বাউলশিল্পী সবুজ মিয়ার সাতকাহন || সুমনকুমার দাশ  

বাউলশিল্পী সবুজ মিয়ার সাতকাহন || সুমনকুমার দাশ  

তখনও ট্রেন ছাড়েনি। হঠাৎ করেই মানুষটি আমাদের কামরায় ওঠে। তাঁর চেহারাটা অদ্ভুত মায়াবী। মুখে স্নিগ্ধতার পরশ। বাম চোখ অন্ধ। হাতে বেহালা। সেই বেহালার তারের নিচে তেল-চিটচিটে ময়লা। ঘামে ভিজে জবুথবু সাদা চেক শার্ট শরীরে লেপ্টে আছে। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ঠিক আমাদের শোভন চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়ালেন। সফরসঙ্গী সঞ্জুদা (সঞ্জয় কুমার নাথ) লোকটির দিকে তাকাতেই মুচকি হেসে বেহালা বাজাতে শুরু করলেন। সে-এক মন-পাগল-করা সুর। মিনিটপাঁচেক বাজানোর পর বললেন, ‘বাউলগান শুনবেন তো? কোন মহাজনের গান শুনবেন?’ আমাদের উত্তরের আগেই ধরলেন, ‘কেন বাঁধো দালানঘর, মন আমার / মাটির ভিতর হবে গো, কেন বাঁধো ঘর…’।

অসাধারণ তাঁর গায়কী। এতক্ষণ যারা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিলেন কিংবা একমনে পত্রিকা পড়ছিলেন, তারা সবাই এই লোকটির দিকে ফিরে তাকান। যারা মুঠোফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলেন, তারা তড়িঘড়ি কথা শেষ করে মাথা দুলাতে দুলাতে মুঠোফোনে গায়কের দৃশ্য ধারণ করতে লাগলেন। লোকটির কণ্ঠের জাদুতে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন কামরার প্রায় সব যাত্রী। গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে যাত্রীরা পাঁচ, দশ, বিশ টাকা — সাধ্য অনুযায়ী লোকটির পকেটে গুঁজে দিচ্ছেন।

লোকটি একনাগাড়ে গেয়েই চলছেন শাহ আবদুল করিম, হাসন রাজা, দুর্বিন শাহ সহ বিভিন্ন বাউল-গীতিকারের লোকপ্রিয় গান। একপর্যায়ে গান শেষ হলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এভাবে গান গেয়ে রোজ কত টাকা পান?’ তিনি মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘যা পাই তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে যায়।’ কিন্তু টাকার পরিমাণটা কত, সেটা তো বললেন না — পুনরায় একই বিষয়ে প্রশ্ন শুনে তিনি কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবলেন। এরপর বললেন, ‘কত আর হইব? ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তা দিয়া ভালামতন সংসার চলে না। কিন্তু মনে কোনও দুঃখ নাই। কারও কাছে হাত পাতি না, সেইটাই তো বড় কথা।’

কথায় কথায় জানতে পারি, চল্লিশোর্ধ্ব ওই বাউলশিল্পীর নাম সবুজ মিয়া। তাঁর বাড়ি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়। স্ত্রী আমেনা বেগম, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও ঈদগাহ এলাকায় তাঁর বাসা। বাসার সংলগ্ন মাইজগাঁও রেলস্টেশন। ওই স্টেশন থেকে তিনি প্রতিদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটগামী ট্রেনে ওঠেন। এরপর বিভিন্ন কামরায় গিয়ে যাত্রীদের গান শোনান। যাত্রীরা খুশি হয়ে তাঁকে যে টাকা দেন, সেটি খুশিমনে গ্রহণ করেন। এ টাকা দিয়েই চলে তাঁর সংসার। সবুজ মিয়া বলেন, ‘গান গাওয়ার সময় মানুষ ভালোবাইস্যা যদি হাতে টাকা গুইজা দেয়, সেইটা নিই। আবার না দিলেও কুনু ক্ষতি নাই। যাত্রীরারে গান শুনাইয়া আনন্দ দিতাম পারতাছি সেইটাই আসল কথা।’

সবুজ মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘বাউল করিমছাবের (শাহ আবদুল করিম) একটা গান আছে, “দিন হতে দিন আসে যে কঠিন, করিম দীনহীন কোনপথে যাইতাম”। দিন দিন জিনিসপত্রের যে দাম বাড়তাছে, যাওয়ার আর উপায় নাই। আগের মতো দিন আর নাই। পাঁচ বছর আগেও দেখছি — বাউলগানের দিকে মানুষের মুখ আছিল, এখন মোবাইলে তার লাগাইয়া কানে দিয়া মানুষ গান শোনে। আমরার গান মানুষরে আর আগের মতো টানে না।’

সবুজ মিয়া নিজের পরিবারের কথা বলতে গিয়ে জানান, আর্থিক অসঙ্গতির কারণে বড়মেয়েটি সপ্তম শ্রেণি এবং দ্বিতীয় ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়শোনা করেই থেমে গেছে। অপর দুই সন্তানের চোখ তাঁর মতোই অন্ধ। এসব কথা বলতে বলতে তিনি চোখের পানি মোছেন। নিজের দুঃখ ভুলে মিনিটপাঁচেক পর তিনি আমার উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ‘করিমছাবের গান শুনতাইননি?’

আমি মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিতেই সবুজ মিয়া ধরলেন শাহ আবদুল করিমের বহুল শ্রুত গান ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…’। তবে সবুজ মিয়ার গাওয়া গানের কলির বিভিন্ন পঙক্তিতে ছিল কথার বেশ হেরফের। বুঝতে পারি — সেটা বিকৃতি নয়, এটা তাঁর অজ্ঞতা। নিরক্ষর এ মানুষটি লোকমুখে কিংবা কোনও অডিওপ্লেয়ার/সিডিতে শুনে এ গানটি সম্পূর্ণ শ্রবণশক্তির উপর নির্ভর করে নিশ্চয়ই মুখস্ত করেছে, ফলে তাঁর নিজের অজান্তেই কয়েক পঙক্তি এদিক-সেদিক হয়ে গেছে।

সেটা বুঝতে পেরে এ প্রসঙ্গে কোনও কথা তুললাম না। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনার গানের গলা যে কত চমৎকার, সেটা কি আপনি জানেন?’ আমার এ ধরনের কথা শুনে গায়ক সবুজ মিয়া অনেকটা বিব্রত ও লজ্জিত হয়ে পড়েন। তাঁর কালো মুখ দেখে সেটা হয়তো অনুধাবন করা সম্ভব নয়, তবে তাঁর চোখমুখের প্রতিক্রিয়ায় আমি ভেতরে ভেতরে ঠিকই সেটা অনুভব করতে পারি।

একসময় বাউলশিল্পী সবুজ মিয়া আমাদের কামরা ছেড়ে অন্য কামরার দিকে রওয়ানা হন। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে সবুজ মিয়া বেহালা বাজিয়ে হেঁটে হেঁটে বলে চলেন, ‘আমার মান্যবর কম্পার্টমেন্টের ভাইবোনেরা / […] / গান শুনে যারা খুশি হয়ে টাকা দিলেন, তাদের সহ সবাইকে সালাম।’ পাশের কামরা থেকে যেন সবুজ মিয়ার অস্পষ্ট সুর ভেসে আসছিল। চোখে কিছুটা তন্দ্রাভাব আসে। সেই ‘আধো ঘুম আধো জাগরণে’ পথে যেতে যেতে ভাবছিলাম সবুজ মিয়ার কথা। একসময় যখন ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে গন্তব্যে পৌঁছল তখন দেখলাম সকালের সূর্য চিকচিক করছে আমার জানালার পাশে। বাইরে তাকাতেই দেখি একটা সাদা সাইনবোর্ডে গোটা গোটা কালো হরফে লেখা — চট্টগ্রামে আপনাকে স্বাগতম।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে নেমে এরপর একটি অটোরিকশা নিয়ে সোজা কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ড চলে যাই। সেখান থেকে গাড়ি চেপে দুপুর নাগাদ নির্দিষ্ট গন্তব্য কক্সবাজার গিয়ে পৌঁছি। খেয়েদেয়ে সামান্য বিশ্রাম শেষে সমুদ্রসৈকতে যাই। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। সটান হয়ে শুয়ে পড়ি সমুদ্রসৈকতে-বিছিয়ে-রাখা চেয়ারে। ধীরে ধীরে আঁধারের তীব্রতা বাড়ে। রাত যত গভীর হয় সমুদ্রের গর্জনও তত বেড়ে চলে। কিন্তু আমার চোখে ভাসে সেই ট্রেন, সেই কামরা। মনে পড়ে যায় মিনিটত্রিশেকের সেই ক্ষণ, সেই সুর —‘কেন বাঁধো দালানঘর, মন আমার…’।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you