গানপার নতুন প্রজন্মের লেখকদের অভয়াশ্রম হয়ে উঠুক এটাই চাওয়া। ছোটকাগজে কাজটি আমরা করতে পারিনি। অনলাইনে মনে হয় সেটা সম্ভব। গানপার, অরাজ ছাড়াও একাধিক সাইটে এ-রকম দু-একজনের লেখা মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। সংখ্যাটা বহুসংখ্যকে মোড় নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া এক প্রজন্মের লেখকের পক্ষে পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তাভাবনার হদিশ পাওয়া সম্ভব হয় না। যত যা-ই বলি, আমরা এখন পুরনোদের কাতারে চলে গিয়েছি। নতুনরা সেখানে ভরসা। তাদের চোখ দিয়ে নিজেকে পরখ করা দরকার বৈকি। রবীন্দ্রনাথের এই গুণটা ছিল। চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির জগতে শতেক ছুঁৎমার্গ বা বাতিক থাকলেও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ওঠবসের অভ্যাসে কখনো ছেদ ঘটতে দেননি। সঙ্গপ্রভাবে রবির ভাবনার বনেদ সেখানে আমূল পাল্টে গিয়েছিল এমন নয়, কিন্তু তাতে কি, নতুনদের পত্তনি চিনে নিতে নিজ আঙ্গিকে সেখানে বীজ বোনার চেষ্টায় সদা সচল ছিলেন। একালে ঘটনাটি সহজে চোখে পড়ে না!
দুই বাংলার প্রয়াত বা জীবিত অনেক খ্যাতিমান লেখকরা শুনতে পাই তরুণদের সঙ্গে ওঠবসে অভ্যস্ত, কিন্তু তাঁদের লেখায় গমন করলে ওঠবসের প্রভাব কিছু টের পাওয়া যায় না। হতে পারে নতুন প্রজন্মের লেখককে তাঁরা স্বয়ং এতটাই প্রভাবিত করেন যে সেখানে তৃতীয় পরিসর জন্ম নিতে পারে না। অথবা নতুন প্রজন্মের লেখকের সৃষ্টিশীল বিস্ফার টের পেলেও সে-আঙ্গিকে নিজেকে পরখ করার ঝুঁকি নিতে ভয় পান। এমনও হতে পারে নতুন প্রজন্ম স্বয়ং গুরুজনদের তোলা প্রাচীর ভেঙে নতুনত্বে গমনের শক্তি রাখে না। তৃতীয়টা কেন জানি নিজের কানে হাস্যকর শোনায়। কোনটা সত্য সে এক ঈশ্বর জানেন! তবে হ্যাঁ ত্রিশ দশকের তুর্কিদের সঙ্গে ওঠবসের অভিজ্ঞতা পোক্ত হওয়ার ক্ষণে রবীন্দ্রনাথকে লিখতে দেখি, “আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে / বাঁধব না আজ তোড়ায়, / রঙবেরঙের সুতাগুলো থাক্, / থাক্ পড়ে ওই জরির ঝালর।” — স্মৃতিকাতর এই ঘোষণায় চাপা দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকারের সুর কানে খট করে বাজে। বিশ্ব জুড়ে নতুন অনুভবে স্নাতক কবিদের পালে হাওয়া তখন লাগতে শুরু করেছে। এর ঝাপটে রবির নিজেকে পরিত্যক্ত ও দলছুট মনে হচ্ছে। প্রজন্মান্তরের ভাবনায় সুর মিলাতে মন মানছে না কিন্তু দলছুট দশাখানাও যে প্রাণে সয় না! যারপরনাই রবীন্দ্রনাথকে দ্বৈতবোধের টানাপড়েন সমেত নয়া কবিতার ভাষাঅঙ্গে কথা কইতে দেখি। এখন রবির অভিমানভারাতুর স্মৃতিকাতর অতীত-প্রত্যাখ্যান নতুনকে কতটা ধারণ করতে পেরেছিল সেটা পৃথক বিতর্কের বিষয়। মোদ্দা কথা হলো নিজের নবায়নে জাতি তাঁকে বিমুখ বোধ করতে দেখেনি। একালে ঘটনাটি ব্যাপক হওয়ার কথা থাকলেও নতুন প্রজন্মের ভাবনা ও ভাষা-নিরীক্ষায় অগ্রজ প্রজন্মের কম লেখককেই নয়া বাঁক নিতে দেখেছি।
হুমায়ুন আজাদ হয়ত এ-কারণে আধুনিক বাংলা কবিতা-র সংকলন করতে বসে ষাটে এসে আটকা পড়েন। ষাট-পরবর্তী বাংলা কবিতার মোচড়গুলো তাঁর অনুভবে তরঙ্গ ও নতুন ভাবনার উদয় ঘটাতে বিফল হয়। প্রত্যেককে কমবেশি বিগত বা নিজ প্রজন্মের ফাঁদে বন্দি থেকে সমকালীন ও উত্তর প্রজন্মের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে চোপায় নামতে দেখি! এই ভূবর্ষে মরমি বা আধ্যাত্মিক সংবেদচর্চার ইতিহাসে গুরুবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও লেখালেখির জগতে এটা জহরতুল্য, যদিও এখানে জহরের প্রকোপ মারাত্মক বটে। কোনো-না-কোনো গোষ্ঠী ও সিন্ডিকেটে নাম লিখিয়ে কবিলেখকদের একে অন্যের পিঠচাপড়ানি বা ব্যজস্তুতি আর কাহাতক চলবে কে জানে!
কারুবাসনার চর্চায় গোষ্ঠী বা শিবিরে কবিলেখকের ভাগ হয়ে পড়া আদৌ সমস্যা নয় যদি সেখানে পাল্টাপাল্টি সৃষ্টিমুখর তরঙ্গ ও আন্দোলন জন্ম নিতে থাকে; তবে হ্যাঁ, উদ্দেশ্য ভিন্ন হলে আলাদা কথা। আখেরে করেটরে খাওয়ার ধান্দা যদি মুখ্য হয়ে ওঠে তাহলে ফাঁকা আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছু কানে পশে না। গোষ্ঠী বা শিবির বিভাজন তখন হরিষে বিষাদের অনুভব দিয়ে যায়। বাংলাভাষী ছোটকাগজে পুরনো ও নতুন লেখকের ভাববিনিময় যে ঘটতে গিয়েও ঘটল না তার পেছনে সৃষ্টি-প্রতিবন্ধী এইসব শিবির বিভাজনের দায় কম নয়। আমরা কেউ হয়ত তার বাইরে থাকতে পারিনি। এখন গানপার যদি তার তনাই বা সাধ্য অনুসারে কাজটা করে যেতে পারে সেক্ষেত্রে নতুন পথে মোড় নেওয়া সম্ভব হতেও পারে। শক্ত একটা ঝাঁকুনি আসলে খুব দরকার হয়ে পড়েছে। বয়স্ক লেখকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তরুণ থেকে তরুণতর লেখক দুর্বার গতিতে নতুন ভাবনা, নিরীক্ষা আর অভিনব আঙ্গিক সহ অনলাইন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে … এ-রকম ঝাঁকুনি সত্যি প্রয়োজন। এছাড়া বাংলা ভাষায় সৃজন ও মননচর্চার পাশ ফেরা বা নতুন পাঠক সৃষ্টির ঘটনা বোধহয় সম্ভব নয়। ঝাঁকুনিটা উপভোগের সুখ আমাদের কপালে না-ও জুটতে পারে। সে নাহয় না-ই জুটল, দূর ভবিষ্যতে যদি ঘটে সেদিন যারা বেঁচে থাকবেন তারা হবেন বাংলাভাষার সাচ্চা লেখক। গানপার নাহয় সেই লক্ষ্যে নিজেকে এখন থেকে আরো অনুসন্ধানী করুক। আমাদের মতো বুড়ো-হাবড়াদের পাশে তরুণ তুর্কিরা ব্যাপকভাবে উঠে আসুক এই কামনা আন্তরিক জানবেন। এছাড়া নিজের জমিজিরেতে নতুন বীজ বোনা সহজ নয়।
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS