প্যাট্রিয়টিজম ইজ্ দ্য লাস্ট শেল্টার অফ স্কাউন্ড্রেল্স। কথাটা স্যামুয়েল জন্সন নামে কেউ বলে থাকবেন বহুকাল আগে। এই ভদ্রলোক ইংরেজি ল্যাঙ্গুয়েজের গাব্দাগোব্দা অভিধান আর কবিজীবনীকার হিশেবে এতদঞ্চলে প্রসিদ্ধ। ঠোঁটকাটা ছিলেন। কড়া লাইনের ক্রিটিক লিখতেন। তখনকার প্রায় বেবাক লেখকদেরই লেখাপত্তরে, — কেবল জন্সন একলাই নন, — অ্যাফোরিজমের প্যাটার্নে সেন্টেন্স মেইকিঙের একটা টেন্ডেন্সি লক্ষ করা যাবে। যেমন ছিলেন আমাদের এখানকারও অনেকেই, কিছুকাল আগে পর্যন্ত, লিখতেন প্রবাদবাক্যশৈলী দিয়ে এবং রচিত বাক্য মাত্রই ছিল চোখা তীক্ষ্ণ। ওই সিক্সটিজের অনেকেই, বিগত শতকে, লিখতেন স্মরণীয় বচনের আদলে। যেমন হুমায়ুন আজাদ। পড়তে যেয়ে লোকে যেমন আমোদিত হতো, হয় আজও, অতি তীক্ষ্ণতার ঠাপানিতে বেজায় বিরক্তও হতো লোকে। লেখালেখি জিনিশটা আর-যা হোক শুধু চোখা বাক্যাবলির চয়নিকা যে নয়, তীক্ষ্ণ অথবা ভাঁড় ভোঁতা আদলের কথাঠাপ নয়, সেন্সটুকু কমন্ লোকেরা খুইয়ে বসেছে কি না মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়। ইদানীং সন্দেহ ঘোরতর — কমনার্স য়্যুজারদের ফেবুস্ট্যাটাসঠাপে জেরবার হয়ে।
এপিগ্র্যাফিক যে-একটা বাক্যে এই নিবন্ধ অবতরণ করেছে, একদম পয়লা লাইনে লক্ষণীয়, এই তিতপুরানা আমলের কথাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবার পেছনে একেবারেই রিসেন্ট সোশ্যাল এবং সোশিয়োকালচারাল ফেনোমেনাগুলো সংশ্লিষ্ট। চুন থেকে পান খসলেই ইদানীং ধরণী দ্বিধা, মানে এক-খসাতে দেশ দুইভাগ, স্বাধীনতার পক্ষ ও প্রতিপক্ষ তো পুরানাকালিক যুগ্ম অপোজিশন। বর্তমানে দেশভাগের ক্যাটিগোরি-ইন্ডিক্যাটরগুলো নববিন্যাস্ত। নতুন নতুন সূচক, বয়ানের সবক, যতসব নবঢঙা সারণী ও ছক গজাচ্ছে মুহুর্মুহু চৌদিকে। ব্যাপারটা ভালো, উৎফুল্লকর, উন্নয়নের লক্ষণযুক্ত। বৈপ্লবিকও, বলছেন কেউ কেউ। মুশকিল অন্যত্র। নোটন নোটন পায়রা হলেও ঝোটন বাঁধবার পরে ঠাহর হয়, কিসের নতুন কিসের নয়া, পায়রাগুলো পুচ্ছে-পাখায় ত্রিকালপ্রাচীন। শুধু ঠমকে ও ঠাঁটে একটুকু যা আধুনিকায়ত। অন্যথায় যেই বিচি সেই লাউয়েরই মাফিক।
কাঁহা তক, কহ, নব নব কল্কি দিয়া প্রাচীন গাইঞ্জা টানা! আল্লার দুনিয়ায় নিত্যনয়া ড্রাগের কত-না ব্র্যান্ড কতই-না রেলা! তাদিগের টেইস্ট-সোয়াদ-এফেক্ট সমস্তকিছুই পৃথক বৈশিষ্ট্যে আলাদা। দাঁড়াও, পথচারী, বিচ্ছিন্ন-পথবিভ্রান্ত প্রজন্ম! জন্ম যদি তব বর্তমান বাংলায়, বাংলাদেশে, ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া হাঁকিয়া ষাষ্টাঙ্গে ক্ষেতের নাবালে লুটোপুটো গড়াগড়ি যাও! বন্ধুরাষ্ট্র, মিত্রশক্তি, প্রতিবেশী কৃপাস্বামী ইত্যাদি মিছিলের বন্যায় ভেসে যায় ধুয়েমুছে যায় নিত্যকার মহাভারতীয় করাল আগ্রাসন ও অপমানকর বহুবিধ প্রজাতান্ত্রিক অনৈতিকতা আর অন্যায়।
প্যাট্রিয়োটিক পার্ভার্শনে এখন, অধুনা, বর্তমান বাংলাদেশ সয়লাব। সমস্তকিছুতেই দ্বিকোটিক চিন্তাদারিদ্র্য সর্বত্র। হয় তুমি নিঃশর্ত সমর্থন করিয়া যাও আমারে, ম্যেরা হামসফর হও, নতুবা তুমি আমার শত্রু বলিয়া ট্রিটেড হবে। অ্যামেরিকানীতি ডিউরিং ওয়ার অন টেরর। এবং এখনও তা-ই। কিন্তু অ্যামেরিকা আমরা গার্হস্থ্য বৈঠকে ডেকে আনতে চাই না, অ্যামেরিকারে আমরা হালে বেইল দেই না, ভারতের মতো মহা বাংলাদেশবন্ধু থাকতে অ্যামেরিকা নিপাত যাক। বন্ধুরাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধমিত্র, ঔদার্য-অবতার। মাদার ইন্ডিয়া। তাহারা বাংলাদেশসাংস্কৃতিক সূতিকাগার। বাংলাদেশরাজনীতির প্রণয়সিদ্ধা পাহারাদার। বাংলাদেশার্থনীতিক চৌকিদার। উহারা আমাদের ভালো চায়, ক্রেতার খোঁজে বেরোবার আগেই ইনারা আমাদের মালসামান ব্যুকিং দিয়া ছিনাইয়া নিয়া আমাদের দুঃখ ঘোচায়, আমরা তাদের মিত্রস্তন্যপানের ঋণ শুধিবারে নাহি পারি ইহজন্মে। এদিকে চোখে চালশে, দেহে নাই বল, বুকে ল্যাক অফ কনফিডেন্স। এই আমাদের অপরূপায়িত সোনার বাংলাদেশ। চুতিয়াবৃত্তিতে এখন আমরা চ্যাম্পিয়্যনপ্রায়। ফেইসবুকে এহেন চুতিয়াবৃত্তি, নিজের নাক কেটে পরের নরুনের কিমৎ চুকানো, নিযুত নিদর্শন দেখে যাই আমরা নানা ঘটনার মুড়ায় এবং লেজে।
ভারত বহুকিছুতেই আমাদের চেয়ে এগিয়ে, ব্যাপক এগিয়ে, এইটা খাঁটি দিবালোকের চেয়েও সত্য। বুদ্ধিবিদ্যা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, বিজ্ঞান ও ভূরাজনৈতিক নেতৃত্ব, সর্বোপরি বিজনেসে ওরা আমাদের চেয়ে একশ বছর এগিয়ে। কেবল কয়েকটা জায়গায়, যেমন এডুকেশন ফর অল্ এবং রক্-ন্-রল্, বাংলাদেশের সঙ্গে এককাতারে এসে দাঁড়াতে রেসের গতি ইন্ডিয়াকে সেভেনফোল্ড এক্সেলারেইট করতে হবে। এবং, বলা বাহুল্য, অমর্ত্য সেন বলেছেন বলেই নয়, এইচডি ইন্ডেক্সে এদেশ মেট্রোসিটিকেন্দ্রী উন্নয়ননীতির ভূখণ্ড ভারতের চেয়ে ঢের এগিয়ে। এই কথাটা পৃথিবীর সর্বাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দেশগুলোর অগ্রসারির একটি ইন্ডিয়া স্বীকার করুক বা না-করুক, রাষ্ট্রীয় মদতে বেশুমার মুসলমান-শিখ-দলিত্-মনিপুরী-আদিবাসী-মাওবাদী নিধনের দেশ ভারতের ‘শিক্ষিত’ ও ‘আধুনিক’ জনগোষ্ঠীর বিবেচনাবোধের পরিচয় শেষমেশ বিধর্মীনিধনকারী নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি-শিবসেনা-বজরঙ্গ খুনতৃষ্ণ জোটের মসনদে এনে বসানোর মধ্যেই পাওয়া যায়। বাংলাদেশে যেদিন এই ধরনের প্রকাশ্য-দিবালোকে-ধৃত হন্তারক মসনদাসীন হবে, সেইদিন রকমিউজিকের গর্জন ও গলা আমাদের চিরতরে মিউট হয়ে যাবে। এই নিবন্ধকারের আঙুলে এবং কিবোর্ডে এককাৎরা সেন্স থাকতে সেইটা হবে না বলেই মনে হয়। এইখানেও পশ্চিমবেঙ্গল তথা ভারতমহান ছোটমুটো-টুটাফাটা বাংলাদেশের কাছে বহরে-গতরে এবং অবশ্যই আত্মায় বেঁটেখাটো।
তবে কি প্রীতিভাজন রইবা তুমি ইন্ডিয়া ঠাকরুনের? যতদূর পর্যন্ত অ্যাফোর্ড করা যায় প্রীতিভালোবাসা, ফাইন; কিন্তু আদাজল খেয়ে, চোখ-মাথা নুইয়ে, শ্যামপ্রীতি নিরন্তর বজায় রেখে যাবার ধনুর্ভাঙা পণ প্রারম্ভে করে বসে থাকা আখেরে বেক্কলের কারবার। দুইটা দেশের সম্পর্ক কেমন, পরিণত না অপরিণত, বুঝতে হয় বার্গেইন বা দরকষাকষি দেখে। সেইটা যা-কিছুই হোক, ইশ্যু যা-ই হোক, দরকষাকষির দক্ষতা বা দখল দেখেই একে অন্যের সমীহ তথা পারস্পরিক সম্ভ্রম আদায় করে। এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তো পরিণত নয়ই, উপরন্তু নুয়ানো। ভক্তিমূলক বন্ধুত্বের। ভক্তরা খানিক দেশাত্মবোধক না-হইয়া মানসম্মান বাঁচাইবার, প্রেস্টিজ পাংচারের কেলেঙ্কারি হইতে বাঁচিবার, উন্নত পন্থা নাই দ্বিতীয়।
সো, সুন্দরবন নিয়া আস্তে কথা বলো, টিপাই নিয়া আলাপ তুলিও না, ফারাক্কা হ্যাজ্ গ্যন্ উইথ দ্য উইন্ড, বঙ্গোপসাগর নিয়া খামোশ থাকো, ক্যুয়িক রেন্টাল খদ্দের হইয়া বাঁচো, ট্র্যানজিট নিয়া নাতিপুতিরা আদায়-উশুলে নামব বোধহয়। এবং রোহিঙ্গা ইশ্যুতে ইন্ডিয়ার বিগব্রোসুলভ বদমায়েশি চাক্ষুষ করিয়া বালিকা বাংলাদেশ অভিমানাহত খাজুল নয়নে বন্ধুর পানে চাইয়া থাকো, মুখে রা কাড়বার নাই উপায়। ক্যেই স্যেরা স্যেরা।
শোনো, দুনিয়ায় আল্লা সবাইরে সবকিছু দিয়া পাঠায় না। হাসিল করিয়া লইতে হয়। কেউ কম কেউ বেশি, নিজের কিছু-না-কিছু থাকে যেইটা আইডেন্টিফাই করে সেরে পরে এগোতে হয়। ব্র্যান্ডিং দরকার। প্রোমো দরকার। অনেককিছুই ছিল তোমার, যা আক্কেলদোষে বেখেয়ালে তোমার মিত্রশক্তি নিয়ে গেছে শিশিরশিকারের ন্যায় আলতো চরণে, প্যাটেন্ট করে নিয়েছে নিজনামে নিম থেকে শুরু করে ঘোড়ামুত্রা আর চুত্রা পাতাটাও, তুমি তখন কীর্তনবিভোর ঘুমাচ্ছিলে। এখনও তোমার ঘুম ভাঙবে না, হায়!
ব্যান্ডের গানে, রকমিউজিকে এতদঞ্চলে, বাংলাদেশ মধ্য-নব্বই পর্যন্ত উন্নত ছিল; — কথাটা সাম্প্রতিক সার্কাসকালীন অনেককেই বলতে শোনা গেল, অংশত সত্য হলেও অধিকতর সত্যের খাতিরে বলা কর্তব্য যে সেই উন্নতির পরম্পরা আজও অব্যাহত। বর্তমান দুইহাজারষোলো সনে এবং নিকটভবিষ্যতের সতেরো-আঠারোয়, যে-কয়টা ব্যান্ড একনিশ্বাসে ভালো চিহ্নিত হবে বাংলাদেশে, — একবিংশদিনের ব্যান্ড সবাই, — একব্যক্তির কররেখায় সেগুলো গুনে কুলানোর নয়। লিস্টি দিচ্ছি না। টাকাপয়সা বাগাইতে পারলে, ইন্ডিয়ান স্টেট ব্যাংক বা অ্যাম্ব্যাসির কাছ থেকে, একটা রিসার্চ প্রোজেক্ট লঞ্চ করতে পারেন আপনি নিজেই।
কিন্তু শুরু করেছিলাম স্যামুয়েল জন্সন দিয়া। মানে একটা এপিগ্র্যাফ কোট-আনকোট ঝুলন্ত রচনাসূচনায়। শেষেও শুরুর রেশ রাখি একটু? হুমায়ুন আজাদ একটা কবিতা লিখেছিলেন তার অন্তিম কাব্যগ্রন্থের আগের কাব্যগ্রন্থে, ‘দেশপ্রেম’ সেই কবিতার নাম, কবিতাবইয়ের নাম ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’; জন্সন রয়েছেন সেই কবিতা জুড়ে, স্যামুয়েল জন্সন এবং প্রোক্ত এপিগ্র্যাফ তার, সেই কবিতাটা আস্ত পড়ে ফেলি ফিরে একবার ফের উদ্ভট উটের পিঠে চেপে দেশভ্রমণ করতে করতে।
আপনার কথা আজ খুব মনে পড়ে, ডক্টর জনসন।
না, আপনি অমর যে-অভিধানের জন্যে, তার জন্যে নয়, যদিও আপনি
তার জন্যে অবশ্যই স্মরণীয়। আমি অত্যন্ত দুঃখিত তার জন্যে
আপনাকে পড়ে না মনে। আপনাকে মনে পড়ে, তবে আপনার
কবিদের জীবনীর জন্যেও নয়, যদিও তার জন্যেও আপনি অবশ্যই
স্মরণীয়। আমি আবার দুঃখিত, ডক্টর জনসন। আপনার কথা মনে পড়ে
সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে; আপনার একটি উক্তি আমার ভেতরে বাজে
সারাক্ষণ। আড়াই শো বছর আগে একবার আপনার মুখ থেকে
বের হয়ে এসেছিল একটি সত্য যে দেশপ্রেম বদমাশদের
শেষ আশ্রয়। আপনার কাছে একটি কথা জানতে খুবই
ইচ্ছে করে স্যামুয়েল জনসন; — কী ক’রে জেনেছিলেন আপনি
এই দুর্দশাগ্রস্ত গ্রহে একটি দেশ জন্ম নেবে একদিন,
যেখানে অজস্র বদমাশ লিপ্ত হবে দেশপ্রেমে? তাদের মনে ক’রেই কি
আপনার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল এই সত্য?
ডক্টর জনসন, আপনি আনন্দিত হবেন জেনে যে বদমাশরা
এখানে দেশের সঙ্গে শুধু প্রেমই করছে না, দেশটিকে
পাটখেতে অলিতেগলিতে লাল ইটের প্রাসাদে নিয়মিত করছে ধর্ষণ।
বর্তমানে ফেইসবুকে দেশপ্রেমবাহার দেখে এই কবিতার প্রণেতা আজাদ এবং কবিতায় স্মৃত ডক্টর জন্সন উভয়েই কী ভিমরি খেতেন না? যার যা কাজ সে তা না করে স্রেফ ফাঁপা বুলি আওড়ায়ে যেয়ে ভাবছে অ্যাক্টিভিস্ট বনে গেছে ব্যাপক। কথায় কথায় স্ট্যাটাসের প্রতিক্রিয়াশীলতা ছাড়া আজ আর ক্রিয়া নাই কোনো। বর্তমান বাংলায় নিউটনের তৃতীয় ফর্মুলা ছাড়া আর কোনো সূত্রানুসূত্রের চর্চা হারাম ফোঁটাটাও গরহাজির বস্তুত। তুমি মিডিয়াবাহিত ঘটনায় ইম্প্রেসড হয়ে মারদাঙ্গা স্ট্যাটাস দিচ্ছ না মানেই হচ্ছে তুমি বিপক্ষ ষণ্ডা দাগের ধামড়ার ছাপ্পা লভিয়াছ। পরক্ষণে ফের আরেক ইশ্যু তুমি অ্যাড্রেস্ করলেই স্বীয় বোধবুদ্ধিচিন্তা পাব্লিশের কারণেই বিরাগভাজন হয়ে যাচ্ছ দেশপ্রেমপাইকারদের। এই মিডিয়েভ্যাল্ মদ্দা-মাদিদের দেশপ্রেমঠাপে একটুকু চুপ করবি তুই, দোহাই, দিবি মোরে অবসর ভালোবাসিবারে?
- কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ - January 14, 2025
- মুরারিচাঁদ কলেজ, অশোকবিজয় রাহা এবং একটি অগ্রন্থিত রচনা || মোহাম্মদ বিলাল - January 14, 2025
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
COMMENTS