ফারুক ওয়াসিফ উনার নিজস্ব একখান ভাবাদর্শের মোড়কে বসে লেখেন। নয়াপুঁজিবাদে আগাগোড়া রঙ-করা দুনিয়ায় বইসা লেখেন। যার কিয়দংশ এখন আমাদের এইখানেও ক্রমশ ঢুকতেসে, তার মধ্যে বইসা লেখেন। এর সাথে আবার পুরান পাপী পুঁজিবাদের বদলক্ষণগুলাও সদর্পে নিজেকে জাহির করে এখানে। ওয়াসিফ তার মধ্যে বইসাও লেখেন। নয়া ও পুরানা দুই পাপীর মধ্যকার বুলফাইটিংয়ের মাঝখানে যে-পড়ছে তার কিন্তু কম্মো সাবাড়। বাঁচার একটা উপায় হইতেসে শর্টকাট নেওয়া। ওইটা তারে লড়াইয়ের ময়দান থেকে স্কিপ করতে সাহায্য করে। নিরাপদ দূরত্বে সে তখন চইলা যায়। দর্শক হয়। মত্ত দুই ষাঁড়ের শিংয়ের চিপায় যারা আটকা পড়ছে তাদের দুর্দশাটা নিরাপদ দূরত্বে বসে বেশ অবজার্ভ করতে পারে। এক্সপ্লোরও হয়তো করে। ফারুক ওয়াসিফ যেমন প্রথম আলোয় বইসা কাজটা একসময় করছেন। এখন বোধহয় সমকাল-এ বইসা করতেসেন। অনেকদিন বাদে তাঁর লেখা পড়ে সেরকম ধারণা হইল।
যা-ই হোক, শর্টকাটকে বাংলাদেশের কনটেক্সটে উনি মার্ক্সবাদ বইলা বোঝেন মনে হয়। তার ওপর নিজের স্বত্বও খাটান। দেশের ফোঁপরা মধ্যবিত্ত এককালে যেমন খাটাইতেন আর কি! আধো ঘুম আধো জাগরণে চলতে থাকা খোঁয়ারিকে আমরা একসময় মার্ক্সবাদ বইলা বুঝতাম। সাম্য নজদিক ভেবে মনে-মনে পুলকিত হইতাম বেশ। ফারুক ওয়াসিফ এখনো সেইটা আঁকড়ে বসে আছেন দেখে অবাক হইলেও ব্যাপারটা কিন্তু মন্দ লাগে নাই। স্মৃতিকাতর দীর্ঘশ্বাস উনি বহন করতেসেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত যার মধ্যে একদিন বিচরণ করতে ভালোবাসত। দীর্ঘশ্বাসটা অনেককিছু মনে করায়। মধ্যবিত্তের সেইসব দলছুট দিন! চায়ের কাপে রাজাউজির মারা দিন। আন্দোলন আর বিপ্লবের খোয়াবরঙিন দিন। ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু / বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’-র আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান দিন। ‘আমারো তো বয়স হচ্ছে / রাতবিরেতে কাশি / কাশির দমক থামলে কিন্তু বাঁচতে ভালোবাসি’-র জোয়ারে নিজেকে চনমনে রাখার দিন। তো এই জায়গা থেকে ‘মধ্যবিত্তের দিন কি শেষ?’ লেখাটার জন্য শাবাস উনি দাবি করতেই পারেন।
অনেকদিন বাদে মধ্যবিত্তের ক্রাইসিস নিয়া কাউকে অবেশেষে লিখেতে দেখতেসি। ছুরি হাতে সীমার হয়ে লেখাটা তিনি লেখেন নাই। পাঠ যাওয়ার পর কেউ নির্মলেন্দু গুণ আওড়ে বলবে না : ‘বুকের উপরে তুমি খঞ্জর হাতে বসে আছো সীমারের মতো / ক্যামেলিয়া, তুমিও কি ব্যর্থ-প্রেম? তুমিও কি প্রেমের সীমার?’ সীমারের মতো খঞ্জর হাতে মধ্যবিত্তবুকটায় বসেন নাই ফারুক ওয়াসিফ। লিখসেন দরদ দিয়া। স্মৃতিকাতর জখমগুলা বুকে গুম করে মধ্যবিত্তকে উন্নয়নের পিছনে ঘুরে নিজের মানইজ্জত খোয়ানোর বদলা নিতে গণতন্ত্রে ফেরত আসার ডাক দিসেন। শ্রেণিটারে সবাই তো দেখি খালি গালমন্দই করেন! যারা এখানে বিলং করেন, তারা করেন। যারা বাহির হইতে ছটফট করেন কিন্তু দিনের শেষে বাহির হইতে পারেন না, তারাও জুতাপেটা সমানে করতেই থাকেন। হয়তো দেখেন না যে, থুতুটা নিজের উপ্রে আইসা পড়তেসে। ফারুক ওয়াসিফ ওই পথে হাঁটেন নাই। নিজের মধ্যবিত্ত সত্তাটাকে উনি ডিনাই না করে গ্রহণ করতেসেন দেখে ভালো লাগসে। হইতে পারে সত্তাটা আধো ঘুম আধো জাগরণের খোঁয়ারিতে বুঁদ, তবু ভালো লাগসে পড়ে। তাঁর লেখাটাকে, বলতে দ্বিধা নাই, অনেস্ট মনে হইসে আমার।
খোঁয়ারিবুঁদ মধ্যবিত্তসত্তা, যাকে অনেকদিন বাদে কেউ ফিরে দেখতেসেন, মিথ্যে নয়, ষাট-সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দিনগুলায় দেশ জুড়ে ওই সত্তাটা বিরাজ করত। তার পকেটে টাকাকড়ি ছিল না কিন্তু মানইজ্জত পাইতেসে ভেবে আত্মতৃপ্তি বোধ করত। সত্তাটা এখন কিনা না-ঘরকা না-ঘাটকা অবস্থায় কালাতিপাত করে! লেখার ভালো দিক যদি বলি তাইলে বলা উচিত হয়, ফারুক ওয়াসিফ আয়না হিসেবে তারে ব্যবহার করতে ত্রুটি করেন নাই। নিজের মুখচ্ছবি দেখার চেষ্টা করসেন তার মাঝারে। আমরা নিজেও তো কমবেশি মধ্যবিত্ত এই সত্তাটারে যখন-তখন রিকল করি। তোমার দেখা নাই গো বন্ধু ভেবে, লোকটারে মরহুম ঠাউরে আমাদের মনখারাপ হয়। স্মৃতিকাতর হই। সম্ভব না জাইনাও ফেরত আনতে চাই তারে। অনেস্ট এই কনফেশন লেখায় উনি বজায় রাখসেন।
মধ্যবিত্তের ক্রাইসিসকে মার্ক্সবাদের চশমা চোখেই নিরিখ করসেন ফারুক ওয়াসিফ। চশমাটা সাদাকালো, রঙিন না, তা-বলে পাতিবুর্জোয়া শ্রেণিটারে দেখার নাম করে তার ওপর নিষ্ঠুর হন নাই। সত্যিই তো শ্রেণিটা এখন আক্ষরিক মাইনকাচিপায় আছে। অন্যদিকে নয়াপুঁজিবাদ ও পুরানা আমলের দুবৃত্ত পুঁজিবাদের গুঁতাগুঁতির মাঝখানে পিষ্ট হইতে থাকা শতভাগ আপসকামী উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত আর ক্রমশ জ্ঞান-মান-মেধায় নিম্নগামী ও সকল দিক দিয়া অকর্মার ঢেঁকি মধ্যবিত্ত কেন পরাজিত হইতেসে বারবার? — সওয়ালের জবাব যদি পাইতে চাই সেক্ষেত্রে ফারুক ওয়াসিফ স্বয়ং, এবং সেইসাথে তাঁর লেখাটা আয়নার কাজ দিতে পারে, যে-আয়নায় আমরা কমবেশি প্রতিবিম্বিত হইতেসি।
উন্নয়নের পিছু নিয়া উপ্রে ওঠার সিঁড়ি খুঁজতে থাকা মধ্যবিত্ত দিন শেষে বাঁশ খাইছে এই কথা ধ্রুব সত্য। ক্ষুদ্র একটা অংশ হয়তো উন্নয়নের পোন্দানি সহ্য করে উপ্রে উঠসে, নতুন ঢাকায় আমরা তাদের ডাঁট মেরে চলতে-ফিরতে দেখি, এর বাইরে পইড়া-থাকা মেজরিটির কিন্তু টিসিবির ট্রাকের পেছনে দাঁড়াইতে বাকি নাই। শরমে দাঁড়াইতেসে না। সত্তরে মুজিব সরকার যেমন সর্বজনীন রেশনিং চালু করসিলেন, ওইরকম একটা কিছু হাসিনা সরকার করলে পালে-পালে লাইন দিত। মোদের আব্বাদের তখন রেশনে লাইন দিতে দেখসি নিজ চোখে। এখন আমরা যারা আব্বা হইসি, রেশনিং থাকলে দাঁড়াইতে দ্বিধা করব না। এই মধ্যবিত্ত হইতেসে মোটা দাগে ফারুক ওয়াসিফের সেই মধ্যবিত্ত যাদেরকে মিন করে লেখাটা তিনি লিখসেন। প্রশ্ন হইল, তারা তো গণতন্ত্রের পাছা হাতাবে বলে পাকিস্তান বা তারো আগে থেকে তার পেছনে ঘুরতেসে। কোন কলাটা কপালে জুটছে তাদের? উত্তরটা লেখায় থাকলে ভালো হইত। না থাকায় গণতন্ত্র নিয়া স্বয়ং ফারুক ওয়াসিফের ভাবনার দিশা পাওয়া গেল না! ওইটা কি তাইলে আধো ঘুম আধো জাগরণে দেখতে থাকা খোয়াব? এমন খোয়াব, যার লেজ দেখা যায় কিন্তু মাথা নাই বইলা ভ্রম হইতে থাকে!
খোঁয়ারিবুঁদ মধ্যবিত্তের মগজে শান দেওয়ার তরিকা, যার উপ্রে দেশের নগরসংস্কৃতি ভর দিয়া চলে, আখেরে ওই হ্যাংওভারটায় নিজেকে শহিদ হইতে দেখসে। পরিস্থিতি এখনো তা-ই আছে। এইটা ঠিক, আগের খোঁয়ারিতে মানইজ্জত ছিল মাগার টাকাপয়সা ছিল না। উন্নয়নখোঁয়ারিতে তার ভাগে জুটছে কাঁচকলা। মানে দাঁড়াইতেসে, ফারুকের মধ্যবিত্ত বিস্তর মেহনত শেষে রেনিগেড বিপ্লবী বনতে পারে নাই। শ্রেণিকরণ তারে যেখানে জন্ম নিতে মজবুর করে তুলসিলো সেখানে বিলং করে ওই অবস্থায় নিজেরে নিয়ে যাওয়া কঠিন। সৎ চেষ্টা অনেকেই করসিলেন তবে কামিয়াব হইতে পারেন নাই। কেন পারেন নাই তার ব্যাখ্যা কিন্তু মার্ক্সে আছে। শ্রেণিটার শিকড় ও গাছ হইতে থাকার পদ্ধতি তিনি বুঝতে ভুল করেন নাই। জাত ঠিক চিনছিলেন। সমাজবদল আন্দোলনের সংকট হইতেসে মধ্যবিত্ত ওই শ্রেণিটারে বাদ দিয়া কোনো আন্দোলনের গোড়াপত্তনে সে গমন করতে পারে নাই। ঘটনাখান একদিক দিয়া বিচার করলে খোদ মার্ক্সের মজবুরি মানতে হয়। মার্ক্সবাদের তো বটেই! ফারুক ওয়াসিফের মধ্যবিত্ত, যারে তিনি গণতন্ত্র ফেরত আনতে রাজপথে নামতে বলতেসেন, ওই মধ্যবিত্তের যোগ্যতা লেখায় তিনি যাচাই করেন নাই। বিষয়টা নিয়া তাঁর মনে কোনো প্রশ্ন নাই দেখে হতাশ হইতে হয়!
আমাদের কনটেক্সটে দূর ও নিকট অতীতে যত আন্দোলন মধ্যবিত্তের কারণে আমরা ঘটতে দেখসি তার মেরিট নিয়া লেখক প্রশ্ন তুলবেন আশা করছিলাম। তোলেন নাই। কৃষককে জাগাইতে গিয়া সে কি স্বয়ং কৃষকে রূপান্তর লাভ করসিল তখন? শ্রমিকশ্রেণি যেহেতু এই দেশে মোটের ওপর অবিকশিত নয়তো বিকাশমান, তারে নতুন সমাজ পত্তনের খোয়াব দেখাইতে থাকা মধ্যবিত্ত কদাপি শ্রমিকের জীবনটারে যাপন-যাচাই কিছুই করে নাই। ওই ফিলটাই সে নিজের ভিত্রে আনতে পারে নাই যেইটা ছাড়া নিচের তলায় পড়ে থাকা লোকজনের বিশ্বাস আদায় করা মুশকিল হয়। একটা আলগা শিক্ষা কেবল তার উপ্রে চাপাইছে। আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে চলতে থাকা খোয়াব আর সাথে তুঙ্গ হইতে থাকা ভাবাদর্শ ঝোলায় ভরে সে ভর করসে খেতমজুরের ঘাড়ে। ভূতটা যে শ্যাওড়াগাছ হইতে তার ঘাড়ে চাপছে ওইটুকুন বুঝ খেতমজুরের বিলক্ষণ ছিল বৈকি। ফলাফল, গোটা জিনিসটা ব্যাকফায়ার করছিল। মধ্যবিত্তে ভর দিয়া দাঁড়ানো কৃষক-শ্রমিক-খেতমজুর ইত্যাদি যত তৎপরতা আমরা অতীতে হইতে দেখসি, প্রচুর থিওরি উড়তে দেখসি আসমানে, তার সব-ক’টা ফানুসের মতো হাওয়ায় জ্বলে পুড়ে শেষ হইসিলো। ফারুক ওয়াসিফ মনে হয় ট্রাজেডিটা রিকল করতে চান নাই। কারণ, তাঁর মিশন আওয়ামী সরকার! সমগ্র সিস্টেম না। লেখক তো ছিন্নভিন্ন করবে সিস্টেমকে। সরকারগুলা, যে-ই আসুক, সব-ক’টা হারামজাদা। একটার বদলে আরেকটা আসলে মধ্যবিত্তের কপালে ওই লবডঙ্কাই জুটবে। এছাড়া অন্যকিছুর আশা করার চান্স দেশে নাই।
আবার এই মধ্যবিত্ত (খুদে ব্যতিক্রমকে যদি পাত্তা না দেই) আপার ক্লাসে নিজেকে উঠাইতে পারে না। সমাজের গুটিচালক ও মালিকের সারিতে বসার জন্য যে চালাকি দরকার হয়, ইংরেজ আমলে সওদাগরি আপিসের কেরানি হওয়ার মানতে সৃষ্ট শ্রেণির পক্ষে এলেমটা রপ্ত করা নামুনকিন। রাষ্ট্রশাসনের ছক, ক্ষমতাকাঠামো, বরাবর হিসেব করে তারে কেরানি বানিয়ে রাখসে। ইংরেজ বিদায় নেওয়ার পরে অসীম রায় যেমন তাঁর এক আখ্যানে কোট-আনকোট প্রশ্নটা তুলসিলেন,— লাখো-লাখো কেরানির উপ্রে ভর দিয়া যে-দেশটা পাইলাম তার গন্তব্য কি? এই কেরানির পক্ষে ঘুষখোর হওয়া সম্ভব কিন্তু মাফিয়া সে হইতে পারবে না। উন্নয়নমাফিয়ারা তারে দিয়া কাম সারবে এবং এই পর্যন্ত লিমিট তার।
লেখাটা পড়তে-পড়তে মনে হইল লেখক নিজের মরণ নিয়া সাতিশয় উদ্বিগ্ন। নিজের মধ্যবিত্ত সত্তাটারে যেহেতু তিনি ডিনাই করতে পারতেসেন না, এখন ওইটা মরহুম হওয়ার মানে ফারুক ওয়াসিফ বা তাঁর ওই আধো তন্দ্রা আধো জাগ্রত খোয়াবেরও মরণ। ভাই, আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন, সে মারা যাবে না। উন্নয়নমাফিয়া নিজের প্রয়োজনে তারে বাঁচাইয়া রাখতে বাধ্য থাকবে। বাদশাহি আমল তারে বাঁচাইয়া রাখছিল। ইংরেজ আমলটাও তা-ই। পাকিস্তানের এত জুলুমেও কেউ তারে মরতে দেখে নাই। মধ্যবিত্ত হইতেসে কৈ মাছের প্রাণ। জিন্দাই থাকবে সে। কারণ, তারে ছাড়া ওপর-নিচের মাঝখানে বিরাজিত ভ্যাকুয়াম পূরণ হবে না। আবিশ্ব না ঘর না ঘাট মধ্যবিত্তই পুঁজিমাফিয়ার চালিকাশক্তি। নিচের সারির লোকগুলা নয়। ওইগুলা হইতেসে ক্রীতদাস। চিরকালের গোলাম। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের অমোঘ প্রশ্নের খোরাক হওয়া ছাড়া সমাজে তাগো কোনো বেইল নাই।
Can the Subaltern Speak?—প্রশ্নটি তোলার দিন থেকে যত শোরগোল হইতে দেখসি সেখান থেকে বুঝতে বাকি নাই, গোলামরা যতই হিরো আলমগিরি দেখাক, দিনের শেষে তারা বোবা। নিজ মুখে ঠিকঠাক কথা ডেলিভারি দিতে মজবুর। ফারুক ওয়াসিফ যেইটা নিজেও লেখায় কবুল করসেন। ভিত্রে চাপা প্রাইড নিয়াই বুঝাইসেন, গোলামগুলার পক্ষে কথাবলা লোকের বড়ো অভাব। তাদের হয়ে আপার ক্লাস কিংবা এ-যুগের অতিকায় অসুরগুলার সাথে আলাপ করতে ফারুক ওয়াসিফদের লাগবেই লাগবে। হিরো আলম তো ওই চক্করে পড়ে এখন মাইর খাইতেসে বেদম। তারে নিয়া বিপ্লব সম্ভব না। তার হয়ে ওকালতি করনেওয়ালারা ওইটা এখন বিলক্ষণ টের পাইতেসেন। আমাদের সুশীল-কুশীল কবি-লেখক-বুদ্ধিবিক্রেতার দৌড় তো ওই পর্যন্ত!
নিচের তলায় খাবি খাইতে থাকা জনগোষ্ঠীর মুখপত্র হইতে চাওয়ার প্যাশন, ওই খোয়াবঘোর খাসলতটাই সকল অনাসৃষ্টির মূল;—ফারুক ওয়াসিফ মনে হইতেসে আজো সেইটা ধরতে পারেন নাই। ফরহাদ মজহারের মতো ভকচক্করে এখনো ঘুরতেসেন বেদম। ইনসাফ কমিটি করে লোকজনকে ইনসাফ বুঝাইতেসেন। ফারুক ওয়াসিফ, ফরহাদ মজহার এবং এই লাইনে আরো যারা লাইন দিয়ে আছেন, লোকগুলার ইনসাফ নিশ্চিত করতে তাদের হয়ে উনারা যত বেশি বকবক করবেন ততই পুঁজি-উন্নয়ন-বাজার-বিশ্বায়ন-বহুজাতিক, মোদ্দা কথা যত আকারের মাফিয়া জগতে আছে, তাদের জন্য শ্রেণিটারে কব্জায় রাখা সহজ মনে হইতে থাকবে। কারণ, নিচের তলায় জ্যান্ত শ্রেণিটা মধ্যবিত্তের ভাষা একবর্ণ বোঝে না। বাপের জন্মে কোনোদিন বুঝতে পারছে কি না সন্দেহ। সিম্পল এই ব্যাপারটা ফারুক ওয়াসিফ তাঁর আধো ঘুম আধো জাগরণঠাসা খোঁয়ারির কারণে মিস যাইতেসেন বারবার!
মধ্যবিত্ত একটা ব্যবহারজীবী শ্রেণি। সে অনেকগুলা একটুখানির সমষ্টি। একটুখানি ভীরু। একটু পরিমাণ লাজুক। একটু বেশি মফস্বলী। একটু করে প্রতিবাদী। একটুসখানি ভাবুক। একটুখানি স্বাপ্নিক। এক-আধটু নৈতিক। এক-আধটু অনৈতিক। একটুস রাবীন্দ্রিক। একটু অধিক উন্নাসিক। একটুখানি মওকার অপেক্ষায় কাতর কিন্তু ওইটা বাগাইতে বিফল। তার সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি যেইগুলা এই দেশে ষাট-সত্তর-আশি-নব্বইয়ের জন্মকারণ, সেগুলা ব্যর্থ হইসে এরকম শত-শত একটুখানিতে এসে। নিজের এই স্বভাবটারে যদি সে ঠিকঠাক ভাষা দিতে পারতে তাইলে ওইটা হইত তার সত্যিকার কামিয়াবি। আর কিছু না পারুক, নিজের চেহারা চিনতে সে ভুল করেনি বইলা মনে হইত তখন। শোধরানোর রাস্তাও হয়তো খুঁজত তখন। এই সাহিত্য, সংস্কৃতি কিংবা রাজনীতি কি সে করে উঠতে পারছে কখনো? সওয়ালটা ফারুক ওয়াসিফ তুলতে পারতেন কিন্তু তোলেন নাই।
অন্যকে শিখানোর ঠেকা মধ্যবিত্ত নিতে পারবে না;—মামলাটা এতদিনে পরিষ্কার হওয়া উচিত। তার জন্য ওইটা ব্যাকফায়ার করবে, যেমন অতীতে বারবার করসে। আপাতত এর কোনো সমাধান আসলে নাই। ডেভিলস রুলস দ্য ওয়ার্ল্ড। তো এরকম বিশ্বে ক্ষমতামাফিয়াচক্রে যে-মধ্যবিত্ত নিজেকে শামিল করতে পারবে তারে প্রমোশন ঘটবে উপ্রে। যারা সেইটা পারবে না তাদের চিন্তার কারণ নাই, উপ্রে যারা আছেন তারা এই শ্রেণিটারে গৃহপালিত জানোয়ারের আদরে রাখার নামে জীবন্মৃত বাঁচাইয়া রাখবে। এই জানোয়ার ইনজেকটেড থাকবে সেখানে। চেতনাবিহীন সচেতন এক প্রাণী হয়ে নগর-বন্দরে বিরাজ করবে সে। স্বয়ংক্রিয় রোবটের মতো নিয়ন্ত্রিত পরাধীনতা যাপন করবে যুগযুগান্তর। অ্যালডাস হাক্সলির ব্রেইভ নিও ওয়ার্ল্ড-র কল্পবিশ্বে আমরা যেমন দেখি, ওই অবস্থায় প্রজাতিটারে পেলেপুষে রাখবে ক্ষমতামাফিয়া।
ভয় নাই ভাই, তারা পোন্দানি খাবে তবু মরবে না। হিরো আলমদের টিটকারির পালটি টিটকারি দিবে কৈ মাছের জান নিয়া। এবং তারা লাইনেও দাঁড়াবে,—রেশনের জন্য। ওপেনহাইমার দেখতে সিনেপ্লেক্সেও যাবে। ব্যান্ডের গান শুনবে। এক-আধটু রবীন্দ্রনাথ যাপনে মরিয়া থাকবে। অদ্ভুত এই কমপ্লেক্সিটির মধ্যে তার সকল শক্তি ও মজবুরি নিহিত। গণতন্ত্র বা উন্নয়নের কোনোটা তার হাতে নাই। ছিলও না কোনোদিন। ক্ষমতাচক্রে সে ব্যবহৃত চিরদিন। গায়ত্রী নিম্নবর্গ তার নিজের কথা নিজে বলতে পারে কি না প্রশ্নটি তুলসিলেন। মধ্যবিত্ত কি নিজের কথা বলতে সক্ষম হইসে আজ অবধি? কথা সে বলছে। বলবেও। এগুলার মধ্যে কোন কথাটা তার নিজের সেটা সে জানে কি? সমস্যাটা ফারুক ওয়াসিফ স্কিপ করে গেছেন। কারণ, নিজের ও উপ্রের লোকগুলার সাথে দূতিয়ালীর জায়গায় তিনি এখনো নিজের দেখতে পাইতেসেন। উপ্রের লোকের সাথে বসে দরকষাকষির খোয়াবে গণতন্ত্রটারে দেখতেসেন। আধো ঘুম আধো জাগরণে ভাবতেসেন, তারে কী ইজ্জত দিয়াই না ডাকতেসেন ওপরওয়ালা! বোঝা যাইতেসে হ্যাংওভার এখনো কাটে নাই। কোনোদিন কাটবে বইলা আপাতত মনে হইতেসে না।
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS