গুড্ডি
শৈশবে কত ঘুড়ি উড়িয়েছি ইয়ত্তা নেই। পুরাতন ক্লাসের খাতার কাগজ, বড়শির চিকন সুতো অথবা সাদা ভান্ডুল (শুদ্ধ নাম মনে নেই) আর বাঁশের চিকন কাঠিই ছিল অবলম্বন। ঘুড়িকে আমরা ডাকতাম ‘গুড্ডি’। গ্রামের আকাশজুড়ে গুড্ডি উড়ত। কত ধরনের গুড্ডি যে ছিল, আজ অনেকগুলোর নামই (অবশ্যই আঞ্চলিক নাম) মনে নেই। চিলা গুড্ডি, পেটকাটা গুড্ডি, বাক্স গুড্ডি, প্লেইন গুড্ডি, সাপ গুড্ডি এবং মানুষ গুড্ডির নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি। তিনজন মানুষের কথা বিশেষ মনে পড়ে, যারা সব রকমের গুড্ডিই বানাতে পারতেন। রফু ভাই, হাফিজুল ভাই ও আমির ভাই। রফু ভাই নাই। প্রথম যৌবনে হঠাৎই লোকটি ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে না-ফেরার দেশে চলে যান। তার বাক্স গুড্ডি, মানুষ গুড্ডি, সাপ গুড্ডি অবাক হয়ে দেখতাম। তার মতো এত ভালো কেউ বানাতে পারত কিনা জানি না। হাফিজুল ভাই ও আমীর ভাইয়ের গুড্ডি মানেই ছিল পেটকাটা আর প্লেইন গুড্ডির বাহার। তারা এখন কী আর গুড্ডি বানান কি না, জানি না।
কয়েক বছর আগে একবার একটানা বহুদিন গ্রামে ছিলাম। আকাশে কখনোই ঘুড়ি দেখিনি। প্লেইন গুড্ডি, বাক্স গুড্ডি না হোক একটা চিলা গুড্ডিও দেখিনি। কারণ আমাদের সময়ের প্রায় যেকোনো বালকের জন্য একটা চিলাগুড্ডি বানানো ডালভাত ছিল। বিশেষ ধরনের গুড্ডি বিশেষ কয়জনেই বানাতে পারতেন। স্কুলের মাঠে একবার ঘুড়ি ওড়ালে তা সন্ধ্যার আগে সহজে নামত না। ক্লাসের সময় হলে ঘুড়ির সুতা গাছের ডালে বাঁধার অভ্যেস প্রায় সকলেরই।
আজ এই সময়ে এসে ব্যাগের ভারে ক্লান্ত শিক্ষাব্যবস্থার মন্ত্রীরা কি মাঠ ও ঘুড়ির খবর রাখেন। বিকশিত শৈশবের জন্য একটি ঘুড়ির কথা কি তারা গুরুত্বের সাথে নেন?
২০ এপ্রিল ২০১৯
মাঠ
মাঠ হারিয়ে যায় পদ্যবইয়ের নাম-পদ্যের শেষের স্তবকে কবি তুষার কর লিখেছেন, ‘মাঠের ওপর বাড়ির সারি / খেলব এখন কই?/ মনখারাপের এই বিকেলে / একলা বসে রই।’ মন খারাপের এই বিকেল বড়ো দীর্ঘায়িত হতে হতে প্রায় নাই হয়ে গিয়েছে। দেশটি শিশুবান্ধব করতে পারিনি আমরা। পথভ্রষ্ট শহরের সাথে গ্রামও ধীরে ধীরে বিপথগামী হচ্ছে। পরিমিত খেলার মাঠ নেই, পুকুর নেই, দিঘি নেই, পার্ক নেই, পাঠাগার নেই_ নেই! নেই! নেই! অনেক কিছুই নেই। যা আছে তাও হারিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থার কালো থাবায়। শুধু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্নীতি, বাড়ছে উপসনালয়, বাড়ছে মৌলবাদ আর সর্বগ্রাসী ফ্যাসিবাদ। স্মার্ট শব্দের অর্থ যদি ধরে নিই চৌকষ তবে তো খাঁচাপোষা শিশুদের দিয়ে আগামীর দেশপ্রেমিক চৌকষ বিশ্বনাগরিক জনতার প্রত্যাশা বাতুলতা মাত্র।
বাচ্চারা সাঁতার শিখবে কোথায়? দৌড়ঝাপ করবে কোথায়? সাইকেল চালাবে কোথায়? খেলবে কোথায়? দম ফেলবে কোথায়? পাঠাভ্যাস গড়বে কোথায়? প্রকৃতির সঙ্গ নেবে কোথায়? স্মার্ট ফোনে? আমরা কোন পথে হাঁটছি? একজন মানুষের মনোস্বাস্থ্যের মূল ভিত্তি তো রচিত হয় তার শৈশবে। নড়বড়ে ভিত্তি দিয়ে কী টেকসই উন্নয়ন হয়?
গ্রাম তো গ্রামই থাকার কথা। গ্রামকে নাকি আমরা দিচ্ছি শহরের ছোঁয়া। তো সে কোন শহর? খাঁচাবন্দি মানুষের শহর? শহুরেপনার উন্মত্ত ধারনায় গ্রামগুলোও দিন দিন খাঁচা হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়াচ্ছে। পুকুরে সাঁতার ঝুম ঝুম আওয়াজ কমে আসছে। স্কুলঘরের দেওয়াল থেকে ফিরে আসা ফুটবলের আওয়াজ নেই বললে চলে। স্কুলের বাউন্ডারিতে তালা লেগেছে। দেওয়াল ময়লা হওয়ার অজুহাতে বন্ধ সিংহভাগ স্কুলচত্ত্বর। কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, লুকোচুরি, দাড়িয়াবান্ধা, বন্দী সকল খেলাই যেন দিনদিন ছুটি নিয়ে পরবাসী হয়ে গেছে। আকাশভরা ঘুড়ির দেশে শিশুদের আকাশ দেখতে হচ্ছে স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে? সত্যিই দিনদিন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে হাঁটছি আমরা!
১০ জুলাই ২০২৪
চারাগাছ
সকল শিশু এক রকম নয়। কেউ হয়ত একটু চটপটে । আবার কেউ লাজুক বা মুখচোরা। বড়োদের কেউ মনে করেন চটপটে হওয়া দোষের, আবার কেউ মনে করেন লাজুক হওয়া দোষের। এতে করে সবচেয়ে বিড়ম্বনার শিকার হয় শিশুরা। নিজেদের নিয়ে তখন তারা হীনমন্যতায় ভোগে।
শিশুদের সাথে সম্পর্ক গড়তে, বিকাশ নিশ্চিত করতে সরাসরি “দোষ ধরা” বা “না বলা”-র মতো বিপজ্জনক বিষয় পরিহার করতে হবে। ইতিবাচক আলাপ ও অনুপ্রেরণার মধ্য দিয়ে তার সাথে সংযুক্ত হতে হবে। তবেই তার ভেতরের মানুষটিকে পূর্ণমাত্রায় জাগানো সম্ভব হবে। আপনি হতে পারেন অভিভাবক, স্কুলের শিক্ষক, প্রতিষ্ঠাতা, সমাজের যেকোনও স্তরের প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ। আপনি প্রেম ও সমবেদনা নিয়ে বাচ্চাদের সাথে সম্পর্ক পাতুন। তাদের কারো অঙ্গভঙ্গি, মুদ্রাদোষ, কথার ধরন, গায়ের বর্ণ, শরীরের আকার প্রভৃতি নিয়ে মজা করা থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকুন। না হয় আপনি হয়ে উঠবেন অঙ্কুরবিনাশী শুয়োপোকা, যার সৃজন ও মননে মানবিক ধ্যান নেই, নেই ইপ্সিত বিকাশের সামান্য লক্ষণ।
বিশেষত স্কুলওয়াদের সাবধান হওয়া বেশি জরুরি। বাচ্চারা কোনও পণ্য নয়, আপনার তথাকথিত সাফল্যের মিথ্যা বিজ্ঞাপনের নয় কোনও উপাদান। ওরা সমাজ, দেশ ও পৃথিবীর সম্পদ। ওরা চারাগাছ — ওদের বাড়তে দিতে হবে বাধাহীন।
১০ জুলাই ২০২৪
- কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম ১ || জয়দেব কর - May 30, 2025
- ছুরির ডগায় মধু / শিন ইউন :: ভাষান্তর / জয়দেব কর - May 16, 2025
- মুক্তির পথে বুদ্ধ : অভাজনের ভাবনা || জয়দেব কর - May 11, 2025
COMMENTS