রিকশাওলা || ইমরুল হাসান

রিকশাওলা || ইমরুল হাসান

সারা গা ভেজা নোনা ঘামে
তবু পথচলা নাহি থামে
তিনটি চাকায় লেখা ঠিকানা
পিচঢালা পথ বড় চেনা
শুধু বিশ্রাম মেলে না
রিকশাওলা …

চাকা না চললে কাটবে উপোস বেলা
রিকশাওলা
চাকা না চললে কাটবে উপোস বেলা
রিকশাওলা

আন্দোলন, বন্ধ, হরতাল
দেশ নিয়ে ওরা উত্তাল
সেই স্রোতে খুলে যায় কত নেতার কপাল
রিকশাওলার পোড়া ওই কপাল বদলায় না
শুধু বিশ্রাম মেলে না
রিকশাওলা …

চাকা না চললে কাটবে উপোস বেলা
রিকশাওলা
চাকা না চললে কাটবে উপোস বেলা
রিকশাওলা

ককটেল বোমাবাজি
ভোট নিয়ে কারসাজি
অনিয়মে ডুবে গেছে এই দেশটা আজি
অনিয়মে পথচলা তার থামে না
শুধু বিশ্রাম মেলে না
রিকশাওলা …

চাকা না চললে কাটবে উপোস বেলা
রিকশাওলা
চাকা না চললে কাটবে উপোস বেলা
রিকশাওলা …
[রিকশাওলা ।। গায়ক ও সুরকার / জেমস্ ।। গীতিকার / আসিফ ইকবাল ।। অ্যালবাম / অনন্যা ।। ঢাকা ১৯৮৮]

https://youtu.be/QmrnXJ2-eII

জেমস্ যখন মাকসুদ-টাইপ আছিলেন, তখনকার গান এইটা। উনার ফার্স্ট অ্যালবামের গান। মাকসুদ-টাইপ বুঝতে ফিডব্যাকের ‘মাঝি’ গানটার কথা মনে করতে পারেন।*

গানটাতে তেমন কোনো সমস্যা কিন্তু নাই, সিরিয়াসলিই গাইতেছেন জেমস্ বা লিরিসিস্ট একটা ‘সহমর্মিতা’-র জায়গা থিকাই লিখছেন; যে গরিব রিকশাওলা, ‘বিশ্রাম’ (মানে, রেস্ট; প্রথম-আলো এইরকম চাতুরি করে দেখবেন, রেস্পোন্সিবিলিটি লিইখা ব্র্যাকেটে লেখে দায়িত্বশীলতা) নিতে পারে না; যদিও এখন শিফটের ডিউটি চালু হইছে ঢাকা শহরে। তারপরে ধরেন, বোমা যে মারে, ইলেকশন যে হয় না ঠিকমতো — এই কমপ্লেইনগুলাও ঠিকঠাকমতোই আছে। যে, এইসব কিছুর এফেক্ট তো পড়ে রিকশাওলাদের উপরেই। দরদীভাবেই বলা।

কিন্তু শুনতে গেলে, কেমন জানি হাসি আসে এখন! 🙂 মানে, এইগুলা যে আলগা দরদ, একভাবে টের পাই আমরা। জেমস্ যে চিন্তিত না রিকশাওলাদের নিয়া — তা না, কিন্তু যেইভাবে চিন্তিত হইতেছেন, এইটা বেশ ফানি হইতে পারতেছে এখন। মানে, ঘটনাটা ইশ্যুটারে নিয়া না, বরং ইশ্যুটাতে যেইভাবে এনগেইজড হইতেছেন।

ফ্যাক্ট হিসাবেও তো মিছা না যে, রিকশাওলা গরিব, নির্যাতিত, প্রলেতারিয়েতও ইভেন, সে নিজে না বুঝলেও। রিকশাওলা কষ্টে আছে — এইটা নিয়া একজন ব্যান্ডের গায়কও কষ্ট পাইতেছে, সেইটা তারপরও ফানিই লাগতেছে। সে যে কষ্টে আছে এইটা নিয়া আইজুদ্দিন যখন ঢাকা শহরের দেয়ালে লিখত তখন তার কষ্টটারে ফানি মনে হইত না এতটা; কারণ সে তার নিজের কষ্টটার কথা কইতেছে। আরেকজন কত কষ্টে আছে — এই রিপ্রেজেন্টেশনে যে আরামটা বা চিকন ভাল্গার একটা ভালোলাগা আছে — এইটা মেবি টের পাওয়া যায়।

ব্যান্ডের গায়কদের খারাপ লাগে না বা উনারা মকারি করতেছেন — এইরকম না, কিন্তু এইভাবে অন্যের কষ্টে সাবস্ক্রাইব করার কথাটা আরো ডিসট্যান্ট কইরা তোলে ঘটনাটারে। বিশ্বজিৎ-এর খুন বা তনু-র রেইপ-মার্ডার নিয়া কবিতা দেখলেও কাছাকাছি রকমের ফিলিংস হইতে পারে। যারা লিখতেছেন, তারা যে কষ্টটা থিকা লিখতেছেন না — তা না; কিন্তু একভাবে কষ্টটারে তারা ‘সাহিত্য-উপাদান’ হিসাবে ইউজ করতে পারতেছেন। গরিবি আরেকটা আর্টের ম্যাটেরিয়্যাল হয়া উঠতেছে।

তো, এর সাথে ডিফ্রেন্স মেবি টের পাওয়া যাবে জেমসের পরের গানগুলাতে, যেমন — ‘মান্নান মিয়ার তিতাস মলম’ বা ‘লেইস ফিতা লেইস’ গানগুলাতে। পাতলামি হইতে পারে, কিন্তু অ্যাটলিস্ট গরিবির ভিতর রিডিউস করার চেষ্টাটা নাই।


রিকশাওলা পেশাটা এখন মার্জিন্যাল হয়া আসতেছে আমাদের দেশে, ব্যাটারির রিকশা আর টমটম আসার পরে, উনারা ঠিক রিকশাওলা না আর যারে ঠেইলা চালাইতে হইতেছে, বরং ড্রাইভারই অনেকটা। অ্যাক্টিভিটির কারণে ক্লাসের জায়গাটাতে গ্যাপ আছে, উঁচা-নিচা ব্যাপার আছে। টয়োটা গাড়ির ড্রাইভার আর পাজেরো গাড়ির ড্রাইভারের মধ্যেও আছে।

আর রিকশাওলা ব্যাপারটা লিনিয়ারও না এতটা, কয়দিন আগে একটা সিনেমা দেখলাম, ‘টেইক দিজ ওয়ালজ’ । কানাডার ঘটনা, নায়ক রিকশা চালায়, তা-ও কলকাতার মতন টানা-রিকশা, বেশ রোমান্টিক একটা ঘটনা; কারণ সে আবার ছবিও আঁকে, মানে, ওইটাই মেইন আইডেন্টিটি আসলে। যেমন, আমি তো ক্যাব চালাই না, কবিতা লিখি, এইরকম। 🙂


রিকশাওলা নিয়া আরো দুইটা গানের কথা মনে হইতেছে, মানে, আমাদের মিডলক্লাসের স্পেইসে পরিচিত।

একটা হইতেছে ইন্ডিয়ার, পশ্চিমবঙ্গের ‘চন্দ্রবিন্দু’ ব্যান্ডের গান, ‘রিস্কাওলা’। ওইটাতে আসলে রিকশাওলাদের কিছু নাই, তার ইনফিরিয়র আইডেন্টিটির ইউজটা ছাড়া, যদিও মনে হইতে পারে যে, করুণ মিহি হিউমারই করতে চাইতেছেন উনারা, কিন্তু এইখানে রিকশাওলা বাদ দিয়া বুটপালিশওলা বা মাস্টার্স-পাশ-করা বেকার পোলা হইলেও কোনো হেরফের হয় না। কিন্তু রিকশাওলা কইলে যেই ছোটলোকামিটা শো করা যায়, এইটা অন্যকিছুতে এতটা আসার কথা না। এই জায়গায় ‘গান্ডু’ সিনেমার ওই সিনটার কথা মনে করতে পারেন, যেইখানে রিকশাওলা মিডলক্লাস পোলাটারে চড় মারে, মানে সে মিডলক্লাস হওয়ারও যোগ্য না, রিকশাওলা তারে চড় মারে! এরচে বাজে কী হইতে পারে! তুই শালা রিকশাওলারে যখন-তখন চড় মারতে পারবি আর রিকশাওলা তোরে চড় মারলে, এইটা বিরাট ধরা খাওয়ার ঘটনা! রিকশাওলা হইতেছে স্ট্যান্ডার্ড। তো, চন্দ্রবিন্দুর গানটা একই জায়গা থিকা আসছে। করুণ বা হিউমারাস হইলেই যে এই হেইট্রেডটা নাই, তা তো না!

চন্দ্রবিন্দুর ‘রিস্কাওলা’ :

আমি যে রিস্কাওলা
দিন কি এমন যাবে
বলি কি ও মাধবী
তুমি কি আমার হবে
আমি যে রিস্কাওলা

আকাশে সূর্য ওঠে
পুকুরে পদ্ম ফোটে
হৃদয়ে কুটনো কোটে
অসহ মদনজ্বালা
আমি যে রিস্কাওলা

আমি যে রিস্কাওলা
দিন কি এমন যাবে
বরাবর পাগলা ভোলা
নিশিদিন ফুল কুড়াবে
আমি যে রিস্কাওলা

দিন যায় সন্ধে ঢলে
গরুতে হাম্বা বলে
জ্বল এলে পাড়ার কলে
তুমি হও চাঁদের কণা
আমি যে রিস্কাসোনা

আমি যে রিসকাসোনা
দিন কি এমন যাবে
সকালে ভাত খাবো না
রাতেরা আমায় খাবে
আমি যে রিস্কাওলা

জলে যায় জলের পোকা
স্কুলে যায় কোলের খোকা
বসে রয় হদ্দ বোকা
দু-চোখে তোমার ছবি
আমি যে রিস্কাকবি গো

আমি যে রিস্কাকবি
দিন কি এমন যাবে
বলি কি হে মাধবী
তুমি আর আসবে কবে
আমি যে রিস্কাওলা …

আরেকটা হইতেছে, ফকির আলমগীরের ‘ও সখিনা’ গানটা। গানের ভিডিওটা দেখলেও বুঝবেন, রিকশাওলাদের ওই দিন নাই আর ঢাকা শহরে, এত বড় রাস্তাতে রিকশা চলে না আর। আর রিকশাওলারাও বানের কারণে ভাইসা আসা মানুষ না, বরং সেকেন্ড বা থার্ড জেনারেশনের বস্তির পোলাপাইনও আছে এই জায়গায়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হইল, আমি শিওর কোনো রিকশাওলারে কোনোদিন এই গান শুনতে দেখবেন না আপনে, অ্যাজ অ্যা প্যাসেঞ্জার। কারণ এইখানে তার বেদনার বাইরে আর কিছু তো নাই তার! কিন্তু সে তো একটা বেদনা উৎপাদনের মেশিন না রে ভাই! (এইখানে আরো জিনিস আছে, দেখবেন, গরিবের বউ আসলে সুন্দর, ল্যাঙ্গুয়েজটা ছোটলোকের, তারপরও ছোডলোকের ল্যাঙ্গুয়েজ যে আছে একটা, এইরকম, এইরকম জিনিস …)

ফকির আলমগীরের ‘ও সখিনা’ :

আমি অহন রিস্কা চালাই ঢাহা শহরে
ও সখিনা গেসস কি না ভুইল্লা আমারে।।

এবার বানে সোনাফলা মাঠ হইল ছারখার
দেশ-গেরামে শেষে নামে আকাল হাহাকার।।
আমরা মরি কি আসে যায়
মহাজনে পাওনাটা চায়
বেবাক ফসল তুইলা দিলাম আমরা তাগোর খামারে।।

জলার পাশে কলাগাছের ছায়া সারি সারি
তার তলাদি চইলা আইলাম আমি অনাহারী।।
হাজার ঠেকায় গরীব ঠকায় তাকায় রাঙা চোখে
মিডা কথা কয়না তো কেউ আমরা ছোডলোকে।।
লক্ষ মশার উৎপাতে
রাত কাটে না ফুটপাতে
লয় মনে আজ বদলা লমু উইড়া যামু তোর ধারে
ও সখিনা গেসস কি না ভুইল্লা আমারে

ও সখিনা গেসস কি না ভুইল্লা আমারে
আমি অহন রিস্কা চালাই ঢাহা শহরে।।


এর বাইরে যে রিকশাওলাদের নিয়া গান নাই, তা কিন্তু না, হাজার হাজার আছে। মানে, একটা হিউজ নাম্বার থাকার কথা।

যেমন, হিন্দি এই সিনেমার নায়ক রিকশাওলা, বোম্বের আর্লি স্টেইজের ঘটনা, এইটা দিয়াও একভাবে বুঝতে পারার কথা যে, রিকশাওলা ব্যাপারটা শহরের ফর্মেশনের প্রথমদিককার রিয়্যালিটি। শহর যখন আরো মেট্রোপলিটন হইতে থাকে, রিকশাওলারা আরো মার্জিন্যাল হইতে থাকবেন। যেমন, এখন হিন্দি সিনেমায় নায়ক তো দূরের কথা, কোনো রিকশাওলা কোনো ক্যারেক্টার পাওয়া যাইব কি না, আমি ডাউটফুল। (ইউটিউব লিংক) । এই কারণে সাবজেক্ট ধইরা আর্টকালচার করাটা যে খুব ইনোসেন্ট একটা ঘটনা — তা না, বরং অনেকবেশি উল্টাটা, যে বাজার আছে বা রিকগ্নিশন পাওয়ার ঘটনাটা অনেকবেশি রিলিভেন্ট। মানে, এই জায়গা থিকা দেখা যাইতেছে তো, চ্যুজিঙের ঘটনাগুলা। 🙂

রিকশাওলাদের নিয়া আইটেম-স্যংও আছে, হেব্বি ম্যাস্কুলিন, স্পেশালি যেইখানে রিকশার হ্যান্ডেলটা ধরার ভঙ্গিটা আছে (ইউটিউব লিংক), ইন্ডিয়ান কোনো রিজিয়োন্যাল ল্যাঙ্গুয়েজের, পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মতোই লাগল কিছুটা।

এছাড়া সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের প্রিয় মমতাজের গান তো আছেই অনেক, যেই জায়গায় আমরা এখন ঢুকতে পারতেছি একটু একটু কইরা (ইউটিউব লিংক)। এইটা ঠিক উল্টা একটা জায়গা, আমরা যারা রিকশাতে কইরা ঘুরি — তাদের জায়গা থিকা দেখা হইতেছে না, বরং রিকশাওলাদের জায়গা থিকা দেখা হইতেছে, যেইখানে রিকশাওলারা তাদের প্রলেতারিয়েত প্রেম দিয়া মিডলক্লাস মেয়েদরকে পটায়া ফেলতে পারতেছেন। সুন্দর ফ্যান্টাসি একটা! যেন, আর্টের আর কাম কি! এইরকম ফ্যান্টাসি ক্রিয়েট করাই তো! এইরকমটা পুরাপুরি সাবস্ক্রাইব না করলে, অ্যাটলিস্ট খারাপ লাগার কথা না উনাদের! যে, দেখো বাল, আমার কাছে গান বেচার লাইগা, আমারেই নায়ক বানায়া দিছে! মোস্টলি ঘটনাটা মেবি এইরকমই, অনেকটা।

* মাঝি   গানটা অবশ্য আরেকটু বেশি বাজে। মানে, খালি মাঝির দুঃখেই থাইমা থাকে নাই ঘটনাটা, যারা  ডিস্কো নাচে, কিন্তু মাঝিদেরকে রেডিও কিইনা দেয় না, দান-খয়রাত করে না, তাদেরকে লজ্জা দেয়ার ব্যাপারটাও আছে।

ফিডব্যাক ও মাকসুদের মাঝি  গান :

মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না
আইতাছে ভাইঙ্গা এত বড় ঢেউ
সারা বাংলাদেশ জানল মাঝি
তুই তো জানলি না রে।

পইড়া খবর পত্রিকাতে
বুক ভাইসা যায় চোখের জলে
দেখতাছি যে টেলিভিশনে
ভাইসা গেছে সাগরজলে
কুকুর-গরু-বাছুরের মাঝে উলঙ্গ তোর দেহখানা।
মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না …

দেইখা ভীষণ অবাক লাগে
বড় মানুষ বড় মুখে
তারাই নাকি বড় হোটেলে
তোর কারণেই তোরই দুঃখে
সারারাত্রি ডিস্কো নাইচা
টোকাইতাছে টাকা-আনা।
মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না …

তোর লাশেরে নিয়া সবে
লোক দেখাইয়া কাইন্দা মরে
এক সাধারণ শিল্পী হইয়া
দুঃখ জানাই কেমন কইরা
গানের সুরে চোখের জলে শোধ হয় কি দুঃখের দেনা?
মাঝি তোর রেডিও নাই বইলা জানতেও পারলি না …

রচনাকাল / মার্চ ২০১৯

ব্যানারে ব্যবহৃত পেইন্টিঙের শিল্পী আফ্রিদা তানজিম মাহি। পেইন্টিঙটি অকালপ্রয়াত শিল্পীর স্মরণে সঞ্চালিত ফেসবুকপেইজ ‘দি আফ্রিদা তানজিম মেমোরিয়াল আর্ট ফাউন্ডেশন’ থেকে সংগৃহীত।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you