নতুন কবি, নতুন কবিতা, গাব্বার ইজ ব্যাক ও অক্ষয় কুমার

নতুন কবি, নতুন কবিতা, গাব্বার ইজ ব্যাক ও অক্ষয় কুমার

 

ওরে আয় পাখি লেজঝোলা / তোকে খেতে দেবো কোকাকোলা / তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা / আমি গাব্বার সিং

চন্দ্রবিন্দুর এই গানটা খাসা! নার্সারি রাইমের আদল আত্মসাৎ করে চন্দ্রবিন্দুর গাওয়া গানগুলো বাংলা গানাবাজানায় ব্রেইক-থ্রু এনেছিল মনে পড়বে শ্রোতৃবর্গের। উপরে ঝোলানো পঙক্তিধৃত গানের লিরিকটা দারুণ, বরাবরের চন্দ্রবিন্দুনাম্বারগুলোর ন্যায় কিউট খুবই। গ্রসলি একটা কথা আপাতত বলা যায় যে, বাংলা গানে এদ্দিন ব্যাপিয়া ভাঁড়ামি ছিল, সঙের ঢং ছিল, স্যাটায়ার-সার্কাজম ইত্যাদি ছিল, সর্বোপরি ছিল সিরিয়াসনেস, মহাকায় সিরিয়াসনেসের গাম্ভীর্যে আবহমান বাংলা গানের দশা টালমাটাল। অত্যন্ত উন্নত জাতের গম্ভীর ও ঘন প্রেমপূর্ণ স্যংরাইটার বাংলা গানে সমাজসংস্কৃতির সেবা করে থাকেন। কবিতার ব্যাপারেও কথাটা তথৈবচ। চন্দ্রবিন্দুর গানে একটা টাটকা তাজা প্রাণস্ফূর্তি ফুরফুর করে লিরিকের লতাপাতাফাঁকে। এদের গানে যে-ক্যারেক্টারটা দৃষ্টিকাড়া তা হচ্ছে এদের উইট ও হিউম্যর। এমনকি স্যাটায়ার ইত্যাদি লিটারারি কোনো উয়েপন কোনো কৌশলই ঠিকঠাক অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী হয় না যদি হিউম্যর ও উইটি রসের ভিয়েন সেখানে না-থাকে। এইটা বাংলা গানে বেশ ভালোভাবে ফের-একবার চন্দ্রবিন্দু  মনে করায়ে দিয়েছে। যে-গানের লাইন দিয়ে এপিগ্রাফ, সেইটা আস্ত শোনা যাক আরবার।

সূর্যের দিকে চেয়ো না, চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে
সূর্যগ্রহণের দিকে চেয়ো না, চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে
সন্ত যোহনের দিকে চেয়ো না, চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে
লেগে যাবে, খোঁচা খাবে / নির্জন নদীয়ায় / কে হায় প্রেম বিলায় / ঠুনকো ন্যাড়া মাথা

পাখপাখালির দিকে চেয়ো না, গায়ে ঝিলমিল লেগে যাবে
রাতে মা কালীর দিকে চেয়ো না, চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে
উগ্র আকালীর দিকে চেয়ো না, বুকে ঝিলমিল লেগে যাবে
লেগে যাবে, ব্যথা পাবে / ছোট আছো ছোট থাকো / সস্তা সাবান মাখো / ঘুরে দ্যাখো কলকাতা

কারো লেখাপড়া ট্যাঞ্জাবে / কারো গিলে-করা পাঞ্জাবি / কেউ জাহাঁপনা খাঞ্জাখাঁ / খেলে পিংপং বল
তুমি দোল খেলো হাজরাতে / তুমি উঠে বসো মাঝরাতে / তুমি পুষে রাখো পাঁজরাতে / চোরা মফস্বল
বলো কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনার ন্যাকা সুরে এঁকে যাবে লতাপাতা!
এঁকে যাবে, বেঁকে যাবে / সকলি ফুরায় ফুচকার প্রায় / পড়ে থাকে শালপাতা

শাল-পিয়ালের বনে যেয়ো না, মনে ঝিলমিল লেগে যাবে
খেঁকশিয়ালের পানে চেয়ো না, লেজে ঝিলমিল লেগে যাবে
স্যুররিয়ালের দিকে চেয়ো না, ব্রেনে ঝিলমিল লেগে যাবে
লেগে যাবে, রেগে যাবে / চীনে বা জাপানে যাও / তাড়াতাড়ি চানে যাও / শুনে দ্যাখো মা-র কথা

কেউ মাধুরির ফ্যানক্লাবে / কেউ চাকু হাতে চমকাবে / কেউ রাত্তিরে কম খাবে / হবে স্লিম-জিম-ট্রিম
ওরে আয় পাখি লেজঝোলা / তোকে খেতে দেবো কোকাকোলা / তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা / আমি গাব্বার সিং
আরে পাখিফাকি আছে নাকি / তুমি সালা আনলাকি / নিজভূমে অন্তরীণ
ভিনদেশি, ক্ষীণজীবী / সমস্ত দিন কোষ্ঠকঠিন / হাসিমুখে আড্ডা দিন!

বলে হ্যাট্রিক পেতে চেয়ো না, পায়ে ঝিলমিল লেগে যাবে
ন্যাড়া কাত্তিক বনে যেয়ো না, প্রাণে ঝিলমিল লেগে যাবে
নদীমাতৃক হতে চেয়ো না, গায়ে ঝিলমিল লেগে যাবে
সেল্যুলয়েডের দিকে চেয়ো না, মনে ঝিলমিল লেগে যাবে
মার্ক্স-ফ্রয়েডের দিকে চেয়ো না, প্রাণে ঝিলমিল লেগে যাবে
পিঙ্ক ফ্লয়েডের দিকে চেয়ো না, গানে ঝিলমিল লেগে যাবে …

এখন, অতঃপর, কি হবে? এত সমস্ত বিধিনিষেধাজ্ঞার বাদে ‘নতুন কবিতা’ হবে কেবম্প্রকারে? এ-পর্যায়ে, সুধী দর্শকমণ্ডলী, বক্তব্য নিয়া আসবেন কি কোনো নতুন কবি? কিন্তু ‘নতুন কবি’ কি আদৌ সম্ভব? নতুন কবিতা, আদৌ, কতটুকু পর্যন্ত নতুন বস্তুত? ঘোষণায় বিরাজেন তিনি, কিন্তু কার্যত নয়। দৃশ্যত নতুন কবিতা, নতুন কবি, প্রকৃত প্রস্তাবে কবি ত্রিকালদর্শী যেহেতু, টাইরেসিয়াস, নতুন কবিতাও ত্রিকালপ্রাচীন। তথাপি তিনি ও তার কাজ চিরনতুনের বার্তাবহ। দুনিয়ার এসেন্সগুলো বদলেছে কি খুব-একটা? গ্যালিলিও গ্যালিলির পরে কি সূর্য নতুন কোনো গগনকক্ষ পর্যটনে বেরিয়েছে? এখনও দুঃখ পেলে মানুষ রোদন করে, ক্ষিদে পেলে, প্রেম পেলে চ্যাঁচায় কিংবা তাকায় হাভাতের ন্যায় সকরুণ। মায়া, ইনকা, মহেঞ্জোদারো ইত্যাদি পেরিয়ে এই-যে এই হিংসা ও হননের গনগনে সভ্যতা, আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতা, উত্তরোত্তরাধুনিকতা, কান্না আর ম্লানিমা ও মুখরতা আজও তো বিরাজে হেথা। কাজেই, এই জিনিশগুলো ফর্দের ভেতরে রেখে যেন নতুন কবিতার হৈদরি হাঁক কিংবা মিকিমাউসের মিউমিউ তোলা হয়। আদারোয়াইজ পুরনো প্রমাদগুলোই ফিরিয়া ফিরিয়া সাধিত হতে থাকবে কবিদিগের হাতে।

এর মানে কি তবে এ যে, নতুন কবিতা না-সম্ভবে? বিলকুল না, বিলকুল না। ভাষান্তরে যেয়ে ভাব কী সাংঘাতিক মিসিন্টার্প্রিটেশন ঘটায়, এইটা মনে রাখুন। আর ভরসা রাখুন নিশিদিন এই অনুজ্ঞায় যে, হ্যাঁ, নতুন কবিতা আলবৎ সম্ভব। তবে শর্টকাট কোনো ওয়ে নেই নতুন কবিতার। দুনিয়ার যাবৎ ডাইভারশন সড়ক ও কালভার্ট-ব্রিজগুলো অত্যন্ত সাময়িক। গোটা রাস্তামানচিত্র চোখের সামনে ভাসানো না-থাকলে কেমন করে আদিকল্প আর বিকল্পের ভেদ বুঝবেন মুহতারাম? ও, আচ্ছা, উল্লম্ফন? মানে শাখামৃগের ন্যায় লাফাইয়া লাফাইয়া পাতা হইতে পাতান্তরে বেড়াইবেন কবিতাগাছ ঝাঁকাইয়া ঝাঁকাইয়া? আর ঝরঝর ঝরিয়া পড়িতে থাকিবে কবিতার আমলকি? ফিজিক্সের বই না-পড়েও অবগত জনসাধারণ যে পদার্থের একটা আবশ্যক গুণ হচ্ছে তার স্থিতিস্থাপকতা। কিন্তু স্থিতিস্থাপকতারও আছে সীমা। একেক পদার্থের স্থিতিস্থাপনসীমা একেক অঙ্ক পর্যন্ত। অসীম নয় সেই সীমা। আর কবিতা, নতুন বলুন বা তিতপুরনো, সসীম কলকৌশলের কব্জা দিয়া অসীমকে ক্যাপচার করবার কিমিয়া। কাজেই উল্লম্ফনের নামে যা চালাইতে আছেন, তা নিয়া পুনর্বিবেচনা করেন, উল্লম্ফনের ইল্যাস্টিসিটিও তো ইনফিনিট না।

আর, আরও-যে একটা ব্যাপার তা এ-ই যে, নতুন কবিতার নামে আপনি যা করতে চাইছেন তা আগেও হয়ে গিয়েছে কি না, ব্যর্থ অথবা সফল, সার্চ জারি রাখুন। বোর্ডাম অপনোদনে একটা ক্যাটালগিং টাইপের বস্তুপিণ্ড জড়ো করলেন কয়েকটা প্রোজেয়িক স্ট্যাঞ্জায় — এইটা না-হয় যেন, লক্ষ্মী ভাইডি-বইনডি আমার! মনে কেন রাখবেন না যে তালিকায়নের এক মহা আপদ থেকে বহু জনমের সাধনায় আল্লার অশেষ মেহেরবাণীতে শেষে বেরিয়ে এসেছে দুঃখিনী বাংলা কবিতা। আবার ‘পুরনো ইতিহাস ফিরে এলে লজ্জা কি তুমি পাবে না, ও বন্ধু!’ বস্তুর জয়জয়কার চারিদিকে, পণ্যের পরাক্রম, কমোডিটি ফ্যাটিশ, নতুন কবিতায় এগুলো আসতে হবে। এগুলো আসবেই। কিন্তু ফর্দের ন্যায় এগুলোর সন্নিবেশন ও সন্নিপাতন পুরনো-নতুন কোনো কবিতারই কাজ নয়। রিসার্চের আওতা হতে পারে বড়জোর। বস্তুপ্রকৃতি, বস্তুনিসর্গ ইত্যাদি নিয়া কবিতার কাজ করার বয়স ও রেপ্যুটেশনও তো অনেক দীর্ঘ। ব্যোদলেয়্যর তো তোমার কাছ থেকেই নবজন্ম লভিবেন হে নূতন! অতএব, ব্রা-প্যান্টি-কন্ডোম সমস্তই নিয়া আসো কবিতায়, ভেবেই নাও যে এগুলো তুমিই পয়লা আনিতেছ বঙ্গের অক্ষরে, অসুবিধা নাই, কিন্তু এগুলো যেন এগুলোর ভিতরেই ঘুরপাক না-খায় খালি। কোনো ফ্লাইট নাই যে-পড়ছে তার লাগি, খালি নতুন কবিই উড়িলেন গজদন্তগগনে, এইটা জাস্টিস হয় না ভাইডি! তা-ও যদি নিজেও উড়তে পারো মন-উজাড় বাপের দুর্দান্ত ব্যাটার ন্যায়, এইটাও কম কথা কিছু তো না। তা, ওড়ো। পুঞ্জাক্ষিগুলোর মধ্যে একটু ওয়েন্টমেন্ট দিও অবসর পাইলে। এইটুকুই এ-যাত্রা।

আর, লাস্ট কথা, শাস্তরে একটু দখল হাসিল করে নিতে পারলেই যজমানি বামুন হওয়া যায়। কিন্তু ফটর ফটর শাস্তর মারতে থাকলে পূজাআচ্চায় কেউ বসাবে না আপনেরে ডেকে। এমনিতেই মহাকালের পুজারিরা, শুনতে পাই, সাংঘাতিক ঘাউড়া হয় কি-না! কাজেই ডিকন্সট্রাক্ট করুন, মেঘনাদবধের ধাঁচে রাবনের রিভাইভ্যাল ঘটায়ে ভাবুন ও প্রচারিতে থাকুন যে আনিয়াছি পৃথ্বীর বুকে এক অভাবিত নতুনের ছাও, তবে এইসব করতে যেয়ে শোলেরও গুম্ফকেশ না-ছুঁয়ে যে-ব্যাক ঘটাইলেন গাব্বারের, এমনধারা নায়্যিভ কম্মখানারে ঢাকঢোলঝাঁঝর বাজিয়ে মাইকেলের ঘুম ভাঙায়েন না। এমনিতে গাব্বার ইজ ব্যাক  ফানি সিনেমাই হয়েছে। এ-যুগে এত পলিটিক্যাল ডাম্বনেস্ মেনে নেয়াও মুশকিল। শ্রুতি হাসানের একটু ধুমম্যাসালা আইটেমপ্রতিভা দেখাইলেও তবু মহাভারতবাসীর চিত্ত ও জেবের রেস্ত কতকটা সান্ত্বনা লাভ করিত। অক্ষয়ের নায়কপনার ঠাপে সেই নসিব হইল না স্পেক্টেটরদিগের। বলিউডি হিরোরা বাংলা কবিতার নতুন কবিদের ন্যায় পারঙ্গম সর্ববিদ্যায়, অ্যাকশনে, ফ্যাশনে, ভাষণে ও বিলাসব্যসনে। একমিনিটেরও গ্যাপ নাই যে আপনি ঢুকবেন নায়কামোর চোট এড়িয়ে। এই ফিল্মি ম্যাসালা কাবিতা  লইয়া আমরা কি করিব? ধর্মেন্দ্র হাঁক ছাড়িয়া উঠিবে কি, ইন্ কবি কা সামনে মাৎ নাচনা বাসান্তি! না, না, বালাই ষাট, এভাবে বলতে নেই। ফির বলেঙ্গে। নতুন জমানার বাংলা কবিতা আমরাই লিখেঙ্গে।

জাহেদ আহমদ

জাহেদ আহমদ

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you