ম্যাজিক পঞ্চাশ ও ছোটকাগজকারীর বসবাস || আহমদ মিনহাজ

ম্যাজিক পঞ্চাশ ও ছোটকাগজকারীর বসবাস || আহমদ মিনহাজ

সিলেট থেকে মানেগুণেধারে শানদার ছোটকাগজ বের করার শত হুজ্জোত সম্পর্কে যে-কথাগুলো আপনি ই-মেইলে বলেছেন তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে আগে বাড়ি। ছোটকাগজ সম্পাদনায় বিলোঅ্যাভারেজ-র সমস্যাটি বোধ করি কেবল সিলেটের একার নয়, গোটা দেশ জুড়ে ওটা কমবেশি চোখে পড়ে। যুগ ও পরিপার্শ্বের সঙ্গে সংযোগহীন ভোঁতা কাজকারবারে আমাদের মসিচর্চা বোঝাই হয়ে আছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ অনেক ভেবে খুঁজে পাইনি। নিরুপায় হলে মানুষ শুনেছি মরিয়া হয়। আমার অবস্থা সে-রকম বলতে পারেন। লেখালেখির স্বাধীন পরিসরকে ক্রমাগত সংকীর্ণ হতে দেখছি। একে পাত্তা না দিয়ে অবশ্য লেখা যায়। অনেকে লিখছেনও। সমস্যা হলো এভাবে লিখতে মন মানে না। যারপরনাই আমাদের মতো লোকজন লেখালেখির জগতে দলছুট আর ব্রাত্যই থেকে গেলাম! না কেউ গেরাহ্য করে, না গেরাহ্য করা প্রয়োজন ভাবে! এমনকি কষে প্রশংসা বা গালমন্দের কোনোটাই করে না। প্রশংসা ও গালাগাল দুটোই সমান জঘন্য হলেও এর সুবাদে নিজের দোষগুণ বা ভুলচুক নিয়ে ভাবার সুযোগ জোটে। ঈশ্বর এই দুখসুখের ভাগ থেকে মোদের বঞ্চিত রেখেছেন! পরের হয়ে গতর খেটে একজীবন গেল। এখন ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো / পার করো আমারে’ জপ করা ছাড়া উপায় দেখছি না!

এ-রকম গ্যাঁড়াকলে বসে নিরন্তর লিখে যাওয়া সুকঠিন সাধনার সমতুল। জানি না কতদিন পারব। মাথা দেখছি আগের মতো ছুটতে চায় না। মগজের কোষে আলোসংকেত যখন-তখন ঝিলিক দিতে কঞ্জুসি জানায়। বুকের গহিনে ধস ধস করে পাড় ভাঙার আওয়াজ শুনছি প্রতিদিন। ঘুমের ঘোরে মাইকেল মধুসূদন মুচকি হেসে হাঁক দিয়া যান। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে অগত্যা চেঁচাই : ‘…একে একে শুখাইছে ফুল এবে, নিভিছে দেউটি / নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী; / তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে? / কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?’ যার নাই কোনো গতি তার সহায় মধুসূদন, এই স্তোকবাক্যে গয়ংগচ্ছ দিন কাটাই এখন।

উপশহরে সি-ব্লকের মোড়ে একসময় টুকরি-কোদাল হাতে রোজকামলাদের সার বেঁধে বসে থাকতে দেখতাম। যার প্রয়োজন সে এসে দরদাম করে তাদের কাজে নিয়োগ দিত। রোজকামলারা এখনো ওভাবে বসে কি-না বলতে পারব না। কতকিছু যে এখন আর বলতে পারি না অথবা লক্ষ করি না সেসব ভেবে মাঝেমধ্যে বিমনা হই। বুঝতে বাকি থাকে না, চারপাশের জীবনকে দেখার আগ্রহ ক্রমশ উবে যাচ্ছে। লেখকের রসদ বলতে তো বুঝি নিজের চোখকে ক্যামেরা বলে ভাবা। সে হচ্ছে ক্যামেরাম্যান। নিজের চারপাশে ক্যামেরা ঘোরানো তার একমাত্র কাজ। ক্যামেরাটা ইদানীং আগের মতো কাজ করে না। লেন্সে জং ধরেছে। ক্যামেরাকে শক্তি যোগায় যে-ব্যাটারি অর্থাৎ মস্তিষ্কটা মনে হয় দ্রুত মরণপানে ধাইছে। রিচার্জ করে দেখেছি, বেশিখন চাঙ্গা থাকে না। নিজের চারপাশ থেকে দূর চারপাশ…সবটাই নানা ছুতোয় দেখছি অথচ মন বলে সে নাকি কিছু দেখতে পাচ্ছে না। হুটহাট কত কী ভাবি কিন্তু কী ভাবি সেটা নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। এর মানে হলো চোখের পাওয়ার কমেছে আর মগজটা ভোঁতা বিলকুল। পরাক্রমশালী এক রাবণকে লেখক বলে এতদিন জেনে এসেছি। অতুল লঙ্কাপুরীতে বসে অট্টহাস্যে সে নাকি জগৎ কাঁপায়। নিজের মধ্যে রাবণটাকে খুঁজে পাই না। তার বদলে যাকে দেখা যায় সেই বেচারা এক পরাভূত সৈনিক। লঙ্কাপুরীর গরিমাকে সুরক্ষিত রাখার ক্ষমতায় ম্রিয়মাণ!

তবু বেশ চলছে জীবন। জানা বা না-জানা, দেখা অথবা না-দেখার ঘোরচক্করে স্বপ্ন হানা দেয় নিদমগ্ন দেহে। স্বপ্নে দেখি আদুল গায়ে খাতা-কলম নিয়ে উপশহরের ওই মোড়টায় বসে পড়েছি। হঠাৎ ছোটকাগজের সম্পাদক মহাশয়ের মতো দেখতে এক লোক সেখানে উদয় হলেন। ঘটনা কী! তিনি একখানা কাগজ করবেন। তার হয়ে গতর খাটতে হবে। পারব কি না জানতে চাইলেন। সাহিত্যে প্রথমবার নোবেলের মেডেল গলায় পরেছিলেন এমন এক কবিকে নিয়ে লিখতে হবে বলে শর্ত ঠুকলেন। আকাশ-পাতাল একাকার করে কবির নাম স্মরণের চেষ্টা করি। কিছুতেই মনে পড়ছিল না! সহসা বিলেতপ্রবাসী বন্ধুর মতো দেখতে এক লোক আবছায়া মতো স্মরণে হানা দিলেন। বোঝার বাকি থাকল না তিনি হচ্ছেন সেই লোক যার মুখে একদিন ওই কবির নাম উচ্চারিত হতে শুনেছিলাম!

প্রবাসী বন্ধু বা তার ডুপ্লিকেটকে এখন কোথা খুঁজে পাই এই দুর্ভাবনায় আদুল গায়ে ঘেমে নেয়ে উঠলাম ক্ষণিক! ওদিকে খাতা-কলম নিয়ে উপশহরের মোড়ে দিনভর বসে থাকা সম্ভব নয়। একটু পরে ট্রাফিক পুলিশে এসে আচ্ছাসে ঠ্যাঙাবে। ক্ষুধাও পেয়েছে জবর। মগজে কিছু দানাপানি না দিলে ভুখা থাকতে হবে সারাদিন। দুর্দিনে নিজের একটা হিল্লে হচ্ছে ভেবে দয়ালকে মনে-মনে স্মরি। রাখে আল্লা মারে কে জপ করতে-করতে সম্পাদকের প্রস্তাবে মাথা ঝোঁকাই। চোখের কোণে সেই মুহূর্তে একফোঁটা জল এসে জমেছিল। অশ্রুফোঁটাকে পাত্তা দিতে গেলে আপদ বাড়বে বৈ কমবে না। শার্টের হাতায় জলটা তাই চট করে হাপিশ করি। এ তো জানা কথা, গতরখাটা রোজকামলার জীবনে চোখে জল জমতে নেই। যদি জমে তবে দিনের খোরাকি জুটবে না। জলটাকে লুকিয়ে অগত্যা খাতা-কলম হাতে সম্পাদকের পেছন-পেছন হাঁটতে থাকি।

ঝকঝকে আকাশে ততক্ষণে একখণ্ড মেঘ আমার ও সম্পাদকের মাথার ওপর এসে স্থির হয়েছে। মেঘটাকে কবি কালিদাসের মতো লাগছে দেখে অবাক যাই। কালিদাস বোধ করি মেঘ হয়ে আকাশে বিরাজ করছেন। উনি ভগবানতুল্য লোক। ঈশ্বর নিজের কিছু গুণ ধার দিয়ে তাঁকে ধরায় প্রেরণ করেছিলেন। এখন আদর করে আকাশে তুলে নিয়ে মেঘ করে রেখেছেন। মেঘকালিদাসকে একখানা পেন্নাম ঠুকে তাঁর সহায় মাগি, — রক্ষে করো কবিবর! নোবেলের মেডেল প্রথম যে গলায় পরেছিল সেই লোকটার ব্যাপারে যক্ষের মাধ্যমে কিছু খবর পাঠাও। তার কারণে অধমের বরাত খুলেছে আজ। নয়তো উপশহরের জঘন্য মোড়টায় বসে বৃথা অপচয় হতো দিন! স্বপ্নটা ওই অবধি এসেছিল কেবল, এমন সময় বউয়ের কনুইয়ের গুঁতোয় বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সে!

সকালটা শুরু হলো বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে। আমি নাকি ইদানীং নাকডাকার সঙ্গে বিড়িবিড় করে অখাদ্য কবতে আওরাই। বিউটিফ্যুল সকাল ছিল সেটা। চারদিকে সোনারোদের ঝিকিমিকি। ‘ও আকাশ সোনা সোনা / এ মাটি সবুজ সবুজ’ বলে হেমন্তের মতো গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছিল। মরার কোকিল ওদিকে সেগুন গাছের ডালে বসে বেদম আনন্দে ডাকছিলেন। এ-রকম এক সকালে বউয়ের সঙ্গে কোমর বেঁধে বচসায় নামতে হলো। বচসা শেষে কিরা কাটলাম, অনেক হয়েছে, স্বপ্ন যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে সম্পাদকের মতো দেখতে লোকটা বোধ করি শামীম শাহান ছিলেন। নিজের রেনিগেড ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে তাকে অবিলম্বে একখানা ই-মেইল করা প্রয়োজন। এছাড়া আদুল গায়ে খাতা-কলম হাতে উপশহরের মোড়ে বসে থাকার দুর্দিন ফুরাবার নয়। আমাদের মতো লোকের সামর্থ্য তো এটুকুই। নয় কি?

 


মনে-মনে ভাবছিলাম গ্রন্থী  করে লাভের লাভ কিছু হবে না সে তো জানা কথা; তবে হ্যাঁ, এই বার্তাটি অন্তত পৌঁছানো যাবে, — কিছু লোক বিরুদ্ধস্রোতে ভেসে যাবার ক্ষণে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা অন্তত করেছিল। ছায়াসম্পাদনার বিরক্তিকর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে শাহানভাইকে ই-মেইল দিতে তাই দেরি করিনি। প্রত্যুত্তরে উনি কবিবর মোস্তাক আহমাদ দীনের মাধ্যমে অধমকে সংযোগ করলেন। দ্বিতীয় দফায় পানিবন্দি হওয়ার প্রাক ক্ষণ ছিল সেটা। বাবুলভাইকে বগলদাবা করে বন্দরবাজারে মিট করলাম তিনজনা। আড়াই ঘণ্টা ধরে বাতচিত চলেছিল সেদিন। নিজের কমফোর্ট জোন  ছেড়ে বেরিয়ে আসার ঝুঁকি উনারা নেবেন না সেটা বুঝতে মাথার চুল ছিঁড়তে হয়নি। আলাপ উপসংহারে গড়িয়েছিল অবশ্যই। সারনির্যাসটা এই ফাঁকে স্মরণ করি একবার।

মোস্তাক মোটামুটি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন সংগীত বা অন্য কোনো বিষয়ের বীজসূত্র ধরে ধারাবাহিক কাজে নামার সময়, পরিবেশ ও সে-রকম খ্যাপা লোক এদেশে বিরল। এমতাবস্থায় ছোটকাগজের পেছনে মগজ খর্চার প্রেরণা বা দমের কোনোটাই নিজের মধ্যে তিনি অনুভব করতে পারছেন না। জীবনবাস্তবতায় বিরাজিত হাজারটা চাপ সামলে পুনরায় চ্যাংড়ামির দিনকালে ফিরে যাওয়ার রোমাঞ্চ তাকে এখন আর অতটা উতলা করে না। তার বক্তব্য অযৌক্তিক এটা ভুলেও বলব না। কথা সত্য, কবি মোস্তাক আহমাদ দীন স্বয়ং নব্বইয়ের দিনকালে দাঁড়িয়ে নেই। তার চুলে পাক ধরেছে আর বয়স ওদিকে পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই বলা যায়। মনের গড়ন সেক্ষেত্রে যুবা বয়সের দলছুট পাগলামি থেকে ভিন্নখাতে বইবে এটাই স্বাভাবিক। যারপরনাই আমার দিক থেকে মোস্তাকের বক্তব্যকে কাউন্টার  করার মনোবল খুঁজে পাইনি সেদিন।

সত্যটা তবু মেনে নিতে বুকের ভিতরে খচখচ করছিল। সমস্যাটা ব্যক্তিগত। মোস্তাকের আগে বুড়ো হওয়ার ম্যাজিক ফিগার অধম ছুঁয়ে বসে আছি। ওটা ছুঁয়ে ফেলার দিন থেকে মাঝেমধ্যে কবীর সুমনের পঙক্তি আওড়াই। তাঁর মতো কিছুতেই সম্ভব নয় জানি তবু হেড়ে গলায় গুনগুন করি : ‘দেখো বইছে এখন বয়েসকালে / পাতায় পাতায় এবং ডালে / কালের ওজন / তিনি বৃদ্ধ হলেন, বৃদ্ধ হলেন / আমায় ছেড়ে বুড়ো হলেন / আমার সুজন’; — মবির্ড পঙক্তিগুলা আওড়ানোর ক্ষণে জানি না কী দোষে অধমের দেহমন নয়ের দশকের চৌহদ্দিতে নিজেকে দেখতে পায়। ওটা ছিল সেই সময় যবে আবোলতাবোল বোঝাবুঝির ঘোরে শহরের একঝাঁক যুবা ছোটকাগজে নিজের বাহাদুরি প্রমাণে মেতে উঠেছিল। কিছু প্রমাণ তারা করতে পেরেছিল কি না সে’ বলতে পারব না কিন্তু প্রমাণের ঝোঁকটা খাঁটি ছিল। মোস্তাক ওই যুবসংঘের অন্যতম সিপাহসালার ছিলেন। আমার প্রিয় সুজন কালের ওজনে বুড়ো হলেন দেখে বুকের ভিতর মোচড় দিচ্ছিল বারবার।

বাড়ি ফেরার পথে ভাবছিলাম, আমাদের সমাজে চল্লিশ-পঞ্চাশের ঘরে পা রাখা লোকজন বড়ো দ্রুত নিজের মরণটাকে দেখে ফেলে। দেহের সঙ্গে মনে ভাটার টান লেগেছে বলে বচন আওড়ায় যখন-তখন। মরণব্যবসায়ী মোল্লা-পুরুতের দল তো রয়েছেই, নির্বেদমগ্ন কবি, বাউল, গায়করাও অহরহ ওটা স্মরণে রাখতে লোকজনকে বাধ্য করেন। মানবজাতির দেহমনে ভাটার টান তাদের কবিতা ও গানে অনুভবের যত তরঙ্গ উঠায় সেগুলো মনকে আর্দ্র করে না এই কথা যদি বলি তবে সেটা মিছে কথা হবে। আর্দ্র হই বৈকি। বিমনাও বোধ করি অহর্নিশ; — তথাপি নিজেকে সেখানে জব্দ রাখার যুক্তি খুঁজে না পাই। যে-কারণে হয়তো বাউলা বা সুফিভাবে মাথা মোড়ানো অধমকে দিয়ে এ-জনমে হওয়ার নয়!

বুড়ো হওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে জীবনবাস্তবতার অজস্র তরঙ্গ থেকে উথলে ওঠা তরঙ্গের একটি আর তাকে সেভাবে সম্ভোগ করতে চাইব মরণাবধি। বয়স যত ভাটির দিকে গড়াবে তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে নিজেকে যুবা ভাবতে না পারলে মরণভীতির অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া দুষ্কর। রেহাই যদি না মিলে তাহলে হুটহাট আট কিংবা নয়ের দশকের ছেলেমানুষীভরা দিনে নিজেকে বিরাজ করতে দেখা কঠিন। বয়সের সঙ্গে লড়াইটা গেরিলা যুদ্ধের শামিল। কলেরার দিনগুলোয় প্রেম  নামের আখ্যান ফেঁদে মার্কেজ সেই কাজে নিজের কামিয়াবির প্রমাণ রেখেছিলেন।

উদাহরণ আসলে অগণিত। বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি? মোদের ঘরের লোক রবিঠাকুর স্বয়ং মরণের আগে অবধি একই লড়াইয়ে জীবন তামা করেছেন। সত্তরের কিনারায় দাঁড়িয়ে শেষের কবিতা  লিখেছে লোকটা! কাঁচা বয়সে লিখলে হয়তো লাবণ্য-অমিত-কেতকীর রসায়নে পরিপক্ক যে-জটিলতার স্বাদ পাঠক পায় সেখানে খামতি ঘটা বিচিত্র ছিল না। বয়সকালে পৌঁছে লেখার কারণে ঠাকুর তাঁর পরিপক্ক মগজখানাকে সেখানে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। শেষের কবিতার প্লটিং অবশ্য আগাগোড়াই সিনেমাটিক। কাহিনির ছকটাকে কাঁচা হাতে লেখা বাংলা সিনেমা বলে ভ্রম জাগে মনে। প্রেমটাও তথৈবচ। সত্তরের কিনারে দাঁড়িয়ে ঠাকুর বাংলার সিনেপর্দায় প্রেমরোগের জটিলতা নিয়ে কেমনে জমিয়ে লিখতে হবে তার আগাম ফর্মুলাটা যেন-বা জাতিকে ধরিয়ে দিলেন। লাবণ্য ও কেতকীর চক্করে অমিতকে সিনেমাটিক মেলোড্রামার ছাদেই বেঁধেছিলেন। দুই নারীকে গড়টড় করে অমিত যেখানটায় শেষাবধি পৌঁছায় সেটা আবার সত্তর-ছুঁইছুঁই এক আদমসুরতকে নজর করতে বলে। নারীকে জীবনভোর পাঠ করার সামারি  অমিতের দেহে ছুপা রুস্তম হয়ে ঢুকে পড়া রবিঠাকুর এইবেলা দিয়া যান। এখানে এসে শেষের কবিতা  সেন্টিমেন্টাল ট্র্যাশে ভরপুর প্রেমের কাহিনি থেকে রবিকবির নারীবীক্ষণের পরিণতমনষ্ক দলিল হয়ে ওঠে। কীভাবে? সে-প্যাঁচাল রবিকবির পরব্রহ্ম  নামক আধখেঁচড়া গদ্যে বোধহয় টুকে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কাজেই কথা আর না বাড়াই।

গুরুতর ঘটনা এটুকুই, কুড়ির ঘরে পা দিয়ে বেশ পরিপক্ক হয়ে ওঠা এক যুবাকে ঠাকুর তাঁর ছ’ফিট লম্বা দেহে সবসময় ধরে রাখতে ব্যগ্র ছিলেন। আশি অবধি পথযাত্রায় যতগুলো ঘর তিনি একে-একে পেরিয়ে এসেছিলেন তার প্রতিটির মধ্যে কুড়ির ঘরটাকে পরখ করেছেন। হরেক উপায়ে কাঁচা বয়সকালকে উত্যক্ত করে-করে দুইহাতে জমিয়ে লিখেছেন বটে! ত্রিশের ঘরে বসে বিরচিত ঝুলন  কবিতার কিয়দংশ তাৎক্ষণিক উদ্ধৃত করা যায়। রবি সেখানে ডাঁট মেরে লিখছেন :

তাই ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে
নূতন খেলা
রাত্রি বেলা!
মরণ দোলায় ধরি রসিগাছি
বসিব দুজনে বড় কাছাকাছি,
ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া
মারিবে ঠেলা,
আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে
ঝুলন খেলা,
নিশীথ বেলা!

দে দোল্‌ দোল্‌!
দে দোল্‌ দোল্‌!
[ঝুলন, সোনার তরী]

কবিতাটি ঠাকুর কোন ভাবের চক্করে পড়ে লিখেন তাতে এই অধমের কিচ্ছু যায় আসে না। যুবাকালে প্রেমে বিজয়ী হতে ও মরণভয় জয় করতে হয়তো লিখেছিলেন। বুড়ো হওয়ার দিনকালে পঙক্তিগুলা মরণনির্ভীক জীবনযজ্ঞে যুক্ত থাকার প্রেরণা যোগাবে ভেবেও লিখে থাকতে পারেন। ঝুলন পঙক্তিগুলাকে এই জায়গা থেকে ভাবলে আমরা যারা পঞ্চাশের ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছে দিশেহারা তাদের একটা হিল্লে বুঝি হয়! পঞ্চাশটা ছুঁতে চলেছি ভেবে যারা দীর্ঘশ্বাস ফেলছি গোপনে কিংবা দেহের সঙ্গে মনের বল উধাও দেখে সব তেতো মনে হচ্ছে … এই আমাদের জন্য ঠাকুরের কবিতাখানা টনিকের কাজ দিতেও পারে। বয়স হচ্ছে  কথাটি মুখে অহরহ বলে বেড়ালেও অধমের মন তাতে সাড়া দিতে তাই সংগোপনে আপত্তি জানায়।

চল্লিশ থেকে পঞ্চশের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যে-অভিজ্ঞতা মানুষের হয় সেটা তাকে নতুন সুগন্ধে সুবাসিত করে। মানুষটা এখন মরণনির্ভীক। দেহকোষের বৃদ্ধি মন্থর হওয়ার ঘটনা জরা হয়ে মরণের দিকে গড়াচ্ছে জেনে বেচারা তখন জীবনবাদী এক বান্দায় মোড় নেয়। দেহে কুলাবে না বুঝে মন দিয়ে জীবনকে রমণ করতে উতলা হয়। মরণ নিয়ে আতঙ্কে ভোগার বাতিক তার থাকবার কথা নয়। দেহকোষ যতদিন নিজের বৃদ্ধি জারি রাখছে ততদিন পরিপক্কতাকে টেটনের মতো ব্যবহারের চেষ্টা তার জন্য মঙ্গল বয়ে আনে। কিন্তু হ্যাঁ, পরিপক্কতাটা বেফজুল যদি মনটাকে সে হেনতেন যুক্তি দিয়ে পিষে মারে! মোস্তাকের সেদিনকার কথাবার্তার মধ্যে এই সুরটা প্রচ্ছন্ন দেখে দমে গিয়েছিলাম।

চল্লিশ-পঞ্চাশের বয়সকালে পা রাখার দিন থেকে দেহ নয় বরং মনের দিক দিয়ে নিজেকে যুবা ভাবার দম ধরে রাখা লেখকের জন্য জরুরি বলে জানি। অন্যথায় ময়দানে টিকে থাকা সম্ভব নয়। মোস্তাকের সঙ্গে বাতচিতের ক্ষণে ঠাকুরের কবিতার চরণাংশ কেন মাথায় গুঞ্জন তুলছিল জানি না, হয়তো এ-কারণে যে, জীবনের সঙ্গে ঠাকুরের লড়াই করার গেরিলা-পদ্ধতি থেকে আমাদের কিছু শেখার রয়েছে। লোকটাকে আমরা হেলাফেলায় পাঠ যাই ও অবিরত বাতিল করতে মরিয়া থাকি, যদিও তাঁকে সাইডলাইনে ঠেলতে গিয়ে শেষমেশ নিজেরা সাইডলাইনে পড়ে যাবার শঙ্কা ঘনায়। আপন কমফোর্ট জোন-এ দিব্যি হেসেখেলে বেড়িয়েও বৈচিত্র্যবিহারী ঠাকুরের থেকে বোধ করি আজো অল্পই শিখতে পেরেছে বাঙালি।

মসিজীবীর জীবতকালে কমফোর্ট জোন-এ থিতু হওয়ার প্রয়োজনীয় তাকে অধম কিন্তু নেতিবাচক ভাবার পক্ষে নয়। অবিরাম ভাঙাগড়ার নৈরাজ্যে মত্ত থাকা লেখকের জন্য দরকারি হলেও দিনের শেষে শক্ত পায়ে দাঁড়াবার মাটি তাকে খুঁজে নিতেই হয়। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি তখন অতল অজানার সন্ধানে যাত্রা করেন। তার সক্ষমতার সারার্থ ও সার্থকতা এছাড়া পষ্ট হয় না। মসিজীবী হয়তো জীবনভোর নিজেকে পরখ করেন এবং অবশেষে সেই ভূমির দেখা পান যেখানে তার সঞ্চিত বীজগুলো তিনি ভালো করে বুনতে পারবেন। লেখকের কমফোর্ট জোন  বলতে আমি এটুকু বুঝি। এখন মোস্তাক বা কায়সার যদি সে-রকম কোনো জোন-এ অবস্থান করেন তাহলে আমি একে ইতিবাচক ভাবার পক্ষে ওকালতি করতে একপায়ে রাজি। ঘটনা যদি বিপরীত হয় তবে একে ডিসকমফোর্ট জোন  বলে দাগানো উচিত মনে করি। মোস্তাক বা কায়সার ঠিক কোন জোন-এ অদ্য অবস্থান করছেন সেটা আমার দিমাগে আর ধরে না! তারা প্রিয় মানুষ এবং আজীবন প্রিয় থাকবেন, যদিও লম্বা সময় একসঙ্গে ওঠবস করার পর দেখতে পাচ্ছি তাদের কমফোর্ট জোনটা আমার কাছে বোধাতীত কুয়াশার মেঘে ঢাকা!


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
গানপারে ছোটকাগজ বিষয়ক অন্যান্য রচনা

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you