সিনেমায় গানে গল্পে উপন্যাসে আমাদের দাদিমা ঠাকুমা || আহমদ মিনহাজ

সিনেমায় গানে গল্পে উপন্যাসে আমাদের দাদিমা ঠাকুমা || আহমদ মিনহাজ

আমাদের দাদিযুগ’ লেখাটি এই ফাঁকে পড়েছি। আপনি উসকানি দিতে ওস্তাদ। এই লেখায় সেটি যথারীতি বিরাজে। তবে আজ এ-নিয়ে সবিস্তার লিখব না, কারণ দাদি সংক্রান্ত সাহিত্য বাংলায় সত্যি কতটা কি আছে সেটি নিজের ঠিক স্মরণ হচ্ছে না। খালি এই কথাটি মাথায় ঘুরছে, — বাংলা সাহিত্যে টুকরাটাকরা দাদিবর্ণন বোধহয় দুর্লভ নয়। তার একটির মধ্যে দাদি মানে ঠাকুরমা রূপকথার গল্পের ঝাঁপি খোলার কারিগর বা সূত্রধর। অর্থাৎ সেই ফ্যান্টাসির উদ্বোধক যার গপ্পোর ঝাঁপি শেষ হওয়ার নয়। এর বাইরে দাদি ওরফে ঠাকুমারা যেসব ছিন্নসূত্রে দেখা দেন গান-নাটক-সিনেমা ও সাহিত্যে, সেখানে তারা কেন জানি মর্বিড!

পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার ঠাকুমার কথা ভাবুন! ওই ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো’ বলতে-বলতে গঙ্গাযাত্রা! সূর্য দিঘল বাড়িতে দাদি (যদি ভুল না করি) ছিল মনে পড়ে, সে ওই তিক্ত গরিবির সঙ্গে নিরন্তর পাল্লা দেওয়া এক রমণী, তবে বেশ দাপুটে ও মায়াবি। জ্যেতিরিন্দ্র নন্দীর ফ্যান্টাসিমাখানো দাদির কথা এইবেলা মনে পড়ছে। লেখক অবশ্য তাকে মা এবং প্রবীণা রূপে এঁকেছেন, যদিও তার বয়সের ভার তাকে দাদি ভাবতে বাধ্য করায়। কোনো নাতিপুতির সঙ্গে তার কাজকারবার গল্পে ঘটে না। তার সকল কারবার প্রায় তার বয়সের ধার ছুঁতে চলা পোলার সঙ্গে। অদ্ভুত এক কাহানি এবং লেখকের বয়নের প্রসাদগুণে অন্যমাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিল।

শওকত ওসমানের গল্পে দাদির-বয়স-ছুঁইছুঁই তিন রমণীর পাকসেনা কর্তৃক নির্যাতিত (এবং ধর্ষিত) হওয়ার কাহিনিটি মনে পড়ছে। এভাবে আরো হয়তো আছে। সবখানেই দাদি বা এই বয়সটা মর্বিড রূপেই বোধহয় বাংলার লেখকরা হাজির করেছেন। কেন সে ভাবনার বিষয়। গুম নিয়ে লেখা অধমের একখানা গল্পে (পাঠকের কাছে হয়তো গল্প নয় তবে আমার কাছে গল্পই) দাদি কাহিনিছকের মধ্যভাগে এসে দেখা দিয়েছিলেন এবং শেষতক তাকে কেন্দ্র করেই গল্পের প্রধান চরিত্রের নিরুদ্দেশযাত্রা ঘটেছিল। গল্পটি ‘স্লাটেটট’ নাম দিয়ে বছর তিনেক আগে লিখেছিলাম। তারপর থেকে পড়ে আছে। আপনি দাদি প্রসঙ্গে যাওয়ায় মনে পড়ল।

এসবের বাইরে দাদিবর্ণন মানে আপনার ভাবনার জায়গাটিকে যদি হিসাবে আনি, আমাদের সকলের নিকট পরিচিত এই দাদির ছবিখানা বোধহয় আজো সেভাবে কেউ আঁকেনি! এর পেছনে রমণীর অন্তঃপুরে প্রবেশ তার খুঁটিনাটি বর্ণনে আমাদের লেখককুলের অনভিজ্ঞতা অথবা বিরাগ অথবা অন্য জটিলতা থাকতেও পারে। বঙ্কিমকে এইবেলা বড্ড মনে পড়ে। অন্তঃপুরের বিবরণে খাসা ছিলেন। রবিও কমন যাননি। শরৎচন্দ্রেও সেটি ছিল। তবে তারা কেউ দাদি/ঠাকুমাকে সাবজেক্ট করেছেন কি না স্মরণে আসছে না।

আমাদের সাহিত্য থেকে প্রাত্যহিক সিরিয়ালে দাদি খালি মবির্ড তা নয়, প্যাসিভও বটে। তাকে ফুলদানি করে বেঠকখানা নয়তো শোবার ঘরে বসিয়ে ও শুইয়ে রাখা হয়। পরিবারের লোকজন তাকে দেখে আবার দেখে না! রঙ্গ করে আবার করেও না। আসা যাওয়ার মাঝে একখান অচিহ্নিত হাইফেন হয়ে দাদি শুয়েবসে দিন কাটায়। সিরিয়ালে বউ-শাশুড়ির প্যঁচের চোটে সে নিষ্ক্রিয় একটুকরো চিহ্ন, যেহেতু একদা সংসারে তার যে-ভূমিকা ছিল সেটি এখন আর মূল্য রাখে না।

ফ্যান্টাসি, মর্বিড প্যাসিভ ত্রিভূজ এই ছকের বাইরে দাদির ফ্যান্টাস্টিক পুরুষত্ব  মানে রমণীদেহমনে বিরাজিত ম্যাস্কুলিনিটি নিয়ে পুরুষলেখকরা আর কি লিখবে? সে নিজেই তো এর আদিঅন্ত বোঝার এলেম ধরে না! নারীলেখকরা লিখতে পারতেন। কেন লিখেন না তার নেপথ্যে হয়তো সেই মনোবীজ কাজ করে যেখানে নারীলেখক ঘরদোর-আন্ডাবাচ্চা থেকে শুরু করে স্বামীর মেজাজ সামলানোর পর স্নেহময় নাতিপুতির কবলে পড়ে রঙ্গ ও মমতার রসে দাদি ওরফে বঙ্গরমণীর কবরযাত্রাই দেখে।

আপনি যে-কন্টেক্সটকে নিয়ে এলেন সেটিকে মহিমান্বিত করতে হলে যে-ন্যারেটিভ দরকার তাকে সৃষ্টি করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এর জন্য সাহস এবং স্রোতের বিপরীতে যাওয়া প্রয়োজন। আমরা মনে হয় চিরচেনা দাদির এই স্বকীয়তাকে লেখার মতো ভাষাটি আমরা আজো রপ্ত করতে পারিনি!


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you