রকগান, রকবাদ্য, রকলেখা

রকগান, রকবাদ্য, রকলেখা

শেয়ার করুন:

 

রকগায়কেরা মৃত্যুর গান গায়। ওদের নাচ, আলো, মঞ্চ, পোশাক, সবই মৃত্যুর। মৃত্যুও যে কত জীবন্ত, তা ওদের ঘাম ও গর্জন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ওদের গলার ফুলে-ওঠা শিরা বিষনীল, মূলত ওদের গান বোবা। ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো সেদিন রাতে, যখন ওদের একটা ক্যাসেট হাতে নিয়ে দেখতে পেলাম, ভিতরে গোটানো আছে সাপের খোলস, চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত …

রকগায়কেরা তাহলে তো দেখি বিদ্যাপতি হে! ওই-যে, ভানুদার সুবাদে এক-দুইটা বিদ্যাপদ আমরাও তো গলাধঃকরণে সক্ষম হয়েছিনু, রসাস্বাদনেও থোড়া-সা, বাংলার কালেজমাশটার না-হয়েও লুকিয়ে লুকিয়ে এক-দো মঙ্গলকাব্যপঙক্তি-চর্যাশ্লোক মাঝেমধ্যে টাকরায় চেখে দেখা আদৌ কঠিন কিছু না। তা, বেশ, কার ভরসায় ক্লেইম করছ তুমি যে বিদ্যাপতি ছিলেন একজন রকার? প্রিমিটিভ বহুকিছুতেই রকানুষঙ্গ সুলভ না-হলেও দুর্লভ হবে না খুঁজতে নামলে। তাই বলে একেবারে রকার বানিয়ে ফেলবা বিদ্যাপতিজিরে? এখন, রকার যদি বানানো যায় তো ক্ষতি কি! বিদ্যাপতি তো রকারই। কেন, মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান  উনি গাহেন নাই? কিংবা শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা / কুঞ্জপথে সখি ক্যায়সে যাওব / অবলা কামিনী রে … এইগুলা তো রক মাল, তাই না?

 


তাইলে কি ব্যাপারটা এমনই যে রকগায়কেরা খালি মৃত্যুরই জয়ভেরী বাজায়ে চলেন? না, তা না মনে হয়। মৃত্যুর মতন নীল তাদের সৃজন (কী তামশা! মৃত্যু কি নীল? তুমি দেখেছ বুঝি মৃত্যুবর্ণ? আজব!); তবে মৃত্যুর জয়গান যেমন নয়, তেমনি জীবন নিয়াও উচ্চকিত নন রকাররা। রক মিউজিকের কারবার জীবন নিয়াও না, আবার মৃত্যুপ্রতিম মিউজিক হলেও অবিকল যে-মরাটা আমি-আপনি নিতিদিন মরি সেই কমন মরা নিয়াও তাদের ব্যবসাবাণিজ্য ভাবিত না। তারা ইনডিড জীবনমুখী-মৃত্যুমুখী কিচ্ছুটিই না। তারা সিসিফাস। গড়ানো পাথরের পেছনেই তারা থাকেন। জীবনমুখারা, আগুনমুখারা, মৃত্যুমুখা তথা মরমিরা গান করেন আর ভাবেন ও বলে থাকেন হামেশা যে এই বিপুলা ভুবনেরে একটাকিছু ওয়ার্থোয়াইল দিয়া যাইছেন উনারা নিত্য। রকারের এইসব আন্দুধুন্দু ভাবাভাবির বেইল নাই। দি মিথ অফ সিসিফাস তারা জানেন। ব্ব্যাস। তারা রকগান করেন। রকগায়ক। রকার। ভ্যানতারা নাই তাদের। রক অ্যারাউন্ড দ্য ক্লক। রকিন অ্যান্ড রলিন অ্যারাউন্ড অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ বিয়ন্ড দ্য গ্লোব। দ্যাটস্ অল।

 


রকগান নিয়া বাংলার সিরিয়াসদের অবস্থান খুবই গোলমেলে। এরচেয়েও অধিক গোলমেলে হিন্দুস্তানি ধ্রুপদ মিউজিক নিয়া তাদিগের পজিশনমার্ক। বাংলার কবিসাহিত্যিকরা তো অতীব মজাদার আচরণের পয়দা করে চলেছেন সেই প্রিহিস্টোরিক পর্যায় থেকে। ভাবখানা এমনই যে, এককালে রক শুনে বেড়ে উঠেছ, আচ্ছা ঠিক আছে, এখন বাপু তুমি বঙ্গজ ঠোঙাকাগুজে মহান কবিসাহিত্যিক, তোমার একটা ভাবমূর্তি রাখা চাই টাইট করে ধরে, যেন ক্ষুণ্ন না-হয় রক-ফাঙ্কি-সাইকেডেলিকে মজে। বরং তুমি হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল শ্রবণ করো, উপভোগ করো, সমুজদারি করো কর্ণাটকি মিউজিক বা পাতিয়ালা-হারিয়ানা ঘরানার। কেমন চেহারা সেই সমুজদারির? উস্তাদ বড়ে অমুকজি কিংবা মাঝারি তমুক মিয়াঁসাহাব ক্যায়া গানা গায়া! আলাপের কাজটুকু অতীব মনোহর হয়েছিল, আর জোড়-মীড়ের কাজ তো দুইকথায় কহতব্য নয় হে! আর উনার পরনের তহবন/শাল/আলোয়ানখানা কাশ্মির থেকে জেয়াদা পাঁচলাখ তনখা খর্চিয়া খরিদ করা। কাশ্মিরের উমদা জাতের ল্যাম্বলোম হইতে তোয়েরকৃত পশমিনা। আহা হা! তা, এ-ই হলো উমদা শাস্ত্রীয় সমুজদারির কারবার। আমার বচপন থেকে এই মুহব্বতের ঠ্যালায় গানাবাজানা কানে শোনা প্রায় ছেড়েই দিয়াছি বলা যায়। অ্যানিওয়ে। এর বাইরে একটা গ্রুপ আছে, বঙ্গজ সিরিয়াস/সাংঘাতিক/মারাত্মক কবিসাহিত্যিকদের, এরা বাউলগান আর পল্লিমিউজিক ছাড়া হারাম কিচ্ছুটি বোঝেন না। ফ্যাসিনেশন থাকতেই পারে একজনের, বিশেষ একজনে/একবিষয়ে ফ্যাসিনেইটেড/অনুরক্ত হইতেই পারেন আপনি, কিন্তু একটার প্রতি প্রেমজনিত কারণে জগতের বাকি সবটার প্রতি বিরাগ, এইটা আপনের কিমুন বিবেচনা কত্তা! সেই-যে, যা-কিছুই জানতে যাও, গুরু উবাচ : ‘বেদে আছে’ — এই ব্যাদে আছে … ব্যাদে আছে  আওয়াজে জঙ্গল প্রকম্পিত, টিকিয়া থাকা দায় হইল পুজারিদিগের। দুনিয়ার সব পথ রোমের দিকে গেছে, বা মক্কায়, বেথেলহেমে, বারানসিতে বা অযোধ্যায় বা মণিকর্নিকার ঘাটে, বোধগয়ায়, ঠিকই তো আছে। এইটা আরও অধিকতর ঠিক যে পথ সর্বত্র ও সর্বদা আলবৎ বিরাজিত। পথের বিরাম নাই, মৃত্যু নাই, ধ্বংস নাই, লীলা খালি, পথের লীলা অপরূপা। সাধনপীঠ বা তীর্থধাম মুখ্য না, আনন্দই মুখ্য অভিযাত্রাপথের। সেইটার খোঁজ না-দিয়া খালি বাকবাকুম সমুজদারি, বিতিকিচ্ছিরি পৃষ্ঠপোষকতামারানি, মিউজিকের বেবোধা প্যাট্রন কোথাকার!

 


বাংলায় কি ‘পিউর রক মিউজিক’ হয়েছে? এইটা লাখ টাকার এক খোঁজাখুঁজি কিন্তু! সংক্ষেপে জেনারালাইজ করে এইটা খানিক কেশে বলা যাক যে সিক্সটিজের বব ডিলান ইনফ্লুয়েন্সড যে-রক ওইটা আপনি ঠিক ‘পিউর রক’ বলতে পারবেন না। আদৌ বলা হয়ও না। বলা হয়, ডিলান নিজে বলেছেন, ফোক-রক। বাংলায় যেটুকু রকপ্রয়াস, মোস্টলি সেগুলো ফোক-রক। কোনো-না-কোনোভাবে সেসব একসময় ফোক টিউন লতিয়ে ওঠে। এইটা বাংলাদেশের সমস্ত বড় ও পায়োনিয়র ব্যান্ড/রকগ্রুপগুলোর কাজে লক্ষ করা যাবে। আর পিউর রক করতে সেই-অর্থে তারা চানও নাই ইনিশিয়্যালি। ফিউশন করেছেন, ব্লেন্ডিং ঘটায়েছেন ইস্ট-ওয়েস্ট এবং সর্বশ্রেণির শ্রোতাকে ছাতার তলায় নিতে চেয়েছেন এবং সর্বোপরি অপসংস্কৃতি  অভিযোগ মুকাবিলা করতে চেয়েছেন মরিয়া। কাজেই করতে হয়েছে বিচিত্র আপোসরফাও। ‘ওয়ারফেজ’ ছাড়া তখনকার দিনে কে তেমন দুইয়েকটা সাহসী মিউজিক করেছে যেইটা আপনি হার্ডকোর রক বলতে পেরেছেন বা পারবেন? ‘রকস্ট্রাটা’ আরও পরে এসেছে; সেভাবে সফলও বলা যাবে না তারে। জেমস বলুন বা মাকসুদ, ফিলিংস-ফিডব্যাক, ফজল মাহমুদ আর তাদের ‘নোভা’, তারা সাহসের বহু পদক্ষেপ নিয়েছেন ব্যান্ডগান বা বাংলা রকে, কিন্তু রক পূর্ণাঙ্গ করার চেয়ে জ্যাজ-ব্লুজ-সাইকেডেলিক সংমিশ্রণ ঘটাতে ছিলেন পূর্ণমনস্ক এবং তাতে পেয়েছেনও সাফল্য। অনেক পরে, নেক্সট-জেন গ্রুপগুলো রক বরং অনেক অ্যাগ্রেসিভলি করেছে। ব্ল্যাক-এর কিছু কাজ, এবং বহুলাংশে আর্টসেল । সবাই মিলে রক ঘরানাতেই ছিলেন, টাইমটা দারুণ রল-আউট করেছে ফিল্ডে সেই নব্বইয়ের গোটা কালপর্ব জুড়ে। একবিংশদোরগোড়ায় ব্ল্যাক, আর্টসেল, শিরোনামহীন, নেমেসিস  প্রভৃতি মিউজিকটিম রকিং ভাইব দিয়েছে, স্টেজে এবং রেকর্ডে শ্রোতারা হাতেনাতে পেয়েছে রকের উন্মাদনা।

বাংলায় পিউর রক খুঁজতে নামার ব্যাপারটা, কি বলব, আপাতত যুৎমতো শব্দ হাতড়ে না-পেয়ে স্রেফ হুদা কামই বলতে পারি। ইংরেজিতে কি পিউর বাউলগান বা মুর্শিদি কি কীর্তন হয়? ফ্রেঞ্চে বেদম ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি? চিনে-জ্যাপ্নিজে জারি কিংবা সারি? ইফ নট, বাংলায় পিউর রক তো দূরের কথা, পান্তা-হাঁড়িয়ার রক্তে সেই ইংরেজি রক জিনিশটাই-বা পাবেন কেমন করে? মেটাল? দুইচামচ আগায়ে ডেথমেটাল? বলে কি-না সাইকেডেলিয়া! বাংলায় যা পাবার তা বাংলায় পাবেন, ইংরেজিতে যা থাকার তা ইংরেজিতেই আছে, মধ্যপ্রাচ্যে যেটুকু মধ্যপ্রাচ্যেই। কিন্তু বঙ্গরক বুঝি নিতান্ত নগণ্য, সনাক্তিরও অযোগ্য? শোনেন, রক্তের লগে বেঈমানি আপনি করলেও রক্ত তার দাগ ঠিকই দেখায় আখেরে, এইটা মাথায় রাইখেন।

 


আসলে গোটা-একটা গানকে পিউর রক হিশেবে না-পাইলেও ঘরানার অন্তর্ভূত গানগুলোর মধ্যে অনেক রক মোমেন্ট পাওয়া গিয়াছে বটে। একটা গোটা গান রক কি না, তা মাপার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কন্সার্ট। রকের সহি বিচার শ্রোতার মাঝারে যেয়ে সরাসরি হতে হয়। এমনিতে গিটারিং বা ড্রামিং থেকেও বোঝা যায় অবশ্য। তবে লিরিক্স কখনোই রকের প্রধান বিবেচ্য/বিচার্য নয়। যেমনটা ক্ল্যাসিক্যাল সর্বভারতীয় সংগীতে বাণীপ্রাধান্য ধর্তব্য কোনোকালেই ছিল না। যে-অ্যাবস্ট্র্যাকশন ধ্রুপদ সংগীতের আরাধ্য, রকেরও অবিকল তা-ই। ঘাপলাটা এইখানেই যে, যারা রকভোক্তা, আমি দেখেছি, তারা ক্ল্যাসিক্যাল ওয়েস্টার্ন-ইস্টার্ন সমানভাবেই ভোগ করে বা করতে চায়, কিন্তু উল্টোটা ঘটে না বা ঘটতে দেখি না বলেই সন্দেহ হয় যে হেথাকার ক্ল্যাসিক্যাল কফশ্লেষ্মাধারী মিউজিকপ্যাট্রনরা আদৌ অ্যাবস্ট্র্যাকশন জিনিশটা আদৌ হজম করতে পারেন কি না।

 


আংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেন এবং মশহুর অ্যাওয়ার্ডেড আংরেজ লেখক যারা আংরেজ গর্ভ ও ঔরসে জন্মেছেন এমন ডজনখানেক অথার সার্চ দিয়া বার করে একটা জিনিশ খুঁজলাম যে তারা খালি অপেরা-সোপ্র্যানো আর ফোক সংগীতমালাই পছন্দ করেন, না আউর কুচ। দেখি যে, ওমা, এদের বেশিরভাগই মিক জ্যাগারের ফ্যান! পিঙ্ক ফ্লয়েড ওদের জান! রোলিং স্টোন্স, য়্যু-টু  প্রভৃতি গ্রুপের কন্স্যার্ট থেকে ফেরার পরে এরা সসম্ভ্রম প্রবন্ধকলাম লিখে তাদিগের মহাজাগতিক অভিজ্ঞতা সাড়ম্বরে বিবৃত করেন! য়্যু-টু  ব্যান্ডের বুনোকে নিয়ে, রোলিং স্টোন্সের মিক জ্যাগার আর ডেভিড বাউয়্যি নিয়ে, বি-জিস নিয়ে, নোফ্লার আর হেন্ড্রিক্স নিয়ে, লেনন-ডিলান নিয়ে, অ্যাল স্টুয়ার্ট নিয়ে, হ্যারিসন-মরিসন নিয়ে, ম্যাকার্টনি নিয়ে লেখক-কবি-শিল্পীদের মধ্যে ব্যাপক রচনাপত্র প্রণয়নের আগ্রহ লক্ষ করা যায় বেঙ্গল কম্যুনিটির বাইরে। এদের — ননবেঙ্গলি, ইংরেজি মোস্টলি, রাইটারদের — ভাবমূর্তি নাই! এরা তাইলে তো অচিরেই নিপাত যাবে। এদের মধ্যে গ্যাব্রিয়েল্ গার্সিয়া মার্কেস তো মশহুর আমাদের গ্রামেগঞ্জে শাকিরাফ্যান হিশেবে। এছাড়া সালমান রুশদিও রকমিউজিক নিয়া সাংঘাতিক সপ্রশংস উচ্চকণ্ঠ। গবেষণার বাকি দশজনের নাম ক্রমশ প্রকাশ্য। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল এই ডজনখানেক আংরেজি কবিসাহিত্যিকের ফিউচার নিয়া। আচ্ছা, ভালো কথা, বাংলার মহাকাল আর দুনিয়ার মহাকাল কি এক-ও-অভিন্ন হিসাবের জিনিশ? সন্দেহ হয়। ঘোরতর সন্দেহ হয়।

 


এপিগ্রাফে যে-গানটা গাইলাম, এইটা রণজিৎ দাশ নামে এক রকারের, রকগান, পাওয়া যায় ‘ঈশ্বরের চোখ’ নামে একটা অ্যালবামে, বেরিয়েছিল নাইন্টিননাইন্টিনাইনে। এইটা গাইবার সময় মনে পড়ছিল, অনেকদিন আগে একটা দারুণ গল্প পড়েছিলাম রকগায়ক উপজীব্য করে, টেরিফিক গল্প, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই গল্পকারের নাম। সম্ভবত ‘কাচভাঙা রাতের গল্প’ অথবা ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ — এই দুইটার কোনো-একটা বইয়ের গল্প হবে সেইটা। বানপ্রস্থে যাবার প্রাক্কালে এইসব মনে পড়ে মানুষের, থেকে-থেকেই ইয়াদ হয়, — গলার ফুলে-ওঠা বিষনীল শিরা, বোবা গান, ঘাম ও গর্জন, নাচ, আলো, মঞ্চ, পোশাক, গোটানো সাপখোলস, চুঁইয়ে-পড়া রক্ত … প্রভৃতি। একই রকারের আরেকটা গান, এইটা গান  শুধুই, ‘বন্দরের কথ্যভাষা’ অ্যালবাম — যা রিলিজ পেয়েছিল ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে — সেইখানে অ্যাভেইল্যাবল, গাইতে গাইতে শেষ করি ডিস্কাশন শোয়ের এই পার্টটুকু :

যদি কোনো বড় গান জেগে ওঠে ধলভূমগড়ে —

কোনো-এক বালিকার দেহাতি হৃদয়ে, তার সরল খেলায়
পেয়ারা-চুরির পথে জেগে-ওঠা ধুলো ও বেদনা
যদি তাকে স্পর্শ করে দুই হাতে — অন্ধ গৃহশিক্ষকের মতো
মাটির পুতুল ভেঙে, গাভীদের ঘুম ভেঙে, অন্তর্গত বৃষ্টির ভিতর
শিক্ষকের হাত ধরে যদি সেই গান ক্রমে দেশান্তরে যায় —

আমাকে খবর দিও, আমিও পিছনে যাবো, ভাগ্যহীন, অন্তিম যাত্রায়

গলার ফুলে-ওঠা বিষনীল শিরা, বোবা গান, ঘাম ও গর্জন, নাচ, আলো, মঞ্চ, পোশাক, গোটানো সাপখোলস, চুঁইয়ে-পড়া রক্ত … উপরের অনুচ্ছেদে এই জিনিশগুলা ড্রাফট করতে যেয়ে ভাবছিলাম, নব্বইয়ের দশকের বাংলাদেশে এমন অনেক অ্যালবামকাভার বা ক্যাসেটের ইনলে কার্ড সমেত প্রচ্ছদপটে এ-ধরনের রকমোটিফগুলো ফুটে উঠত, যেমন ক্যাপ্সুল ৫০০ মিগ্রা, আইয়ুব বাচ্চু আর জেমসের সেই বিপুল দ্বৈরথ, তখনকার জনপ্রিয় ইংলিশ রকব্যান্ডগুলার ইন্সপিরেশনে দেশের ক্যাসেটপ্রচ্ছদের জগতে একটা আর্ট অফ অল্টার্নেটিভ অ্যান্ড আন্ডারগ্রাউন্ড গড়ে উঠছিল। পরে একটা ক্যায়োটিক পপ ঘরানায় একচ্ছত্র পর্যবসিত হয় গোটা বিষয়টা। শায়ান চৌধুরী অর্ণবের একের পর এক অ্যালবামকাভার ও বর্ধিত কলেবর ব্লার্বের ডিজাইনগুলি বিবেচনায় রাখলেও কথাগুলো সম্যক বোঝা যায়।

 


বাহ্! এ-ই তো হওয়া বাঞ্ছনীয়, এ-ই তো হওয়ারই ছিল কথা। বাংলায় এদ্দিন ধরে গানবাজনা নিয়া আলাপালোচনা ব্যাপারটা ছিল একটা ঘেরাটোপের ভেতর আবদ্ধ। ঘুরেফিরে সেই বটগাছের বপু বেষ্টনী দিয়া নাচনকুদন। রমনার বটমূলে ফেব্রুয়ারি-ডিউরিং জ্ঞানভক্তির আতিশয্য। বর্তমানে ফেস্ট ইত্যাদির আনাগোনা বাড়তির দিকে যদিও। ঘটনাটা রাজরানীদের ফুলবাগানে একটু হাঁটিয়া বেড়ানো অব্দি সীমাবদ্ধ অবশ্য। মধ্যবিত্তের সংস্কৃতিবিলাস ভারি আমোদজনক, কারণ এরা শোনে এক এবং বলে আরেক। বা যা বলে তা শোনে না। যা শোনে তা বলে না। আর করে যে এরা কি, তা তো বলা বারণ। এদের জীবন মহা এক সেন্সরশিপের মামলা। আরেকদিক থেকে দেখতে গেলে, মধ্যবিত্তকে হক-নাহক কষে বকাবাদ্যি করা এদের প্যাশন। আমরাই এরা, এরাই আমরা। আশার ব্যাপার এ-ই যে, দৃশ্য বদল হচ্ছে। এখন মধ্যবিত্তীয় পুরনো রোগবালাই থেকে বেরোনোর ব্রেকথ্রু সর্বত্র। অন্তত শিল্পসাহিত্যে এইটা আড়াল ফুঁড়ে আলোয় আসছে। একঘেয়ে পল্লিসাহিত্য তথা খাঁচাছাড়া আত্মারাম আর আত্মাছাড়া খাঁচা নিয়া বাঁধা গানপঙক্তি ব্যতিরেকে বেশিকিছু স্বাগত জানানোর ইতিহাস আমাদের লেখালেখিজগতে নেই। কিংবা থাকলেও কড়ে গোনা। আমরা ঐতিহ্যের বাইরে, অভ্যাসের বাইরে, হ্যাবিচুয়েটেড ফ্রেমের বাইরে যেতে পারি না বা যাবার ইচ্ছাআকাঙ্ক্ষাটুকুও অতীব অল্প। প্রথাশাসিত সর্বাবস্থায় আমরা আমুণ্ডুনখাগ্র। কোনোকিছু লিখতে যেয়ে এই প্রথাশাসন, এই অভ্যাসানুবর্তন, হয়ে ওঠে ব্যাপক পীড়াদায়ী ও অলমোস্ট অসহনীয়।

 


অথচ পল্লিগীতিঘেরা যাপনজীবন তো অধিকারে নেই আমাদিগের। সেই গেরুয়া আলখেল্লা বা আলবোলাটানা যাপন তো অনুপস্থিত প্রপিতামহের আমল থেকেই। কিন্তু প্রপিতামহের প্রকাশাভিব্যক্তি থেকে বেরোতে কেন পারছি না আমরা, আল্লা মালুম। কোনোকিছু লিখতে যেয়ে কেন যাপনানুবর্তী থাকতে পারি না, সাংস্কৃতিক উচ্চম্মন্যতার পরিচয় দিতে যেয়ে কেন মিথ্যে অভিজ্ঞতা বর্ণনের আশ্রয় নিতে হয়, এ এক গবেষণাপেক্ষী বিষয় নিশ্চয়। একটা ভাষাগোষ্ঠী যখন একাধিপত্যমূলক পল্লিগীতি কিংবা বাউলগান বা বড়জোর ঔপমহাদেশিক ধ্রুপদ ছাড়া আর-কিছু শ্রবণাভিজ্ঞতা জনসমক্ষে প্রকাশে কুণ্ঠিত থাকে, ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে বসার মতন গুরুতর নিশ্চয়। একটা হতে পারে যে, এই জাতিটার দেশাত্মচৈতন্য অসম্ভব পুষ্টিহৃষ্ট। অথচ তা তো না। আর-দশটা জাতিগোষ্ঠীর মতনই তো এদের দেশবোধ। অস্বাভাবিক কোনো বিকার সেইভাবে দৃষ্ট হয় না এদের অন্যান্য ক্ষেত্রে। যেমন ধরা যাক সাহিত্যের অন্যান্য সংরূপগুলো অভিজ্ঞতান্তর্গত করে এরা দুনিয়ানুবর্তী থেকেই। মিলিয়েমিশিয়ে অভিজ্ঞতার বয়ান হাজির করতেও অকুণ্ঠ থাকে। এরা তাদের কবিতা বা ছোটগল্প বা উপন্যাস বা নাটক-সিনেমা দেখনাভিজ্ঞতা লিখতে যেয়ে আদ্দিকালে পড়ে থাকে না। এক্ষেত্রে অবশ্য অগ্রবর্তী ধাপে সে বিচরণ করে, একটু অতিমাত্রায় অগ্রবর্তী, পারলে নিজের ভাষার লেখালেখিগুলো অস্বীকারিয়া হলেও নিজের ইন্টেলেক্টের অ্যাডভান্সড লেভেল প্রমাণিতে আদাজল খেয়ে ব্রতী হয়। কেবল গানশ্রবণাভিজ্ঞতা প্রকাশে হেন উলটোবুজলি বিতিকিচ্ছিরিতা। আজব! এলিয়ট-পাউন্ড পড়ুয়া লোকলস্কর গান শোনার অভিজ্ঞতা হাজির করতে যেয়ে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বা আরেকদিক থেকে লালন পর্যন্ত বর্ডারিং অ্যারিয়া। রামকুমারের টপ্পা-ঠুম্রি কিংবা বড়েগোলাম-আমজাদআলি বা হালের হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সাংগীতিক বলিউডি ক্রেইজ উস্তাদ রশিদ খাঁ। অথচ এর বাইরেই জীবনযাপন-জলপানি ও যাবতীয় মামলামোকদ্দমা তাদিগের, হিন্দি ফিল্মি গানা আর বাংলা বেধড়ক ড্রামপেটানো ব্যান্ডসংগীতে বেড়ে-ওঠা তাদের, অথচ তার কাছে যখনই আপনি তার গানযাপন সম্পর্কিত গল্প শুনতে যাবেন, দেখবেন সে আপনাকে তার জাল গল্প শোনাচ্ছে। ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ শুনতে শুনতে একদিন একটা কবিতা লিখে একসময় বেশ নাম-কামানো উঠতি কবি হয়ে উঠেছে যে-মানুষটা, তার গানের গল্প ভরা শাহ আব্দুল করিম। তাজ্জব ব্যাপার! অথবা তাজ্জব না আসলে, এইসব সহজে ব্যাখ্যেয়। তবে এইখানে সেইদিক দিয়া না-যাই আমরা। টাইম শর্ট, তাই, দরকারও হয়তো নাই।

 

১০
কিন্তু স্থিতাবস্থা কাটছে। এইটা আশাব্যঞ্জক খবর। এখন এমনকি ফিল্মি গানা নিয়া, ইংরেজি ক্র্যাশরকমুগ্ধতা নিয়া, পাকিস্তানি জল-জুনুন বা কোকস্টুডিয়োবাহিত কোনো ভিনভাষার মাতোয়ালা বাজনা-গাওনা নিয়া লেখার মানুষ ও মনন-মানসিকতা বাড়ছে বৈকি। নিঃশ্বাস ক্রমে সহজ হয়ে উঠছে সংস্কৃতির। হাহ্! সংস্কৃতি! বিলাস মনে করে যে-দেশের তথাকথিত শিক্ষিত মনুষ্যগোষ্ঠীর স্টক-সীমিত শ্রেণিটি নিজেদের সংস্কৃতিক্রিয়াকলাপ, নিউজপেপারে ‘সংস্কৃতিবিলাস’ শীর্ষক একটা সাপ্তাহিক কলামে যে-দেশের বুদ্ধিবিনোদজীবী বিভিন্ন বহরের গতরস্বাস্থ্যের ব্যক্তিবর্গ হুমড়ি খেয়ে হে-হে ক্যালাইতে থাকে এবং বলে ফেরে ভ্যান্তারা করে কোন বই পড়তে যেয়ে তাদিগের মালমাত্তা মাথায় ওঠে বা কোন গান শোনার কালে নাসিকা ডাকাডাকির ব্যাপারটা ভারি আরামের হয়; এবং, কসম খোদার, ওয়েল-সার্কুলেইটেড বর্ণিত দৈনিকপত্রটির বিলাসিতা বাংলাদেশজ সংস্কৃতির শিখর গণ্য করছেন কেউ কেউ গত দশকোর্ধ্ব সময় ব্যেপে! এইখানে, এহেন পরিস্থিতিতে, এদের কাছ থেকে, ব্যান্ডমিউজিকের বা রকের বা ফোকের ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রিসিয়েশন পাইলেই কি আর না-পাইলেই কি! বিলাস মনে করে যে-দেশের ইন্টেলিজেনশিয়্যা তার সংস্কৃতিকে, সেই দেশে চিরকাল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াই মিউজিক ফেস্ট গণ্য হবে এবং মরা রাজারাজড়ার পৃষ্ঠপোষণাপ্রাপ্ত সংগীতকলাই শিরোধার্য সোহবৎ বিবেচিত হবে, এরা জ্যান্ত সংগীত ও জীবিতের গানের কদর করবে কেমন করে! এরা নিজেরাই পায়রা-ওড়ানো সুর্মাচক্ষু উনিশ-শতকী মৃত নবাবিয়ানার প্রেতাত্মা ভাঁড় একথোকা। তারিফ পাবেন এদের কাছে কেবল সৎকারগাথার। সংস্কৃতিকীর্তনিয়াদিগের মধ্যে একটা মোটাতাজা অংশ ওদিকে কেবল পল্লিমিউজিক ছাড়া বাদবাকি সবকিছুরেই মনে করেন হ্যালাফ্যালার, দুনিয়ায় তামাম বস্তুভাণ্ডে তেনারা মাটির গন্ধ শুঁকে বেড়ান এবং না-পাইলে ডেফিনিটলি গোস্বা হন, দুনিয়া-আখিরাতের তামাম শোধবোধ বাউল গানেই নিহিত বলিয়া তাদিগের প্রচারণা আবহমান। উনারা পাওয়ার্ফ্যুল তুলনামূলকভাবে অন্যান্য সংস্কৃতিনিশানবাহীদিগের চেয়ে। বেদজ্ঞ পুরোহিত কিংবা তালেবুল-উলুম হুজুরের জারি-করা শাস্ত্রস্তোত্র/ফতোয়ার চেয়েও অনড় ও দুষ্পরিবর্তনীয় উনাদের সংস্কৃতিকৃত্য যেন!

 

১১
মধ্যবিত্তের কোটআনকোট সংস্কৃতি ইমামসায়েবের ফতোয়ার চেয়েও অনড় ও দুষ্পরিবর্তনীয় হয়ে উঠতেসে যেন! ওয়েল, ইট’স্ গেটিং ওভার নাওঅ্যাডেইজ। ফর দ্য টাইমস দ্যে আর অ্যা চেইঞ্জিং — বব ডিলানের সেই গানের মতো। অনেক ধরন ও ধারার গান নিয়েই এখন লেখার লোক বাংলায় বিচ্ছুর ন্যায় দিকে দিকে বাড়িয়া উঠিছে তো! সত্যি বলতে কি, এর কোনো পূর্বনজির নেই বস্তুত। মেইনস্ট্রিম বলিয়া খ্যাত মিডিয়ামেশিন এখনও শক্তি সংগ্রহ করে উঠতে পারে নাই এইধারা কাজকর্ম শরীরে ধরার। এসব মুখ্যত অনলাইন পঠনোপকরণের একচ্ছত্র অবদান। সম্প্রতি এমন আরেকটা অভিজ্ঞতা হলো ‘লাল জীপের ডায়েরী’ রিডিং-সাইটের সৌজন্যে। এই সাইটের একটা ফ্যাসিনেইটিং ব্যাপার হলো জ্যান্ত গানবাজনা ও জ্যান্ত ম্যুভি বা জার্নাল প্রভৃতির প্যাট্রোনাইজ করা। গ্রাঞ্জ ঘরানা নিয়ে, এবং তৎপ্রাসঙ্গিক অন্যান্য, ‘অ্যালিস ইন চেইন্স’ ব্যান্ডের একটা গানসূত্রে লেখা আবর্তিত হয়েছে। লিখেছেন শফিউল জয়।

 

১২
‘অ্যালিস ইন চেইন্স’ ব্যান্ডের যে-গানের ছুঁতায় আবর্তিত জয়ের লেখাটা, সেই গানের পঙক্তিগুলো নিম্নরূপা :

We chase misprinted lies
We face the path of time
And yet I fight
And yet I fight
This battle all alone
No one to cry to
No place to call home…

My gift of self is raped
My privacy is raked
And yet I find
And yet I find
Repeating in my head
If I can’t be my own
I’d feel better dead…

গানটার নাম, মানে টাইটেল অফ দি স্যং, ‘মিসিন্টার্প্রিটেড লাইজ’। কিন্তু না, সার্চ করে দেখলাম  মিসিন্টার্প্রিটেড লাইজ নয়, মিসিন্টার্প্রিটেড বা মিসপ্রিন্টেড মিথ্যাচার নয়, গানটার অরিজিন্যাল ট্র্যাকের ‘নাটশেল’ নাম। নামে কী আর আসে যায়।

লাল জীপের ডায়েরীতে পাব্লিশড শফিউল জয়ের লেখাটার লিঙ্ক রাখছি এই প্যারার নিচের প্যারায়, ‘গ্রাঞ্জ এবং অ্যালিস ইন চেইন্সের নাটশেল’ শিরোনামে লেখাটা ভালো ও উপভোগ্য হয়েছে।

গ্রাঞ্জ এবং অ্যালিস ইন চেইন্সের নাটশেল’ বাই শফিউল জয়।

লিঙ্ক কাজ না করলে দোষ আমার নয়। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা আদৌ কোনোদিনই দীর্ঘায়ু ছিল না, আজকাল তা আরও স্বল্পায়ু হরেক মাপে ও মাত্রায়।

 

১৩
“আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়” এবং ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি কত কত নতুন দেশগাঁয়ে নেমে বাংলায় পেশ করি মম পরিচয় — এবং “আমি নাগরিক কবিয়াল গান বাঁধি” এবং “বাংলায় পাই পৃথিবীর পরিচয়” — এ-মুলুক ও-মুলুক ঘুরে আমি মাধুকরী করে ফিরি বাংলা ঝোলা কাঁধে, বাংলাকে নিয়ে এবং বাংলারই তরে। … কেবল বাউল গানে বেঁধে আমারে রেখো না প্রিয়তমা, আমি তো কত দুয়ারে দুয়ারে কুড়িয়েবাড়িয়ে চলেছি খুদকুড়ো তোমারই খিচুড়ির সুঘ্রাণবর্ধনে, কেবলি হিন্দুস্তানি মার্গমিউজিকে কিংবা বাংলা স্বর্ণযুগীয় পুরাতনী ভদ্রগানে পুতুপুতু পিয়েচডিপিপীলিকামার্কা কাটাই নাই সংস্কৃতিসেবী দিন  … “কত যে সাগর-নদী পেরিয়ে এলাম আমি / কত যে পথ হয়ে পার / তোমার মতন এত অপরূপ সুন্দর / কাউকে তো দেখিনিকো আর” — সেই সাগর-নদী-গিরি অভিযানের গল্পগাছা হোক এইবার, সমস্ত গোছানো-সাজানো প্রতিষ্ঠানের পিন-আটকে-যাওয়া ভাঙা রেকর্ড বাজানোর বাইরে এইসব অনুপম-অপরূপ গল্পগাছা উন্মোচিত হতেছে ধীরে ক্রমে  … অ্যালিস বেচারি তো কবেই ওয়ান্ডার্ল্যান্ডে দম আটকে মারা যাইতে বসেছে, অ্যালিস ইজ ইন চেইন্স সিন্স ইয়ার্স — এই খবর দিকে দিকে জনে জনে প্রচারিত হউক, আর বাজুক শত ফুল ফুটিবার গীতি : “শিকল ছিঁড়িয়া দে মরি দেখিয়া, তারে মরি দেখিয়া” …

 

১৪
নব্বইয়ের গোড়ার দিকে ক্রেইজ তৈরি হয়েছিল কুর্ট ক্যুবেইনের, তার জীবনাচার-ড্রাগাসক্তি, ক্যুর্টনি ল্যভের সঙ্গে প্রেম ও পাপারাৎসি ইত্যাদি, তিরিশ বছর বয়স পূর্তির আগেই মৃত্যু ও ডেথনোট, মৃত্যু না আত্মহনন বিতর্কধুম্র, এবং সর্বোপরি ব্লুজের চেয়েও নিমজ্জনকারী মিউজিক গ্রাঞ্জ ঘরানার হিপ্নোটিক আবেশ তথা নির্ভানার স্টেজ-পার্ফোর্ম্যান্সে কুর্ট ক্যুবেইনের গিটারবাদনকালীন বুঁদ সন্তভঙ্গি ইত্যাদি তখন ভীষণ পপ্যুলার আমাদের কাছে। সেইসময় এমটিভি  ও অত্যল্পকালের মধ্যেই বিবিসিসিএনএন  ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কুর্ট ক্যুবেইন ও নির্ভানার খবরাখবর জানাজানির প্রাইমারি পর্যায়েই আমরা পাই মৃত্যুসংবাদ তার। এবং তখন আমাদের এক বন্ধুর আত্মীয়ের সুবাদে ‘রোলিং স্টোন’ পত্রিকার একটা-কোনো সংখ্যায় ক্যুবেইনের বায়োস্টোরি পড়তে পাই, সেইখানেই নির্ভানার লাইনাপ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি, এবং ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত ঘটে-যাওয়া ক্যুবেইনের লাইফ-ইভেন্টগুলো, বিশেষ করে তার ও তাদের ড্রাগডুবন্ত জীবন ইত্যাদি জেনে উঠি। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে কুর্ট ক্যুবেইন তথা নির্ভানা  ফেব্রিট হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। ‘এআইসি’ পার্ফোর্ম্যান্স দেখেছি এমটিভিতে, চূর্ণসংবাদ পেতাম বিবিসিসিএনএনবাহিত, লিখিতভাবে ‘এআইসি’ সম্পর্কে জেনেছি ওই ‘রোলিং স্টোন’ ম্যাগাজিনের সেই আর্টিক্যল থেকে। এরপর গানও শুনেছি ক্যাসেটপ্লেয়ারে। ইউটিউবযুগে এসে দেখেছি অসংখ্য অনামা অথচ ক্যাসেটপ্লেয়ারে-শোনা গানের মিউজিকভিডিও।

এইসবের — এই শোনার দেখার জানার গল্পের গুজবের — একটা ইম্প্যাক্ট তো অবশ্যই আছে আমার দিনযাপনে, আমার বিকাশে, আমার বেড়ে ওঠাউঠিতে। নিশ্চয় আছে। কিন্তু লিখতে বসে কেন ভুলে যাই এসব? লিখতে বসেই কেন মঙ্গলকাব্যযুগে যাবার বায়নাক্কা ধরি? লিখতে লেগে কেন অস্বীকার করি নিজের বেড়ে-ওঠাউঠির কালটাকে? ‘ফিরে চল মাটির টানে’ মানে কি তবে বানোয়াট মাটিপ্রীতির ভান ও ভং ধরা, না আসলে শেকড় তথা নিজের বিকাশ ও উন্মেষমুহূর্তে ফেরার অভিলাষ? আমার বয়সী অসংখ্য লোকজনা যারা শহরে/শহরতলিতে জন্মেছে ও বড় হয়েছে, তারা আসলে প্রাণ দিয়ে ব্যান্ডবাংলা আর আংরেজি গানটাই শুনেছে, এবং হিন্দিও ধুমধাড়াক্কা, লালন-করিম প্রভৃতি নিশ্চয় মর্যাদা দিয়েছে কিন্তু সেইসব জায়গায় নিজের সঙ্কট নিজের টেনশনটা পায়নি কখনো। মহাকালের বা চিরকালের সঙ্কট বা আততি দিয়া ওই বয়সে আমরা তো বৈতরণী পার হইতে পারতাম না। আমার বন্ধুর/বান্ধবীর দেয়া দাগাটা ভুলে যেয়ে জীবনে ফিরেছি যেই গানটা শুনে, সেই গানটার প্রতি কৃতজ্ঞতা না-জানিয়ে এই মৃত্যুমুখর জীবন থেকে বিদায় নেব আমি? নেভার।

যদিও লাইফ ইজ অ্যা মিসপ্রিন্টেড মিথ্যাচার, মেটিক্যুলাসলি ডিজাইনড মিথ্যাচার, অ্যান্ড ইয়েট আই ফাইট, এইটা আমার একার যুদ্ধ, এইখানে আমার লাগি রোদন করিবে এমন কেহই নাই, এলায় আমি কার কাছে যাই কই গিয়া জিগাই, দুয়ার এঁটে কার ঘরে ঘুমাই … আর আমার আমিটা তো কবেই শ্লীলতাহৃত, হায়! কিন্তু আমি পৃথিবীকে একটি পেন্নাম ঠুকে যেতে চাই আমার যাবার আগে … একটি নমস্কারে, প্রিয়, একটি নমস্কারে …

 

১৫
এরপর শফিউল জয়ের সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় কানেক্টিভিটির সুবাদে পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও উন্নত হয়, কিন্তু পরিচয় ওইখানে, ওই মিসপ্রিন্টেড মিথ্যাচার অথবা নাটশেল নামের গানটার ছুঁতায় লালজীপের ওই লেখাটায়। এর পরের বছরগুলায় মিউজিক নিয়া তার আরও অনুবাদ ও অন্যান্য রচনা পাঠ করার মওকা পাবো। গোড়ার দিকটায়, পারস্পরিক পরিচয়ের একেবারেই গোড়ায়, একটা আলতো কনভার্সেশনের সূত্রপাত হয় একটি বইপাঠোত্তর সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ নজরে এলে, ফেসবুকে এই পাঠপর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেন শফিউল জয়, সেই বইয়ের নাম ‘ইনসাইড আউট : অ্যা পার্সোন্যাল হিস্টোরি অফ পিঙ্ক ফ্লয়েড’, বইটি লিখেছেন ব্যান্ডের ড্রামার নিক ম্যাসন। বইটার হদিসই জানতাম না হয়তো শফিউল জয়ের সৌজন্য ও বরাত ব্যতিরেকে। অ্যানিওয়ে। বই তো পড়া হয় না আজকাল আর, হবেও না হয়তো, কোনোদিনই সেইভাবে আর পড়া হবেনাকো, কুড়ি কুড়ি বছরের পার চলিয়া গিয়াছে আমাদের জীবনের বইপড়াপড়ি দিনগুলো। তবু বই পড়ার গল্প শুনতে ভালোবাসি। বই পড়ার আওয়াজ কানে এলে পথচলতি থমকাই, ঘাড় ঘুরায়া খানিকটা তাকাই, কান খাড়া করি, উৎকর্ণ হই। তো, সেইভাবেই একদিন পথিমধ্যে থমকে এই আলাপ।

শফিউল জয় নিয়মিত পড়াশোনারত, বিশ্ববিদ্যালয়িক শিক্ষার্থী, লেখক ও যদ্দুর মনে হয় মিউজিকের সঙ্গে জড়িত। মোস্ট প্রোব্যাব্লি হার্ডকোর ফ্লয়েডফ্যান। কমেন্টবক্সে কনভার্সেশন সংঘটিত হয়েছিল, হয়ে গেছে বেশ অনেক বছর, শফিউল জয়ের টাইমলাইনের আঁতিপাঁতি অনেক খুঁজেও ওই পোস্ট নোটিস করা যায় নাই বিধায় আলাপের মূল অংশটা যেইটা শফিউল করেছিলেন সেইটা উদ্ধার করা যাইল না। কাজেই এই নোটকার জিমেইল ড্রাফ্টস অপশনে যেয়ে সেই আলাপের কিয়দংশ উদ্ধারিতে চেষ্টা করেছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, নোটকার তার আপন মুদ্রাদোষে ইউনিকোডে বাংলা টাইপ করা ছাড়া গত্যন্তরহীন হবার কারণে অনেক প্রাচীনকালীন খসড়াপাতা ড্রাফ্টস আর্কাইভ থেকে দরকারমতো লোকেইট করা যায়। কিন্তু পরিতাপ এখানে এ-ই যে এই আলাপের কমেন্ট পোর্শনে যে-দুটো সবিস্তার রিমার্ক শফিউল করেছিলেন, যেখানে ম্যাসনের বইটার আরও খানিকটা পাঠাভাস লভেছিলাম, এবং অনুষঙ্গের কয়েকটা কথাবার্তা, কোনো-এক পর্যায়ে, সেগুলো সংরক্ষণ করতে পারি নাই বলে এখানে রাখা যাচ্ছে না। কোটেশনমার্কের ভেতর শফিউল জয়ের পোস্ট থেকে চয়িত কথাগুলো ধরে শুরু হয়েছিল কনভার্সেশন। শফিউল কথার শুরুতে সেই বই থেকে নিক ম্যাসনের বক্তব্য টুকেছেন —

technique is so secondary to ideas… I have never been a fan of gymnastic workouts at the kit, by myself or anyone else দুইটা কথা একই সুরে গাঁথা, এবং যার সারাংশ দিয়ে দুই হাজার সালপরবর্তী বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিকের যে সাধারণ প্রবণতা শোম্যানশিপের — সেটার মর্মমূলে আঘাত করা যায় । সঙ্গত কারণেই দেশি এই ব্যান্ডগুলোর মর্মে রক দর্শন কাজ করে না, কাজ করে পশ্চিমা জগতের উপরিতলের যে ব্যাপারস্যাপার আছে — সেগুলো গায়ে মেখে ব্যান্ড ময়ূর ভেকধারী কাউয়া হওয়ার প্রবণতা।”

ভালো পর্যবেক্ষণ করেছেন জয়। নিক ম্যাসন আর ডেভিড গিল্মোর যে-অর্থে ব্যান্ডের জন্য অন্তপ্রাণ, রজার ওয়াটার্স, সিডও তো তা-ই, মনে হতো দূর থেকে। বইতে সিড ব্যারেট ও তার কন্ট্রিবিউশন নিয়ে লেখে নাই কি কিছুই, লিখলে কী লিখেছে, এইগুলাই জিগাই? কিছুই আমার পড়ার সুযোগ হয় নাই এ-নিয়া, আজকাল উইকিযুগে এসে এদের ক্রনোলোজিক্যাল ইভোল্যুশন সম্পর্কে উইকিকৃত ওভার্ভিয়্যু পড়েছি শুধু। উইকিবুকনি দিয়া আলাপ চালানোর মতন বোকামি করা বার্ধক্যবয়সে এসে উচিত হবে না মনে করি। একসময় ভেবেছিলাম ‘উইকিপিডিয়া ছায়াবলম্বনে পিঙ্ক ফ্লয়েড’ … ‘উইকিপিডিয়া ছায়াবলম্বনে লেড জেপ্লিন’ … ‘উইকিপিডিয়া ছায়াবলম্বনে অমুক’ … ‘উইকিপিডিয়া ছায়াবলম্বনে তমুক’ — এইরকম করে একগাদা রাইটাপ বানাব পছন্দের ও শ্রবণাভিজ্ঞতাভুক্ত ইংরিজি গানাবাজানা নিয়া। যদিও মনে হতো, এবং এখনও হয়, এইসব সার্চইঞ্জিনের ওপেন পেইজগুলো অথেন্টিক কিছু নয় এবং অনেক বিকট সব ব্লান্ডার করতেও দেখি এইসব পেইজে আমাদের জানাশোনা ব্যাপারস্যাপার নিয়া। যা-ই-হোক, একসময় খেয়াল করে দেখি যে চারপাশে বিশ্বসাহিত্যের হ্যানত্যান বিষয়াশয় নিয়া নিবন্ধপ্রবন্ধমুখোশে যা-কিছু মার্কেটে নামানো হয় সেসবের চোদ্দআনাই ঢালিউডি সিনামার কাটপিসের চেয়েও হতভম্বকর। এইটা আন্দাজ করার পর থেকেই আমার একটা বাজে হ্যাবিট হয়ে গিয়েছে যে বাংলা লেখাপত্রে ইংরিজি কোনো বিষয়াশয়, ধরেন যে কুন্ডেরা নিয়া বা আধুনিকতা-ফতা নিয়া, দেখলেই সেই বাংলা লেখাটা থেকে একটা-কোনো বা একের-পর-এক চাবিশব্দ চয়নপূর্বক গ্যুগলগোলার্ধে যেয়ে ইতিউতি উন্মুক্ত পেইজগুলো নজর করে গেলেই মামলার মেরিট ক্লিয়ার হয়ে যায় মম আঁখিপাতে। স্কলার্লি আর্টিক্যল বা কোনো মশহুর ওয়েবসাইট পর্যন্তও যাওয়া লাগে না আদৌ।

ঘটনা হচ্ছে, ইনফর্মেশন এবং এমনকি ইনসাইটের দরকারেও আমি উইকিবিহার করতে পারি, কিন্তু লেখার বিষয়টা কোনো-না-কোনোভাবে আমার স্মৃতি-সত্তাসংলগ্ন না হলে বা আমার অভিজ্ঞতা লেখার গায়ে লেপ্টে না-থাকলে সেইটা বাংলায় লেখাটা ফার্স নির্ঘাৎ। তো, এই তরিকায় ঢের আপনা-মামা ও আপন সন্তানের মামাদিগেরে চেনা হয়েছে এ-জন্মে। লেখা দেখে সমীহ হয় পয়লা যে এই লোক তো কামেল আদমি, বিস্তর জানেটানে ইত্যাদি, কিন্তু অচিরে মেহসুস হয় যে না, তা তো নয়ই, ভিতরে সকলি উইকিবিপন্ন। বই পড়তে দেখি খুব কম লোকেরেই। রিসার্চ রিভিজিট করতে দেখি আরও কম সংখ্যায়। গান লোকে শুনে কি না আই ডাউট, গান তো স্ট্যাটাস আপডেটের জিনিশ, ব্রেইনি কোটস বা নানা কায়দার কোটেশনের পাতা তো আছে বেশুমার কাতারে কাতার আল্লার দুনিয়ায়।

ইংরিজি গান নিয়া না আসলে, একদমই মিসিন্টার্প্রেট করা হবে এমনটা ভাবলে, এই নিবন্ধপ্রণয়নকারীর খুব প্যাশন ছিল বয়সকালে ইংরিজি গানশোনা নিয়া লিখতে-টিখতে। সেইটা আর মর্ত্যধামে না-হইল মম। মরার ছোটকাগজ-ফাগজে এইসব সিলি থিংস নিয়া টাইম ও স্পেইস ছিল না কোনোদিনই। কিন্তু পল্লিগান ও বাউলপনা গানগম্যি নিয়া আহাউঁহুর অন্ত ছিল না কাগুজেদের। অ্যানিওয়ে। আমি আবার — সংকোচে জানাই আজ — চিরদিনই ফিদা অফ সিলি থিংস। সম্প্রতি সমদুঃখী কিছু লোকজনের সনে দেখাসাক্ষাৎ-করমর্দন হচ্ছে যারা এই লাইনের বিজনেসম্যাগ্নেট একেকজন, মার্চেন্ট অফ সিলি থিংস। এরা ভালো করছেন ও করবেন বলে বিশ্বাস হয়। অ্যানিওয়ে।

 

১৬
সে আপনি যে-ই হন, বই পড়ে শেষ করেছেন অতএব এইবার ভোজ দেন। ফিস্ট। বই খতমোত্তর ইমপ্রুভড ডিনার। রিভিয়্যু লিখুন। বুকরিভিয়্যু। বাংলাদেশের ব্যান্ডগানে পিঙ্ক ফ্লয়েডের প্রভাব, ডিসগাস্টিং অপটু নকলবাজি, কিংবা স্যান্টানা  কপি করে গিটারওয়ার্কের বস্ হয়ে মসনদাসীন হওয়া ইত্যাদি নিয়া না-লিখলে তো প্রবাসী বঙ্গসাংস্কৃতিক লোকজন ভাববে এইদেশের লোকেরা গানবাজনা শুনিয়া আসল-নকল বুঝবারই পারে না! যার যা প্রাপ্য অ্যাক্নোলেজ করে, রেয়াত না-দিয়ে, এই ধুনফুনগুলি লিখে রেখে যেতে হবে তো, নইলে আমাদিগের বাচ্চাকাচ্চারাই দুইদিন পরে বলবে — আব্বু, তোমরারে খালি ঠকাইসে সিনিমাওয়ালা-গানওয়ালা-লেখাওয়ালা বেবাক ব্যাটাবিটি মিলে, তোমরা হারাম টেরও পাও নাই! লিখুন, অথবা পিডিএফ দেশবাসীরে দেন, লোকে একপাতা পড়বে আর সাতপাতা আংরেজি কোটেশন স্ট্যাটাস ঠুকে জাতে উঠবে। এবং পিঙ্ক ফ্লয়েড কামব্যাক কন্সার্ট লাইভ রেকর্ড শুনে থাকলে একাধটু শেয়ার করতে পারেন আদি পিঙ্ক ফ্লয়েডের সঙ্গে এখনকার পিঙ্ক ফ্লয়েড কোথায় কি খুইয়েছে বা জুড়েছে ইত্যাদি। বয়স তো একটা ব্যাপার, এবং গায়ের জোর বা স্ট্যামিনা যা-ই বলি, রকগানে অন্তত। শুনতেসি মহীনের ঘোড়াগুলিও প্রত্যাবর্তন অনুষ্ঠান করতে চলেছে সাড়ম্বরে। কে জানে কেমন হয়।

 

১৭
লেখার জন্য সশ্রদ্ধ পড়াশোনা-জানাবোঝা আবশ্যক বটে। এইটাও মনে হয় ভুল নয় যে লেখাটাকে যদি জীবনযাপনের স্বাভাবিক একটা ফ্যাকাল্টি ভেবে নেয়া যায় তাহলে বেশ-একটা স্পন্টেনিটি থাকে, যখনকার যেমন অনূভূতি তখনকার মতো করে বলে ফেলাটাও মন্দ নয় কিন্তু, অপেক্ষা করে অধীত বিদ্যাবোঝাবোঝি দিয়ে লেখাপত্র তো অবশ্যই কুর্নিশযোগ্য। তবে এইটাও স্মর্তব্য, প্রমথ চৌধুরী বোধহয় এই কথাটুকু বলেছিলেন যে লেখালেখিতে খেলাচ্ছলে প্রবেশ করাটা ভালো, খুব প্ল্যান করে বুঝেভেবে লেখাটা আবার অরিজিন্যাল টোন অতটা না-ও ধরতে পারে। লেখার আগে যেমন আইডিয়া ব্যাপারটা কারো কারো যোগায়, যে-আইডিয়া/ভাবের ব্যাপারটা লেখার জন্য জরুরি নিশ্চয়, তেমনি লিখতে লিখতে লিখনকালে এমনকি লেখকেরও অজান্তে আইডিয়া/ভাব/সৃষ্টি ফর্ম/জেনারেইট করতে পারে। ব্যাপারটা, প্রবণতাটা, একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হয় নিশ্চয়। কিন্তু প্যাশনেইট থেকে লেখালেখি চালাতে গেলে, লেখক হিশেবে প্রোফেশন্যাল হবার প্ল্যান না-থাকলে, লেখার জন্য ওয়েইট করাটা আদৌ দরকার হয় না। মানে আমি বলতে চাইছি যে আজকে আমার পিঙ্ক ফ্লয়েড নিয়া ভাবনা আর বারো বছর পরে যেয়ে জেনেবুঝে আমি পিঙ্ক ফ্লয়েড নিয়া যা ভাবব — দুয়ের মধ্যে একটা ফারাক তো হবেই। কিন্তু বারো বছর পরের লেখায় আজকের আলোবাতাস, তা যতই অনাবশ্যক হোক, রিগেইন করা ডিফিকাল্ট হবে মনে হয়। একজন প্যাশনেইট লেখকের কাছ থেকে, একজন অ্যালাইভ গানশ্রোতার কাছ থেকে, এই দুই প্রান্তের ফ্লেভারই চাইব আমি। অ্যানিওয়ে।

 

১৮
এইভাবে, রক মিউজিক সাবস্ক্রাইব করার তিনচাইর দশকের একটা লম্বা সফরে, কতই-না আগড়মবাগড়ম অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, লেখায় তার কিছুই নাই প্রায়। এমন বহু জিনিশই হয়েছে যা নিয়া আমরা ভাবি নাই। কিছু আছে যা আমরা নানান সময় বিক্ষিপ্তভাবে ভেবেছি, পিছপা থেকেছি প্রকাশে। ‘মেটাল জারি’ জিনিশটা আমি নিজে স্বকর্ণে শুনি নাই, ধরা যাক, শুনলেও ঠিক আইডেন্টিফাই করতে পারি নাই, কিন্তু হয়েছে বাংলায় শুনতে পাই, কিংবা শুনে থাকলেও নিশ্চয় চিনতে পারি নাই, সৃষ্টিশীল আমাদের রকাররা নিশ্চয় উমদা আর মজাদার মাল বানিয়েছেন! কোথায় গেলে এই জিনিশগুলা আর্কাইভড পাবো? গৌতম চ্যাটার্জি একটা ধারা বানিয়েছিলেন যেইটাকে তিনি নিজে লেবেলিং করেছিলেন ‘বাউল জ্যাজ’ নামে। তো, হোয়াটেভার, বাউল জ্যাজ, মনে পড়ল, মাকসুদের গানে পেয়েছিলাম, আরও যথা ‘মেটাল মুর্শিদি’, মা’আরেফাতের পতাকা  আর তার পরের ‘…নিষিদ্ধ’ ও ‘ওগো ভালোবাসা’ অ্যালবামে। অ্যানিওয়ে। এইসব অনর্থক কে আর কোথায় শেয়ার করে?

 

১৯
এইসব শেয়ার করাটা ভালো লাগল। সন্ধ্যাটা ভালো কাটানো হলো ফ্লয়েডস্মৃতিসূত্রে এমনটা গানগল্প করে। ভালো থাকি আমরা সবাই, গানে থাকি, সুরে ও সবুরে, বেলেল্লা রাজনীতিহীন রমণীয় মধুজ্বরে।

 

২০
ও আচ্ছা, আরও পরে, ‘ইনসাইড আউট : অ্যা পার্সোন্যাল হিস্টোরি অফ পিঙ্ক ফ্লয়েড’ বইয়ের উল্লেখযোগ্য কয়েক অধ্যায় ট্র্যান্সলেইট করেন শফিউল জয়, ‘রাশপ্রিন্ট’ ওয়েবম্যাগে সেইটা পাব্লিশ হয়, একলগে এর তিনটা পার্টের লিঙ্ক রাখলাম। অধিকন্তু, সূত্র/লিঙ্ক কাজ না করলে, মেনশন বাহুল্য, দোষ আমার নয়। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা আদৌ কোনোদিনই দীর্ঘায়ু ছিল না, আজকাল তা আরও স্বল্পায়ু হরেক মাপে ও মাত্রায়। নিবন্ধে পুনরুচ্চার নিন্দনীয়।

রচনাকাল ২০১৪ পরিমার্জনাকাল ২০২৫

জাহেদ আহমদ

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you