আমাদের কাছে ঈদ মানেই ছিল নতুন চাঁদ, নতুন জামা — ধুমসে খাওয়াদাওয়া, আর বড়দের শিথিল শাসন, আব্বা-চাচাজানের বাড়ি ফেরা।
ঈদের আগে থেকেই দিদির মহাব্যস্ত সময়। ছেলেরা ঈদের পরবে বাড়ি আসছে, ধোয়াপাকলা না-করলে কেমন হয়? চাদর, বালিশের ওয়ার, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি যত আছে সব ক্ষারে দাও। ঘরদোর লেপেপুছে ঝকঝকে তকতকে রাখো।
ক্ষারে দেওয়া মানে সোডা আর গরম পানিতে কাপড় সেদ্ধ করা। সেই সেদ্ধ কাপড় পুকুরের পাড়ে নিয়ে পিঁড়ি পেতে আছড়েপিছড়ে ধোয়া। দিদির এমনই পরিষ্কারের বাতিক ছিল যে এই ক্ষারজলে পুরনো অব্যবহৃত কাপড়চোপড়, ছেঁড়া কাঁথা, মশারি ইত্যাদিও দিয়ে দিত।
বাড়ির চারপাশের আগাছা-জঙ্গল কেটেকুটে সাফ করে, ঘরের ডোয়া নিকিয়ে-লেপে একেবারে মহা-হুলুস্থুল কাণ্ড যাকে বলে!
ঈদের আগের দুই-তিন হাট থেকে এত এত বাজার-সওদা বাড়িতে আসত যে, দাদাজান কুলি ভাড়া নিত। সেই কুলির মাথায় কালিজিরা, বাসমতি, ঘি, তেল, লবণ, তেজপাতা, সেমাই আর চিনির বোচকা।
পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধে সারাবাড়িতে ঈদ লেগে যেত। মশলা পিষতে বসতো তিন-চারজন কাজের মহিলা। শিল-পাটাতে বাটনা বাটার শব্দেই যেন আমাদের ঘরে ঈদ-আনন্দ একেবারে খলবলিয়ে উঠত।
আমাদের ঘরে সবার জন্য নতুন জামাকাপড় একেবারে অবধারিত ছিল। নতুন জামাকাপড় পরার সাথে সাথে আরো কিছু রেওয়াজ চালু ছিল — ঈদের দিন নতুন সাবান দিয়ে গোসল করা। পুরাতন সাবান কেসেই পড়ে থাকত। মোড়ক খুলে একেবারে গন্ধ-ম-ম সাবান চাই। ফলে কসকো, লাক্স, লাইফবয়ের ঘ্রাণে ফুরফুরা হয়ে গোসল করা ঈদের দিনের অনুষঙ্গ ছিল।
ঈদের দিন আম্মা-চাচিমারা তাদের তোরঙ বা আলমিরা খুলে বের করে আনত গয়নাগাটি। গয়নাগাটির সঙ্গে বেরিয়ে আসত ন্যাপথলিনের সুঘ্রাণ। নানান বাহারি ব্লাউজ বা কাপড়ের চেহারা আমরা ওইদিন খুব ভালো করে দেখতে পেতাম।
গয়না পরা ছিল জাকাতের অংশ, পরতেই হতো। ফলে ঈদের দিন আমরা আম্মা-চাচিমাদের অন্য রূপেও দেখতে পেতাম।
ঈদের দুইদিন আগে থেকেই রান্নাবান্নার ধুম চলত। আমাদের অন্দরমহল মহাব্যস্ততায় দিন কাটাত। আমাদের দিকে খেয়াল করার সুযোগ পেত না। আর সেই ফাঁকে আমরা দুষ্টামি ঝালাই করে নিতাম।
ঈদের জামাত শুরু হওয়ার আগেই বাড়ির প্রায় সকলেই গোসল সেরে নিত। দিদি গোসল সারত ভোরের কাকডাকার আগে। এতে নাকি বেহেস্তে যাওয়া সহজ হয়। তবে আম্মা-চাচিরা এত কাজের চাপে ভোর-ভোর গোসল সারতে পারত না। কিন্তু দুপুরের খাওয়ার আগে সকলের গোসল সম্পন্ন হয়ে যেত। এটা না-হলে দাদাজান, চাচাজান ও আব্বা ভয়ানক রাগ করত।
আমরা ছোটরা মুখিয়ে থাকতাম ঈদগাহে যাওয়ার জন্য। এটা আমাদের জন্য প্রচণ্ড লোভনীয় ছিল। আমাদের বাড়ির ছোট-ছোট মেয়েরাও ঈদগাহে যাওয়ার সুযোগ পেত। বড়রা টুপি-পাঞ্জাবি পরে হাতে জায়নামাজ ঝুলিয়ে মাঠে যেত। ঈদগাহ ময়দানকে সবাই বলত মাঠ। আমি মেয়ে হয়েও এই মাঠে যেতে পারতাম।
পুরুষরা সার বেঁধে জামাতে দাঁড়াত। আমরা বাচ্চামেয়েরা জামাতের একেবারে শেষে নতুন জামা পরে, সেজেগুঁজে দাঁড়িয়ে থাকতাম।
নামাজ কখন শেষ হবে সেজন্য অধীর প্রতীক্ষা করতাম। কারণ নামাজ শেষেই তো আমাদের জন্য আসল ভেলকি অপেক্ষা করত। ঈদগাহের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে থাকত রঙিন বেলুনওয়ালারা। নানান কিসিমের বাঁশির হাতছানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত বাঁশিওয়ালারা। বড়রা নামাজ শেষ করেই আমাদের কিনে দিত সেই রঙিন বেলুন, বাঁশি, অথবা বেলুন-লাগানো বাঁশি। সেই বাঁশির বেলুন ফুলিয়ে প্যাঁ-পোঁ করতে করতে আমরা বাড়ি ফিরে আসতাম। আসলে আমাদের ঈদ ছিল ওই রঙিন বেলুন ও বাঁশিকে ঘিরেই।
ঈদের জামাতে যাওয়ার আগে বড়দের জন্য দুধসেমাই ও জর্দা খাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। আরো বাধ্যতামূলক ছিল চাঁদ দেখা। খালপাড়ে দাঁড়িয়ে গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে আমরা অনেক কষ্টেমষ্টে চাঁদ দেখতাম। ঈদের চাঁদ দেখে দিদি মোনাজাত করত।
ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে আরো একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটত। জামাত শেষ হলে দাদাজান-আব্বাকে দেখতাম ডাক্তারবাড়িতে যেতে এবং তারা ওই বাড়ির একটা বিশেষভাবে-বাঁধানো কবর জিয়ারত করে আমাদের বাড়িমুখো হতো। ওই কবরটা ছিল আমাদের দাদাজানের মায়ের কবর। তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী বাপের বাড়িতেই গোর দেয়া হয়েছিল। ফলে দাদাজানরা তাদের মায়ের কবর জিয়ারত করে এসে বাবার কবর জিয়ারত করত।
পুরুষরা ঈদের নামাজ পড়ে এলেই শুরু হতো খানাদানা। বাড়ির পুরুষরা সকলে আমাদের ঘরে একসাথে খেতো। তখন অন্য শরিকরা বাটি বা গামলা করে নিজেদের-রান্না-করা খাবার সকলের সামনে দিয়ে যেত। যেহেতু পোলাও-কোর্মা-কালিয়া সবার ঘরে প্রস্তুত হতো না, ফলে আমাদের ঘরে দস্তরখানা পেতে বা টেবিল-চেয়ারে বসে একসঙ্গে খেতো সবাই। খাবার শেষে দই, পায়েস, ফিরনি খেতো প্রায় চেটেপুটেই। খাওয়ার পর অন্দরমহলের সবাই ঝলমলে কাপড় ও গয়না পরে একে অন্যের ঘরে যেত। পুরুষরা বিছানায় গড়াগড়ি দিত বা আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়ে পড়ত। ছোটরা বাড়ির বড়দের পা ছুঁয়ে সালাম করত। এজন্য কোনো সেলামি কেউ পেত না। প্রায় সারাদিনই কেউ-না-কেউ বেড়াতে আসত।
সে ছিল এক মহামিলনের দিন!
… …
- সুরমাসায়র ১২ || পাপড়ি রহমান - July 8, 2020
- সুরমাসায়র ১১ || পাপড়ি রহমান - July 2, 2020
- সুরমাসায়র ১০ || পাপড়ি রহমান - June 23, 2020
COMMENTS