স্তালিন পেডাগোজি!

স্তালিন পেডাগোজি!

এটা রাখো, ভালো করে দেখো, ঘাসটিতে একটুও দাঁত বসাইনি আমি। আমার কথা মনে রেখো, আমার নাম জোসেফ স্তালিন।

বন্দী অবস্থায় এই কথাটি স্তালিন বলেছিলেন নির্যাতনশিবিরের এক প্রহরীকে লক্ষ্য করে। রোজ সকাল থেকে বেলা দুইফর পর্যন্ত রুটিনমাফিক খোলা ময়দানের তন্দুরতাতানো রোদে বন্দীদের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে তীব্র যন্ত্রণা প্রদানের সময় স্তালিন দাঁতে চেপে রেখেছিলেন একপাতা ঘাস। যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন দাঁত-কিড়িমিড়ি, শেষে তৃণখণ্ডটি মুখ থেকে বের করে দেখিয়েছিলেন : অক্ষত!

অবাক বিস্ফারিত চোখে প্রহরী তাকিয়েছিল একবার ঘাসে ফের একবার বন্দীর পানে। ঘাসের গায়ে দাঁতের চিহ্নও লাগেনি! অত্যাচারীপক্ষের প্রহরীকে একচিলতে সেই তৃণখণ্ড দিয়ে স্তালিন বলেছিলেন প্রোক্ত কথাগুলো। বলেছিলেন : ঘাসটিতে আমি একটুও দাঁত বসাইনি দ্যাখো। বলেছিলেন : আমার কথা মনে রেখো, ভুলে যেও না আমার নাম, আমি জোসেফ স্তালিন।

বহুবছর বাদে এই লোক, জোসেফ স্তালিন, হয়েছিলেন তার নিজের দেশের অধিকর্তা শাসক। বন্দী অবস্থায় তার ওই কথাগুলো, ওই ঘটনাটুকু, প্রমাণ করে স্তালিনের সহনক্ষমতা। কী অমানুষিক যাতনা সহ্য করে একজন লোক তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে, একজন মানুষের মনোবল কতদূর দৃঢ় হতে পারে, এ ঘটনা তারই এক নজির।

আবার, এই তৃণখণ্ডটিকে যদি দেশমাতৃকার সঙ্গে তুলনা করে ভাবা যায়, সেক্ষেত্রে পাওয়া যাবে অন্য এক সৌন্দর্যের হদিস। স্তালিন যেন বলতে চেয়েছেন : যত যাতনাই সইতে হয় সইব, কিন্তু আমার প্রিয় মাতৃভূমির গায়ে একটুও আঁচড় বসাতে দেবো না। কোমলতার পক্ষে এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে!

অবশ্য ইতিহাসে স্তালিনের নিষ্ঠুরতা পরে যেভাবে দেখা গিয়েছে, তার সঙ্গে এই ঘটনাটি খাপ খায় না। তা যা-ই হোক, তবু তো ঘটনাটি সাক্ষ্যাৎ সৌন্দর্যের দৃষ্টান্ত একটি। বিউটি অফ ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড রাইটিয়াস্নেস।

জোসেফ ভি. স্তালিন নিয়া আমার জানাশোনা এট্টুকুনই। এর ভিত্তিতে উনারে মহান বা ভিলেন কোনোটাই ভাবা আমারে দিয়া সম্ভব হচ্ছে না। জানাশোনা আর বেশিদূর আগাবার চান্স খুবই লিটল। শুধু স্তালিন কেন, কোনো পরদেশি লিডার-ক্যাডার নিয়া আমার কোনো মহৎবৃহৎ চিন্তাচেৎনা নাই। কিছু স্টোরি ইয়াদ রাখি নিজের বেঁচে-থাকাটাকে একটু ভয়ঙ্কর সুন্দর করিয়া রাখতে, অল্পবিদ্যায় সেই ভয়ঙ্কর বিউটিটা পাওয়া যায়।

কিন্তু ওভারঅল স্তালিন রাইটিয়াস্ ছিলেন না রুথলেস্, কম মেরেছেন না বেশি, এইগুলা নান্ অফ মাই কন্সার্ন। আমি শুধু একটা জ্ঞান আছে বলিয়া দাবি করি যে স্তালিন দুনিয়ার শীর্ষস্থানীয় ডিক্টেটরদের মধ্যে একজন। উনার মায়ামমতা, মাইরধইরের মধু ও দংশন, উনার ক্যারেক্টারের নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি নিয়া তার দেশের লোকেরা যা বলবে তা-ই শুনতে হবে আমরারে।

অ্যানিওয়ে। তিন দশকের ডিক্টেটররে যদি মহান বলেন আপনি, তাইলে আমরাও তো পিছায়া নাই, আমরাও মহান হবার হাফ অফ দ্য ওয়ে পেরিয়ে এসেছি। ইনশাল্লা স্তালিন গো-হারা হারবেন আমাদের কাছে। আর যদি ভিলেন বলেন, উপায় নাই, গর্দানটা আমরা মিহি এবং মসৃণভাবে নেব করতলে।

এইগুলা ফায়শা আলাপ। রুশিদের খুশিতে আমরাও খুশি হব, রুশিব্যথায় সমব্যথী, ওই দিনেরে তো বহু আগেই বাঘে খাইসে। চেয়ার্ম্যান অফ চায়না আমাদের চেয়ার্ম্যান মনে করে এমন লোক আছে এখনও? তবে একটা ব্যাপারে এখনও আমার বিস্ময় যায় নাই, বিস্ময়টা আছে সেই শিক্ষাশালার বয়স থেকেই, লালফৌজি নিশানবর্দারেরা বোধহয় ডিক্টেটরতন্ত্রটারে হেইল্ করতে চায়। আক্কেল গুড়ুম হবার বয়সে এই জিনিশটা লালবইবিক্রেতাদের মধ্যে দেখেছি। বুঝেছি যে এক্সট্রিমিজমের একটা ডিপরুটেড সিড বোধহয় রেডপার্টিওয়ালাদের মধ্যে রোপিত রয়েছে। এইখানেই ডানে-বামে খিচুড়িটা পাকায়।

স্তালিন শুধু নয়, এইরকম বহু অপ্রেসর-সাপ্রেসর নিয়া আমারও দুইটা বা তিনটা অ্যানেকডোট্যাল/ইতিকাহিনি শোনা আছে। যেমন মুয়াম্মার গাদ্দাফি, সাদ্দাম হোসেন, অ্যাডলফ হিটলার ইত্যাদি। কিন্তু উহাদের হেরোয়িক বা দানবিক গল্পগাছা জানার ভিত্তিতে এমন কোনো অনুভূতি আমার মধ্যে জন্মায় নাই কোনোদিনই। নিছক প্রয়োজনে এই ফিগারগুলারে আমি ইয়াদ করতে পারি, প্রীতিভালোবাসা নাই আলাদা কিছুই। সপ্তম নৌবহরের কারণেও কোনো প্রণয় আমি ফিল্ করি না রাশিয়ার প্রতি।

কিন্তু ঘাসের ঘটনাটা ঘটায় স্তালিনের নাম ইয়াদ রাখা আমার জন্য সহজ হয়েছে, এইটা বলতে পারি। কাহিনিটা ‘ভাবনা-ভাষান্তর’ নামে একটা বইয়ের ভিতরে পেয়েছিলাম বোধহয়। আমাদের শাহাদুজ্জামানের অনুবাদবই। বিশ/বাইশ বছর আগেকার জানা কাহিনি। স্মৃতির উপরে এখন আর আগের মতো অত আস্থা রাখতেও পারি না। যা-হোক। স্তালিন নিয়া মায়াকান্না নাটকসিনেমা ফাঁদবার লাগিয়া বাংলাদেশে বহু লোকই পাওয়া যাবে এখনও আগুয়ান ও উৎসুক। উহাদের বুলন্দ্ নসিব হোক।

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you