গদ্য, পদ্য, গব্বর সিং

গদ্য, পদ্য, গব্বর সিং

 

কবিরা লেখক নয়। তারা লেখে না। কবিতা শুরু হয় সেখান থেকে যেখানে লেখার শেষ।

গব্বর সিং উপরোক্ত ডায়লগটা ঝেড়েছিল কোথাও, মনে নেই ফিল্মটা বা ডিরেকশন-প্রোডাকশনসংশ্লিষ্ট লোকেদের কারোরই নামঠিকানা, তবে সেই দিলিপ-ধর্মেন-অমিত-জয়া-হেমা তারাকাননের শোলেতে নয়, একটা-কোনো ইন্টার্ভিয়্যুতে এইটা বাংলার আমজাদ খান তথা গাব্বার সিং বলেছিলেন ইয়াদ হয়।

বাংলার গাব্বার সিং! — আজ্ঞে, জ্বে কত্তা, বাংলা সাহিত্যের গাব্বার সিং। উচ্চারণায় আকারহীন বঙ্গীয় গব্বর অথবা আকারযুক্ত হিন্দি গাব্বার — ফারাক কোথায়  — কে? সে তো সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়! যেখানে যেয়ে লেখার শেষ, লেখালেখির জারিজুরি ফাঁস হয় এবং ফেঁসে যায় লেখা ও লিখিয়ে যেইখানে, সেখান থেকেই কবিতা শুরু হয়। ক্লিয়ার-কাট কথা চাটুজ্জেবাবুর। ‘চাটুজ্জেরা রাখছে দাড়ি, মিঞারা যায় নাপিতবাড়ি’ — না, আমাদের এই চাটুজ্জে মঁসিয়ের দাড়ি ছিল না, না গুম্ফরাশ, ক্লিনশেইভড টিল হরিবোল। গল্প, উপন্যাস, না-আখ্যান প্রভৃতি লিখেছেন। নিজেকে না-লেখক মনে করে গেছেন সতর্ক সর্বত্র।

কথা সেইটা না। গাব্বার সিং এখানে এল কোত্থেকে? সেইটাই তো কথা, দাঁড়াও, রোসো, বলচি, আরামসে। যব্ গাব্বার আয়ে গা, সোচে-কা টাইম নেহি মিলে গা, না সুসু করনে-কা মওকা। কাজেই গাব্বারের গপ্পো ঘুমাবার আগে আগে, লেখার শেষের দিকে, একলাইনে সেরে নেয়া যাবে নে।

এইবার কাবিতা । মানে কবিতা  আর-কি। কি হয়েছে কাবিতার? বুখার আ গিয়া? বুরা হাল? বলচি, রোসো। পোয়েট্রি নিয়া আলাপের কালে কেউ রগড় করবেন না, খামোশ, খবর্দার! বার্না গাব্বার আ যায়ে গা, আনে-কি বাদ পুকার তোলে-গা : ইয়ে হাত মুঝে দে দো ঠাকোর! তখন কি হবে?

ব্যাপারটা হচ্ছে, সন্দীপন তো কবি ছিলেন না; যদিও, অবিস্মরণীয়, আমরা তার কবিতাও পড়েছি কিছু কিছু। সন্দীপনকবিতার আলাপে এখন না-ঢুকি বরং। কবি না-হয়েও সন্দীপন কবিবন্ধুপরিবৃত রইতেন সবসময়। এইটা ইন্ট্রেস্টিং খুবই যে এক কথাসাহিত্যিক কখনো অন্য কথাসাহিত্যিকের সঙ্গ করে না, ঠেকায় না-পড়লে। প্রেফার করে কবিসঙ্গ। সংগত কারণেই। স্কিপ করি এই টপিকটাও। অথচ কবিরা কিন্তু কবিসঙ্গ ছাড়া আর-কিছুই হিসাবের আওতায় জ্ঞানগ্রাহ্যি করে না। ভারি আমোদের ব্যাপারটা, না?

তারপরও সন্দীপনের কিছু অন্তর্দৃষ্টি, কতিপয় ইনসাইটস্, কবিতাপ্রাসঙ্গিক বিশেষত, উৎকীর্ণ রয়েছে তার না-আখ্যানমূলক রচনারাজির নানা বাস্তুভিটেয়, সেগুলো নজর বুলিয়ে দেখেন তো, হয়তো উপকৃত হবেন আপনি, বিশেষত যদি এর মেটাফোর বা কখনো-কখনো গিমিকের খোসাটা খসিয়ে একবার খতিয়ে দেখেন।

কবিতায় আপনি বিজ্ঞান-অজ্ঞান-দুর্জ্ঞান-মেহেরজান সবই করতে পারেন; — শুধু, জানেমান, শুধু পণ্ডিতি জাহিরের জায়গা কবিতা না, — এইটা তো আপনি মানবেন, নো? হোন আপনি সাধু অথবা শয়তান, কবিতার কালাপাহাড় বা কবিতাকৃষ্ণমূর্তি, কবিতার সম্ভাব্য শত্রুমিত্রপাত্রঝোলাব্যাগ সকলেই স্বীকারিবেন যে কবিতা যদি প্রকাশরূপগত গতরজোর দেখাতে যায় নির্ঘাৎ ডুববে। পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন প্রকাশের দায় গদ্যের, পদ্যের নয়। জোর প্রদর্শনে গদ্যের সনে পেরে-ওঠা আমাদের আদুরে কাবিতার পক্ষে একটু মুশকিল আছে। কেন, ওই প্রশ্নের উত্তর যুগযুগান্ত ধরে কোনো-না-কোনো বব ডিলান গাইছে, গেয়ে গেছে অবিরল। নতুন গুপী গাইন আর বাঘা বাইন কারোরই দরকার নাই। ইন-শর্ট কথাটা এইটুকুই যে কবিতার কাজই নয় শক্তি প্রদর্শন। স্বচ্ছ চিনে বা বাংলা বা বিশ্বমাটির বাসনকোসন বানাবার দায় কবিতার নয়, এইটা পারবেই না বেচারি, এইটা পারতে গেলে সে তার আইডেন্টিটিই খোয়াবে। সে পারে এমনকিছু, যা গদ্যের মহাপরাক্রমী মা-বাপেরও সাধ্যি নাই পারে, এমন ম্যাজিক তার জন্মকরায়ত্ত, কি সেইটা? — আমরা জানি না, কবি জানে, যেমন ব্রহ্মা জানে গোপন কম্মটি কি। ইট’স্ অ্যা ম্যাজিক। গদ্যের, যে-কোনো সংরূপের গদ্যকাজের, প্রাথমিক দায়িত্বটাই হলো স্বচ্ছকরণের জোর প্রদর্শন জবরদস্তিহীন। গদ্য তার গতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোতে যে-শক্তি নিয়া হাজির হয় এলাহি রেস্লিঙের এই দুনিয়ায়, সেইটা আল্লা কাবিতারে দেন না। কাবিতার আছে অন্য কাজ, অন্য স্বর, অন্য মন, মনান্তর, বন ও বনান্তর।

শোনেন, কাবিতা  বিষয়ে আমি বিশেষ-কিছু তো মুম্বাই-দূর, কিচ্ছুটিই জানি না। আমার এক বন্ধু ছিল, মরে গেছে, ক্লাস সেভেনে কি এইটে পড়ার সময় আমরা হাফটাইমে এটা-ওটা নানাবিধ কুস্তিমাস্তি খেলতাম, আমাদের সেই ত্রিকালজয়ন্ত বন্ধুটি খেলত কবিতা, আমরা বাড়িফেরা বিকেলের মনমরা রাস্তায় সেই কবিতাগুলো শুনতাম। সে বেজায় প্রীত হতো বুঝতে পারতাম। তার কাছ থেকেই আমার যা-কিছু কবিতাজ্ঞান, কাবিতানলেজ। এইখানে দেখি দুইয়েকটা চালাইতে পারি কি না নিজনামে, মৃত বন্ধুর কাছে জনান্তিকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে। যে নাই, সে তো নাই-ই, তারে নিয়া আবার কিসের কাবিতা ! কিসের টেনশন! আজাইরা! আমরা কাবিতা  করব যথেচ্ছ, পণ্ডিতি রয়েসয়ে, তবে কবিতায় পণ্ডিতি করা যায় বে-লাগাম। কেউ ধরার নাই তো, কবিতায় যে-কোনো অতিপুরাতনীও অভিনব-অপূর্বভাবিত বলিয়া চালানো যায়। You can fool all the people some of the time, and some of the people all the time, but you cannot fool all the people all the time. খামোশ! আব্রাহাম লিঙ্কনগিরি ফলাইও না মিঞা! যা বলতে লেগেছিলে, মরা বন্ধুর মুখামৃত, সেইটে বলো।

এজরা পাউন্ড নামে এক কবি ছিলেন, এখন আর নাই তিনি, ‘নতুন কবিতা’ লিখতে পারেন না যেহেতু সো উনি নাই-ই তো! পাউন্ড দশটা অবশ্যপরিত্যাজ্য খবর্দারবাণী ড্রাফ্ট করেছিলেন, টেন ডোন্টস্ ফর দ্য পোয়েটস্, সেগুলোর মধ্যে একটা ছিল এ-ই যে, যা-কিছু গদ্যে লেখা হয়ে গিয়েছে তা কখনো কোনো প্রলোভনে কবিতায় পুনর্লিখনে যেও না বাবু! মরবে বেঘোরে। কবিতারও ঘণ্টা বাজাবে, নিজেরটা তো কিছুই হবে না, তদুপরি বিপদের কথা হলো যে অপর দুইয়েকজন সত্যিকারের সম্ভাবনাপ্রসূ কবিরও হয়তো বিপথগমনের পথ তৈয়ারের ভিলেইন হবে। এই কথাটা আস্ত অবিকল এইভাবেই তিনি বলেছিলেন, এমন নয়। কিন্তু মোদ্দা কথাটা ছিল এ-ই। এর মানে কি? মৃত বন্ধু বলে দিয়া যায় নাই।

ব্যক্তিনির্ভর গদ্য হয়। বিষয়নির্ভর গদ্য হয়। বিজ্ঞাননির্ভর গদ্য হয়। সাহিত্যতত্ত্বনির্ভর গদ্য হয়। ইত্যাদি কিসিম কিসিম নির্ভরতার ভিতর দিয়াই গদ্যের গতায়াত, গলাবাজি, সবই চিরকেলে ব্যাপার। কিন্তু কবিতা? আমাদের সাধের কাবিতা  কারোর, কোনোকিছুর, নির্ভরতাসাপেক্ষী? যদি উত্তর না-বোধক হয়, যদি কবিতা হয় সেল্ফমেইড, সেল্ফরিলায়েন্ট, তো নজর রাখবেন গদ্যের সঙ্গে কবিতা যেন হুদা হুদা যুদ্ধে না-যায়। গদ্যের নির্ভরতাধর্মের কারণেই গদ্যগতরে পেশীশক্তি/তাকত/জোর বেশি, কিমতের জোর, হিম্মতের জোর, কব্জিজোর। কবিতা সেইদিক থেকে নির্ভরতাশূন্য, নিরালম্ব, অনেকার্থে লা-শরিক। কবিতার জোর লুকানোয়, চুপানোয়, যা-কিছু দূরপাল্লার শক্তিবাহী এই দুনিয়ায় তা-কিছু ক্ষমতা লুকিয়ে রেখেই আগায়, আড়াল রচনার ভিতর দিয়াই কাবিতা  তার শক্তিমত্তা হাজির রাখে। দেখাতে গেলেই, ট্রিক্স দেখিয়ে ফেললেই, ম্যাজিক আর থাকে না ম্যাজিক। দৃশ্যায়নের এই ধুন্দুমার দিনকালে দেখানোপনা দিয়া কাবিতা   বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারবে বলে ভরসা নিতান্ত ক্ষীণ। সম্ভব? পারবে কি সে পেরে উঠতে, দেখাতে নেমে, আইটেমগানার সঙ্গে? দেখানোর শক্তিতে সে যুঝে উঠতে পারবে কি, সিনেমার সঙ্গে, ফটোগ্র্যাফির সঙ্গে, বিজ্ঞাপনের সঙ্গে, ক্যাবারেড্যান্সের ফ্লোরে সে পারবে কি, নিয়ন ও ফ্লুরোসেন্ট আলোর সঙ্গে, হোর্ডিং-বিলবোর্ডের সঙ্গে? এইভাবে কম্পিটিশনে গেলে কাবিতার কি হবে দশা-চল্লিশা, ভাবিয়া দেখেন এলায় একবারটি। কিন্তু মনে করেন পারল, সম্ভব হলো পারা, কাবিতার ঠাপে ‘ছেড়ে দে মিনসে, আর পারিনে’ বলে সিনেমা-টিভিসি চিরতরে পাততাড়ি গুটায়ে নিলো ধরাধাম হইতে। সেক্ষণে কবি কি ইনিশিয়েটিভ নেবেন না কাবিতাকে কাবিতায় ফেরাবার জন্য?

মনে করুন, সাপোজ, পোড়ার এই বাংলাদেশেই আশির দশকে, নব্বইয়ের দশক জুড়ে, যে-কথাবার্তাগুলো গদ্যে হয়েছে, ডেরিডা ইত্যাদি অনুশীলনী যেভাবে হয়েছে, সেই কথাগুলোই আপনি কবিতায় আনছেন। অকল্পনীয় অর্বাচীনতা। বালখিল্য। করতালিযোগ্য হয়তো, কারণ আপনার চারপাশ চাইছে আপনি গদ্যকার হোন উত্তরোত্তর, এই-মুহূর্তের দুনিয়াবি কাজেকামে লাগুন। তাহলে কি হলো? জহর সেনমজুমদার ছেড়ে এ কোন পরিহাস্যকর পগারের পার দিয়া দৌড় পাড়লেন আপনি, প্রিয় তরুণ কবি? পারছেন না, ভালো কথা, ওয়েইট অ্যান্ড সি। তাই বলে কবিতাকে পুরাকালে মীমাংসিত গদ্যতত্ত্বকথার ছেলেকলা বানাতে লেগে যাবেন! কল্পনা ছাড়িয়া গেছে, জহর মজুমদারের কপিক্যাটও হচ্ছে না আর, তো গদ্যেই পুরনো তত্বকথাগুলো রিফ্রেজ করুন। কবিতার উপর দিয়া আর কত উৎপীড়নের মেশিন চালাইবেন!

ধরুন আপনি লেবু নিয়া কবিতা লিখছেন। যদিও কোনোকিছু লইয়া কবিতা লেখা ব্যাপারটাকে আক্ষরিকভাবে নেয়াটা আপদের। আরেকজন ওই নিম্বুড়া নিয়াই ছড়া/রাইম লিখতে বসেছে। এখন, দশলাইনের ছড়ায় তেরোবার লেম্বু শব্দটা আসতে পারে, কিন্তু দশলাইনের কবিতায় যদি একবারও লেম্বু শব্দটা আসে তাইলে মনে করেন যে ব্যাকরণসম্মত বাক্যরচনাই হইল মুখ্যত। ‘নতুন কবিতা’ কি থ্রি-ফোরের ‘বাক্য রচনা’? আশির/নব্বইয়ের দশকের বহুপঠিত তত্ত্বের তরলিত পুনঃপ্রকাশ?

ওয়েল, আব্ তেরা ক্যায়া হো গা রে কাবিতা? গাব্বার ইজ গেটিং ব্যাক স্যুন! লেট’স্ গেট ইন্টু ডিপ হাইবার্নেশন।

জাহেদ আহমদ

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you