পাটিগাণিতিক বিদ্যা ভুলে যেয়ে অ্যালজেব্রাপারদর্শী যারা হতে পেরেছেন ইত্যবসরে, এই নিবন্ধিকা তাদের জন্য। অন্যরাও, ধরুন যারা জ্যামিতি কিংবা জনমিতি/ট্রিগোনোমেট্রি/ক্যাল্কুলাসবিদ্বান, পড়তে পারবেন মর্মে উন্মুক্ত অনুমতি আগেভাগেই দিয়ে দেয়া যাইল। তবে একটামাত্র সম্প্রদায়ের জন্য বলবৎ রহিবে এই নিবন্ধিকা পাঠসংক্রান্ত অননুমোদন; কোন সেই সম্প্রদায়? যারা বাইশবর্ষব্যাপী, কিংবা তাচ্চে বেশি, দিব্যজ্ঞানপ্রাপ্ত রয়েছেন কবিতায়;— যারা, আরও সংক্ষেপে এভাবেই স্বীকার্য, কবিতাসাম্প্রদায়িক। কেন, কেন? উত্তর : প্রতিক্রিয়া সামলানো সম্ভবপরতার বাইরে হবেই নির্ঘাৎ এই নিবন্ধকারের পক্ষে, এহেন আশঙ্কায়।
এইবার, ধরুন, অঙ্ক কষতে যেয়ে যেমন ধরতেন এককালে, সেই-যে সেই ইশকুলরঙের দিনগুলি, এক্স ইজ্ ইক্যুয়্যাল টু ওয়াই, ঠিক ওই কিসিমেই মনে করুন, মনমেজাজমর্জি রীতিবহির্ভূত রকমের ভালো আপনার, গত দুই-তিন বা তারও কয়েকদিন বেশি ধরে; এমনিতে দেশে এবং সমাজে এবং বাজারে এবং সোশ্যালমিডিয়ার আস্তিক-নাস্তিক উদ্ভট উটেদের মরুভূমিতে হেন কোনো কোয়ালিটেইটিভ চেইঞ্জ সাধিত হয়া যায় নাই যে পেখমমুক্ত ময়ূরনৃত্য করবেন আপনি। বিলকুল সবকিছু পূর্ববৎ, তথৈবচ, চলছে এবং চলছেও না আগেরই ন্যায় বিন্দাস্ অবিকল। চোর ও তার মাসতুতো ব্রো, রানী ও রাখাল ছেলে, সওদাগরসংঘের পোয়াবারো ও অন্যান্য ফজিলত, বুড়ো কবির ভাঁড়ামো, সংখ্যাগুরুদের ষণ্ডামো ও লঘুদের প্রায়-অনপনেয় ইনফিরিয়োরিটি কমপ্লেক্স প্রভৃতি চিরঅমরত্ব অর্জনের দোরগোড়ায়; এবং ধর্ষণ, এবং খুন, এবং গুম, এবং কাজের মেয়েটা মরেছে মরুক কিন্তু রাধিকা মালকিনের মূর্তি রক্ষাকরণ প্রকল্প সমস্তই কিন্তু বহাল। তবু, অত্যাশ্চর্য, মন আপনার ভালো। অত্যন্ত না-হলেও অনেকটাই ভালো। মনে কোনোই বিকার নাই আপনার। সুন্দরবনদুঃখ নাই। তেলগ্যাসকষ্টও নাই। বিধর্ম নাই। স্বধর্মও নাই। ঈশ্বরনৈতিক মুক্তি না অর্থনৈতিক মুক্তি, কিসের জন্য লড়াই করা বাঞ্ছনীয় প্রভৃতি নিয়া আপনার কোনো গমচিন্তা নাই। ভীষণ নির্ভার, নির্ভাবনা, ভালো।
কোনো কলুষ নাই, লিকলিকে বেদনা নাই, নিরর্থ হতাশাও অনুপস্থিত। অর্থানুপস্থিতির মধ্যে একটা আনকা মানেবোধিনী কিংবা ভালো অর্থগুচ্ছ খুঁজে বের করার কাজে মনোনিবেশ করবেন কি করবেন না ভাবছেন নিশিদিন। খুব মৌজে আছেন, কারণটারণ জানেনটানেন না যদিও, মনে করেন। কবিতা লিখছেন, মনে করেন, বহুদিন বাদে, বেশ ভালোই স্পিডে। সেখানে স্পন্টেনিটি আছে কি নাই, ইমোশন হাজির না গরহাজির, ওভারফ্লো হচ্ছে নাকি আন্ডারকারেন্ট রয়ে যেতেছে এতকিছু পরিমাপন করা যায় নাই। কিন্তু কবিতা আপনি লিখে চলেছেন, মনে করেন, প্রাগুক্ত সার্কাম্সট্যান্সেস সত্ত্বেও, কবিতার পর কবিতা, সাপোজ্, যথেষ্ট ধুন ধরে। এইটা একটা কারণ হলেও হতে পারে হেন অকারণ মন ভালো থাকার।
অবশ্য, বলা বাঞ্ছনীয়, মন ভালো রইবার জন্য অত কারণ-রিজন দরকারও হয় না আদৌ। মন আদৌ অত যুক্তিগ্রাহ্য কোনো অঙ্গ/ইন্দ্রিয় নয় যেহেতু, ওখানকার ব্যাপারস্যাপার তাই কিছুটা আলাদাই তো হবে। এবং, তর্ক বাহুল্য, আলাদাও। কবিতায় তো ওই বিদঘুটে ব্যাপারস্যাপারেরই নির্জলা-নির্মলা কারবার। ফলে কবিতা অত বিচিত্র, অত উদ্ভটও, অত অবর্ণনীয় বর্ণিল। অথবা বর্ণাতীত ব্যাপার যদি কিছু ভুবনে বিরাজে, সেইটা ওই জিনিশ, এইটেকে লোকে কবিতা জানে। এইটাই ইম্পোসিবল ক্যাপচারকরণের কিমিয়া এবং নির্ভরযোগ্য মিডিয়া। আরও অনেককিছুও, মনে করেন আপনে না-জানলেও, অবশ্যই আরও অনেককিছুও। অন্য কোনো সোশ্যাল-আনসোশ্যাল-অ্যান্টিসোশ্যাল মাধ্যমেই ঠিক ওই-রকম অতল (অদৈর্ঘ্য-অপ্রস্থ-অবৈদিক) কারবার নিয়া কাজ করে না কেউ। কবিতা জ্ঞানগম্যিহীন অভাবিত ঘটনা, আপনি নিজেও ভুলিয়া যান যদিও হরহামেশা আর জ্ঞানঘূর্ণিপাকে বেহদ্দ হাবুডুবু খান, মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট অভিজ্ঞতাটা আসে ফের হেন প্রত্যয়ের সুরত ধরে যে, হ্যাঁ, আদ্যন্ত কবিতা কারুকাজহীন কারুকার্য।
মন আর কবিতা, আপনি নিজেই ভেবে দেখেন না, খাপে খাপ মিল কতটুকু! দুইটাই ঠিকঠাক বাস্তবে ধরার সাধ্যি কিছুটা থাকলেও পুরাটা আপনার হয়তো-বা নাই। কিংবা আছে হয়তো, মনে করেন, মহাজ্ঞানী ও মহাজনদিগের। সেই পথে তো গমন আপনি করেন নাই। কিন্তু কবিতা আর মন, এই দুই ও তৎসঙ্গী পাঁচফোঁড়ন নিয়া আপনি বিকেলে কিংবা সান্ধ্য জোনাকজ্বলা বাতায়নে একটা হাল্কাপাৎলা ভাবনাচিন্তা চালাইতেই থাকেন ঘুরেফিরে। কেন, কোন ভূতের তাড়ায়, গড নোজ্। মন ও কবিতা, উভয়ের কাউরেই ঠিকঠাক তর্কাতীত শনাক্ত করা যায় না যদিও, দুইয়ের অস্তিত্ব অস্বীকারও করা যায় না একেবারে। স্বীকার করারও দরকার নাই। বোধহয়।
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
COMMENTS