সাধনা দাওয়াখানা

সাধনা দাওয়াখানা

পাগল আবদুল করিম বলে
হলো এ কী ব্যাধি
তুমি বিনে এ ভুবনে
কে আছে ঔষধি

পাড়াগাঁয়ের এক পদকর্তার গান এইটা — আবদুল করিমের গান। শাহ আবদুল করিম — করিম শা নামেই চেনে তাঁরে তাঁর গাওদেশের লোকে। এসএ করিম নামেও সম্বোধন করা যায় তাঁরে, অ্যানিওয়ে, এইসব ডাকাডাকির ব্যাপারে উনার তেমনকিছু বলার থাকতে পারে না। ‘পাগল আবদুল করিম’ নিজেরে যেসব নামে ডেকেছেন জীবনব্যাপী, নিজের প্রত্যেকটা গানের ভনিতায় স্বাক্ষরপরিচয় রাখতে হয়েছে রীতি অনুযায়ী, দীনহীন একটা জায়গায় রেখে গেছেন স্বভাবস্ফূর্ততায়। নিজের মুর্শিদরে ডেকে ডেকেই নিশি ভিড়েছে বিহানবেলায়, নিজেরে বিতং করে একটা লাম্পাডাম্পা নামে ডেকে ঢোলশোহরতের দরকার তার হয় নাই, ঠিক সেই নামফাটানোর আকাঙ্ক্ষাটাও উনার মধ্যে আগাগোড়া অ্যাবসেন্ট দেখতে পাই। ফিরে ফিরে সেই পাগল, বাউল ইত্যাদি ডিগ্রেইডেড বিশেষায়িতা নামে ডেকে যেতে দেখি। কিন্তু লোকে উনারে ডেকে যায় একাধিক নামে একের অধিক ঢঙে ও উচ্চারণে। যেমন ও-কারান্ত ‘হ’ বর্ণযোগে কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য করিমেরে ডাকেন শাহ আবদুল করিম, খুব সুন্দর শোনায় কালিকার গলায় আদুরে ও সশ্রদ্ধ এই ডাক, মনে হয় একটা রাবীন্দ্রিক উচ্চারণশৈলীর নমুনা। তা, উল্লেখের আবারও দরকার হয়, বাউলেরে তাঁর আপন গাঁয়ের জনমুনিষেরা ‘শা আবদুল করিম’ নামেই চিনায়া দ্যান কদাচিৎ পুরা নামোল্লেখের জরুরৎ পড়লে। এক্ষেত্রে ‘হ’ ব্যঞ্জনবর্ণটা তাদেরে হজম করে ফেলতে দেখা যায়। কেবল গতানুগত লোকগবেষকেরা ‘বাউলসম্রাট’ না বললে যেন করিমের মর্যাদাহানি হয় ভাবেন। গতানুগত লোকগবেষকদিগের নিম্নমাধ্যমিকধাঁচা হাবাগোবা বাক্যিক বস্তাপচা উপস্থাপনা আমাদেরে এরই মধ্যে এই ইম্প্রেশন দিয়ে সেরেছে যে এসএ করিম সম্রাট কিসিমেরই কিছু-একটা হবেন বোধহয়। এম্পিররদের মতোই বিদূষকবেষ্টিত, বিদঘুটে এবং অতিকায় এলেবেলে। এসএ করিম যদিও সম্রাটের উল্টা আইডি দিয়াই নিজেরে একের পরে একেকটা কাজে প্রেজেন্ট হবার মাধ্যমে ব্যক্ত করে গেছেন নিজের অভিপ্রায়।

একবার ধলমেলায় গিয়েছিলাম আমি আর শাওন। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার প্রত্যন্তসীমায় এই মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে করিমগৃহসংলগ্ন ধান-কেটে-নেয়া মাঠে। করিমেরই নিজের প্রবর্তনায় মেলার পত্তনি। গিয়েছিলাম আমি ও শাওন, ২০০৫ ঈসায়িতে সম্ভবত, তখনও করিম জীবিত হলেও শয্যাশায়ী।

তিনদিনব্যাপী কালনী নদীতীরবর্তী ধানক্ষেতের মাঠে মেরাপ বেঁধে মেলা, গানাবাজানা, সাধুসঙ্গ, খৈ-বাতাসার পসরা নিয়ে বসা মানুষজন, দুধে-ভাসা চায়ের দোকানগুলো, স্যাকারিনে-ডোবা গ্রামীণ রসগোল্লা। ধুম রইদের মধ্যে লাল-সালু মঞ্চে গাতকেরা গাইছেন সাধারণ মাইকে। পুরা মাঠজোড়া শামিয়ানা তো সম্ভব না, শামিয়ানার তলায় সারি-কয়েক ‘ডেকোরাটার্স’ চেয়ার, সেসব চেয়ারে বসার চান্স পায় আর কয়জন, বেশিরভাগই ইতিউতি রিসেন্ট-কেটে-নেয়া-ধানগোঁড়া-বাইর-হয়া-থাকা মাঠে চরে বেড়াচ্ছে রইদ মাথায়, ঘেমে একসা ঝালমুড়ি খাচ্ছে ঠোঙাটা হাতের চেটোয় আলতো উপুত করে, এবং গান শুনছে গুচ্ছে গুচ্ছে গল্প করতে করতে। গানও যে শুনছে, তা বোঝা যাচ্ছিল তাদের ছাড়া-ছাড়া হ্যাডব্যাঙ্গিং দেখে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় কারো কারো মুখের আওয়াজও কানে আসছিল, গানের টুকরাটাকরা লাইন, সরগমের লম্বা টানটোন, আহা-উহু।

ওইবার আবিষ্কার করি একটা মজার ব্যাপার, সেটা হলো, করিমকে তাঁর ভক্ত-আশেকানদের বাইরেও গোটা তল্লাটের লোকজন পিরসা  বলে ডাকে এবং মান্য করে। বেশকিছু দেহাতি মানুষজনের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম করিম সম্পর্কে তাঁর জন্মাঞ্চলের লোকেদের পার্সেপশন জানবার আগ্রহে — যেমন নৌকোওয়ালা, ঝালমুড়িওয়ালা, বাতাসা আর খৈ-জিলিপিবিক্রেতা, গাঁয়ের ফুলবাবু যুবক, ঘোরাফেরারত ফুদ্দিদাড়ি মুরুব্বি এমনকি লেবাসে-লেহাজে শরিয়তি পরহেজগার — এঁদের প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করেন, যে-ঘটনাগুলো অধুনা-অতীত করিম শা-র শৌর্য ও সত্যাগ্রহী ইলিমওয়ালা কিংবদন্তির বিবরণ প্রকাশ করে। ঘটনাগুলো আবার থিম্যাটিক দিক থেকে অভিন্ন। প্রত্যেকের বিবরণ থেকেই কোনো-এক গানের আসর ঘিরে শরিয়তপন্থী ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে করিমের বাহাস উপস্থিত এবং অনেক তর্কবিতর্কের পর হুজুরদের পিছুহটার চিত্রসম্বলিত করিম শা-র জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বাতেনি দিক নিয়ে এলাকাবাসীর শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময় হাজির। বুঝতে পেরেছিলাম করিম তাঁর প্রতিবেশীদের কাছে কেন পিরসা  সম্বোধিত, যদিও করিমের মার্গ ও তাঁর কাজের মর্ম মোটেও জনপরিচিত পিরাকি লাইনের কিছু না বরং উল্টো। তবে এহেন সম্বোধন খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছিল তখন আমার কাছে, এখানে সেই বয়ান পেশ করছি না, আবার কখনো সুযোগ পেলে সেই আলাপ তুলব বিস্তারে। এখানে সাধনা শব্দের সূত্রে করিমের কথা মনে পড়ল, হঠাৎ করেই, তাঁর জীবন ও কর্মপ্রাসঙ্গিক আলাপের প্রস্তুতি এ-মুহূর্তে নেই আমার। উল্লেখ করে গেলে তেমন ক্ষতিবৃদ্ধির আশঙ্কা নাই যে সেদিন ধল থেকে ফেরার রাস্তায় ঝিক্কুরঝুক্কুর বাসের জানালায় ইয়েলোয়িশ বাল্বের আলোয় গ্রামবাজারের একটা সাইনবোর্ডে দেখি লেখা ‘সাধনা দাওয়াখানা’। আমাদের মনে পড়ে কেমন করে এই দিরাই বাসস্ট্যান্ডধার থেকে রেন্ট-অ্যা-নৌকা ব্যবস্থায় আমরা কালনীতীরবর্তী করিমের ধলে যেয়ে পৌঁছাই, ছিলাম সকাল-সন্ধ্যা আস্ত সময়টুকু করিমেরই নিসর্গলৌকিক ক্লিনিকে, ছিলাম করিমের দাওয়াখানায়।

পিরসা   এত জানেন, হুজুররা তাঁর সঙ্গে পেরে ওঠে নাই কোনোদিন, কিন্তু আফসোস যে পিরসা   নামাজ-কালাম করেন না — পাকপবিত্র কোরান সম্পর্কে পিরসা   যত জানেন, অত্র তল্লাটে কেউ অত জানে না — এই নিয়া স্থানীয়জনের মুখে আক্ষেপ শুনেছি। ইন্টারেস্টিং না ব্যাপারটা? আমি নিজে ভেবেছি অনেক এ-নিয়ে, একসময় এই ভাবনাভাবনিগুলো গুছিয়ে বলবার ফুরসত খুঁজতেসি আজকাল, মওকা পেলে বলব পরে। এখানে কেবল সুতো বের করে রেখে যাওয়া, পাছে ভুলিয়া যাই। কিন্তু লোকমুখবাহিত গল্পোক্ত বাউল ভার্সাস মোল্লাবামুনদের বাহাস তো অভিনবশ্রুত মনে হবার কথা না। আমরা লালনের লাইফের সঙ্গেও অনুরূপ একটা বাহাসের যুক্ততা পাই বিভিন্ন বিবরণে। এইসব ঘটনার দিনক্ষণগত বস্তুনিষ্ঠতা না তালাশিয়াও ঘটনাগুলা বাস্তবপ্রাসঙ্গিক বুঝতে বেগ পেতে হয় না আমাদেরে। করিমের কবিতাঙ্গিকে লেখা আত্মজৈবনিকী ‘ধলমেলা’ ও ‘আত্মস্মৃতি’ শীর্ষক দীর্ঘতর রচনাজোড়ায় এমন অনেক সামাজিক সংঘাতের হাজিরানা আমাদের নজর এড়ায় না। অ্যানিওয়ে।

এখন বলি সাধনা সম্পর্কে। এবং করিমের গান গুনগুনাই সেই সূত্রে। এত সরল কথার গান, এত প্রেমের পারদে চুবানো সুর, এমন মত্ততা ভাবের! করিমের কত কত গান, কত কত ভাবকালাম, কত কত সুর! কত সহুজে সেসব, আর কতই শ্রীমন্ত! লোকের মুখে মুখে, সারাদেশে, আজ করিমের সুর ঘুরে ফেরে। করিমের অজান্তেই তাঁর সাধনা সিদ্ধ হলো, যখন প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই তিনি আজ অস্তমিত। এ থেকে এই বিশ্বাস তো জন্মায়, সাধনা কখনো বিফলে যায় না — আবহমান এই আপ্তবাক্যে ফের আস্থা আনাইতে এসএ করিমের কাজ টনিক যোগায়। সাধনা ও সততা থাকলে, নিবেদন ও দরদ থাকলে, ধ্যান ও দৃষ্টিসারল্য থাকলে দোরগোড়ায় সাফল্য এসে গড়াগড়ি যায়। কামিয়াব হওয়ার কামনা মাটির তলায় চাপা দিয়ে রেখে কেবল প্রকাশ্য/গুপ্ত প্ররোচনায় কাজ করে গেলে পথঘাট ঠিকই একসময় নিষ্কণ্টক হয়ে আসে। এই যে আমরা পারি না, তার দোষ আমাদেরই। কিন্তু আমরা পাড়া মাথায় তুলি ‘ইহা নাই বলে আমার উহা হইল না’ টাইপের কান্দনে মেতে। বেফায়দা। পরিবেশ-প্রতিভা-পরিস্থিতি ইত্যাদি খোঁড়া অজুহাত তোলে তারাই, যারা সাধনাবিমুখ। সাধনা, প্রাচীন ও ঔপনিষদিক অচল উপাদান, হায় রে!

একটা আয়ুর্বেদিক ঔষধালয়ের নামও সাধনা । সাধনা ঔষধালয়। এরা গোটা উপমহাদেশেই বিস্তৃত করেছে তাদের ব্র্যান্ডের সেবা। আজকাল হামদর্দ প্রভৃতি বিগ ক্যাপিট্যালের সঙ্গে এরা প্রায় পেরে উঠছে না মনে হচ্ছে। মূলত হরিতকির নির্যাস ও হরিতকি-বহেড়া-আমলকি — ত্রিফলা বলে এইটারে সম্ভবত — শুকিয়ে ও অন্যান্য প্রোসেস করে বানানো ভিনেগারমিশ্রিত একধরনের সিরাপ দিয়া বাংলার ভেষজপ্রিয় বয়স্ক মানুষের মন জয় করেছে এরা। ছেলেবেলায় দেখতাম, আমাদের দাদিস্থানীয় মুরুব্বিরা সাধনার শক্তিবর্ধক ঔষধ তথা বলারিষ্ট প্রভৃতি অতি একিনের সঙ্গে সেবন করতেন। আজকালকার বৃদ্ধেরা সাধনাবিমুখ, সদগতিপ্রিয়, রতিবিমর্ষ। যুবকেরা তো বলা বাহুল্য।

প্রচ্ছদে ব্যবহৃত করিমপ্রতিকৃতিটির শিল্পী : প্রণবেশ দাশ
লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you