যদিও পাশে কেউ ঘুমিয়ে থাকে—তোমার ঘুম আসে না বিছানায় শুয়ে শুয়ে। তখন তুমি এক নিঃসঙ্গ-জন! বাইরে জোছনা থাকলেও তোমার ভিতরে অন্ধকার ঘিরে থাকে। কখনও-বা তোমার চোখে ঘুম আসে চুপিচুপি, নির্জন জোছনায়। সে কোনও রাজদূতের মতো এসে কড়া নড়ে না, কোনও যুদ্ধদূতের মতো হুংকারও করে না। ঘুম আসে, আর কোনও-এক অদৃশ্য হাতে বুজিয়ে চোখের পাতা, গুঁজে দেয় কানের ওপারে কোনও স্তব্ধতার তুলো। সে একান্ত ব্যক্তিগত, অথচ সর্বজনীন প্রয়োজনের তরি-পার করে ক্লান্তির নদী। সে, কখনও এক ছায়ামূর্তি, বড়ো কোমল কিন্তু অধরা। কখনও মঞ্চে আসে, কিন্তু মুখ ফিরিয়ে থাকে। তার গলায় ধূসর-নীল শাড়ি। সে ঘুরে ঘুরে তোমাকে দেখে, কিন্তু ঘিরে ধরে না। কখনও সে তোমার মাথায় হাত রাখে আশ্বাসের মতো, আবার কখনও কখনও বুকে চাপা কষ্ট হয়ে বসে থাকে—নির্বাক, নিষ্পলক। তাই না?
ঘড়ির কাঁটা গুনে গুনে তুমি দেখ রাতের নখর—একটা… দুইটা… তিনটা… আর ঘুম, সে যেন পাতার মতো কবে উড়ে এসে বসেছিল তোমার চোখে, মনে পড়ে না। একা একা তুমি বিছানায় শুয়ে থাকো, আর তোমার মাথার পাশে থাকে ঘড়ির টিক টিক শব্দ। আর সময় ধাতব ছন্দে হাঁটে আর বিদ্রূপ করে তোমাকে বলে, ‘তুমি তো ঘুমুতেই জানো না!’
তোমার পাশ ফিরে শোওয়া মানে আরেকবার নিজেকে বোঝানো—‘এইবার ঘুমের সঙ্গে দেখা হবে’, কিন্তু ঘুম আসে না। তোমার মনে হয়, শরীরটা শুয়ে আছে, কিন্তু মন যেন পরিচিত রাস্তার পাশে কোনও চা-দোকানে এক কাপ দুশ্চিন্তা হাতে বসে থাকে। কোনও কোনও রাতে তুমি হয়তো আধঘুম, আধস্বপ্নের ঘোরে চিঠি লিখে চলো—প্রাপকহীন; আর, জানালার কাচে কেবলই ধুলোবালি কিংবা কুয়াশা জমে। ঘুম আসে না তোমার কাছে। নাগরিক, অদৃশ্য সেন্সরে কাটা হয় তোমার ঘুমের কবিতা। তোমার শহর ঘুমিয়ে পড়ে, আলো নিভে যায়, পাখিরাও ডালে ডালে থামিয়ে দেয় গুঞ্জনধ্বনি, তখন ঘুম তোমার দেহ থেকে সমস্ত বোঝা খুলে নিতে পারে না। তোমার ব্যস্ততা, ব্যর্থতা, বিজ্ঞাপন আর বিষণ্নতা ফেলে রেখে ঢুকে যেতে চাও কোনও-এক অন্ধকারের অতলে, যেখানে কোনও ট্যাক্স ফেলা লাগে না বা কোনও পরিচয়পত্র দেখাতে হয় না। তাই না?
ঘুম এক ধরনের মৃত্যু; তবে তা আবার জেগে ওঠার জন্য। এক-একটি ঘুম যেন নিজেকে খানিকটা মুছে ফেলা, আর এক-একটি জাগরণ মানে নতুন করে ধুলোবালি কিংবা কুয়াশার গদ্যলেখা শুরু।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন আসে; সবসময় নয়, মাঝে মাঝে আসে। কখনও স্বপ্ন আসে আর ফিসফিস করে—‘এই দেখো, তোমার হারানো দিন!’—আবার কখনও কোনও স্মৃতি, যাকে তুমি কবর দিয়েছিলে বহুকাল আগে, সে ফিরে এসে বুঝিয়ে দেয়—আসলে তার মৃত্যুই হয়নি।
ঘুম, সে যেন একটা ধাঁধার মতো। চোখ বন্ধ করলেই কি সে তোমাকে তুলে নেয় তার আড়ালঘেরা দুনিয়ায়? চোখ বন্ধ করলেই কি তাকে পাওয়া যায় কোনও চুক্তিপত্রে?
যখন তোমার কাছে ঘুম আসে না, তখন তুমি তার কত-যে প্রয়োজন বোধ করো; তাই না? যখন তোমার কাছে ঘুম আসে না, তখন হয়তো বিছানা খাঁ খাঁ করে, ত্বকে পিঁপড়ে হাঁটে, আর মগজে জাগে কতশত দৃশ্য ও শব্দের ট্র্যাফিক জ্যাম।
মাঝে মাঝে রাত্রি যখন নিজের গা থেকে সমস্ত তারা খুলে রেখে দেয় আঁধারের বালিশে, তখন কেউ কেউ হয়তো একা বসে থাকে এক নির্জন শব্দের পাশে। আমরা যাকে নীরবতা বলি, আমরা তাকে চিনি, সে শব্দের জন্মমুহূর্ত। তার কণ্ঠে জন্ম নেয় আলো। একটা বিকারহীন কেঁপে ওঠা—যা মুখে উচ্চারিত না-হলেও ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। শব্দ নিজের ছায়া হারায়, আলো হয়ে ওঠে। ‘শব্দের আলো’—এটা কোনও উপমা নয়, এটা এক অব্যক্ত জ্যোতির নাম, যে-কোনও না-ঘুমের ভিতরেও জন্মাতে পারে সে।
ঘুম এক অভ্যন্তরীণ অভিবাসন। আমরা থাকি শরীরে, কিন্তু আত্মা ভেসে যায় অন্য কোথাও—যেখানে শত-বাস্তবতার কোনও মানচিত্র থাকে না।
ঘুম, আমাদের চেতনায় এক গভীর আরাম! এক নির্ভরযোগ্য পালানো! হয়তো তা নিঃশব্দে আত্মার সাময়িক ছুটি কিংবা কোনও পুনরুদ্ধার!
যখন বিছানায় শুয়ে তোমার ঘুম আসে না, তখনও সময় থেমে থাকে না—সে বরং তোমারই গা ঘেঁষে বয়ে চলে হিমস্রোতের মতো। সেই স্রোতে তুমি হয়তো পড়তে থাকো তোমারই ফেলে আসা চিঠির ভাষা, শেষ না-হওয়া কথা, হারিয়ে যাওয়া মুখ, ক্লান্ত-স্মৃতি! যখন ঘুম পালিয়ে বেড়ায়, তখন হয়তো তুমি তাকে ডেকে ডেকে তোমার কণ্ঠস্বর হারাও, চোখের পাতা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তোমার বিছানার চাদর তখন হয়তো একটা বাল্যবন্ধু, যাকে হারিয়ে ফেলার ভয় জাগে, অথচ সে কোনও সান্ত্বনাও দিতে জানে না। বিছানায় শুয়ে যখন ঘুম আসে না, তখন হয়তো তুমি টের পাও—সময় এক আলোছায়ার প্রতারণা।
বাইরে চাঁদ থাকলেও ভিতরের অন্ধকার থেকে সবসময় মুক্তি মেলে না। কোনও কোনও নির্ঘুম রাতে হয়তো তোমার ক্লান্ত চোখে জ্বালা ধরে, মগজটা হয়ে ওঠে চিরচেনা শহরের কোনও ভাঙা ট্রাফিক সিগন্যাল—সবুজ আলো আর আসে না যে সিগন্যালে; কিন্তু তোমার চিন্তার গাড়িগুলো থেমে থাকে না। কত পুরনো কথোপকথন কিংবা অপূর্ণ কাজের তালিকা কিংবা কোনও নিষ্ফল সম্পর্কের ভাঙা হাড়গোড় কেবল উঁকি দেয়—ঘোরাফেরা করে তোমার মাথার ভিতরে। আর, মাথার ভিতরে কেন এত আলোরহিত-শব্দ আসে, কেন এত হিসেবের নড়াচড়া—কোনওটাই ঠিকঠাক মেলে না! না-ঘুমের গোপন অস্থিরতা, ক্লান্তি তোমাকে বয়ে বেড়াতে হয়।
চোখের পাতায় নামলে ঘুম, নামে নিঃসঙ্গতা। আর তখন তুমি বোঝো—ঘুমের ভিতরে তলিয়ে যাওয়া মানে শুধু বিশ্রাম নয়, তা এক প্রকার করুণা; যা চাইলেই মেলে না, যা হঠাৎই দূরে সরে যেতে পারে।
না-ঘুমের গদ্যলেখায় যেন রাতের কপালে নিঃশব্দে জ্বলে চন্দ্র-টিপ আর নক্ষত্ররা যেন নিভে যাওয়া বাতির প্রতীক হয়ে ওঠে, যাদের আলো নিঃশেষ—তবু এক অদ্ভুত উপস্থিতি রাখে আকাশে। তুমি হয়তো চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকো—ঘুম কেমন পাখি হয়ে উড়ে যায়। মাথা বালিশে ঠেকতেই জ্বলে ওঠে তোমার কল্পনার ধূপকাঠি। আর ঘুম হয়ে যায় এক অদৃশ্য দরজা, যা খোলার চেষ্টা করলে আরও ভারী হয়ে যায়। যেন তুমি নিস্তব্ধ অন্ধকারের মুখে শুনতে পাও সময়ের বিলাপ। না, কোনও শব্দ নয়, কেবল একপ্রকার ভার, যা বুকের উপরে জমে থাকা অতীতের মতো। যখন তোমার হৃদয়ে বাজে না ঘুমের গান, তখন তুমি যেন সেই রাজা—যার রাজ্যে দিনের আলো নিষিদ্ধ, আর ঘুম, এক বিদ্রোহী প্রজার মতো, যে পালিয়ে বেড়ায় নীরব রাতের জঙ্গলে। অন্ধকার গায় তার গোপন সুরে। তুমি কেবল শুনতে থাকো।
ফজলুররহমান বাবুল ও তৎসংক্রান্ত রচনারাশি
- ঘুম ও না-ঘুমের গদ্যলেখা || ফজলুররহমান বাবুল - June 12, 2025
- অবসাদ ও অন্যান্য || জওয়াহের হোসেন - June 11, 2025
- ছোট ছোট লেখাগুলো || যুথিকা ঋতু - June 11, 2025
COMMENTS