Try once more like you did before / Sing a new song, Chiquitita!
এই রেস্তোরাঁটি — পাঞ্জেরী রেস্টোরান্ট — ধরে আছে অনেক অনেক স্মৃতি, আমার উঠতি-বয়স জীবনপর্বের। না, খুব রগরগে স্মৃতি নয় সেসব। খুব সুন্দর, শোভন, শান্তি-শান্তি স্মৃতি সব। সে কী এই জন্মের স্মৃতি? না। সেসব কোনো দূরজন্মের, সুরজন্মের স্মৃতি — আমার আগুনজন্মের, বিষাদজন্মের স্মৃতি। অনেক বছরের ধূসরতার ভিতর দিয়ে গিয়েও তারা — আমার সেই নিষাদজন্মের কিরাতজন্মের সুহৃদেরা — আজও জ্বলজ্বলে, এখনও হীরেদ্যুতিভরা। আজ তারা কই সব? কোথায় … কোথায় …? … আমি হারায়েছি তারে … তাদেরে … পদ্মার ঢেউ রে … মোর শূন্য হৃদয়পদ্ম নিয়া আমি বসে আছি এথা … রে পদ্মা … রে বুড়িগঙ্গা … রে চাঁপাই-রাজশাহীর মহানন্দা … রে নবীগঞ্জের মিছরির-ছুরি বরাক … রে তিতাস … রে সুরমা … রে ঠানামানা-জানা টেমস নটিনী … কী সর্বনাশা হাতছানি দিয়া আমাদেরে ছত্রখান করে দিলো এই ক্লিকবাজ নদীগুলো! দয়ামায়া নাই এদের … এই নদীদের … নদী নির্দয়ভাবে কেবল নিজের দিকে টেনে নিয়া যায় আমাদেরে … ফিরিতে দেয় না আর … দেখিতে দেয় না প্রিয় তোমারে আমার …
And your love’s a blown-out candle / All is gone and it seems too hard to handle / Chiquitita, tell me the truth / There is no way you can deny it / I see that you’re oh so sad, so quiet
এখন নেই, ছিল একদিন, জীবন আমাদেরও। এখন নেই, ছিল একদিন, পাঞ্জেরী রেস্তোরাঁ।
Chiquitita, you and I cry / But the sun is still in the sky
এই শহরে এই একটিমাত্র জায়গা যেখানে এককাপ চায়ে দেয়া যেত অনায়াসে একঘণ্টা কাটায়ে। এ আমাদের ছোট শহরের ছোট-ছোট মনমানসিকতায় আবিল মানুষের জন্য বড়লোকী ভাব ফলাবার জায়গা। আজ আর নাই, ছিল একদিন। আমাদের কফিহাউস। সন্ধের পরে এখানে আড্ডারু সকলে এসে জড়ো হতো। চা-সিগ্রেট খেত। আর সবচেয়ে বেশি খেত মৌরি। কোনো-এক অজ্ঞাত রহস্য হবে ব্যাপারটা, আমি জানি না বা জিগ্যেশ করা হয়নি কাউকে, টেবিলে টেবিলে থাকত প্রচুর অঢেল মৌরি প্লেটভর্তি। তিনটাকা কাপের চা ফুরায়ে যেত তিন সেকেন্ডে, সকলেরই, এরপর বেদম মৌরি চাবাও। কফি পাওয়া যেত বটে, প্রেম-ফুটিফুটি যুগলের মধ্যে সেই কফি সার্ভ করতে দেখতাম মূলত, তবে সেটা হতো দুধে-ঘোলা বিদঘুটে আইসক্রিমস্বাদ। কফির স্বাদ দুনিয়াকাঁপানো তিতকুটে হলেও আমি সহ্য করে নিতে পারি, বেশিরভাগক্ষেত্রে তেতো কফি এনজয় করি বলা ভালো, কিন্তু দুধ-বিদঘুটে কফি — নৈব নৈব চ। ফলে এখানে এই পাঞ্জেরীতে যারা আসত, বসত, খানাখাদ্য পরোটা-চা সামনে নিত শুধু বসার স্বার্থে। একবারই মাত্র, চক্ষুলজ্জাবশত, সঙ্গে সঙ্গে আসন সংরক্ষিত হয়ে যেত আপনার জন্য রেস্টোরান্টের আলো নেভানোর আগ পর্যন্ত। একেকবার মনে হতো, আমাদেরকে স্রেফ বসিয়ে বসিয়ে ব্যবসা করে নিচ্ছে এর মালিক মশাই! কিন্তু, আজ বুঝি, ভুল ভাবতাম। ওই রেস্তোরাঁমালিক নিশ্চয়ই জীবনের হিসাববিজ্ঞানে একেবারেই ভূতকাঁচা ছিলেন, যেমন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীকালে এমনই হিসাবমূর্খ প্রমাণিত হয়েছে। এবং, যা বলতেসিলাম, এই একটা জায়গা, যেখানে ভোজনরসিক নয়, আড্ডাগুলতানিরসিকদের জমায়েত হতো রোজ সাঁঝ-ফুরানো নগরান্ধকারে।
Chiquitita, you and I know / How the heartaches come and they go
রেস্তোরাঁয় বসে লিখতেন হেমিংওয়ে — দ্যাট ওল্ডম্যান, সমুদ্র ও শিকার সম্পর্কে ছিল যার দুর্ধর্ষ প্যাশন — উস্তাদ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। স্মৃতিকথায় পেয়েছি তাঁর লেখার পরিবেশ ও প্রক্রিয়ার তুখোড় সব বর্ণনা। আমাদের দেশের সৈয়দ হক তেমনি একজন, রেস্তোরাঁয় বসে লিখতেন/লিখসেন বিস্তর। সেসব জেনেছি নানা জায়গায় তাঁরই নিজের জবানিতে, সহযাত্রী লেখকদের অনেকেই তাদের স্মৃতিনিবন্ধে সৈয়দ হকের এই দিকটি নিয়ে বলেছেন। পড়তে পড়তে সেইসব লেখার অভিযানে যেন আমিও শরিক হয়ে গেছি এমনটা মনে হতো। সৈয়দ হক ও হেমিংওয়ে দুজনের লেখা আমরা প্রাণ-উজাড় প্রেমে জোরে জোরে পড়তাম তখন, গদ্যের দার্ঢ্য ও তেজোদ্দীপ্ত পৌরুষ উদযাপন করতাম, বড়সড় আয়োজন করে একটা গদ্য-আবৃত্তির অনুষ্ঠান করব বলে ছকে রেখেছিলাম, অন্য অনেক মহত্তর প্ল্যানের ন্যায় এই প্ল্যানও বাস্তবাযন হয় নাই শেষমেশ। যা-হোক। পৃথিবীর খুব থ্রিলিং দৃশ্যের একটি — ভরভরন্ত রেস্তোরাঁর এককোণে একমনে টেবিলে বসে ঘাড় নুইয়ে লিখে চলেছেন একজন লেখক, ফাঁকে ফাঁকে পাত্র তুলে নিচ্ছেন হাতের তিন-আঙুলে গলার কাছে, ভিজিয়ে নিচ্ছেন গলা ও গদ্য, অ্যাশ্ট্রেতে অনেকক্ষণ উবু-হয়ে-থাকা সিগ্রেট নিভে যাবার আগে শেষবার নিয়ে নিচ্ছেন ঠোঁটে — দৃশ্য বটে! আমাদের দেশে ওই কালচারটা, ধারণা করি, সেভাবে গড়ে ওঠে নাই। বিদেশে এইটা আছে, এখনও, অন্তত অরহান পামুক যদি মিথ্যা না-বলেন। আমরা এখানে রেস্টোরান্টে যাই বিশেষত পটাতে, শ্যালিকার আব্দার রক্ষার্থে, লেখকরা যান পরধনে মোগলাই-মোসাল্লাম-মদ্য ভক্ষিতে। আমি নিজে লেখক নই, তিনচাইরজন লেখকবন্ধুর সঙ্গে কালেভদ্রে আলাপনসূত্রে লেখকজীবন সম্পর্কে দুটা-একটা কথা আমি জেনেছি মাত্র। তবে দেখি তো, বঙ্গবিজয়ের কারবারীদের রুসুম ও রেলা, যার যার খোঁয়াড়ে সেঁধিয়ে অভিধান সামনে নিয়ে মারিংকাটিং করে এমনতরদেরই আধিক্য। অধুনা যুক্ত হয়েছে সাইবার কালচার। ক্লিক ক্লিক ক্লিক … আপলোড অ্যান্ড গেট লাইক … লাইক … লাইক! সিপিএম যুগ ফিরেছে আবার, সর্বত্র, ধুন্দুমার চমৎকারা। কাট-পেইস্ট মাস্টার্স! ফলে অভাবিত কোনো ভাবনা, ভূমি-কাঁপিয়ে-দেয়া কোনো কান্না, মৌলিক কোনো চিৎকার ফলে তৈরি হয়ে উঠতে দেখি না আমাদের।
Chiquitita, tell me what’s wrong / You’re enchained by your own sorrow / In your eyes there is no hope for tomorrow
এলোমেলো কত-কী-যে করতাম, বকে যেতাম অনর্গল, কোনো-এক সুবর্ণ অতীতকালে, সেই স্মৃতিদ্যুতিময় পাঞ্জেরী রেস্তোরাঁর দেয়ালঘেঁষা একটি টেবিলে! সেই বিশেষ টেবিলটি — জীবনে একটা-সময়-পর্যন্ত সকলেরই থাকে একটা বিশেষ রেস্তোরাঁ, আর সেখানে থাকে সকলেরই একটা করে বিশেষ টেবিল নির্ধারিত — ছিল সুনির্দিষ্টভাবে আমাদেরই জীবনের জন্য এবং সেই টেবিল খালি না-হওয়া তক আমরা ইতিউতি পায়চারি করতাম তবু দ্বিচারিনী হই নাই ভুলেও। মুখোমুখি একদঙ্গল বকাসুর, বসতাম টেবিলে, মারতাম রাজা-উজির, রয়েসয়ে দেখতাম আকাশকুসুম। বৃত্তে কেউ কেউ থাকত শুধু সন্ধেসুহৃদ, রাত্রিসহচর, দিনে এরা কাটাত অন্যত্র কোনো দঙ্গলে মিশে। ক্যামোফ্লেজে আমরাও মিশে রইতাম নানান গোত্রে-উপগোত্রে। শুধু সন্ধেবেলা সম্মিলিত কোরাস। ফ্রন্টলাইন ব্যাটলে কেউ, কেউ মুচকিমুচকি স্ট্রাটেজিক ওয়ারফেয়ার সামলাতো। অস্ত্র বলতে অ্যাশ্ট্রে একখানি, পানির জগ একটি ও গেলাশ মাথাগুনতি, আর সেই ইন্দ্রধনু মৌরিপ্লেট। এবং সিগ্রেট। এবং দুধে-ডোবা আইসক্রিমস্বাদ চা। এবং মামা আমরারে একবার আইয়া দেখিয়া যা হাঁক রেস্তোরাঁচাপরাশি লক্ষ করে। এই ছিল আমার সন্ধে। আমাদের বন্ধুদের সন্ধে। এই আমাদের অপরূপ গরিবদিনের সুলতানি সন্ধে উদযাপন। এইটুকু থাক। আপাতত এইটুকু।
Chiquitita, tell me the truth / I’m a shoulder you can cry on / Your best friend, I’m the one you must rely on / You were always sure of yourself / Now I see you’ve broken a feather / I hope we can patch it up together
এইটুকু থাক। আপাতত এইটুকু। কোথাও জ্বলুক আমাদের সন্ধেতারাখানি, টিমটিমে হলেও থাকুক জাগরুক, যতদিন বাঁচি আমরা …
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS