প্যারা || শেখ লুৎফর

প্যারা || শেখ লুৎফর


আজ ফাগুন মাসের আঠাশ তারিখ, সন চৌদ্দশ সাতাশ। তবু বাতাসে ফুলের গন্ধ নাই! কোকিলের পরানজোড়ানো গলাও কানে আসে না। সারাটা শীতকাল গেল একফোঁটা বৃষ্টিও পড়েনি। তাই রসের অভাবে অনেক গাছেই এবার মুকুল ধরেনি। রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো লেখা পড়লেই আঁচ করা যায়, আমের মুকুলের গন্ধ কিংবা বিরহী কোকিলের ডাক ভেতরে ভেতরে তাঁকে মাতাল করে ফেলত। রবীন্দ্রনাথ রবিঠাকুর হয়ে উঠতে পারার পেছনে সেকালের প্রকৃতিটাও অনেক বড় একটা নিয়ামক ছিল। চূড়ান্ত রায়ের মতো এইসব ভাবতে ভাবতে আমি সামনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। দিগন্তজোড়া হাওর…। ক্ষেতে ক্ষেতে পোয়াতি বোরো ধান। সবুজের এই মহাবিস্তার দেখেও আমি খুশি হতে পারি না। জানি, চাষারা কামলাখরচ বাঁচানোর জন্য ক্ষেতে ক্ষেতে আগাছানাশক দিয়েছে। রাসায়নিক সার, কীটনাশকের সাথে গত কয় বছর ধরে আগাছানাশকও চাষের উপকরণ হিসাবে বাংলায় ঠাঁই করে নিয়েছে। তাই এই সবুজ অবিশ্বাসী প্রিয়তমার মতোই ভয়াবহ অনিষ্টের।

কেমন-একটা অশুভ আতঙ্কে আমি উঠে পড়ি। নিজের অজান্তেই করিডোর-কিচেন পেরিয়ে গিয়ে গ্রিল ধরে দাঁড়াই। লোহার শিকের ওপাশেই ঝাঁকড়া চেহারার দুইটা আমগাছ পিঠাপিঠি ভাইয়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ডালে ডালে, পাতায় জড়ানো ছোট ছোট ঝোপে আমার অস্থির চোখ ঘোরাফেরা করে। কোনো পাখিই নাই! মাঝে মাঝে সকালের দিকে বিরল প্রজাতির এক-দুইজন আসে। তারা লেজঝোলা হলুদ পাখি। কোনো-কোনোদিন কুটুমপাখিও আসে। দারুণ গলায় ডাকাডাকি শুরু করলে বউ বলে, আমাদের তো মেহমান আসার সম্ভবনা নাই তবে কেন কুটুমপক্ষী ডাকে?

আমি সব ফেলে ব্যালকনির দিকে ছুটে যাই। ওদিকে কদমগাছের উঁচু ডালে বসে সে ডাকাডাকি করে। মাঝেমাঝে আমার মেয়েটাও আসে, — কী পাখি বাবা?
— কুটুমপাখি।

চারপাশের গাছগাছালিতে কোকিলের কোনো ডাক নাই! পাশের খালপারে সেচের একটা মেশিন চলছে। তার গুমগুম শব্দে কান পাতা দায়, কোকিলের ডাক শুনব কোত্থেকে? তাছাড়া রাস্তার দিক থেকে আসছে যানবাহনের কর্কশ শব্দ, মানুষের কোলাহল আর গ্রামের সব খানাখন্দ এবং পতিত পালান জুড়ে পলিথিন-প্লাস্টিকের জঞ্জাল। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখি : গাছে গাছে পুরনো পাতা ঝরছে। কোনোটাতে নতুন পাতার সবুজ ঝলক। বসন্ত মাঝউঠানে তবু কোনো কোকিল ডাকছে না! আমার বিচারে এরচে আচান্নক কথা আর কী হতে পারে?

আমার খুব কষ্ট লাগছে। অনেক বড় কিছু হারিয়ে ফেলার আজাব বুকে নিয়ে আমি কিচেন থেকে টেবিলে ফিরে এসে ফিওদর দস্তইয়েফস্কির ‘বঞ্চিত লাঞ্ছিত’ বইটার পৃষ্ঠাসংখ্যা দেখে বন্ধ করে ফেলি। কিছুই ভালো লাগছে না। মনখারাপ করে নিজের রুমে ফিরে আসি। মেয়ে তার ঘরে পড়ছে। বউ টিভিতে কী-জানি কী-একটা দেখছে। আমি প্যান্টট্যান্ট পরে তার রুমে গিয়ে অপরাধীর মতো দাঁড়াই। তার কাছে আমার দোষের কোনো অন্ত নাই। ঘুমের মাঝে নাক ডাকি। নিঃশ্বাসে সিগারেটের বাজে গন্ধ। তাই মেয়ের বয়স আড়াই হতেই সে আমাকে তার বিছানা থেকে খারিজ করে দিয়েছে। ঠাঁই নিয়েছি সামনের রুমে। মাটিতে ম্যাট বিছিয়ে তার উপর তোষক, খেতা-বালিশ। আমি মনে মনে খুশি, লালনও মাটিতে ঘুমাত। মাটির মানুষের জন্য মাটির বিছানাই আসল বিছানা। আরেকটা কথা বিবেচনা করে ভেতরে ভেতরে আমোদ পাই : এতে আমি তিন দিক থেকে লাভবান। ১. ইচ্ছামতো রাত জাগতে পারব। ২. ঘনঘন বাইরে গিয়ে সিগারেট টানতে পারব (ঘরে সিগারেট টানা নিষেধ)। ৩. একলা বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাতে পারব।

তো, তার বড় বড় কালো চোখে একটা বিদ্রæপ খেলা করে। সেটা একঝলক মাত্র। তারপর যেন এই এতিমের ওপর দয়া হয়েছে এইমতো একটা ভঙ্গি করে। আমি তো তাকে চিনি। তার কোমল জায়গাগুলো জানি তাই নরম গলায় বলি, — একটু বাইরে যাওয়া দরকার।

আমার বলার ভঙ্গিটার অস্বস্তি তার চোখ এড়ায় না। সে জানে, দুপুরে খাওয়ার পর একটু ঘুমানো আমার অভ্যাস। সেই ঘুম মাটি করে যেতে চাইছি, তার কাছে না-হলেও জিনিসটার দাম আমার কাছে অনেক। তাই বুঝি আরেকটু নরম হয়। ভাব দেখে আমি তার চোখে কিছু-একটা খুঁজি। যা চাই তা পাই না। তার বদলে দেখি তার ডাগর-ডাগর চোখের মণিতে মমতার চোরা রস চিকচিক করছে। আমি ভেতরে ভেতরে অবাক হই, মেয়েরা মা হয়ে গেলে কী মাতৃত্ব তাদের সবটাই জবরদখল করে নেয়?

আমার কিছুই তার চোখ এড়ায় না। সে নীরবে হাসে; চোখের বড় বড় পাপড়িগুলো একটু-একটু কাঁপে। তারপরই কালো মণিদুটো বিদ্রুপে ঝলক মারে, এই অসময়ে হাওর-বিলে গল্প খুঁজতে যাচ্ছ নাকি? আজ সফরসঙ্গী বাউল না জেলে?

আমার বন্ধুদের তালিকাটা তার মুখস্ত। এদের মধ্যে সরাসরি হাওর-বিলে মাছ ধরে এমন ঘরানার দুইজন আছে। তাদের সাথে কত রাত আমি নির্জন হাওরের গভীর কালো রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বর্ষার সাগরময় হাওরের বুকে কান পেতে কত রাত আমি তাদের একচিলতে ডিঙিতে কাটিয়েছি। ওরা আমার হৃদয় বোঝে, আমি তাদের আত্মার গন্ধ পাই, দুনিয়াতে এরচে আর আপনজন কে?

বন্ধুদের তালিকায় আছে একজন কাঠমিস্ত্রি, একজন রিক্সা-গ্যারেজমালিক, অন্তত ডজনখানেক বাউলশিল্পী আর খাঁটি বাউল একজন। তাই তার গালে ঝালের লাল ঝলক ওঠে, — লেখে কয় টাকা পাইছ?

আমার আত্মায় ঘা পড়ে। তাই ঘাড় ত্যাড়া করে বলি, — আমি টাকার জন্য লিখি না।

তার চওড়া কপাল কুঁচকে ওঠে, — ঘরে ডিম নাই, তেল নাই, এইসব কিনতে কিন্তু টাকা লাগে।

কালো প্যান্টের সাথে ফ্যুলহাতা সাদা শার্ট ইন করে পরেছি। টাকা হাতে তুলে দিতে দিতে একটু হেসে বলে, — নর্মাল প্যান্ট-শার্টে তোমাকে তো ভদ্রলোক-ভদ্রলোক লাগে!

আমি নীরবে টাকা নিয়ে সামনে পা বাড়াই, — হায় খোদা! আমি বুঝি ভদ্রলোক না?

আমাকে নিয়ে তার উপহাস, বিদ্রুপ কিংবা মমতাগুলো অনেকদিন ধরে চিনি বলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই আগুনের ছ্যাঁকাগুলো সহজেই উপেক্ষা করে ভাবতেই থাকি, আজ ফাগুন মাসের আঠাশ তারিখ! তবু কোনো কোকিলের ডাক কানে লাগেনি। আমার ভেতরে ছটফটানি : বাংলার বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় কী কোকিলও?

মাস্ক পরতে পরতে আমার চোখ পড়ে বউয়ের দিকে। তার হাতে বাজারের ফর্দ আর ডিমের ক্যারেট। আমি শেষবারের মতো তার জোড়াভুরু দেখি, চোখের গভীর কালো মণিতে হৃদয়ের হদিশ করি। জানি মেয়েদের আবেগ কম। তাই সবশেষে দেখি, তার চোখে একগুঁয়ে একটা উপহাস খেলা করছে, — তোমার লেখা কেউ পড়ে? কী বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি শব্দ!
আমার ভেতরের মানুষটা ছুরি-খাওয়ার মতো কেঁপে ওঠে।

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি এলেই টিভির স্ক্রল থেকে সে ঠিকই জেনে নেয়, এ-বছর কারা কারা সাহিত্যে পুরস্কার পেয়েছে। কতদিন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, তার আত্মীয়রা মাঝেমাঝে তার কাছে জানতে চায়, আমি সাহিত্যে কোনো পুরস্কার পেয়েছ কি না?

তার গলার স্বরে আর্সেনিকের মতো কঠিন একটা বিষ ঝরে পড়ে। আমি ফর্দ আর ক্যারেট নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ি, আজ যে-করেই-হোক কোকিলের গলা শুনব।
স্বপনকে ফোন দেই, — ছোটভাই তুমি কৈ?
— বাজারে।
শিবগঞ্জ বাজার এখান থেকে সিএনজি-অটোর ভাড়ায় চল্লিশ টাকার তফাতে। আমি ছোট ছিলাম। রাস্তায় গিয়ে একটা বাস পেলে দশটা টাকা বাঁচানো যাবে। ক্যারেট হাতে করে দৌড়ে গেট পেরোচ্ছি দেখে বাসচালক জোরে ব্রেক কষে। আমার মগজে টাকা ও সময়ের হিসাব কিন্তু বুকের মাঝে একহারা গতরের স্বপনের মিষ্টি হাসি। ছেলেটা অদ্ভুত! বিয়ের বয়স পেরিয়েছে অন্তত পাঁচ বছর। তার এক কথা, বিয়ে সে করবে না। দোতারা বাজায়, মাঝেমাঝে বললে বাজনার সাথে গায়ও। কী অসাধারণ দরদ দিয়ে সেতারে সুর তোলে, মায়াবন বিহারিনী…।

গ্রাম, ছোট ছোট হাওর আর নখের পিঠের মতো সমতল, সবুজ  চারণভূমি পেরিয়ে বাস জগন্নাথপুরের দিকে ছুটছে। রাস্তার পাশে সারি সারি গাছ। রেন্ট্রি, অ্যাকাশিয়া, ইউক্যালিপ্টাস। হিজল, তমাল, জারুলের দেশে বেলজিয়ামও আছে।

মাঝেমাঝে এক-দুইটা বরুণগাছের সতেজ মুখ। ডালে থোকা থোকা সাদা ফুল। বরুণফুলের গন্ধ কেমন বুনো বুনো। কাঠ দিয়ে কিচ্ছু হয় না। তাই হিসাবি মানুষের ছক্কা-পাঞ্জায় বরুণগাছও নির্মূলের দিকে।

বরুণফুলের গন্ধ হোক বুনো তবু আমি বাসের জানালা দিয়ে একঝলক দেখে নেই। বাসের শব্দের মাঝেও আশপাশের ছোট ছোট জংলাগুলোর দিকে কান পেতে রাখি, কোথাও কী কোকিল গাইছে?

কোকিল …, হায় কোকিল! শৈশব-কৈশোরের বসন্তদিনগুলোতে তোমার বিলাপে কান ঝালাপাল হতো। তোমাকে নিয়ে বাংলা ভাষায় কত গদ্য-পদ্য তবু তুমি আজ এই বাংলা থেকে প্রায় উচ্ছেদ!

হাতে ডিমের ক্যারেট নিয়ে কী করে আমি স্বপনের কাছে যাই? সে তরুণ বাউলশিল্পী ও চমৎকার বায়েন। কথা বলে খুব কম এবং আস্তে আস্তে। মাথার ছোট্ট টাকটা ঢেকে রাখার জন্য না স্টাইলের জন্য সে সবসময় একটা ক্যাপ পরে। জিন্স প্যান্ট, গোলগলা গ্যাঞ্জিতে তাকে যতটা মানায় তারচে বেশি ভালো লাগে যখন সে এই বেশে সেতার কিংবা দোতারা কাঁধে ঝুলিয়ে হাল্কা চালে হাঁটে।

কথামতো আমি ঠিক একঘণ্টার মাঝে শিবগঞ্জ বাজারে গিয়ে নামি। নেমেই দেখি ইটাখলা নদীর পুলের রেলিঙে হেলান দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠে দোতারা ঝুলছে। ছেলেটা দারুণ! আমার মনের কথা বোঝে। মাঝেমাঝে যদি মন বেশি খারাপ থাকে তাহলে ছাদে গিয়ে তাকে ফোন দেই, — একটা সুর শোনাও ভাই…।

একটু পরেই ওপাশ থেকে সেতারের করুণ সুর ভেসে আসে, ‘ক্যানে পিরিতি বাড়াইলায় রে বন্ধু, ছাইড়া যাইবায় যদি’ … আমি আকাশের দিকে মুখ রেখে ছাদে শুয়ে পড়ি, রাতের একলা আকাশ কী বিষণ্ণ, তারাদের চোখে কত কান্না!

দুইটা স্টার আর হাফলিটার পানি নিয়ে আমি এসে স্বপনের পাশে দাঁড়াই, — কোন দিকে?
— চলেন গলাকাটায়।
গলাকাটা শব্দটা শুনেও আমি চমকাই না। বসতবাড়ি, বাজার আর রাস্তা বাদে সুনাগঞ্জের সবটাই হাওর। আমার কাছে সুনামগঞ্জের একটা মানচিত্র আছে। মাঝেমাঝে ওটা চোখের সামনে মেলে ধরে শতশত হাওরের নাম দেখি আর মনের চোখে তাদের অঙ্গভরা সুধা পান করি।

আমরা ইটাখলা নদীর পার ধরে সিমেন্টে ঢালাই করা পথ দিয়ে হাঁটছি। আমাদের একপাশে হাওরের বরো জমিন আর অন্যপাশে নদী। নদীর বুকে কাদামাটির ছোট ছোট ঢিপি, জার্মনি কচু, ঘোলা পানিতে বিকালের চকচকা আকাশ, পলিথিন-প্লাস্টিকের আবর্জনা। আমার মনটা একটা ধাক্কা খায়। নদীর দিক থেকে আমি মুখ ফিরিয়ে নেই। চোখ সমান সবুজ হাওর আর ঢলেপড়া সুরুজের মিষ্টি আভায় আমার ভিতরের মরমটা জেগে ওঠে।

আমরা ঢালাই সড়ক ছেড়ে হাওরের মাঝ বরাবর মোটা একটা বাতর ধরে হাঁটতে থাকি। মোলায়েম গালিচার মতো ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছি। তারা এত জ্যান্ত-সবুজ! এত কিউট! জুতা পায়ে তাদেরকে মাড়াতে আমার বুকে লাগছিল। আশপাশে কেউ নাই দেখে আমি জুতা খুলে হাতে নিয়ে নেই। আহ! পায়ের নিচে আজব এক শিহরণ।

সামনে দিগন্তঘেরা সবুজ। মাঝেমাঝে বিদ্যুতের খুঁটি। তার ফাঁকে বিশাল হাওরের সবুজ বুকে উপুড় হয়ে পড়ে আছে নীল আকাশ। আমরা ধীরে ধীরে হাওরের গভীরের দিকে যাচ্ছি। সংসারের নুন-তেলের কলরব এখন আর কানে লাগছে না। নাই কোনো যন্ত্রের কর্কশ ধমক, আবর্জনার বাজে গন্ধ। দক্ষিণ থেকে তিরতির করে বাতাস আসছে। হাওরের শেষ সীমার গ্রামগুলো নারীর জোড়াভ্রুর মতো কালো আর বাঁক-খাওয়া। বাতাসে মাঠের ধান, ঘাস আর নানান জাতের লতাপাতার মিলিত সৌরভ! প্রিয়তমার গোপন শরীরের সুবাসের মতো সেই গন্ধ বড় চেনা, বড় মায়ার।

স্বপন আস্তে আস্তে তার এক দীক্ষাগুরুর কথা বলছিল। ফাঁকে ফাঁকে বলছিল বাউল মকদ্দস আলম উদাসীর কথা, হাসন রাজার কথা। সুনামগঞ্জের গ্রামগুলো ঘুরতে ঘুরতে তিনমাথা বুড়োদের কাছ থেকে হাছন রাজার ব্যক্তিজীবন বিষয়ে এত জেনেছি যে, স্বপন যখন বলে, হাসন রাজা যৌবনে নাকি পঞ্চাশটা বিয়ে করেছিল তখনও আমি অবাক হই না।

হাওরের গভীরে এলে আমার ভিতরটা জানি কেমন খালি হয়ে যায়। নিজেকে নিঃস্ব, নফর মনে হয়।

আমরা এসে বসলাম একটা তরুণ বরুণগাছের ছায়ায়। এখন বিকালের রোদের লাল আভায় হাওরের সবুজ জমিনে রঙের খেলা একটু একটু করে জমে উঠছে। এই খেলা হৃদয়ের রং দিয়ে ধরতে হয়, নশ্বর জীবনের করুণ রাগিনীর মতো এই খেলা বড় মায়াবী, বড় ক্ষণস্থায়ী।

আমি দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেদিকে সিমেন্টের ঢাইল সড়ক, মসজিদের গম্বুজ, ছোট আর কালো-কালো মানুষের আনাগোনা। কিন্তু কোনো কোকিলের সাড়া নাই। জানি জগতটা ক্ষয়ের। লোপ পাওয়াই জীবের ধর্ম।

টাকা হলো না, সাহিত্য হলো না …, আপনজন আর আত্মীয়রাও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বউটাও পাত্তা দেয় না। আমার জানি কেমন লাগে…। বুকের মাঝে ইঁদুরের মতো মুখ গুঁজে কে জানি হঠাৎ হঠাৎ কেঁদে ওঠে।

আমি ঠোঁটের বিষাদে সিগারেট গুঁজে দিয়ে লাইটার মারি। স্বপনকেও একটা দেই। জিন্সের পকেট থেকে সে সিদ্ধির পোঁটলা বের করে। মুচড়ে মুচড়ে সিগারেটের তামাক বের করে টাচফোনের চওড়া বুকে রাখে। হাতের তালুতে তৈরি হচ্ছে জিনিস। আমি আর দেখি না। আমার এইসব লাগে না। কেন জানি এমনিতেই আমি চব্বিশঘণ্টা বুঁদ হয়ে থাকি। বুকের মাঝে কত কত মানুষ, কত কত হাসিকান্না, সুখ-অসুখ।

স্বপন জানে আমি সিদ্ধি দূরে থাক রোজ দুই-একটার বেশি সিগারেট খাই না। তবু আমার ইচ্ছা করে স্বপনের হাত থেকে স্টিকটা কেড়ে নিয়ে লম্বা লম্বা কয়টা টান দেই। তারপর গোঁফে তা দিয়ে, চোখ লাল করে এসে বউকে বলি, — আমি টাকার জন্য, পুরস্কারের জন্য লিখি না।
কিন্তু জানি ওতে লাভ হবে না। সে হেসে বলবে, — তোমার লেখা আমারই ভালো লাগে না আর কে পড়বে?

স্বপন হাতের সিগারেট ফেলে, মগ্ন হৃদয়ে দোতারায় সুর তুলে, — গ্রামছাড়া অই রাঙামাটির পথ…।

আমি দিব্যি চোখে দেখি বুড়োটা বোটের খোলে, গদি-আঁটা চেয়ারে বসে লিখছে। দূরে পদ্মার ধু ধু চর।

আমি বরুণের দেহে হেলান দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকি। মনের দরজা-জানালাগুলো একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। স্বপনও আত্মা উজাড় করে লালন বাজাচ্ছে, — আমি অপার হয়ে বসে আছি…।

তারপর উদাসী, দুর্বিণ শাহ, শাহ আব্দুল করিম। সবার শেষে সে বাজায় হাছন রাজার ‘আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার’…।


ইসহাকপুর ।। ১৩ মার্চ ২০২১


প্যারা ২

এই লিঙ্কে ক্লিক করে শেখ লুৎফর প্রণীত ছাব্বিশখণ্ডে সম্পূর্ণ ‘জয়ধরখালী’ অ্যাভেইল করুন

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you