বাংলাদেশের নারীলেখকগণ || আহমদ মিনহাজ

বাংলাদেশের নারীলেখকগণ || আহমদ মিনহাজ

বেগানা সমাচার-এর পাঠ-প্রতিক্রিয়ার শুরু থেকে অন্ত অবধি যে-কথাটি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলার চেষ্টা করেছি অর্থাৎ গানপার-এ নারীলেখকের খরা কাটানোর বিষয় নিয়ে দু-চার কথা আবারও বলা আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পরে হয়ত ভুলেও যেতে পারি, সুতরাং এখনই মেইলে টুকে রাখা ভালো। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য পরস্পরের ভাবনা ও অনুভূতির জগতে অবিরত অনুপ্রবেশ জরুরি বলে মানি। এছাড়া সময়ের বহুবিধ চোরাটান টের পাওয়া সম্ভব না এবং নিজেকে ফিরে দেখার তাড়াও ধীরে-ধীরে মরে যায়। সূনৃত-এর আপাত সর্বশেষ গল্পযাপন  সংখ্যায় আহমদ সায়েম কাণ্ডটা খানিক ঘটাতে পেরেছিলেন। নারীলেখকরা সেখানে বেশ মন খুলে লিখেছেন এবং সংখ্যাটা পুরুষলেখকের অনুপাত বিচারে চোখে পড়ার মতো ঘটনা মানতে হয়। গানপার-এর কথা যদি বলি তাহলে পাপড়ি রহমান বা এ-রকম আরো দু-একজনকে সেখানে লিখতে দেখেছি। সিলেটে বেড়ে ওঠার কাহানি দিয়ে বোনা পাপড়ির সুরমাসায়র-এর কিছু পর্ব পড়েছি মনে পড়ে। দেশে এখন নারীলেখক সংখ্যায় প্রচুর হলেও সৃষ্টিশীল সাহিত্যের বাইরে মননশীল বিচিত্র বিষয়ে স্বল্পসংখ্যককে লিখতে দেখি। একাধিক নারীলেখকের নাম হয়ত নেওয়া যায় যাদের ভাবনা ও ভাষাবয়নে ভিন্ন স্বাদ টের পেয়েছি, যদিও সুষম পরিণতিতে পৌঁছানোর মুহূর্তে সেখান থেকে নিজেকে তারা প্রত্যাহার করে নিলেন বলে মনে হয়েছে! কারণটা আমার ঠিক বোধগম্য হয়নি।

অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি আকিমুন রহমান, মনিরা কায়েস, শাহনাজ মুন্নী বা শুরুর দিককার অদিতি ফাল্গুনীর লেখা এক-সময় বেশ নিয়মিত পড়া হয়েছে। মুন্নী ও অদিতি পুরোদমে সক্রিয় রয়েছেন বলে জানি। মনিরা কায়েস ও আকিমুন রহমানের হালফিল কাজকম্মো সম্পর্কে বিশেষ ধারণা নেই। ওদিকে গুরুজনদের মধ্যে রিজিয়া রহমান একসময় আমার বিশেষ প্রিয় ছিলেন এবং সেটা তার লেখনীশক্তির প্রসাদগুণে। ফ্রেমের বাইরে গিয়ে নারী-পুরুষের সম্পর্কের রসায়ন ও তার গতিপ্রকৃতি অবলোকনের শক্তি তাঁর ছিল। বং থেকে বাংলা  ছোট থাকতে কতবার পড়েছি সে বোধহয় নিজেরও স্মরণ নেই। ছোট-ছোট কাহিনিমালিকায় গাঁথা আখ্যানে বাঙালি জাতিসত্তার ঐতিহাসিক আবর্তনকে তিনি তুলে ধরেছিলেন। নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব  তাঁর আখ্যানের বনেদ নির্মাণে সহায় হয়েছিল। রায় সম্ভবত প্রথম ইতিহাসকার যিনি ইংরেজদের শেখানো পদ্ধতির বাইরে গিয়ে বাঙালি আমআদমিকে ইতিহাসের আকর করে নিয়েছিলেন। রাজ-রাজড়াদের নিক্তিমাপা কাজকারবারকে সেখানে এই প্রথম কেন্দ্রচ্যুত হতে দেখা যায়। ফুটনোট আকারে তারা সেখানে যাওয়া-আসা করলেও রায়ের ইতিহাসগাথা মূলত প্রজাদের ছবি আঁকার চেষ্টায় নিজেকে কেন্দ্রীভূত করতে পেরেছিল।

আর্য-অনার্যের বিপুল তরঙ্গস্রোতকে মনে রাখলেও নীহাররঞ্জন রায়ের ইতিহাস সন-তারিখ আর প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের ঘনঘটা বিশ্লেষণে নিজেকে নিঃস্ব করেনি। নানা উপপ্লবের জোয়ারে প্রাণবন্ত এক জনপদের অবিরত স্থানচ্যুতি ও এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বিবরণকে সে ধারণ করেছিল। রণজিৎ গুহদের নিম্নবর্গ  এই প্রথম ইতিহাসের পাতায় নিজেকে জানান দিয়েছিল। সভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাসে কেউ তাদেরকে লিপিবদ্ধ করার দায় বোধ করেনি। সেই জায়গা থেকে রায়ের ইতিহাসচর্চা অন্যরকম আস্বাদের সঙ্গে পাঠককে নতুন দিগন্ত দেখায়। ক্ষুরধার কল্পনা আর অনুমানশক্তি ছাড়া এই গাথা বয়ন করা সম্ভব ছিল না। সময়ের কুয়াশাজাল ঠেলে প্রান্তিক জনপদে ঢোকার রাস্তা রায় কিন্তু খুঁজে বের করেছিলেন। ইতিহাসকারের জন্য কাজটি সবচেয়ে কঠিন এবং সেখানে তাঁর সফলতাকে কুর্নিশ যেতে হয়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে-কারণে নীহারররঞ্জন রায়ের ম্যাগনাম-ওপাসের মিনি ও স্বাদুপাঠ্য একখানা সংস্করণ তৈরি করেছিলেন। কিশোরপাঠ্য সংস্করণখানাও পড়তে চমৎকার ছিল।

ইংরেজ ইতিহাসকার কলিংউড বলেছিলেন বটে, — দূর অতীতে সংঘটিত ঘটনাকে অনুসরণের পরিবর্তে স্ব-আরোপিত কল্পনাশক্তির সাহায্যে ঐতিহাসিক তাকে দেখার চেষ্টা করেন; তথ্যের সত্যমিথ্যা যাচাই সেখানে গুরুত্ব বহন করে না, বরং তথ্যের ধ্বংসাবশেষ ঘেঁটে যা পাওয়া গেল কল্পনাশক্তির সাহায্যে তার যোগসূত্র রচনা করার মধ্য দিয়ে ইতিহাস নতুন করে জন্ম নিয়ে থাকে। ইতিহাসকার এদিক থেকে আখ্যান-রচয়িতার ন্যায় মৃত ঘটনাকে বিবরণের ভিতর দিয়ে পুনর্জীবিত বা নতুন করে তাকে সৃষ্টি করেন। রায়ের কিতাব কলিউংডের সূত্র মেনেই এগিয়েছিল। বং থেকে বাংলা-য় রিজিয়া সেটা খানিক ধারণ করেছিলেন। যদিও রায়ের মতো সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতায় তাঁকে অভিষিক্ত মনে হয়নি। সেটা আখ্যান রচনা করতে যেয়ে ইতিহাসের সূত্রে পাওয়া তথ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারার কারণে বোধহয় ঘটেছিল। তথাপি আখ্যান ও ইতিহাসের যুগলস্রোত পাঠ যাওয়ার এই ঘটনা সুদূর ছেলেবেলায় রোমাঞ্চকর ঘটনা ছিল। অধমের ইতিহাসপাঠের হাতেখড়ি রিজিয়া রহমানের আখ্যানের কল্যাণে ঘটায় তাঁকে সকৃতজ্ঞ চিত্তে এইবেলা স্মরণ করি।

বং থেকে বাংলা  শুধু নয়, রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষরঅলিখিতি উপাখ্যানশিলায় শিলায় আগুন-এর কথাও বেশ মনে পড়ে। গল্প বোনায় পারদর্শী ছিলেন। বিষয়-ভাবনায় স্বাতন্ত্র্য বা নিজস্বতার কমতি ছিল না। নারী-পুরুষের সম্পর্কের জায়গাটি অন্তত আমাদের স্থানকাল বিবেচনায় চমৎকার ধরতে পারতেন। এই ক্ষমতা সকলের থাকে না তবে রিজিয়া রহমানের বিলক্ষণ ছিল। তাঁর গল্প-আখ্যান নিয়ে ছবি বা নাটক হয়েছে বলে জানা নেই, যদিও তিনি সেটা ডিজার্ভ  করেন। সর্বশেষ আলবুর্জের বাজ  নামে তাঁর একখানা আখ্যান পড়েছিলাম। রিজিয়া রহমানের ইতিহাস-সচেতনা ও সমাজভাবনা আরো ক্ষুরধার হতে পারত যদি তাঁকে নিয়ে আলোচকরা লিখতেন। সে-রকম অধিক চোখে পড়েনি।

সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি  একসময় পড়তে ভালো লেগেছিল। হাঙ্গর-নদী-গ্রেনেড, যাপিত জীবন  অবশ্য বিশেষ টানেনি। গায়ত্রী সন্ধ্যা  শুনেছি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তপোধীর ভট্টাচার্য সম্ভবত এ-নিয়ে লিখেছিলেন। সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে পড়া হয়ে ওঠেনি। সেলিনা হোসেন প্রচুর লিখেছেন বা এখনো লিখছেন জানি। তাঁর বয়ানভঙ্গিতে নারীর অন্তরমহলের জটিল ঘূর্ণি প্রথানুগ বিবরণের বাইরে গিয়ে নতুন নির্মিতি লাভ করেছে বলে মনে হয়নি। এটা অবশ্য অধমের নিজস্ব পাঠকীয় মতামত। অন্যদের সেখানে দ্বিমত থাকতেই পারে এবং থাকাটা স্বাভাবিক।

ওপার বাংলায় আশাপূর্ণা দেবীর লেখায় সময়ের প্রতিকূল স্রোতে নারীচরিত্রের নিজেকে আবিষ্কারের তাগিদ ও সেই সুবাদে যে-বিস্ফার সেখানে ঘটে, সেটা বাংলাদেশের প্রবীণ প্রজন্মের নারীলেখকদের রচনায় কম পেয়েছি। নাসরীন জাহানের উড়ুক্কুর বেলায় অবশ্য এটা ঘটেছিল মনে পড়ে। উড়ুক্কুচন্দ্রলেখার জাদুবিস্তারবৈদেহী  বা উড়ে যায় নিশিপক্ষী  অনেক আগে পড়েছিলাম। নাসরীনের মধ্যে রিজিয়া রহমানের ছায়া দেখতে পাই। পুরুষভাবিক মনোবিশ্বে নারীর সচেতন আত্ম-বিনির্মাণ নিয়ে তাঁকে ভাবনা করতে দেখেছি। তাঁর আখ্যানের রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে কে কতটা লিখেছেন সে বলতে পারব না তবে বহুদিন আগে এম. এম. আকাশই হবেন বোধহয় (*আমার অবশ্য ভুল হতেও পারে), তাঁর এক লেখায় উড়ুক্কুকে অর্থনীতির বাচনিকতায় পাঠ করেছিলেন। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো গরিবের অর্থনীতি (Poor Economics) নামের কিতাবে গরিব দেশের আর্থিক শ্রেণিবিন্যাসের বিভিন্ন স্তরে রাষ্ট্র ও উন্নয়নসংস্থার ঋণ, ভতুর্কি ইত্যাদির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে সুখপাঠ্য আলোচনা করেছিলেন। ঋণ বা ভতুর্কির ঘটনাগুলা কী হেন কারণে নিছক ন্যূনতম প্রয়োজন মিটানোয় সীমিত না থেকে নতুন উপযোগ সৃষ্টি করে এবং টেস্ট  বা স্বাদতত্ত্ব-র জন্ম ত্বরান্বিত করে ও ভুখানাঙ্গার মনোজগৎকে নির্ধারণ করে যায় তার বিস্তর নজির সেখানে তাঁরা পেশ করেছেন। উড়ুক্কুর নীনার জীবনসংগ্রামকে স্বাদতত্ত্ব-র নিরিখে পাঠ যাওয়া সম্ভব। নারীসচেতনার প্রচলিত প্রভাব থেকে বেরিয়ে যৌনবোধের তালাশেও নাসরীন জাহানকে বহু পুরুষলেখকের তুলনায় প্রীতিকর মনে হয়েছে।

নারী তার দেহকে স্বয়ং কীভাবে দেখে? — এই জিজ্ঞাসার উত্তরে প্রজন্ম ভেদে ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক। আশাপূর্ণার সুবর্ণলতা  এর উত্তর একভাবে খোঁজার চেষ্টা করেছে। রিজিয়া রহমানের চরিত্ররা সময়ের পালাবদলে নতুন যেসব স্তর সমাজে জন্ম নিয়েছিল তার আলোকে উত্তরটা  তালাশ করেছে। আধুনিক নগরজীবনের নানা দোলাচলের ঘূর্ণিমাঝারে সুচিত্রা ভট্টাচার্য জিজ্ঞাসার জবাব অন্য আঙ্গিকে খুঁজে ফিরেছেন। সেলিনা হোসেনের উত্তর খোঁজার ঘটনা আমার কাছে অস্পষ্ট লেগেছে। রাবেয়া রহমান পুরনো ঢাকার অলিগলিতে ঢোকার কারণে হবে হয়ত প্রচ্ছন্ন ভাষায় সেখানে খানিক আলো ফেলেছিলেন। নবাবী হালচালের সঙ্গে মহল্লাকেন্দ্রিক জীবনাচার আর চিরাচরিত রক্ষণশীল মূল্যবোধের ঘোরপ্যাঁচে ঠাসা ঢাকাই কুট্টিজীবনের জানালা দিয়ে অথবা গলিমুখে যে-রমণীরা উঁকি দিয়ে যায় তাদের যুবতী দেহে বুনো আদিমতা বোধহয় নীরবে বহে। এই নীরবতাকে রাবেয়া খাতুন সহজাত প্রাকৃতিকতার জায়গা থেকে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন। নাসরীন জাহানের সময়ে এসে পরিসরটা সম্ভবত তৈরি হয় যেখানে নারী নিজের দেহকে একাদিক্রমে পুরুষ ও নারী উভয়ের চোখ দিয়ে নিরিখ করার ভাবনায় গমন করতে চেয়েছিল। চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার-এ ম্যাজিক রিয়্যালিজমের আবেশ কাঁচা বয়সে আমাদের বেশ মুগ্ধ করেছিল মনে পড়ে। বিএনপির জামানা চলে তখন আর এ-রকম সময়ে বিদ্রুপ ও যৌনতার মিশ্রণে যে-কথাগুলো নাসরীন বলতে চেয়েছিলেন তাকে রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মিলিয়ে নিয়েছিলাম। এখন ফিরে পড়লে কেমন লাগবে সে অবশ্য অনুমান করা কঠিন। জাদুবাস্তবতায় যেটা অমোঘ হয় অর্থাৎ কাহিনি ঘূর্ণি-সঙ্কুল চোরাটানের গভীর থেকে গভীরে গিয়ে ঢুকবে, সে-রকম না হলেও নাসরীনের বয়ান তরুণ বয়সের পাঠঅভিজ্ঞতায় উপভোগ্য মনে হয়েছিল।

পাপড়ি রহমান সম্ভবত নাসরীন জাহানের বয়ানকে নতুন শক্তিতে আরো প্রলম্বিত করেছেন। সম্ভবত  বলছি এ-কারণে যে তাঁর লেখার সঙ্গে অধমের পরিচয় নিবিড় নয়। বয়নশহর কিংবা ঊনশহরের গল্প  এবং নদীধারা আবাসিক এলাকা  নিয়ে পাঠকের উচ্ছ্বাস দেখতে পাই। সাহিত্যপাঠের ধারায় লম্বা বিচ্ছেদ ঘটার কারণে একটিও পড়া হয়ে ওঠেনি। সময়-সুযোগ করে যদি কখনো পাঠ যাই তাহলে হয়ত তাঁর কাহিনিবয়নের ধাঁচ ও বাঁক নেওয়ার ধারা সম্পর্কে ঝেড়ে কাশতে পারব। তার আগে অবধি বাড়তি কথা যোগ করা চালিয়াতি ও অসমীচীন হবে। ইশরাত তানিয়া, রমা মোদক থেকে শুরু করে আরো অনেকে এখন দুইহাতে লিখছেন জানি। মাঝেমধ্যে তাঁদের গল্প, গল্পভাবনা ইত্যাদি পাঠের মওকা জুটেছে, তবে বিস্তারিত পাঠের আগে কথা বাড়ানো সংগত নয়।

বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশে নারীলেখক উৎপাদিত লেখ্যবস্তু যতখানি পাঠ গিয়েছি তাদেরকে ঠিক সেই জিনিস মনে হয়নি অধম যার তালাশে থাকে। বিচিত্র পরিধির মাঝে নারী তার নিজেকে নিক্ষেপ করবে এবং সেখানে তার কণ্ঠস্বর অস্তিত্বের গহিন থেকে উঠে আসার ক্ষণে পাঠককে নতুন অভিজ্ঞতার আস্বাদে একাদিক্রমে বিচলিত, বিপন্ন ও সমতুল নিরুপায় করে তুলবে; — এমনধারা আজো ঘটেছে বলে মনে হয়নি। পুরুষলেখক যতরকম অভিজ্ঞান ও ভাবনায় গমন করে তিনিও সেভাবে সেখানে গমন করবেন এবং বিচিত্র আঙ্গিকে লেখা পয়দা করে যাবেন। আমার অভিজ্ঞতা এই জায়গা থেকে এখনো সুখকর নয়।


অনেকে এ-রকম ভেবে থাকলেও অধমের বিবেচনায় ভাষা জেন্ডার নিউট্রাল  কোনো ঘটনা নয়। যার হাতে সে পড়ে তার হাত ধরে লৈঙ্গিক চোরাবর্ত তৈরি করে নেয় এবং পাঠককে সেখানে সেঁধিয়ে যেতে বাধ্য করে। গাণিতিক ভাষার কারিকুরি বাদ দিলে তার যত রূপ সভ্যতায় দেখি তার সবগুলা মূলত পুরুষভাবিক। পুরুষের ভাষা বয়নের জগৎ নিজের একটি চরিত্র দাঁড় করাতে এখানে সফলকাম বটে! চরিত্রটি মোটের ওপর নারী-পুরুষ নির্বিশেষকে প্রভাবিত করায় এ-নিয়ে এখন আর প্রশ্ন ওঠে না। নারীলেখকরা পুরুষপ্রণীত ভাষাছকে জারি থেকে নিজের মনের কথা আওড়ান। যারপরনাই তারা যা বলতে আগ্রহী এবং ভাষার কারণে বলতে নাচার তাকে ধরতে বেগ পেতে হয়। পুরুষকুল নির্মিত ভাষার প্রতিটি অনুষঙ্গকে তাই একালের নারীলেখকের প্রশ্নবিদ্ধ করা প্রয়োজন। এই ব্যতিহার ছাড়া তার পক্ষে নিজের লিঙ্গসত্তাকে তুলে ধরতে জানে এ-রকম বয়ানে গমন সম্ভব বলে বিশ্বাস যেতে মন আপত্তি জানায়।

নারী যখন নিজের ভিতর-বাহির তালাশ করে তখন ভাষার মধ্যে সেই বিস্ফোট ঘটা প্রয়োজন যা তাকে পুরুষভাবিক ভাষাবৃত্ত থেকে বের করে নিয়ে যাবে ও নতুন বাঁক নিতে বলবে। আশাপূর্ণা দেবীর কাছে এখানে শেখার রসদ রয়েছে। প্রথম প্রতিশ্রুতি  থেকে সুবর্ণলতা  অবধি তাঁর যে-পরিভ্রমণ সেখানে নারীর মনোজগৎ বিশ্লেষণের ধারা নারীভাবিক অঙ্গে নিজেকে ভাষা দিয়েছিল। বঙ্কিম বা শরৎকে সেখানে তিনি গোনায় নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। বলছি না যে এখন থেকে তাঁর ধাঁচেই লিখতে হবে। তিনি অসূর্যস্পর্শা নারীর সর্বজায়া  বা সর্বাঙ্গীন অর্থে নারী হতে চাওয়ার বেদনা ও শত প্রতিকূলতাকে ভাষা দিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়াকেও কাজটি করতে হয়েছিল। তাঁদের বয়ানের একরৈখিকতা সময়ের বিচারে অবধারিত ছিল। ওটা ছিল প্রবল প্রতিকূল স্রোতে সর্বাঙ্গে নারীত্বে বহাল থেকে পুরুষের জগতে প্রবেশের দুঃসাহস দিয়ে বোনা নারীর জীবন-আখ্যান। সুবর্ণলতার লড়াইটা বহুমাত্রিক। পুরুষকুলের সঙ্গে শুধু নয়, নিজকুলে বিদ্যমান পুরুষভাবিক নারীর সঙ্গেও তাকে লড়তে হয়েছিল। সুতরাং জেন্ডার নিউট্রাল  হওয়ার কথা সে ভুলেও ভাবেনি।

রান্নাবান্না বা শাশুড়ির সেবাযত্নকে এই সুবর্ণলতা যেমন ছেড়ে যায় না, পুরুষ যবে বাইরে কাজে যায় তখন সে কীভাবে জগতের সঙ্গে নিজের সংযোগ ঘটায় সেটা দেখার অপার কৌতূহল নিজ দেহে শোষণ করতেও সমান উতলা বোধ করে। প্রথম প্রতিশ্রুতির সত্যবতী কিংবা সুবর্ণলতার নারীত্ব দ্বৈততার মধ্যে স্থিত থাকায় নারী-অধিকারের অধুনাভাষ্যের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে তারা সর্বজায়া  অর্থাৎ সর্বাঙ্গীন অর্থে নারী হয়ে ওঠে। আশাপূর্ণার আখ্যান পুরুষভাবিক ছকে নারীকে কেন নাহি দিবে অধিকার  ইত্যাদি ভেদবিচারে গমন করেনি। সে জেন্ডার নিউট্রাল  হওয়ার কথা যেমন ভাবে না, অন্যদিকে সমানাধিকার নিয়েও তাকে ব্যতিব্যস্ত হতে দেখা যায় না। নিজের লৈঙ্গিক বিশেষত্বে সক্রিয় দেহ ও তাকে ঘিরে সৃষ্ট সংস্কৃতি সম্পর্কে এই নারী সজাগ। এগুলোকে ধারণ করেই পুরুষের জগতে প্রবেশ বা সেখানে তাল দিয়ে হাঁটতে চায়। নারী এখানে সামাজিক গ্রন্থির প্রতীক রূপে নিজেকে ভাষা দিয়ে যায়। ঘর ও বাহির দুই জগতে তার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হওয়ার অর্থ হলো পুরুষভাবিক সমাজের মাতৃভাবিক সমাজে রূপান্তর। সামাজিক চুক্তির সেই জগৎকে সুবর্ণলতারা ফিরিয়ে আনে যেখানে পুরুষ নারীকে সুরক্ষা দানে বাধ্য হলেও তাকে ঘরের চারদেয়ালে বন্দি করে সেটি হওয়ার নয়; ওদিকে নারীও পুরুষের জৈব বা সামাজিক দাবিদাওয়া পূরণে বিমুখ নয় তবে সেটা যেন ন্যায়সংগত হয় সেকথা ইয়াদ করাতে ভোলে না।

মাতৃকেন্দ্রিক আদিবাসী সমাজে লম্বা সময় ধরে নারী-পুরুষে বিনিময়ের যে-চল ছিল সেখানে এক পক্ষের অন্য পক্ষকে ওভাররল্যাপ করে যাওয়ার কোনো বিষয় ছিল না। অলিখিত চুক্তি বা বোঝাপড়ার মাঝে উভয়ে নিজেকে ভাষা দিয়েছে। আশাপূর্ণার সুবর্ণলতা  খানিক সে-রকম মাতৃতান্ত্রিক বিভূতির আবেশ জাগিয়ে যায়। এই আবেশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ থেকে শরৎ কিংবা অদ্য নারীসংবেদী পুরুষলেখকের বয়ানের আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে। একালে জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন  ঘিরে যেসব সূক্ষ্ম ও বহুরৈখিক বয়ান গড়ে উঠেছে সেখানে নারী তার নিজের জমিজিরেত কীভাবে বুঝে নিতে চাইছেন তার ধরতাই পরিষ্কার না হওয়া অবধি সত্যিকারের সর্বজায়া নারীর কাহিনি লেখা সম্ভব নয়। আপনার মেইলসূত্রে ও বেগানা সমাচার  পাঠের প্রতিক্রিয়ায় কথাগুলা পরবর্তী বিবেচনার জন্য এইবেলা টুকে রাখলাম।

তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you