স্মৃতিগন্ধা রুমাল ২ || সানজিদা শহীদ

স্মৃতিগন্ধা রুমাল ২ || সানজিদা শহীদ

১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাস। কাকাতুয়ার ঝুঁটির বিষণ্ণতার মতো আমরাও স্মৃতির শহর যশোর ছেড়ে এলাম। বাবা বদলী হয়ে বগুড়ায় এলেন। উত্তরবঙ্গে তখন কনকনে শীত। মা আর আমরা দু-বোন এলাম, ছোটবোন তখন মার কোলে।

কখনো মনে পড়ত রোকেয়াখালার কথা, আমার হাতটা ধরে আর ছোটবোনকে কোলে নিয়ে উনি ওনার বাড়ির দিকে পা বাড়াতেন। আমাকে উঁচু কাঠের পিঁড়িতে বসিয়ে, ছোটবোনকে শাড়ির কোচড়ের ভিতরে নিয়ে উনি সুনিপুণ হাতে সেলাই করতে বসে যেতেন। রঙিন কাপড়ের বাহারী সুতোয় ফুটে উঠত রঙবেরঙের ফুল, লতাপাতার যশোর স্টিচের কারুকাজ, উঠোনের এক কোনায় বাঁশঝাড়ের ভিতর ডেকে উঠত কোনো-এক পাখি — কুহু কুহু! বাঁশপাতারা দোল খেতো পুবালি বাতাসে।

দিন যায়। ধীরেধীরে আমার স্মৃতিরা ফিকে হয়ে যেতে থাকল। বগুড়ায় এসে প্রথমেই যেটা দেখলাম, খাবারদাবার সবকিছু শায়েস্তা খাঁর আমলের মতো সস্তা। তখনো যমুনা ব্রিজ হয়নি, এটাই ছিল এর একমাত্র কারণ। গরুর মাংস ৩০ টাকা কেজি, দুধ ৪-৫ টাকা লিটার, একবস্তা শাক হয়তো ২-৩ টাকা। বাবার জায়গাটা খুব পছন্দ হলো। উনি খুব সস্তায় সাত শতক জায়গা কিনে ফেললেন ৬ মাসের ভিতরেই, আমরা ছোট একটা বাড়ি করে উঠে গেলাম, বাকিটা জায়গায় ফুলফলের গাছ। সুন্দর একটা বাগানবাড়ি। আমার ধর্মভীরু বাবা ঘোষণা দিলেন, উনি ওনার জীবনে সম্পদ যা-কিছুই করবেন, সিরিয়ালি তার নাম হবে — আল্লাহর দান-১, ২, ৩…। আমার প্রখর আত্মসম্মানবোধের বুদ্ধিদীপ্ত মা ফিক করে হেসে ফেললেন,বললেন — সব জিনিসই তো আল্লাহতালার, এটা আবার আলাদা লেখার কি আছে? মা শেষ পর্যন্ত বাড়ির নাম রাখলেন — প্রত্যাশা।

আজ এত বছর পরেও আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে — মা, তোমার কার কাছে কি চাওয়া ছিল? বাবার কাছে? আমাদের দু-বোনের কাছে? নাকি নিজের জীবনের কাছে নিজেরই? আমাদের অনেক সুন্দর দিন যেতে লাগল। রাতে মা আমাকে পড়তে বসাতেন। আমার এখনো সেসব পড়া মুখস্ত — pussy cat pussy cat, where have you been?…I have been to London to see the queen. না-হয় ‘ভোর হলো দোর খোলো, খুকুমনি ওঠো রে’ কবিতা…রাতে শুয়ে শুয়ে আমাদের দু-বোনকে আয়তুল কুরসি, ঘুমের দোয়া এগুলো পড়াতেন। পড়তে পড়তে এগুলো আমাদের মুখে মুখেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম, টেরই পেতাম না। শুরু আরেকটা ভোর।

আমার ছোটবোনটা একটু একটু করে বড় হয়ে যেতে লাগল। একসময় আমাদের দু-বোনকে আলাদা রুমে দেয়া হলো। প্রতিরাতে বোনকে আমার গল্প শুনাতে হতো। ডালিমকুমারের গল্প, ব্যাঙ রাজপুত্রের গল্প, তুষারকন্যার গল্প। একটা সময় প্রতিদিন গল্প বলতে বলতে খেয়াল করলাম,আমি নিজেই খুব সুন্দর রূপকথার গল্প বানিয়ে বলতে পারছি। তবে বোনের তুষারকন্যার গল্পটা সবচেয়ে পছন্দের ছিল। শেষের অংশটা বারবার শুনতে চাইত,যেখানে তুষারকন্যাকে হুট করে একদিন রাজপুত্র এসে বলে ফেলল — তুষারকন্যা, তুষারকন্যা তোমার কেশ ফেলাও, সেই কেশ বেয়ে উঠে এল রাজপুত্র, তারপর প্রেম, বুড়ি রাক্ষসীর প্রাণভোমরাকে তলোয়ার দিয়ে মেরে ফেলে তুষারকন্যাকে উদ্ধার, তারপর দেশে ফিরে বিয়ে। আমি দু-একসময় বিরক্ত হতাম এক গল্প বারবার শুনতে চাইত দেখে।

আজকাল আর বিরক্ত হই না। পেরিয়ে গিয়েছে অনেক অনেক বছর। একা একা জানলায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে তুষারকন্যার গল্প নিজেকেই শুনিয়ে যাই কখনো। যখন বলি — তুষারকন্যা, তুষারকন্যা! তোমার কেশ ফেলাও! … তখন সেই দিঘল কেশ বেয়ে উঠে আসে না কোনো রাক্ষসী ডাইনি বুড়ি বা কোনো সুদর্শন রাজপুত্তুর, উঠে আসে কিছু স্মৃতি।

মা রান্নায় খুব ব্যস্ত থাকতেন। সকালে হুড়োহুড়ি লেগে যেত। বাবা আর আমরা দু-বোন বের হয়ে যাব খেয়ে, এছাড়া কাজের লোক, দাদাবাড়ি থেকে সবসময় আসা আত্মীয়স্বজন তো থাকতই। সন্ধ্যার পরে অনেক সময়ই কারেন্ট চলে যেত, তখন পড়ার ছুটি। উঠোনের একচিলতে পাকা জায়গায় পাটি বিছিয়ে সবাই মিলে গল্পের আসর বসে যেত। তখন শুধু বিটিভি  দেখতাম আমরা, এক/দু-সপ্তাহ পরপর শুক্রবার যখন শাবানা, ববিতা, রাজ্জাক, আলমগীরের ছবি দেখানো হতো, পুরো পাড়ায় সে কী উৎসব! আগে থেকেই অ্যান্টেনা মোড়ামুড়ি করে টিভি ক্লিয়ার করে রাখা হতো। কোনো কারণে যদি কারেন্ট চলে যেত, হয়তো পাড়ার লোকজন চাঁদা তুলে ব্যাটারি ভাড়া করে এনে সেই সিনেমা দেখত। আমি একটু বড় হতেই যখন পড়ালেখার চাপ বেড়ে গেল তখন সব অনুষ্ঠান দেখার পারমিশন পেতাম না। ‘ইত্যাদি’, ‘সিন্দাবাদ’ আর দু-এক সময় নাটক দেখার অনুমতি মিলত।

এখনো যখন ছুটিতে বাড়ি যাই সেই ঠান্ডা জলে স্নান করা, মায়ের হাতে বানানো ভর্তাভাত, বাগানের ভেজামাটির গন্ধ, বহু বছরের পুরোনো ফুলে ছেয়ে থাকা গন্ধরাজ ফুলের গাছটা, পাতার ঘ্রাণ, মৌচাক, মেহগনি গাছে বকের বাসা। আহা, সবই আছে ঠিকঠাক, শুধু নেই মানুষগুলো, বাবা দাদাদাদি, নানি সবাই চলে গিয়েছেন। ভিতরে কেমন যেন একটা শূন্যতা। কিশোরীর না-বলতে-পারা প্রথম নিখাদ ভালোবাসার মতোই স্মৃতিদের সাথে আমার বসবাস, আমার ভালোবাসা।

কখনো মনে হয় স্বপ্নে এক বনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা তীব্র স্রোতের নদীতে, কোনো-এক কিশোরী একটা ছোট ডিঙিনৌকো নিয়ে প্রাণপণ ছুটে চলেছে, সাথে যাচ্ছে রঙবেরঙের লাল নীল মাছ, লতাগুল্ম আর সাথে পেঁচিয়ে যাচ্ছে কিছু স্মৃতি। সেই কিশোরী আর কেউ নয়, আমি নিজেই।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you