাহে যত দুগ্ধদধি’ বলে চিল্লাপাল্লা করি, কিন্তু নষ্টের গোড়া নিয়া ভাবি না। আমরা কেবল প্রকাশিয়া যাই প্রতিক্রিয়ামালা, প্রতিকার বিধানে উদ্যোগী হই না। যদি হতাম, সুরে ফেরাতাম সবকিছুরে ফের। প্রতিষ্ঠা করতাম সর্বাগ্রে ও সর্বত্র সুরের সাংসিদ্ধিকতা। তাতে এমন কোন গোল্লা অ্যাচিভ হতো? হতো তাতে, আলবাৎ, কাজ হতো। এই “ধর্মের বাঘ হেসে / আবার উঠোনে এসে” পেত না আশ্রয় হায় মানুষের কাছে — কেবল সুর যদি থাকিত সংসারে। সংসার, যদি আমরা যাপন করতে চাই, সুর থাকতেই হবে। সন্ন্যাস, যদি আমরা গ্রহণে যাই, সুর থাকা চাই।

এই অপরাহ্নজন্মের মুহূর্তে, এই শ্রীময়ী স্নিগ্ধচন্দ্রা যামিনী অবতরণের প্রাক্কালে, সুরের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে দুই-চারি বাক্য বুনে রেখে গেলাম এথা এই ডায়রিপৃষ্ঠায়। সুরের সামাজিক ভূমিকা, রাষ্ট্রীয় অবদান ও বৈশ্বিক চিৎপটাং প্রভৃতি বিষয়ে ঘ্যানরঘ্যানর করার এলেম আমার নাই। কাজেই খানিক পরেই ইস্তফা দিচ্ছি। কিন্তু তাতে করে সুরের অনুপস্থিতিজনিত শূন্যতার সুরাহা তো হলো না হে! এবে আসো, ঝেড়ে কাশো! হ্যাঁ, নিজের ভেতরে আগে ধারণ করো সুর, তারপর উপদেশ বিলিও অন্য অনেকেরে। সুর তুমি সৃজন করতে পারো, অথবা পারো যথাসাধ্যসম্ভব লালন করতে নিজের মধ্যিখানে। তারপর দেখো, গান হয় কী না-হয়। তারপর দেখো, উপাসনা ফলে না বিফলে যায়।

বিকিকিনির
ভিড়ে
সুরমার উত্তরপাড়ে এখন আলোঝলমলে বিকিকিনির উতলতুতল হাওয়া। ত্রস্ত ক্রেতা, ততোধিক ত্রস্ত বিক্রেতা। তাড়া, বেচাবিকির তাড়া। তাড়া, কেনাকাটির তাড়া। ঈদের বাজার। ব্যস্তসমস্ত বস্ত্রবাজার, সঙ্গে হেনতেন আনুষঙ্গিক নানাকিছু। নানান সাজের নতুন দোকানপাট, নতুন ভবন, অট্টালিকা-ইমারত পেল্লায় সাইজের, বাহারের আড়ম্বর, খদ্দের-আকর্ষক বহুবিধ রঙঢঙ, নতুন দিনের নতুন শপিংম্যল। দেখতে দেখতে এই দিলদরিয়া মফস্বল শহরটা কোন ফাঁকে-যে হয়ে উঠল অমন সুপারমার্কেটের নগরী! অবিশ্বাস্য লাগে, নিজের শহর নিজের কাছে অচিন-অচিন ঠেকে। আহা, আমার শৈশবের শাহেনশা শহর! আমার স্মৃতির দ্যুতিস্নিগ্ধ শহর! আহা আমার মফস্বলগন্ধা বাবা শা’জলালের দেশ শ্রীহট্ট পুণ্যিমৃত্তিকা! আহা আমার শ্রীচৈতন্যস্মৃতিবাহী শ্রীহট্ট!

অথচ আমার ছেলেবেলায় কড়ে-গোনা গুটিকয় মাত্র বস্ত্রবিপণী ছিল : হাসন মার্কেট, বক্স ম্যানশন, লন্ডন ম্যানশন, সবুজ বিপণী, হকার্স মার্কেট, আম্বরখানার কাপড়ের গদি ও মহাজনপট্টির বস্ত্রাদি বিক্রির বনেদি গদিগুলো। এর অনেক পরে, আমাদের চোখের সামনে, গড়ে উঠেছে মধুবন বা কাজী ম্যানশন বা সিলেট প্লাজা ইত্যাদি। এখন তো সীমাসংখ্যা নাই, এত এত বিলাসব্যসনের ব্যাবসালয়! তখন ওই সীমিত পরিসরে কেনাকাটা হতো কতই-না আনন্দে ও আরামে! আর এখন? হাহ্! সবাই কেবল টেক্কা দিয়ে চলেছে এ-ওকে, সে-তাকে। টেক্কা দেয়ার হিংস্র আনন্দে আবিল সবাই বেহুঁশ হয়ে কিনছে আর কিনছে। কেউ জিতছে, কেউ হারছে। সুপারমার্কেটের বহুতল শীর্ষে বসে এক ভূত, দৈত্য এক অতিকায়, কেবল অট্ট হেসে চলেছে।

তারপর এই বৃষ্টি এল। কত সাধনার ধন, ওগো বরিষা আমার, তুমি আমায় ভেজায়ে দিয়া যাও আমুণ্ডুনখাগ্র। এই বিতিকিচ্ছা বাজারের দেশে, এই বারোভাজা হুড়োহুড়ির মরশুমে, আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছি। ভিজি আমর্ম আমি, ভিজুক শহর আমার। শুধু ফ্যুটপ্যাথ-জুড়ে-বসা সিজন্যাল ব্যবসায়ীদের অল্পপুঁজির মালসামানগুলো চওড়া বাদলির আকস্মিক আক্রমণে ভিজে চুপ্সে যেটুকু ক্ষতি হলো।

ছুটির
ঘণ্টা
আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে
শাখে শাখে পাখি ডাকে
কত শোভা চারিপাশে
বাস্তবিক তা হয়তো নয়, কিংবা বাস্তবিকই তাই। হেঁয়ালি মনে হচ্ছে? ব্যাপারটা হলো, কার্যত কল্য হইতে শুরু হতেছে নেমন্তন্নকাল। শুরু হচ্ছে ছুটি, দিন-কয়েকের দম লইবার ফুরসত। আমি যে-বাণিজ্যসংস্থায় পেটা-আধপেটা গোলামি করি, সেই বেনিয়া কাচারিগৃহ আজকের পর থেকে একহপ্তাধিক বন্ধ রহিবে। ফের খুলবে যখন, হুড়োহুড়ি শুরু হবে জীবনের। অযথার কুকীর্তিকাণ্ড, অতিরিক্ততার দাপাদাপি, জীবিকার জান্তব তৎপরতা। তার আগে যে-কয়টা দিন পাওয়া গেল, ডুবজলে একটুখানি মাথা উঠিয়ে নেয়া যাবে নিঃশ্বাস। কম তো নয়, একনাগাড়ে বেশ কয়েকদিনের শ্বাস-উজ্জীবক ছুটি। আর কে অস্বীকার করবে যে, অবকাশবাতাস সর্বদাই ফুরফুরে ও নির্ভার!

তা, এত লম্বাচওড়া ছুটিটা কিসের? কিসের আবার, ঈদছুটি ছাড়া? আমাদের জীবনে দীর্ঘ ছুটি বলতে তো ওই দুই ঈদেই। ঈদুল ফিতরের ছুটিটাই সবচেয়ে লম্বা। আগে অবশ্য, সেই আমাদের ইশকুলবেলায়, ঈদ সহ রমজানের পুরা মাস বন্ধ থাকত ইশকুল। এছাড়াও বড় একেকটা ছুটি পাওয়া যেত কয়েকবার আরও — গ্রীষ্মকালীন অবকাশ নামে একটা, যার পপুলার নাম ছিল আমকাঁঠালের ছুটি, পেতাম ডিসেম্বরের বার্ষিক পরীক্ষা সমাপনান্তে একটা মাসাধিক সময়ের ছুটি, তারপর দুর্গাপুজো ইত্যাদিতেও ছুটি মন্দ মিলত না। এখন সেই দিন নাই। এখন এমনকি ইশকুল-কলেজের ছুটিকালও সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। যেন সবাই মালকোঁচা মেরে পণ করেছে ছুটিহীন পরিশ্রমের দামে দিগগজ গর্দভ হবে!

অবকাশ যদি না-থাকে জীবনে, না-থাকে অবসর যদি, কী করিব এই জীবন লইয়া তবে! কী এমন মহা ফল ফলিবে অবকাশবিহীন মানবজনমে!

বসিয়া
বিজনে, বারান্দাগ্রিলের নকশাকাটা আলোছায়াখেলায়
কে হায় বসিয়া অঙ্গ ভরিয়া
গোধূলির মায়া মাখো
আজও ডানাভাঙা একটি শালিক
হৃদয়ের দাবি রাখো
অল্প গরম। যদিও বরিষা। গাছপালা থমথম। পাতালের টানে চলে-যাওয়া পুকুরপানিতে প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস। রান্নার ঘ্রাণ। হেঁশেলের হাঁড়িকুড়ি-হাতাখুন্তি নাড়াচাড়ার কর্ণসহা আওয়াজ। মশলার তেজ ও সুবাস। তাওয়ায় তেল ছাড়ার ছ্যাঁৎ। বাঁশের ঝোপ থেকে বেজির সংকেত। আশপাশের শিশুদের কণ্ঠ। টলমল জলহাস্য ও কলকাকলি। কিচিরমিচির শব্দ অদৃশ্য পৈখ ও বনপোকার। অদূর হাইওয়ে ধরে ছুটে চলা গাড়ির হর্ন, সহসা ব্রেক কষার কর্কশাঘাত, ওয়েল্ডিং যন্ত্রের গড়গড়। শব্দ। আওয়াজ। পুকার। বোল। ওঙ্কার। নাদ। অনুনাদ। ধ্বনি। ব্রহ্মা। সাউন্ড। তার এফেক্ট। গরম। অল্প অল্প। অন্তরালবর্তী শীতের তুত্তুরি। শীত যদিও বহু দূরবর্তী। ইলেক্ট্রিসিটি নিখোঁজ, অগত্যা, বারান্দায় বসা। পাঁশুটে রোদ। অনুত্তেজ অপরাহ্ন। বৈতালিক সুরের মতো মন্দ্র বেলাশেষের আবহ। সন্ধ্যা নামবে একটু পর, অবিলম্বে, অতি সত্বর। মায়া লাগছে, নিসর্গশরীরে, সাঁঝের। এখন এই ছোট ছোট বাক্যে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া, আগুয়ান, পাতার অন্তিমরেখায় যেয়ে পৌঁছানো। শুধু চলা আর চলা, ক্লান্ত ক্লান্তিহীন এগোনো শুধু নোটনিবন্ধের এন্ডলাইনের পানে, একদিন হকচকানো সমাপ্তিকিনারা। আর-তেমন কিছুই তো করার নাই মানুষের। এগিয়ে যাওয়া … এগিয়ে যাওয়া … এগিয়ে যাওয়া …। আমাদের ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক উৎসব তো অন্যথা-ব্যতিরেকে এ-ই। এগিয়ে যাওয়া গানহীন গনগনে আগ্নেয় দিনের দিকে, এগিয়ে যাওয়া গভীর-গভীরতর রাত্তিরের দিকে, এগিয়ে যাওয়া নির্মম নির্জন নিয়তির দিকে। এগিয়ে যাওয়া … আরও এক অতিজীবিত সংগীতের দিকেই কি?

দিন যখন ধীরে ফুরায়ে আসে, সন্ধ্যা ঝুলিয়া রয় মেহগনিশিখরে, সেই মুহূর্তটি যেন থমকিয়ে দেয়। যেদিন নজরে পড়ে তেমন সন্ধ্যাবতরণ, কোনো অতর্কিত অবকাশে, মুহূর্তগোছা ভাবায়। এবং অবধারিত অনিবার্য মনে পড়িয়ে দেয় কতকিছু! সমস্তই পিছনের, ফেলে-আসার, সামনের কোনো সুখস্বপ্ন অথবা সার্থকতাবাসনা সান্ধ্য মন্থর অবসরে মনে পড়ে না। খালি রিক্যাপ, রেট্রোস্পেক্ট, পূর্বানুবৃত্তি ফিরে ফিরে। এ-জীবনের কত ভুল, কত মশগুল ফুলবাগিচাবাগান, কত কোলাহল! দিবাবসানক্ষণে, একদম সন্ধ্যাপ্রাক্কালে, কেউ যদি চুপচাপ বসে থাকবার ফুরসতটুকু পায় এভ্রিডে, সে আর যা-ই হোক হাতিঘোড়াসাপব্যাঙ, আই বিলিভ, অতি আগ্রাসী দৈত্যদানো হয়ে উঠবে না অন্তত।

চোখের সামনে কলার গাছ গুটিকয়। একগুচ্ছ কদলীবৃক্ষ জড়াজড়ি শান্তিস্নিগ্ধ পরিবার যেন। কলাপাতা এদিক-ওদিক দুলিছে ধীরে-ক্রমে। একটা গাছে ধরন্ত কলাকাঁদি একখানি। এখনও পুরুষ্টু হয়ে ওঠেনি কলাফলগুলো। বইছে বাতাস একটু একটু, মধুমাসের মতন মিষ্টু, স্পষ্টকায়া ঘাসফুলগুলো ক্রমশ মিটোমিটো।

রোদ মরে এল, অশব্দ, মন্থরা। আমাদের দিন, প্রভু হে পরম দীনবন্ধু, সমাপন হলো। শুকরিয়া। আলোর পাতায় লেপন পড়ছে ছায়ার। ছাতিমগাছের ছত্রাকৃতি মাথায় গোলবৃত্ত অন্ধকারের প্রলেপ। আলোর অবসানে যেন প্রচ্ছায়ার জলসানুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে। এই ছায়া বিস্তারিত হলে পরে তাকে বলা যাবে রাত। ঘনযামিনী কিংবা হাল্কা হাওয়ার রাত, গভীর রজনী, দ্য ব্ল্যাক সোয়ান অপেরা ব্যালে। দ্যাট ইজ, রাত্রি মানে বিস্তারিত ছায়া! তা, এভাবেও বলা যেতে পারে বটে, হ্যাঁ। রাত্রিচ্ছায়ায় পৃথিবীর আলোধুলোলুণ্ঠিত শরীরের আব্রু ফিরিয়া আসে। কৃপাময়ী নিশাশ্রয়ে জগতের সুখাচ্ছন্ন ও শোকাতুরা সকলেরই স্থান সংকুলান হয়। আচ্ছাসে।

 

  • শেষ নোটের শীর্ষে এপিগ্র্যাফটি গৃহীত সঞ্জীব চৌধুরীর গান থেকে — “আগুনের কথা বন্ধুকে বলি দু-হাতে আগুন তারও / কার মালা হতে খসে-পড়া ফুল রক্তের চেয়ে গাঢ়” ইত্যাদি লাইন সম্বলিত ‘দলছুট’ ব্যান্ডের সেই সুন্দর লিরিকের গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল — গানলেখক কামরুজ্জামান কামু।

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you