পঞ্চাশ দশকের কবি আল মাহমুদ অবধি বিস্তৃত আবহমান বাংলার কাব্যিক ভাবব্যঞ্জনা আত্মস্থ করে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ‘পুলিপোলাও’ পৃথক অবয়ব নিয়ে হাজির হয়েছিল শূন্য দশকের গোড়ায়। বিগতের সঙ্গে চলমান সময়ের প্রভেদ ও বিচ্ছেদের মাঝে নিয়তিসন্ধানী কবির সরস বাকচাতুর্য পাঠকহৃদয়ে নতুন আস্বাদ এনে দিয়েছিল। ‘পুলিপোলাও’-র অবয়ব জুড়ে মধুসূদনের বঙ্গ ধ্রুপদি ছন্দে এন্তার রং ছড়ায়, ত্রিশের সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চকিত বিক্ষেপে সে-ভাষামুকুরে মুখ ব্যাদান করেন, মঙ্গলকাব্যে ভরভরন্ত মধ্যযুগ কিংবা ‘সোনালী কাবিন’-এ মমিকৃত লোকায়ত বাংলার অনুষঙ্গরা সেখানে আসে-যায়, যদিও স্মৃতিকাতর এইসব চিহ্নের স্মরণ ‘প্রবাসে দৈবের বশে’ নিয়তি যাপনে বাধ্য কবির মনে উপশম ঘনাতে বিফল হয়! ‘বাস্তুহারা গোধূলিবেলায়’ জটপাকানো বিগত স্মৃতির ভেলায় চড়ে এ-ঘাট থেকে ও-ঘাটে ঠোক্কর খাওয়া কবি অতএব নিজেকে নিয়ে মশকরা জোড়েন। মশকরার ধরনটি পাল্টে-যাওয়া কালপর্বে তাঁর হালত চিনিয়ে যায়। অতিকল্পনায় পরিণত ঐতিহ্যকে প্রত্যাখ্যানের বাসনা কবির মনে তীব্র হয়ে ওঠে না, আবার একে গ্রহণও কি করেন? ‘পুলিপোলাও’ অগত্যা সময়ের ঘূর্ণিস্রোতে ভ্যাবাচ্যাকালাগা ‘ব্যক্তি আমি’-র নাজেহাল দশাকে মশকরার ছলে নগ্ন করে যায় :—
এই পূতিগন্ধময় মৃতদেহ নিয়ে
আমি ভেসে এসেছি অনেক দূর, অনেক বন্দর।
আমিই বেহুলা, আর আমি লখিন্দর।
নিজেরে সুবিধামতো গাঙুড় বানিয়ে
নিজেরই মান্দাসে আমি চলেছি ভাসান।
এক ঘাট-দুই ঘাট-বত্রিশ ঘাটার
পরখ করেছি শান :
অতঃপর ঠেকে গেছি, ফেঁসে গেছি, ঝরোকা-কাটার
এই চরে, এ-হাটায়-কারিগরগণ যেথা সারিবদ্ধ, স্তব্ধ অপেক্ষায়,
জুরাসিক যুগ থেকে; আমার প্রেক্ষায়
তারা ঠুকে ঢুকিয়েছে অদ্ভুত প্রিজম-
জীবন-মরণ, তথা দুঃখ-সুখ, সাদা কিংবা কালো
অগত্যা খশিয়া গিয়া, অন্য এক আগন্তুক আলো
পাঁজরের মাঝখানে খুঁড়েছে কী-গূঢ় জমজম…
(পুলিপোলাও ২৩)
গোমেজের মশকরাঘন প্রগাঢ়তা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এখন অবধি স্থানান্তর ও অভিযোজনার নাটকীয় বিড়ম্বনায় সচল মানবপ্রজাতির সঙ্গে ব্যক্তিকে একীভূত করে। স্থানিকতার নতুন পরিসরে ব্যক্তি গোমেজের খাপ খাওয়ানোর কাহিনি ভানতে বসে ‘পুলিপোলাও’ অগত্যা মনুষ্যপ্রজাতির ইতিহাসে আপাত সর্বশেষ উত্তরজীবী হোমো স্যাপিয়েন্সের ঐতিহাসিক বিবর্তনের অঙ্গে নিজেকে জুড়ে বসে। ব্যক্তিসমগ্রর নিয়তিরঙ্গে ব্যক্তিসত্তার খাবি খাওয়ার বিবরণে তাই রস ও পরিহাস দুটোই ছলকায়। অগ্রজদের ভাষাবিশ্বে চরে খাওয়ার ক্ষণে মশকরাঘন প্রগাঢ়তা কবিদেরকে পৃথক সড়কে মোড় নিতে তাড়া দিচ্ছিল ওই সময়টায়।
- মধ্যনগরে বঙ্গাব্দবরণ ১৪৩২ || বিমান তালুকদার - April 18, 2025
- অতি সাধারণ ঋণ বা ন্যানো ক্রেডিট || হুমায়ূন আকাশ - April 17, 2025
- গাজায় মৃত শিশুর ভর্ৎসনা || মোহাম্মদ জায়েদ আলী - April 12, 2025
COMMENTS