অষ্টপ্রহর ওয়াজ নসিহত ও পবিত্র শীতকাল মাহফিল

অষ্টপ্রহর ওয়াজ নসিহত ও পবিত্র শীতকাল মাহফিল

উইন্টারের যে-একটা গাঢ় উদাস নির্জনতা, পাখির মতন পলকা মেলোডিয়াস মন্থরতা, মাইকমত্ত ওয়াজি হুজুরদের হাতে এর নাস্তানাবুদ অবস্থা আজকাল অকহতব্য। উরাধুরা গালাগালি, বিকট হুঙ্কার আর হিংসা, হাঁউকাউ-হৈহৈ ছাড়া, নারী ও অপর ধর্মাবলম্বীদের নিয়া সারাক্ষণ রগ ফাটিয়ে চেল্লাচিল্লি হিংস্র বমন উগরানো ছাড়া বাংলাদেশে একটাও ওয়াজ এখন দুর্লক্ষ। অথচ এমন ছিল না আজ থেকে মাত্র দুই-আড়াই দশক আগেও।

ছোটবেলায় যে-কয়টা আকর্ষণ ছিল সারাবছরের গতরে, দিন গুনতাম অঙ্গুলিমেয় যে-কয়টি দিনের জন্য, শবেবরাত তার মধ্যে একটি। শবেবরাত। সহি উচ্চারণ শব-ই-বরাত, হয়তো, শবেবরাতই বলি আমরা। ভাগ্যের রাত, বলা হয়ে থাকে, ভাগ্যনির্ধারণী রজনী। এছাড়া আর-আর আকর্ষণগুলোর মধ্যে ছিল : দুই ঈদ, শিববাড়ির মেলা, সরস্বতী ও দুর্গাপূজা। আরেকটি ছিল : গ্রামের বাড়ির ওয়াজ মাহফিল।

প্রত্যেক শীতে, পৌষের কুয়াশাজাঁকালো দুইদিন-দুইরাত ব্যেপে, চলত ওয়াজ; — এখনও চলে। আমাদের গ্রামের বাড়ি মোগলাবাজারের কান্দিগাও, সেখানে পেল্লায় বড় এক মাদ্রাসা — জামেয়া তওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা মাদ্রাসা, সেই মাদ্রাসায় প্রতিবছর দূর-দুরান্তের আলেম-ওলামা-মাশায়েখগণ এসে ওয়াজ-নসিহত করে যান বছরের ওই নির্দিষ্ট সময়ে। রেঙ্গার ওয়াজ   নামে সারা সিলেট জুড়েই এর নামডাকপরিচিতি রয়েছে। এই ওয়াজদিনটিকে ঘিরে পুরো ওই এলাকায় দীর্ঘদিন-ধরে-চলিষ্ণু একটি বিশেষ সংস্কৃতি, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, খুব সুন্দর মনে হয় আমার কাছে। কেমন সেটা? এলাকার প্রতিটি বাড়ি উৎসবে মেতে ওঠে এই সময়টায়। ওয়াজমৌসুমে বাড়ির মেয়ে-বৌ-ঝিরা পতিগৃহ থেকে পিতৃগৃহে নাইওর আসেন, সঙ্গে থাকে ননদ-দেবর-জা-শাশুড়িবর্গের সাজোয়া বাহিনী ও লটবহর। দুই-তিন রাত থাকেন সবাই, কেউ-কেউ সপ্তাহও পার করে দেন ঘরে-পালা মুর্গিসুরুয়ায় মজে গিয়ে। আমরাও যেতাম বছরের ওই সময়টাতে, যেখানে গ্রামের বসতভিটা আমাদের, কেবল বড়চাচা থাকেন ওখানকার জমিজিরেত-বাস্তুভিটা আগলে। যেতাম আম্মা-ছোটচাচিমা আর আমরা নানাসাইজের ভাইবোন-কাজিন।

তো, যেতাম আমরা, রেঙ্গার ওয়াজে যেতাম। কেন যেতাম? ওয়াজ শোনার জন্য? কদ্যপি না। দুইদিনভর সদ্য-ধান-কেটে-নেয়া বিস্তীর্ণ ক্ষেতের জমিনে মেলা হতো বি-শা-ল — যেতাম ওই মেলার আকর্ষণে। অন্য সকলেও তা-ই। আমাদের বাড়ির ও আশপাশের কেবল কিছু জইফ মুরুব্বি ছাড়া কাউকেই খুব এশেকের সঙ্গে ওয়াজ শুনতে দেখিনি, দেখেছি রাত জেগে সকলের গালগপ্পোগুলতানি। ভাইবাড়িতে নাইওর-আসা বোনের বছরভর-জমে-থাকা পেটের কথার শুভ অবমুক্তি, পরচর্চা-পরনিন্দা-পরশ্রীকাতরতা, সন্তানগর্ব-স্বামীপ্রেম, শাশুড়িননদিনীর যাতনাকাহিনি … এককথায় দুর্দান্ত সামাজিক কমেডি! ওদিকে বাতাসে ভেসে আসছে মাইকে-ব্যক্ত মৌলানা-ক্বারিহুজুরের বয়েত ও বয়ান, তর্জমা-তফসির … বেশরিয়তি কায়কারবারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি-হুঙ্কার, বেদ্বিন সংস্কৃতি না-পালনের জন্যে নিষেধাজ্ঞা, বাড়িঘরের বউ-ঝিদের কন্ট্রোলে রাখার তালিম … সহসা খুব সুরেলা তেলাওয়াত, উর্দু-ফর্সি কসিদা ও বয়েত ব্লা ব্লা।

আমরা আমাদের আম্মা-চাচিমা-ফুফুমাদের কলকলানো কথাবাদ্য শুনতাম কাঁখের কাছ ঘেঁষে, এবং খুব টানত ওয়াজের আওয়াজ, মাইকের হুজুর কাঁদছেন-ফুঁপাচ্ছেন আর আমরা বেচইন হচ্ছি ক্রন্দনরত হুজুরের শামিয়ানাতলে যেয়ে একটু সমবেদনা জানায়া আসতে। কেউ তো নিয়ে যেতে হবে এসে, আমাদেরকে, কিন্তু শক্তদিল আব্বা-কাকারা গ্রামের ইয়ারদোস্তের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সেরে ঘরে ফিরছেন সন্ধে উজিয়ে। ততক্ষণ আম্মাদের কোলের কাছে ঢুলতে ঢুলতে বড়দের জগৎ সম্পর্কে একটা অম্লমধুর বোঝাপড়া করতাম মনে মনে।

এরপর রাতের ভাতটাত খেয়ে বড়দের আঙুল ধরে যাওয়া হতো ওয়াজে, তুক্কু, ওয়াজে নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে মনোহারী শিশুভোলানিয়া জিনিশপত্তরের মেলায়। সে কী সীমাহীন অতৃপ্তি মেলায় যেয়ে! সে কী আফসোস আর মনখারাপভাব সারাক্ষণ! নক্ষত্রখৈঝরা আকাশের খোলামাঠে মেলাপ্রান্তর, খড়ভেজা পায়ের তলায় শীতের খোঁচা, চারপাশ ছোপছোপ কুয়াশা আর দূরে দূরে ক্ষেতগড়ানো কুয়াশাপাহাড়, ম্যারাপের ঘের আর চাঁদোয়ার তলে হ্যাজাকের আলোকল্লোলিত দুদিনের-মেয়াদে-বসা যত সুপণ্যসম্ভারপূর্ণ দোকানখোপ। মেলাময়্দানের সমস্তকিছু খেতে ইচ্ছে করত, বগলে ঝুলিয়ে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করত সমস্ত মেলার মালসামান। তবে সে-রকম তো আর সম্ভব ছিল না, যা-কিছু বড়রা দিতেন কিনে তা-কিছুর বাইরে তেমনকিছু পাবার জো ছিল না কালেভদ্রের ব্যতিক্রম বাদে। ফলে অনেক অতৃপ্তি গিলে নিয়ে কিনতাম সস্তা খেলনাবন্দুক, সস্তা প্লাস্টিকগাড়ি, সস্তা বাঁশি-বেহালা, সস্তা ফানুশ ও মুড়িনাড়ু-খৈ-বাতাসা আর চিনির-রসে-চুবানো রঙিন গোল্লামিষ্টি ইত্যাদি। কিনতাম ওয়াজের মেলা থেকে এটা-সেটা খেলনা। তারপর আমি ও আমার সহোদর-ভাইবোন-কাজিন সবার আলাদা আলাদা পছন্দের যথাসাধ্য জিনিশপত্তর যার যার হাতে ঝুলিয়ে বাড়ির পথে হৈহৈ হাঁটা।

আহা!কাহিনিকীর্তন হলো অনেক, এইবার সংক্ষিপ্ত আলোচনা। জন্মসূত্রে হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে যথার্থ বলা হয়ে থাকে কথাটা, যে, তাদের বারোমাসে তেরো পার্বণ। কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। হিন্দু ঘরে ও ঘরানায় রয়েছে অজস্র ও বিচিত্র উৎসবের যোগ এবং তারা তা উদযাপনও করতে জানে। কিন্তু মুসলমানদের জীবন অনেকটাই নিরুৎসব, নুন-লবণছাড়া, পানশে। কে জানে, ব্যাপারটি ইসলামে কেন গুরুত্ব পায় না, উৎসবের প্রয়োজনীয়তা ইসলামধর্মে সত্যি স্বীকার করা হয় না — নাকি বিকৃতপন্থীদের মনগড়া ব্যাপার এটা তা-ও জানি না আমি। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে এই ধর্মাবলম্বীদের দৈনন্দিন জীবনে ঢের সাংস্কৃতিক হৈহুল্লোড় ও বৈচিত্র্য রয়েছে বলেই তো শোনা যায়। ইদানীং তো ইউটিউবের সুবাদে দেখতেও পাই অ্যারাব-পার্শিয়ানদের ফেস্ট-পরব্-বিয়াশাদি।

কিন্তু বাঙালি মুসলমানের জীবন যে কী-মাপের নিরুৎসব, নিষেধাজ্ঞানিয়ন্ত্রিত — বলার অপেক্ষা রাখে না। খুব রঙিন যে-দুটো পরব্ এর মধ্যেও ছিল — মুহররম আর শবেবরাত — সমূলে সেসব মুছে ফেলে একেবারে একমুখী তিতিক্ষা-উপাসনা-ধর্মাচারণানির্ভর করে তোলা হয়েছে। আমার ধারণা, খুব পরিকল্পিতভাবে গত দুই-দশকে শবেবরাতের শিশুচিত্তাকর্ষক আমোদ-আনন্দের নির্মল-অনাবিল দিকটাকে নিরুৎসাহ প্রদানের প্রক্রিয়া বহাল রাখা হয়েছে। আমার দেখা ও বোঝাশোনার কিছু নমুনা আমি বিবরণাকারে পেশ করব কখনো কোনো সুযোগমতো, মওলা যদি তৌফিক এনায়েৎ করেন।

চতুর্দিক থেকেই এদেশে ক্রমশ উৎসব উৎসাদিত। উৎসব উৎসাদনের ফলে সবচেয়ে বড় যে-ক্ষতিটা হয়েছে, সেটা হলো : ধর্মীয় অনুশাসনশীলিত একঘেয়ে-মনোটোনাস রীতিনীতি-প্রথানুষ্ঠানাদির মধ্যেও যে একটা সামাজিকতা ছিল এতকাল মানুষে-মানুষে মিলন-মুলাকাতের, তা থেকে অন্তরিত হয়ে তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মানুষ এখন মসজিদে-গেহকোণে বেশি-বেশি বিচ্ছিন্ন/অ্যালিয়েন জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হচ্ছে। চকিত একটা জরিপ করে নিলাম সেদিন, সন্ধেবেলা নামাজোত্তর পাড়া-পায়চারিতে বেরিয়ে এবং বাড়ি ফিরে পিচ্চিকাচ্চাদের সঙ্গে কথালাপে, পোলাপানরাও অধুনা শবেবরাতে ধুপবাতি-তারাবাতি কিংবা বাজি না-পুড়িয়ে বরং পাক্কা পরহেজগারিতে ব্যস্ত সময় কাটাতে স্বতোৎসাহী! হায় শৈশব!

শীতকালীন গাওগেরামের একটা সাধারণ অনুষঙ্গ ওয়াজ-নসিহত। হুজুরেরা মাইকে তারস্বরে চেঁচিয়ে বয়ান দেন দুনিয়াবি ও আখিরাতি নানাবিধ বিষয়-ইশ্যুতে, ঘুমনিদ্রা হারাম হয়ে যায় গ্রামমহল্লা বা শহরবস্তির পাব্লিকের। কেবল গ্রাম বলি কেন, জেলাশহরগুলো ছাড়াও খোদ ঢাকা শহরে এই শীত মরশুমে যেই হারে ওয়াজ মাহফিল হয় রাতভর, ক্যাল্কুলেটরে কাউন্ট করে কূল পাওয়া যাবে না। তা, লোকসমাগমও তো কম হয় না বটে সেইসব ওয়াজের আসরে। যেমন শীতকালে দেখেছি, ঢাকা শহরকেন্দ্র ও সংলগ্ন অঞ্চল জুড়ে, মিরপুর এলাকা বা গাবতলি কিংবা যাত্রাবাড়ি কি সায়দাবাদ প্রভৃতি এলাকায় হিউজ সংখ্যক ওয়াজ মাহফিলের মোচ্ছব লেগে যায়। এইটাও লক্ষ করেছি, বিভাগীয় জেলা শহরগুলিতে ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের হিড়িক বেড়েছে, সেই তুলনায় গেরামাঞ্চলে এইটা খানিক স্তিমিত।

শহরগুলোতে এখন নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে, ট্যাক্সি ও লরিট্রাকের স্ট্যান্ডগুলোতে ম্যারাপ বেঁধে ওয়াজ মাহফিল পরিচালন। পথচারণে কিংবা গাড়িঘোড়া চালনে তাতে যত বিঘ্ন ঘটুক, কারো বাপের সাধ্য নাই বীরভোগ্য ধর্মাচারে আপত্তি ওঠায়। এইধারা আর্বান ওয়াজ-মাহফিলগুলোতে হিউজ অ্যামাউন্ট অফ ফান্ড মোবিলাইজ করা যায়, এবং পথিপার্শ্বের জায়গাটুকু প্রতিষ্ঠা করা যায় লোক্যাল সেই মোবিলাইজার পাণ্ডাব্যক্তি ও তার গোষ্ঠীর ভোগদখলি ভূখণ্ড হিশেবে, অটোমোবাইল গাড়ির স্ট্যান্ড হিশেবে বেশ দাঁড়ায়া যায় জায়গাটা। হালুয়া-রুটির ভাগবিলিবণ্টন যদ্দিন ঠিকঠাক, তদ্দিন পাঁচকান হবার আশঙ্কা থাকে না, আর এইসব ব্যাপার পাঁচকান হওয়া তো বরং পোয়াবারো আজকাল, পাঁচকান হলে পরে পসার বাড়ে। এবং হুজুরদেরে সঙ্গে রেখে সিন্ডিকেইটেড এইধারা আয়-ইনকাম জোরালো হতেছে দিকে দিকে দেখতে পাই।

কিন্তু নগর-কর্পোরেশন অ্যারিয়ায় এহেন পুণ্যমূলক আয়োজন শব্দসন্ত্রাস গণ্য হবে না কেন, জবাব দেয় না কেউ, আর কেই-বা জিগাইতে যায়। এই ছবি সিলেট-বগুড়া-ঢাকা নির্বিশেষে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলেই বিরাজমান। ওয়াজ শোনার এম্পিরিক্যাল অবজার্ভেশন নিয়া আলাপ করা এখন এই ইউটিউবহুজুরদের জমানায় দরকারও বোধহয়। শীতের বয়ান শুরু করলে বহুকিছুই উঠে আসবে। এইরকম মোটামুটি পুরা বাংলাদেশের গাওগেরাম জুড়ে শীতের সময় মাহফিল হয় ওয়াজের, এগুলোর অনেকমাত্রিক ব্যবচ্ছেদ করতে পারলে বোঝা যাবে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও মূল্যবোধগত ভাবগতিক কোনদিকে ধাবন্ত। ওইভাবে লেখায় বা আমাদের ফর্ম্যাল সাহিত্যে এই চিত্রটা আসে না।

খালি শীত মানে খেজুরগুড় আর জীবনানন্দীয় কুয়াশাশিশির তো না, বা শীত মানে কেবল পত্রিকাপাতার শুক্ররমণীয় ‘শীতের কবিতা’ তো না, বাংলাদেশে এই ওয়াজচিত্রটা নানাভাবেই শীতের একটা ব্যঞ্জনাবহ অনুষঙ্গ হিশেবে লেখায় আসতে পারে। এইরকম, এই ধারার, লেখা নিয়া আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ ব্যাপক। ফুকো-দেরিদা পাঠের চেয়ে এইসব পড়া আমার চোখ ফোটাতে এবং চারপাশ বুঝে নিজের জমিজিরেত দেখেশুনে রাখতে অনেক বেশি সরাসরি ক্রিয়া করে। এবং আমি ভুলে যাচ্ছি না, আমাদের ছেলেবেলায় শীতকালে মাহফিল লেগেই থাকত ওয়াজের, আমরা রাতভর অথবা আধারাত অব্দি কোনো অভিভাবকের ঈষৎ শিথিল তত্ত্বাবধানে সেইসব ওয়াজে মশগুল সময় কাটিয়েছি স্কুলফ্রেন্ড-কাজিনদের সঙ্গে। সেইসময়কার ওয়াজের সঙ্গে এখনকার ওয়াজের একটা ব্যাপক তফাৎ লক্ষ করে উঠি অচিরাৎ। তখন বয়ান করা হইত অনেক বেশি দরদ গলায় ঢেলে। এখন যদি কেউ বলেন যে সেইসব বয়ান অনেক ভুলেভালে ভরা আর কুসংস্কারাকীর্ণ ছিল, কথা সেইটা তো না, কথা হইল প্রেজেন্টেশন দরদভরা ছিল।

রোদন একটা মাস্ট অনুষঙ্গ ছিল তখন বয়ান ডেলিভারেশনের, কান্নাকাটি ছিল অনেকটা স্ট্র্যাটেজিক উয়্যেপন যেন, শ্রোতার পাপপোক্তা পাষাণ হৃদয় যাতে একটু কর্ণপাত করে তাতে। এবং অব্যর্থ ছিল কৌশল। হুজুরদের বয়ানে ভিজে-ওঠা চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরতে দেখেছি আমি সেইসময়ের মানুষগুলোকে। এরা-যে কেউ অনক্ষর বা সুফি-দরবেশ ছিলেন তা তো নয়, এদের বেশিরভাগ ছিলেন আমাদেরই মতো অল্পবিদ্বান ছোটচাকুরে, কেবল ফেসবুক ছিল না বলে সেইসময়ের মানুষগুলোর বিদ্যার গুমর ও গর্জন প্রমাণ করা যাচ্ছে না। আজকাল ওয়াজ-নসিহত থেকে ক্রন্দন ও চোখ-ভেজানোর কোশেশটুকু অন্তর্হিত। ধমকের সুরে ওয়াজ করেন হুজুরেরা, লাইনে লাইনে হুহুঙ্কার, শামিয়ানার নিচে বসা মানুষদেরকে তেনারা মনে করেন যুদ্ধের ঘোড়া। তখন ওয়াজে ছিল প্রেমের সুর, এখন প্রতিশোধের। আন্দাজি এলোপাথাড়ি চিলচিৎকার।

ওয়াজে একটা কেন্দ্রীয় সুর ছিল নশ্বর এই পৃথিবীবাসের জন্য মায়া ও ছেড়ে-যেতে-হবে-বলে হাহাকার, এখন সেই সুর আর নাই, এখন সব একচেটিয়া হিংসার। এইভাবে দেখাটা আমার চারপাশের পাড়ামহল্লার মাহফিলগুলো থেকে উদ্ভুত, তবে খুব বেশ-কম হবে না অনুমান করি অন্য সর্বত্রও। মোটামুটি এই চিত্র বাইরে থেকে চোখে পড়ে, ভেতরে গেলে ওয়াজের কন্টেন্ট ও প্রোসেসের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন গোচরে আসবে এইটা কনফার্ম। ওয়াজ-নসিহতের সেকাল ও একাল নিয়ে একটা কম্পারেটিভ স্টাডি করা দরকার। এটা করতে পারলে সমাজগড়ন ও রূপান্তরের দিগদর্শানো অথেন্টিক একটা গ্র্যাফ হাতে আসবে।

লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you