একডজন গান শুনলাম সেদিন, ২০০৬ সনের কোনো-একদিন মূলত, হয়ে গেছে একদশক দেখতে দেখতে এরই মধ্যে! এক্কেবারে পাক্কা একদশক, কম নয়, ভাবো! রবীন্দ্রগান, বহু বর্ষাশীতবসন্ত-উজানো তিতপুরানা গানগুলো, সাহানার গাওয়া।
সাহানা — সাহানা বাজপেয়ী, (Sahana Bajpaie) শান্তিনিকেতনে শৈশব কাটানো, সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষাও সেখানেই — একেবারেই তরুণ বয়সের এই ইন্ডিয়ান-বাংলা গায়িকা; তার জীবনসঙ্গী ছিলেন — এই কিছুদিন আগেও, বর্তমানে বিবাহবিচ্ছিন্ন দুইজনা আলগ বটে — এ-দেশের অল্প-অগ্রসর আধুনিক বাংলাগানে মেধাদীপ্ত তরুণ : অর্ণব।
অর্ণবের সুরসৃজন ও সংগীতায়োজনের সেন্স ইতোমধ্যে প্রমাণিত। ‘নতুন করে পাবো বলে’ অ্যালবামের মিউজিক অর্ণবেরই ডিরেকশনে হয়েছে। এই সংকলনেও, ‘নতুন করে পাবো বলে’ অ্যালবামটায়, তার বাদ্যযন্ত্রযোজনা ও সংগীতবিন্যাস সর্বাধুনিক ও সুশ্রী হয়েছে। এক্ষেত্রে রিস্ক ছিল অনেক, খুব-একটা শ্রুতিপীড়াকর হয়নি যা-হোক। দুই-তিনটা গান তো খুবই সুন্দর ও সুচারু গেয়েছেন সাহানা। ‘তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে’, ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা’, ‘কোন পুরাতন গানের টানে ছুটেছে মন মাটির পানে’ ইত্যাদি রেন্ডিশন্ আলাদাভাবেই উল্লেখ্য।
অবশ্য গান শোনার ব্যাপারে উন্নাসিক যারা, উঁচ্-কপালে যারা, তাদের শ্রবণাভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে। আমার গানগম্যি খুব অল্পদৈর্ঘ্য (জ্ঞানগম্যির দৈর্ঘ্য-প্রস্থে অল্পতা আরও অধিক অকহতব্য), ফলে ওভারঅল্ শ্রবণ অপ্রীত হয়েছে বলা যাবে না; প্রীতই হয়েছি। বিশেষত বিচিত্র বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে আবহ আয়োজন বেশ অন্তরঙ্গই হয়েছে বলতে হবে। এই সময়ের উপযোগী একটা পার্ফেক্ট ড্রইংরুম-প্রেজেন্টেশন হয়েছে অ্যালবামটা।
তা, সাহানা প্রমুখের গাওয়া আজীবন ইম্প্রিন্টেড থাকবে কানে, এমনটা আমার কাছে মনে হয়নি। শিল্পীর গলাটা অ্যাট-লিস্ট লম্বা দৌড়ের গাওয়ার জন্য যুৎসই নয় স্বীকার করতে হবে। একেবারেই অল্প দমের গলা। ফ্লেক্সিবিলিটি নাই। কিন্তু চক্লেটি একটা মিষ্টতা আছে বৈকি, বিষাদস্ফূরিত কৈশোরক কণ্ঠস্বরমধুরিমা সাহানার সম্পদ, এইটুকু সম্পত্তি নিয়া গানদরিয়ায় বেশিদূর সম্ভব না যাওয়া। আলগোছে বেছে বেছে নিজের দমের অনুকূল গানগুচ্ছ করে গেলে নিশ্চয় টেকসই জনপ্রিয়তা থাকবে বেশ বহুদিন।
মৌলিক মন-কেমন-করা গানমালা সাহানা ইতোমধ্যে বেশ-কয়েকটা গেয়েছেন এবং সমাদৃতও হয়েছেন কৈশোরোত্তীর্ণ উঠতি তরুণবলয়ের কাছে। “একটা ছেলে মনের আঙিনাতে ধীর পায়েতে এক্কাদোক্কা খেলে” এমনই একটা গান যেইটা সাহানাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে; এই গানটা অর্ণবেরই সুর ও আবহ আয়োজনে সৃজিত হয়েছে। এবং সর্বোপরি সাহানার আছে একপ্রকার ইনেইট বিউটি, ইনোসেন্স বলে বোধহয় যে-ছাপটাকে, জীবনবাবুর কবিতায় যেমন আছে যে ‘বাসমতি চালে ভেজা শাদা হাতখান রাখো বুকে হে কিশোরী / গোরোচনা রূপে আমি করিব যে স্নান’ ইত্যাদি, সেই চালধোয়াকালীন শঙ্খের সমুদ্রফেনিল সকরুণ শুভ্রতা সাহানার ডিস্পোজিশনে একটা আলাদা মাত্রা দিয়েছে অবশ্যই। ইদানীং চেহারায় এবং চোখে একটা চুরট-আগ্নেয় পোড়া আভার ডিভেস্টেইটিং সিডাক্টিভিটি এসেছে যদিও-বা। পার্ফোর্মিং আর্টের অ্যারেনায় ফিমেল্ আর্টিস্টিদের ফেশিয়্যাল্ বিউটি ইজ্ মাস্ট। অস্বীকার করার জায়গা নাই যে এই মিডিয়াবাইটের বানানো মহাতারকারাজ্যে ফেশিয়্যাল্ এবং অন্যান্য ফিজিক্যাল্ অ্যাল্যুরেন্স বজায় রেখে ফের এর থেকে বেরিয়ে নিজের শিল্পীসত্তাটাকে মেনিফেস্ট করার মধ্যেই শিল্পীর সফলত্ব। সময় বয়ে যায় নাই নিশ্চয়, সাহানা পারবেন বা হয়তো এদ্দিনে পেরেও গিয়েছেন নিজের শর্টকামিংগুলো মোকাবিলা করে ঈপ্সিত বেদিতে নিজেরে স্থাপিতে।
এখন, আজকাল, সাহানার মতো অসংখ্য না-হলেও অনেক ট্যালেন্টেড শিল্পী বিচ্ছিন্নভাবে নেস্কাফে বেইসমেন্ট বা কোকস্টুডিয়ো বা মুর্চাং বা সাউন্ডক্লাউড বা ইউটিউবে পেশাদারিতার বাইরে থেকে গাইছেন। সকলে সমানভাবে না-হলেও অনেকেই ভীষণ ভালো করছেন। তবে শেষমেশ যেইটা জরুরি তা হচ্ছে গানটাকে সাবসিডিয়ারি না-রেখে কেন্দ্রে নেয়া আপন মনোযোগের। সাহানা গানটাই করে যেতেছেন ভালো হোক বা মন্দ প্রোফেশন্যালি এবং বলা বাহুল্য যথেষ্ট সিরিয়াস্লি। কিন্তু যতটা-না গেয়েছেন এতাবধি তারচেয়ে বেশি প্রচারের সাপোর্টটা লাভ করে ফেলেছেন পারিবারিক ও অন্য নানাবিধ এলিটিস্ট পরিকাঠামোর সুবাদে।
যে-অ্যালবামটা নিয়া আলাপ করছি আমরা, ‘নতুন করে পাবো বলে’, তার গানগুলো কতটা নতুন গায়কী দিয়া গাওয়া হয়েছে এমন প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে শোনার সময় কিংবা শোনাশুনি খতম দিয়ে। এখন, নতুন ব্যাপারটারও তো কনোটেশন বিবিধ। সংগীতের আয়োজন নতুন হয়েছে বলা যায়। কিন্তু খুব-যে অভাবিত নয়া তা-ও তো নয়। এমন চেষ্টা আরও হয়েছে এমনকি বিশ্বভারতী নিয়ন্ত্রিত আমলেও। নতুন হয়েছে এর বাদ্যযন্ত্রযোজনা, তা-ও দুম করে বলা যাবে না। সাহানার গায়কীও চমকানোর মতো সৌন্দর্যপ্রসারিত নতুন, নো, মোটেও নয়। কিন্তু নয়া মানুষের নয়া কণ্ঠ লগ্নি হয়েছে গানগুলোতে, এইটা বলা যায়। এ তো বলা বাহুল্যই যে ট্যাগোরের গান নব নব কণ্ঠে নিত্যই গাওয়া হয়েছে বেঙ্গল থেকে বিশ্বের সমস্ত নগরে জঙ্গলে। এইভাবে ট্যাগোর হররোজ নবায়িত হয়ে চলেছেন। সাহানা তার রিনরিনে গলা দিয়া গানগুলোতে একটা বয়ঃসন্ধিস্নিগ্ধ ঔজ্জ্বল্য এনেছেন যা সত্যি মিষ্টি হয়েছে শুনতে।
এমনিতে ব্যক্তিগতভাবে নবাগত কোনো কবি/শিল্পীর কাজ উপভোগ করতে যেয়ে কখনো পূর্ববর্তী মহারথীদের সঙ্গে মেলানো অপছন্দ আমার। সবকিছুতেই আইকন্ খোঁজার চেষ্টা বাঙালির একটা বিচ্ছিরি বাতিক বৈকি। গান শুনতে গেলেও এটা চাগিয়ে ওঠে যত্রতত্র। নতুন একজনকে বরণ/আবাহন করার প্রবণতা দূর থাক, মনোযোগে শোনার আগেই বলে বসে : আরে অমুকের গলায় যদি এই গানটা শুনতেন, তবেই-না বুঝতেন … ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! রবীন্দ্রনাথের গান শোনার বেলায় প্রতিমা-কণিকা-সুচিত্রা-জর্জ-সুবিনয়-গীতা ঘুরেফিরে আসবেই। রিডিকিউলাস্! অর্থাৎ সমস্তকিছুতে অহেতুক অতীতচারণের ভয়াবহ বাতিক।
প্রতিবেদনপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS