রকপ্রেস ও বাংলাদেশ || মাকসুদুল হক

রকপ্রেস ও বাংলাদেশ || মাকসুদুল হক

চার দশক হলো মিউজিকের সাথে – বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক আন্দোলনের সাথে – জড়িত আছি। দীর্ঘ এই সময়ের পথে পথে তীব্রভাবে অনুভব করেছি যে এই সংগীত নিয়ে – আমাদের এই সংগীতধারাটি নিয়ে – লেখালেখির প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। অনেক অনেক তরুণ সাংবাদিক আসেন আমার কাছে এই ব্যাপারে সাহায্যের জন্য এবং আমি চেষ্টা করি যথাসাধ্য। মনে পড়ছে, আমার বন্ধু মাইলস-এর শাফিন আহমেদ এই বিষয়ে প্রথম পদক্ষেপ নেয় সম্ভবত নব্বইয়ের দশকের প্রারম্ভে সংগীতাঙ্গন নামে একটা ম্যাগ দিয়ে। কিন্তু শেষ-পর্যন্ত যা হয় তা-ই হলো। আসলে এ-ধরনের ম্যাগাজিনে যারা লেখে বা যারা রেকর্ড ইত্যাদি করে তারা মূলত পার্টটাইমার বা শখে করে। সেই শখটা বেশিদিন থাকে না। আর বিশাল খরচেরও একটা ব্যাপার আছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যদি এটি করা যায় – একটি রকপ্রেস যদি সৃষ্টি হয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে, তাহলেই আমাদের সবার উপকারে আসবে। মনে রাখতে হবে যে মিউজিক একটি ইন্ডাস্ট্রি এবং বিশ্বে এটি তৃতীয় বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি।

আমাদের দৈনিক/সাপ্তাহিক/পাক্ষিক/মাসিক পত্রিকাগুলোতে মিউজিক নিয়ে যে-ধরনের ইনফর্মেশন আসে তা খুব ভালো মানের বলা যাবে না বা বিস্তারিত কি ইন-ডেপ্থ তেমনকিছু অন্তত আমার চোখে পড়ে না। ছাপা মিডিয়ার যারা আমার কাছে আসে তারা ঘুরেফিরে সেই একই গতে-বাঁধা প্রশ্নই করে। যেমন – মাকসুদভাই কবে গান শুরু করলেন? … গানের বিষয়বস্তু কি? … আপনার সামনের পরিকল্পনা কি? … আপনার প্রিয় পোশাক কি? … প্রিয় খাবার কি? … ইত্যাদি ইত্যাদি … এই ধরনের হাবিজাবি সব প্রশ্ন। দুঃখের জায়গাটা হলো, যিনি আসেন আমার সাথে আলাপ করতে তিনি মিউজিক সম্বন্ধে আদৌ কোনো ধারণাই রাখেন না।

আমার মনে হয় এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার সম্পূর্ণ মিউজিকনির্ভর শক্তিশালী একটা ডাটাবেস। এই উদ্যোগটি প্রথম নিয়েছিলেন সেই আশির দশকে তদানীন্তন বিটিভির প্রযোজক হাবিব আহসান কোহিনূরভাই। কিন্তু দুঃখজনক যে বিটিভি কর্তৃপক্ষ তখন বা আজ অব্দি এটা কোনো কাজে লাগাতে পারেনি। আর্টিস্টের নামঠিকানা ছাড়াও সমস্ত ইনফো সেই ডাটাবেসে ছিল। এমনকি বিটিভির কোন অনুষ্ঠানে শিল্পীর পারিশ্রমিক কি হবে সেটা পর্যন্ত দেয়া ছিল। টাইম প্রিসেট করা ছিল যেখান থেকে শিল্পীর জন্মদিনের ইনফো একসপ্তাহ আগেই চলে আসত ছবি সহ। এ-ধরনের একটি উদ্যোগ নেয়ার সময় আবার চলে এসেছে।

কপিরাইট, শিল্পীর ন্যায্য অধিকার ও সম্মানী
আমি অনেক বছর ধরে এ নিয়ে একাই লড়ছি। যখন শুরু করি তখন এ বিষয়ে কারো কোনো সমর্থন পাইনি। এখন বিষয়গুলো সবার কাছে বোধগম্য। এ নিয়ে এখন অনেক লেখালেখি, বহু তর্কবিতর্ক। কিন্তু আমি হতাশ। যাদের কাছে এখন বোধগম্য হচ্ছে ব্যাপারগুলো, বুঝতে পারছে যারা, তারা এ নিয়ে কেবলই ধান্দা করতে আসছে। এখন তো বিভিন্ন পত্রিকা (নাম বলব না) ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস নিয়ে নতুনভাবে জোরেশোরে আন্দোলন শুরু করেছে। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, যারা অধিকারের কথা বলে মুখে ফেনা তুলছে তারা প্রকৃত অর্থে চাচ্ছে শিল্পীদের অভিভাবক হতে। এটা তারা করতে পারে না; – কারণ, পত্রিকা কখনোই শিল্পীর অভিভাবক না। এ কাজ একজন আইনজীবীর। দেশে কপিরাইট অ্যাক্ট বহাল আছে। কপিরাইটের আইন যেগুলো দেয়া আছে সেগুলোর ভেতরে থেকেই কাজ করার প্রচুর সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রোডাকশন কোম্প্যানিগুলো কখনোই রয়্যালিটি দেয়নি, তাই রয়্যালিটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের শিল্পীদের নিজেদেরই। আমি আবারও বলছি মিউজিক একটি ইন্ডাস্ট্রি এবং এর সাথে রেকর্ডিং কোম্প্যানি, প্রোডিউসার, শিল্পী, ভিডিয়োমেকার্স সবারই স্বার্থ জড়িত আছে। এই সবকিছুর সাথে সমন্বয় সাধন করে ব্যাপারটা ভাবতে হবে। এই কাজ কোনো মিডিয়া বা পত্রিকা করে বলে সারাবিশ্বের কোথাও আজ অব্দি শুনিনি। মিডিয়া নিজেই শিল্পী ঠকায়, এসে বলছে কিনা শিল্পীর সব স্বার্থ দেখবে। সে কে? কেনই-বা তাকে আমরা বিশ্বাস করব? যেখানে পত্রিকা নিজেই বিদেশী কার্টুন, লেখা, ছবি ইত্যাদি কাটপেস্ট করে পাইরেসি দিয়া চালাচ্ছে। নিজের ফোটোগ্রাফারকে ‘স্টাফ ফোটোগ্রাফার’ বানিয়ে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। তাকে কোন ভরসায় আমি বিশ্বাস করব? তারা কি আদৌ জানে, সেই ফোটোগ্রাফারের অধিকার কতটুকু?

সুতরাং কপিরাইট আন্দোলনটা অনেক বড় করতে হবে এবং আমাদেরে চেষ্টা করে যেতে হবে। আমাদের বামবা থেকেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনোভাবেই ব্যাটেবলে আর হয়নি।

অপরদিকে রেডিয়োস্টেশনগুলোর কথায় আসা যাক। তারা নির্দ্বিধায় আমাদের গান বাজায়। কিন্তু পয়সা দেয় না। বলে, এতে নাকি আমাদের প্রচার হচ্ছে। কিন্তু আমরা কি প্রচার চেয়েছি? আমাদের গানগুলো ব্যবহার করে, আমাদের পিঠে চড়ে উনারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সেলফোন, বহুজাতিক আর বিবিধ পণ্যবিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? শিল্পীদের গান না থাকলে কি উনারা এই ব্যবসা করতে পারতেন? যত বড় রেডিয়োকোম্প্যানি হোক না কেন বাংলাদেশের সব-কয়টি রেডিয়োস্টেশন পাইরেসির প্রোমোটার রেডিয়োস্টেশন। তাই এগুলো সম্পূর্ণ বেআইনি। বহির্বিশ্বে কোথাও এটা বরদাশ্ত করা হয় না। আমরা শিল্পীরা তো লাখ লাখ টাকা চাইছি না। গানপ্রতি পঁচিশ পয়সা করেই দিক, তাতেও আমি খুশি। মাস শেষে দেখা গেল পাঁচশ টাকার একটা চেক পেলাম। তাও তো অনেক। অন্তত মনে করব আমার সৃষ্টির মূল্যায়ন হচ্ছে। কেবল পত্রিকা নয়, এই একই সমস্যা টিভিচ্যানেলগুলোর ক্ষেত্রেও।

এখন দরকার শিল্পীদের একাত্মতা
দুর্ভাগ্য যে আমাদের মধ্যে একাত্মতার প্রচণ্ড অভাব। আমরা একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি – এ-পর্যন্ত যেসব কাজ করিয়ে রেকর্ডকোম্প্যানিগুলো শিল্পীদের রয়্যালিটি দেয়নি সেগুলো এককালীন পোস্ট-ফ্যাক্ট একটি অঙ্ক আমরা নির্ণয় করতে পারি এবং আগামীর জন্য যে অর্থ উপার্জিত হবে শিল্পীর গান দ্বারা তার একটি পার্সেন্টেজ অবশ্যই নির্ণয় করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে আইন অনুযায়ী যে রয়্যালিটি আসে সেগুলোই তারা দিক। ঠিক যখন আমি এই কথাগুলো বলছি তখন দেখা গেল একটি রেকর্ডিং কোম্প্যানি একজন শিল্পীকে দশলক্ষ টাকা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করল এবং সেই শিল্পী দশলাখ টাকার লোভ সামলাতে না পেরে দুষ্কর্মটি করেই ফেললেন। একবারও তিনি ভাবলেন না যে তার এই কাজের মূল্য হয়তো কোটি টাকারও উপরে। আগামী দিনগুলোতে তার সন্তানাদি তো বটেই তার সাতপুরুষ খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক লতা মুঙ্গেশকর প্রতিমাসে তিন কোটি টাকার ঊর্ধ্বে রয়্যালিটি পান এবং তিনি পাবেন সারাজীবন। পরবর্তীতে উনার আত্মীয়স্বজন সবাই সারাজীবনের জন্য পাবেন। এখন তোমাদের এখানে যে-যার মতো সুযোগ নিয়ে কেটে পড়ছে। তাহলে কি আমরা সারাজীবন শৌখীন শিল্পী হিসেবে বেঁচে থাকব? আমরা কি সারাজীবন কষ্ট করার পরও দুঃস্থ শিল্পীর অসম্মান নিয়ে মরব? বিশ্বে কোথাও দুঃস্থ শিল্পী আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু এদেশে শিল্পীরা শেষবয়সে দুঃস্থ শিল্পী হয়ে যান। কষ্ট লাগে ভাবতে আমাদের ন্যাশন্যাল আইকন সাবিনা ইয়াসমিনকেও দুঃস্থ শিল্পী হিসেবেও প্রচার করা হয়েছে! এটা কি মেনে নেয়া যায়? এজন্য কি সাবিনা ইয়াসমিন দায়ী? না, এটার জন্য আমি-আপনি দায়ী। কারণ আমরা কি করছি? আমরা কেবলই কথা বলছি, আমাদের এটা নেই তো ওটা নেই। কিন্তু কাজের কথা বললে সবাই প্রথমে ব্যক্তিস্বার্থ দেখে।

মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির হাল অবস্থা
গত কয়েক বছরে কোনো বড় ব্যান্ডের কাজ বাজারে আসেনি। যেমন ফিডব্যাক, মাইলস, এলআরবি, ঢাকা ইত্যাদি। আবার নতুন সম্ভাবনাময় ও ব্যবসাসফল ভালো ব্যান্ডগুলো দুয়েকটি অ্যালবাম বের হওয়ার পর আর-কোনো খবর নাই। প্রোডাকশনকোম্প্যানিরা দোষ দিচ্ছে যে গানের পাইরেসির জন্য এ দুরবস্থা। আমি মনে করি পাইরেসি তখনই হয় যখন চাহিদা থাকে। একটি টিভিইন্টার্ভিয়্যুতে আমাকে পাইরেসির বিপক্ষে বলতে বলা হচ্ছিল। কিন্তু আমি বলেছি আমি পাইরেসির পক্ষে। বলেছি এ-কারণে যে একটি অ্যাবাম বের করার আগে প্রোডাকশনকোম্প্যানিগুলো আমাকে খুব মূল্যায়ন করে। রীতিমতো মাথায় নিয়ে নাচে। কিন্তু রিলিজের পরে সে আমার দিকে একবারও ঘুরে তাকায় না। তো সেই কোম্প্যানির স্বার্থরক্ষার জন্য আমার কি ঠেকা পড়েছে? পাইরেসির কারণে তারই ব্যবসা কমে গেছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সে যে ব্যবসা করছে আমাকে পুঁজি করে তার অংশ কি আমাকে দেয়? তার একটি টাকাও কি দেয়? যদি দিত, আমি কেন সব শিল্পী মিলে আমরা আইনের শরণাপন্ন হতাম। আইন আমাকে সহায়তা না করলে যেসব দোকান পাইরেসি করে তাদের সামনে বসে অনশন ধর্মঘট করতাম। শিল্পীদের স্বার্থ যদি নিশ্চিত থাকে আমি জোর গলায় বলতে পারি শিল্পীরা সকলে মিলে পাইরেসির বিপক্ষে জোর অবস্থান নিত। বিদেশে সচেতন শিল্পীর কমতি নেই, কলকাতার দিকে আমি যাবই না। এ বিষয়ে সৎ সংবাদপত্রিকা বা টিভিচ্যানেল কেউ যদি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায় তবে আমরা জোর ও সাহস পবো। কেবলই মিউজিকের ক্ষেত্রে নয়, শিল্পের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে এই ভালো কাজগুলো হতে পারে। পাশাপাশি একটা অ্যাকাডেমিক পাব্লিকেশনের কথাও আমরা ভাবতে পারি। মিউজিক নয়, এতে আরও সমস্ত শিল্পই উপকৃত হবে। একটি জাতির যদি রাজনৈতিক ধস নামে, সেখান থেকে ফিরে আসা সবসময়ই সম্ভব। তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গন যদি ধসের মুখোমুখি হয়, সেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব। আমরা মনে হয় সেদিকেই যাচ্ছি। এবং সময় এসেছে শিল্পীদের একটু শক্ত অবস্থান নেয়ার, যা থেকে সব ধরনের শিল্পী ও কলাকুশলী উপকৃত হবে।

বহুজাতিক কোম্প্যানির হস্তক্ষেপ
প্রারম্ভে একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই, শিল্প ও শিল্পীর উন্নয়নে বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্প্যানিগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় আমি সমর্থন দেই। কিন্তু কর্পোরেট আজকাল নিজস্ব একটি সংস্কৃতি দাঁড় করাচ্ছে, শিল্পীদের পোষণ-শাসন ও অতিক্ষুদ্র একটি বৃত্তের মধ্যে ব্যাপারটা আবদ্ধ করে রাখতে চাইছে যা সম্পূর্ণ অসম্মানজনক। এবং কোনোভাবেই কোনো সভ্য জাতি এই কর্পোরেট সংস্কৃতি বরদাশ্ত করতে পারবে না। উদাহরণ দিতে পারি। একটি ছোট্ট মেয়ে এসে বলল আমায়, সে অমুক বহুজাতিক কোম্প্যানির যে কোম্প্যানিটা আমি জানি টুথপেস্ট বেচে। রসিকতা করলাম অতি দুঃখে, বললাম, তুমি কি তবে টুথপেস্ট? কেন তুমি নিজের পরিচয় না দিয়ে তুমি একটি কোম্প্যানির পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছ? তুমি একজন শিল্পী এবং তোমার পণ্য তুমি নিজে। কেন তুমি টুথপেস্টের সাথে নিজেকে জড়াচ্ছ? সমস্যা হচ্ছে কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতার নামে যে প্রচরণা হচ্ছে সেখানে দেখতে পাচ্ছি শিল্পীর নিজের পরিচয়ের চেয়ে পণ্যপরিচয় প্রাধান্য/অগ্রাধিকার দেয়। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আমাদের মিডিয়া। ধরা যাক বিশ্বনন্দিত গায়িকা পলা আবদুল, সেও তো কোকাকোলার আর্টিস্ট। তাকে কোথাও কেউ এমএস কোকাকোলা বলে সম্বোধন করে? এমএস পেপসি আর্টিস্ট, স্যার এল্টন জন কোকাকোলা আর্টিস্ট, আমরা কি তাদেরে সেই পরিচয়ে চিনি? এদেশের বহুজাতিক কোম্প্যানিগুলো শিল্পীদের পিঠে চড়ে তাদের পণ্য হিসেবে বিক্রি করছে। এটা করে শিল্পী ও শিল্পকে অপমান করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এ নিয়ে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা কারো নেই। মিউজিকে প্রফেশন যদি করতে হয় শিল্পীকে তো বাঁচতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাকরি করি, এই কথা জেনে অনেকেই শকড হয়। মাকসুদভাইয়ের মতো শিল্পী চাকরি করেন? কিন্তু আমি চাকরি না করলে হয় আমাকে ভিক্ষা করতে হবে নতুবা বহুজাতিক কোম্প্যানির কাছে আমার শিল্পীসত্তাকে বিক্রি করতে হবে। অথবা মিডিয়ার সুনজরে থাকার জন্য ঘুরতে হবে। আমি মনে করি কোনো প্রকৃত সৎ শিল্পীর এগুলো কাম্য হতে পারে না।

আমাদের গান অনেক খাঁটি
আমার চল্লিশ বছরের মিউজিকের জীবনে এগারো বছর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন হোটেল) গান করি। তখন বাংলা গান করতাম না, বাংলা কথাও বলতাম না। ওই এগারো বছরে সমগ্র বিশ্বের ওয়েস্টার্ন মিউজিক শুনতাম ও বিদেশী শ্রোতাদের সামনে পার্ফোর্ম করতাম। সপ্তাহে চার-পাঁচবার পার্ফোর্ম করতাম। জ্যাজ, মেটাল, পাঙ্ক সহ সব ধরনের ফর্মের ওপরে পাঁচশর মতো গান করেছিলাম। তারপরে যখন বাংলা গানে এলাম তখন তো আমি জেনেই এসেছি। ওয়েস্টার্ন মিউজিক দিয়ে আমাকে চমৎকৃত করার বা বিমুগ্ধ করার কিছু নেই। আমি সেগুলো জানি এবং বুঝি। এরপর আমি গ্রামে গেলাম। ওই গ্রামীণ জীবনে চলে গেলাম, হারিয়ে গেলাম দিন-কে-দিন, মাস-কে-মাস। অনেকের তখন দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেল আমাকে নিয়ে। আমি তখন দেখলাম যে আমাদের শিকড়ে যে সম্পদ আছে এখনও এটার ধারেকাছে কোনো ওয়েস্টার্ন মিউজিক নেই। আমরা যদি আমাদের মিউজিকটাকে ওয়েস্টার্ন ফর্ম্যাটে করি তাহলে আমি নিশ্চিত ওয়েস্টার্ন মিউজিকে আমাদের গানগুলো সুদৃঢ় অবস্থানে থাকতে পারবে।

গানপারটীকা
এই লেখাটা আমরা পুরনো পত্রিকাবান্ডিল থেকে উদ্ধার করেছি, কিছু প্রয়োজনীয় বানানভ্রান্তি নিরসন ও অন্যান্য সম্পাদনাপূর্বক কম্পোজ করেছি, কিছু জায়গায় বাক্য অসম্পূর্ণ ও মুদ্রণবিভ্রাটজনিত কারণেই আন্দাজ করি বাক্যবিতরিত ভাব অস্পষ্ট ও অবোধ্য ছিল এবং সেই জায়গাগুলো যথাসাধ্য ঠিকঠাক করেছি। এবং জরুরি বিবেচনায় লেখাটা গানপারের মাধ্যমে পাঠকের সামনে অ্যাভেইলেবল রাখতে চাইছি।

লেখাটা ছাপা হয়েছিল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে, ফেব্রুয়ারি মাসে ভ্যালেন্টাইন্স দিনে বেরোনো নতুন একটা পাক্ষিক পত্রিকার সূচনাসংখ্যায়, ‘রেইনবো’ সেই ম্যাগাজিনের নাম। মাকসুদুল হকের প্রকাশিত বাংলা প্রবন্ধনিবন্ধের বই ‘আমি বাংলাদেশের দালাল বলছি’ খুঁজে দেখেছি এই লেখাটা সেখানে নাই। কাজেই অগ্রন্থিত রচনাটা পাঠকগোচরে এনে রাখাটা আমরা দরকারি বিবেচনা করেছি।

কিন্তু প্রসঙ্গের সময়োপযোগ এখনও বহাল বলেই ম্যাকের রচনাটা আমরা আরও মনোযোগে লক্ষ করব। রকপ্রেসের অভাবজনিত পরিস্থিতি, রয়্যালিটি নিয়া সাংগীতিক জগতে ম্যাকবর্ণিত অবস্থা, পাইরেসি ইত্যাদি ইশ্যুগুলোর খুব-একটা আশাব্যঞ্জক উন্নতি এখনও হয়নি নিশ্চয়। নিরানব্বইয়ে প্রথম প্রকাশকালে এই রচনার শীর্ষক ছিল ‘বাংলাদেশে রক প্রেস এর অভাব’, অর্থের হানি না ঘটিয়ে আমরা আদি শিরোনামে একটু পরিবর্তন এনেছি ।

‘রেইনবো’ উদ্বোধনী ইশ্যুতে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল সাতজনের লেখা ছাপা হয়েছিল ‘জীবনের সাত রং’ শিরোনামের আওতায়। সেই বিভাগে মাকসুদুল হকের পরিচিতিজ্ঞাপক ছোট্ট একটা ভূমিকা দেয়া হয়েছিল পত্রিকাতরফে, সেখানে লেখা : “এদেশে ব্যান্ডইন্ডাস্ট্রির বয়স খুব বেশি নয়। কিন্তু এই অল্প সময়ে যাদের জাদুর বুননে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি সমৃদ্ধি লাভ করেছে তাদের অন্যতম সদস্য আজকের মাকসুদ-ও-ঢাকা ব্যান্ডের মাকসুদুল হক। তিরিশ বছর ধরে এদেশের ব্যান্ডের পরিচর্যা করে এসেছেন তিনি। বাংলাদেশের মিউজিক-ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখনীতে।”

একদশক আগে লেখা হলেও উপভোগ্য কথনকৌশলের কারণে এবং পরিস্থিতি তথৈবচ থাকায় এই রচনার পাঠোপযোগিতা আজও রয়েছে এবং ভবিষ্যতের সংগীতবাজার ও সংগীতবিপণন নিয়া যারা ভাবেন বা কাজ করেন তারা বাংলাদেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির আপডেট মাপতে যেয়ে এই রচনার খোঁজ করবেন নিশ্চয়। কাজে লাগুক রচনাটা সকলের, হাল উন্নত হোক বাংলাদেশের মিউজিকবাজারের, হাওয়া লাগুক নতুন দিনের বাংলাদেশের গানের পালে। – গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you