বিশ্ব জুড়ে করোনামারির বিস্তার দেখে বোঝা যায় মানুষ এতদিন ভিতরে-ভিতরে কতটা অরক্ষিত ছিল আর এখন কেমন নাজুক হয়ে উঠেছে তার চারপাশ! দেহ অদৃশ্য শত্রুর ভয়ে তটস্থ। মন আতঙ্কে দিশেহারা ঝড়ের পাখি। নিজেকে অবিরত প্রবোধ দিয়েই যাচ্ছে, ‘হাত ধুতে থাকো, ধুতেই থাকো। যতক্ষণ-না সব জল ফুরিয়ে খা খা মরুভূমি হয় দেশ।’ মারির আঘাতে ইতোমধ্যে যথেষ্ট এলোমেলো হয়ে পড়েছে জীবন। মনোবলের পারদ তরতর করে নিচের দিকে নামছে। মানুষ থাকার এতদিনের অভ্যাস আর অজেয় সেই আত্মবিশ্বাসে কে যেন একরাশ অন্ধ অভিশাপ ছুঁড়ে দিয়েছে। সে-কারণে হয়তো দেহে ভয়ের অজানা শিহরণ, মন ত্রাসে টলমল। এটা সেই মুহূর্ত নয় যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্নটি করা যায়,— ‘ভালো! বাঘবন্দি খেলায় কেমন বোধ করছ এখন?’
খেলা তো শুধু জীবন থাকলেই সম্ভব। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ খেলে যাওয়াটা সম্ভব। প্রতিযোগীর সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনের দৌড়বাজি চালু থাকে যতক্ষণ-না ‘হল্ট’ বলে থামার ইঙ্গিত দিচ্ছে কেউ। দিগ্বিজয়ী হওয়ার নেশায় কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে যারা ছুটছিল তারা এখন বুঝে গেছে আপাতত থমকে দাঁড়ানোই সুরক্ষা। যদি থমকে দাঁড়ায় তবে বাঁচতে পারে দৌড়বাজ। সুতরাং থেমে থাকাই সুলক্ষণ। ‘হল্ট’ শব্দটি এতদিন কেউ মানতে চায়নি। লাল সংকেত পেয়েও গোঁয়ার শকট কদাচিৎ ব্রেক কষে নিজেকে থামতে বলেছে। সেই ‘হল্ট’ ও ‘ব্রেক’-এর রাজত্ব চলছে সারা বিশ্ব জুড়ে। আপাতত এটাই জীবন! করোনা নামের অদৃশ্য অণুজীবের সাফল্য এখানেই,— দৌড়বাজ হওয়ার নেশায় জল-স্থল-অন্তরীক্ষ দাপিয়ে-বেড়ানো মানুষকে সে সাময়িক হলেও থামিয়ে দিতে পেরেছে।
মানববিশ্বে এখন সবকিছু স্থগিত। জনপদ কোলাহলমুখরিত নয়। শব্দের উৎপাত নীরবতায় লীন। বায়ু আপাতত বিষাক্ত নয় কার্বনবিষে। ওজোন স্তর সুরক্ষিত পুনরায়। আকাশ স্বচ্ছতোয়া পলকাটা কাচ। পৃথিবীর ফুসফুসে বহুদিন পর তাজা হাওয়ার মাতন। সড়ক জনাকীর্ণ নেই। নগরীর ‘প্রতিটি দরাজ কাউন্টার কনুইবিহীন আজ।’ চিরচেনা ভিড় নেই শহরে যেটি দেখে চিত্রকল্পে আতুর হবে কবি ও গায়ক। ব্যস্ত সড়কে মানুষের ভিড় নেই। রেলস্টেশনে চিরচেনা গমগমে স্রোত উধাও। ভিড়ে আবির্ভূত যে-মুখগুলো ‘অলিক’ ভেবে শিহরিত হতো কবি, যেন ওরা ‘জলে আর্দ্র কালো বৃক্ষের ডালে ফোটা পাপড়ি।’, — চমকিত সেই কবি জব্দ নীরবতায়। লোক নেই তাই কবিও লোকান্তরিত অনামা ভয়ের দেশে। শঙ্কার কালো মেঘ ছায়া ফেলেছে প্রতিটি চৌকাঠে! এটা ইঙ্গিত,— মানুষের গড়া লোকালয় যদি ধ্বংস হয় কোনওদিন তবে প্রকৃতি নিজেকে কেমন করে পুনরায় সাজাবে!
করোনা-কবলিত দিনে বেঁচে থাকার ভরসা উধাও। আতঙ্কে অভিভূত জনপদ দাবার ছক! শতরঞ্জের সাদা-কালো কুঠুরিতে নিশ্চল দাঁড়িয়ে পড়েছে মহারাজা, মহামন্ত্রী, অশ্ব-হস্তি-তরণী আর রাজ্যশালার যত নফর-গোলাম। অদৃশ্য খেলবাজের হুকুমের অপেক্ষায় সবে মৌন এখন! কিস্তিমাত-করা এরকম দৃশ্য মানুষের জীবনে বহুদিন পর-পর আসে! বায়ু-অগ্নি-ঈশান-নৈঋত জুড়ে ধাবমান দৌড়বাজি তখন আকস্মিক থমকে দাঁড়ায়। আতঙ্কিত অবসর নামে মানুষের লোকালয়ে। এতদিন ভাবার সময় হয়নি কিন্তু এখন নিরলে বসে মানুষ ভাবে,— অণুজীব বিনা নশ্বর জীবনের সূচনাঙ্ক মিলে না, তাকে বিনে সমাপ্তিও ঘটে না ছাই! জীবন অবিনশ্বর নয়, তা-বলে মৃত্যুও চিরন্তন কিছু নয়। যারা চিরন্তন তারা ভেসে বেড়ায় বায়ুমণ্ডলে। হাওয়াভাসী ওইসব অণুজীব জীবনের সূচনায় গণ্য কারণ, অন্তে এসেও তাদের দাপট! গ্রাম-শহর-জনপদে মৃত্যু বিলি করে যে-চকদার সে ওই অণুজীবের দোসর। স্বেচ্ছাচারী জল্লাদের খড়গের নিচে মানুষের দৌড়বাজি হয়তো নিছক মশকরা ছাড়া কিছু নয়। সত্যটি স্মরণ করিয়ে দিতে শতরঞ্জ খুলে বসে পড়েছে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’!
…
করোনা দেখা দেওয়ার আগে মোটের ওপর মন্দ কাটছিল না মানুষের দিন। করে-খাওয়ার ধান্দায় ব্যস্ত ছিল সবাই। আশা-নিরাশার বিদ্যুতে অলৌকিক ক্লাউনের হাসি আর চোখের জলে রঙিন ছিল দিন। মহাপ্রাজ্ঞ ওরাকল ভবিতব্য জেনেও জীবনের রসে অষ্টপ্রহর মজে ছিল। জীবন মুহূর্তের ফুৎকার বুঝেও মানুষেই সংলগ্ন ছিল মানুষ। সমাজ বেসুর বেহালার ছড় জেনেও সঙ্গকাতর মন সামাজিকে লিপ্ত থেকেছে প্রতিদিন। ভিড়াক্রান্ত জনতার নাগপাশে সুস্থিরতা নেই;— কবির আপ্তবাক্য হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে কলুর বলদ হয়ে মানুষ ঘুরছিল ঘাটে ও আঘাটায়। অন্ধকার গলি ধরে আলোঝিলমিল সড়কে উঠার ক্ষণে কারও মনে হয়নি এভাবেই শহরে ব্ল্যাকআউট ঘনায়। চরাচর অন্ধ করে ভৌতিক আাঁধার নামে, যে-আধাঁরে নীরবে ব্রাত্য হয় শবাধার!
মিছে নয়, করোনা দেখা দেওয়ার আগে জীবনের অযুত চাপ চেপে গিয়ে মানুষ তরঙ্গিত ছিল জোয়ারে। সেখানে এখন ভাটার টান। দিশেহারা নাবিক পাল গুটিয়ে ইঁদুরের গর্তে সেঁধিয়েছে। প্রতিটি জনপদ ইঁদুরের গর্ত। করোনা মানুষকে ফিরিয়ে নিয়েছে তার শৈশবে। মানুষ ফেরত যাচ্ছে বালকবেলায়। বালকের হাতে জপমালা। ইঁদুরগর্তে বসে সে এখন শব্দফেনায় ডুবুরি : — ‘কোয়ারেনটাইন’ মানে জানো তো? ওটা হচ্ছে ঘরে নিজেকে বন্দি করে রাখা। নিজেকে ছাড়া কাউকে ছুঁয়ো না। করমর্দনের সৌজন্য বিলাতে হাত বাড়িয়ো না মানুষের দিকে। চক্ষু, নাসিকা ও ওষ্ঠকে দূরে রাখো হাতের সংক্রাম থেকে। প্রিয়কে ভুলেও জড়িও না আলিঙ্গনে। মনে করো তুমি ঘরে নির্বাসিত। কনডেম সেলে বন্দি মানব। গ্রিক বর্ণের আদ্যাক্ষর আলফা তুমি। ফেরত গিয়েছ আলফাযুগে। আলফাঘরে একা কাটছে দিন। মনে-মনে ওমেগার প্রহর গুনছ। গ্রিক বর্ণমালার শেষ অক্ষর এই ওমেগা। ওটা মানে অন্ত। ওমেগা সাঙ্গ হলে পরিশেষ বলে জীবনে কিছু বাকি থাকে না!
আলফাঘরে নিজেকে নিরোধ রেখেছে বালক। তার কানে নতুন শব্দের গুঞ্জন : — ‘আইসোলেশন’ মানে হচ্ছে তুমি আক্রান্ত; তুমি অস্পৃশ্য শূদ্র! তোমাকে ছোঁয়াও বারণ। বাঁচন-মরণ অনিশ্চিত প্রশ্নবোধক। বেঁচে যেতে পারো যদি মরণজয়ী প্রতিরোধী শক্তি ধরে দেহ। নাজুক-ভঙ্গুর হলে তোমাকে সারিয়ে তোলার কাণ্ডারি অসহায় সে-মরণ ঠেকাতে। মরণবিষে নীল বালক জপমালা হাতে অবিরাম শব্দ জপে চলেছে : — ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’-এর অর্থ জানো নিশ্চয়? তুমি ক্যারিয়ার, অনুজীবের নীরব বাহক। অদৃশ্য ঘাতক দেহে ঢুকে পড়েছে। গলা দিয়ে শ্বাসনালিতে নামার ফিকির খুঁজছে। তুমি বেখবর সে-ফিকিরে। মানুষের জঙ্গলে অবাধ ঘুরে বেড়িয়েছ। উঠে পড়েছ শকটে করে কোথাও যাবে বলে। দুম করে ঢুকে পড়েছিলে রেস্তোরাঁয়। ভুঁড়িভোজ সেরে দেদার হাত মিলিয়েছ সৌজন্যের খাতিরে। দিলখোশ আলিঙ্গনে ধারণ করেছ প্রিয়কে। তুমি ‘সংক্রামক’! লাশের মিছিল দীর্ঘ করতে ছড়িয়ে দিয়েছ অণুজীব জনে-জনে। তুমি ‘হন্তারক’। বিপন্ন করে তুলেছ নগরী ও জনপদ! তোমার কারণে শহরে ‘লকডাউন’। আক্রান্ত জনপদকে নিজের সীমানায় আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা এই ‘লকডাউন’; যেন অদৃশ্য অণুজীব না ছড়ায় এখনও নিরাপদ জনারণ্যে।
জপমালায় বন্দি বালক ব্যস্ত নতুন শব্দ শেখার কসরতে : — ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ কথাটির অর্থ সরল। সশরীর বাঁচতে হলে হাতকে সুরক্ষিত করো। সে এখন তোমার প্রথম প্রতিপক্ষ। করতলে কিলবিল করছে অচেনা ঘাতক। তারা দৃষ্টি ও শ্রবণের অতীত। অবাধে ঘুরছে হাতের মানচিত্রে। ভাগ্যরেখা বেয়ে উঠে পড়েছে ওষ্ঠে। পলকে ঢুকে পড়ছে মুখের সুড়ঙ্গে। রঙিন প্রজাপতির মতো ওই উড়ে-উড়ে ঘুরে-ঘুরে বসেছে নাকের ডগায়। শুঁড় ঢুকিয়ে দিয়েছে সে-টানেলে। অণুজীবরা সুনীল জলের মাছ। তারা এইমাত্র ঝাঁপ দিয়েছে তোমার চোখের তারায়। দক্ষ ডুবুরী টলমল কাকচক্ষু জলে দিয়েছে ডুব! তুমি কিছু টের পাওনি এতদিন। তোমার দৃষ্টি সূক্ষ্ম অণুজীবের নাগাল পাওয়ার সাধ্য রাখে না তাই পাওনি। যদিও সে ঘুরছিল দৃষ্টির নিকটসীমায়! হাতের তালুতে ঘুরে-ঘুরে মরণের নিদান হেঁকে বেড়ায় যে-চকদার তাকে ঠেকানোর জন্য ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’। হাতকে পরিশ্রুত করো স্যানিটাইজারের ফেনায়। মনে রেখো হাত এখন শত্রু; অদৃশ্য ঘাতকের ভাগাড়। তোমার কাজ একটাই,— ‘হাত ধুতেই থাকো ধুতেই থাকো’; যতক্ষণ-না সভ্যতার কানাগলি পেরিয়ে পাড়ি দিচ্ছ ‘তামাম শুদ’-এর জগতে।
করোনা অণুজীবের মশকরার অন্ত মেলা ভার! জগৎ দাপিয়ে বেড়ালো যে-মানুষ তাকে বোকাসোকা বালক বানিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে গৃহকোণে। আহা মানুষ! সে আবার ফিরে যাচ্ছে প্রথমায়। বাঘবন্দি খেলায় আটক বালক নিজদোষে বন্দি আলফাঘরে। তার দেহ মৃত্যুর শঙ্কায় বিচলিত। মন ক্লান্ত অনাহারভয়ে চকিত মানুষের হুলুস্থুল আতঙ্ক-দর্শনে। বাজার থেকে উধাও বেঁচে থাকার জরুরি পণ্য ও পাথেয়। তণ্ডুল দ্রুত উবে যাচ্ছে। হাত ধোয়ার পণ্যরা সোনার চেয়ে দামি। আহা! এমন রগরগে সুখ ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ কোম্প্যানিমানবদের জীবনে কবে আর এসেছে এমন করে? লক্ষবার বাহারি বিজ্ঞাপনে ‘হাত ধুতেই থাকো’ বলে আওয়াজ তোলার দিনে কে কবে ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ উজাড় করতে বাজারে ছুটেছে! মেশিন তাই ঘুরছে দিবারাত্রি। তোতাপাখির কলরবে মুখর চৌদিক,— ‘স্যানিটারইজার’-এ হাত কিন্তু ধুতেই হবে। বাঁচতে হলে সাবান-পানিতে হাতের ময়লা ঝরাও। সুগন্ধি হ্যান্ডওয়াশের ফেনায় নিকেশ করো হাতের অণুজীব। যদি মানুষ থাকতে চাও ‘হাত ধুতেই থাকো ধুতেই থাকো।’
বালক জানে না করোনা তার গলনালীতে বাসা বেঁধেছে কি না। লক্ষ অনুলিপি তৈরির খেলায় পারঙ্গম শিকারি শ্বাসনালী বিকল করে দিতে সেখানে ঢুকেছে কি না ভেবে বালক নিজেই সন্দিহান। মন অজানা নিয়তির আশঙ্কায় স্থবির। মৃত্যুর শতরঞ্জ খুলে বসেছে হন্তারক। প্রোটিনে ঢাকা শরীর ফুঁড়ে সদর্প মাথা তুলে আছে তার শুঁড়গুলো। ওরা হচ্ছে অ্যান্টেনা। অ্যান্টেনাধারী এই করোনা সংহারী অ্যালিয়েন। বলা-কওয়া নেই দুম করে গজব হয়ে নেমেছিল চিন দেশে। তারপর ভিনদেশে নিজেকে ছড়িয়েছে। তাকে নিরোধের একটা উপায় আপাতত সকলের জানা,— ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’। কী আর করা! সকাল-সন্ধ্যা এই এক কাজ জুটেছে মানুষের, হাত ধোয়ার কসরতে বেলা কাবার! হাত ধুতেই থাকো। সংক্রাম এড়ানোর খাতিরে নিজেকে সতর্ক রাখো। হাতের আয়ুরেখায় জমে-থাকা খুনিকে হঠাও সাবানফেনার তোড়ে।
ক্ষণিকের ভুলে খুক করে কাশি দিয়ে অনাসৃষ্টি বাঁধিয়েছে বালক। মনেই ছিল না যখন-তখন যেখানে-সেখানে যথা-ইচ্ছা হাঁচি-কাশির সময় এটা নয়। হাঁচি পেলে তাকে হাপিশ করতে হবে কনুইয়ে মুখ ঢেকে। নতুবা সমাজ দ্রুত তফাতে সরে যাবে। বালক জানে তফাতে থাকার নতুন নিয়ম হচ্ছে ‘তিন ফুট’। প্রিয় থেকে সর্বদা তিন ফুট দূরে থাকো। ভিড় থেকে সরে হাঁটো তিন ফুট। সামাজিকতায় মেনে চলো তিন ফুটের নিয়ম। যেখানেই থাকো মেপে-মেপে দূরত্ব বজায় রাখো তিন ফুট। এভাবে তিন ফুট করে সরে যাও যতটা সম্ভব। সরে যাওয়ার জায়গা ফুরালে সেঁধিয়ে পড়তে হবে শবাধারে, তিন ফুট মাটির গহ্বরে। বালকের এখন পাগলা মেহের আলীর মতো ‘সব ঝুটা হ্যায়’ বলে চিৎকার ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থাকার কাতরতা তাকে ভীষণ চেপে ধরেছে; বড় হাস্যকরভাবে বালক নামের মানুষটিকে জব্দ করে ফেলেছে করোনাদিনে!
…
মন মানছে না তাই প্রশ্নগুলো তোলা,— মানুষ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার এ-বিধান কি নতুন জারি হলো সমাজে? মানুষ কি একে অন্যের থেকে দূরত্বে নিজেকে বহাল রাখেনি? স্বার্থের চোরাটানে বজায় রাখেনি দূরত্বের সংস্কৃতি? জারি রাখেনি দূরত্বের অর্থনীতি? অঙ্কুরে বিনাশ করেনি দূরত্ব ঘোচানোর রাজনীতির সম্ভাবনা? মানুষ থেকে মানুষের তফাৎ মেনে চলার বিধান কি এই প্রথম নাজিল হয়েছে সমাজে? স্বমেহনে বন্দি মানুষ কি ইতোমধ্যে পরস্পর থেকে যথেষ্ট দূরে সরে যায়নি? নিজেকে সরিয়ে নেয়নি প্রকৃতির প্রাণবান উৎস হতে? পৃথক থাকার সংস্কারে আবিল প্রথার শাসনে সে কি অভ্যস্ত করেনি নিজেকে? মানুষ কি সত্যি সঙ্গলিপ্সু? তার সঙ্গলিপ্সা কি সঙ্গীর জন্য অকপট কাতরতা? নাকি বাসনা পূরণের আকাঙ্ক্ষায় সঙ্গ খুঁজে ফিরছে সে? অথবা তার সেই ভুবনবিস্তারী ধার্মিকতা! নিজ ঈশ্বরকে অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পৃথক ভাবার বাতিকদোষ থেকে সেই ধর্ম কি মুক্ত এখনও?
যাত্রীবোঝাই বাস ছুটে চলেছে সমাজের অলিগলি তস্য গলি ধরে। পাশাপাশি বসা সহযাত্রী দুজন টাচফোনে ব্যস্ত। কাচপর্দায় আঙুল ঘুরিয়ে অন্যের সুখদুঃখের খবর নিচ্ছে ফেসবুকে। সহযাত্রীকে কুশল জিজ্ঞাসার সময় ও সৌজন্য বিলীন হয়েছে টাচফোনের আবির্ভাবে! অন্যের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইচ্ছা মরে গেছে। আগ্রহ নেই খবর করার, ‘ভাই, কি নাম আপনার? কী করেন? থাকেন কোথায়?’ সুদীর্ঘকাল মানুষের সান্নিধ্যে থেকেও মানুষ আসলে নামমাত্র সামাজিক! হয়তো সে-কারণে সহযাত্রীর সাথে আলাপে মন নেই যাত্রীর। হাতের আঙুল এক কিংবা লক্ষ ফুট তফাতে থাকা মানুষের তরতাজা খবরে ভরপুর মুখচ্ছবির জগতে ঘুরছে। বাস থেকে নেমে যাত্রী ঘরে ফিরেছে। তার আঙুল টাচফোনে সচল। তিন ফুট দূরত্বের সীমানা নাকচ করে যে-যাত্রী এতক্ষণ পাশে বসা ছিল তাকে নিউজফিডে ঘুরতে দেখে কিছুটা বিহ্বল সে! আরে যাহ! লোকটি তো বাসে পাশে বসে ছিল। মিতালী পাতানোর আবেদনে সাড়া দিয়ে কবে বন্ধুত্ব কবুল করেছি সে অতশত মনে নেই। এর নাম কি দূরত্ব নয়? বায়বীয় কাচপর্দায় বন্ধুত্বকে একদিন যারা হ্যাঁ বলেছিল, এখন, বাস্তবিক সাক্ষাতের ক্ষণে একে-অন্যের কাছে বিলকুল অচেনা মানব!
দূরত্ব নিয়ে এই যে মানুষের এত হুলুস্থূল, গণগোত্রের পতন ঠেকানোর আয়োজনে সামাজিক দূরত্ব জারি রাখার নসিহত, সমাজবৃত্তে ঘনীভূত মানুষ কি জীবনের সূচনাঙ্ক থেকে সে-কলায় অভ্যস্ত নয়? দূরত্ব বজায় রাখার নিদান তবে কী কারণে? এর কারণ ভয়! মরে যাওয়ার ভয়! নিশ্চিহ্ন হওয়ার ভয়! বিলুপ্তির ভয়! যে-দূরত্বের চাপে মানুষ ব্যতীত বাকিরা ওমেগায় বিলীন, যার চাপে শত-হাজার বছরে মানুষ নিপীড়িত মানুষের হাতে, সে-দূরত্ব বজায় রাখা ছাড়া মানুষের পক্ষে এখন বেঁচেবর্তে থাকাটাও কঠিন! মানুষ, তার হয়তো পরস্পরের নিকটে থাকা দরকার ছিল। প্রাণের অযুত উৎসে সংলগ্ন থাকা জরুরি ছিল। মানুষের সঙ্গে মানুষের ভণিতাহীন নৈকট্যের বীজমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ উচিত ছিল তার। তথাপি সূচনা থেকে সে উলটোপথের যাত্রী। মিছে নয়, মানুষ তার জন্মলগ্ন থেকে দূরত্বপ্রিয়। কাছে যাওয়ার নাম করে সে কভু কোনওকিছুর সান্নিধ্যে থাকেনি। না জীবের না অযুত প্রাণের উৎস অত্যাশ্চর্য এই জগতের!
মানুষ কি সতত অনুভব করেছে নৈকট্য কেন প্রয়োজন? প্রাণবান উৎসের সমাবেশে বিরচিত জগতের হৃদয়ে হৃদয় মিলানোর অর্থ বোঝা কেন দরকারি? সে তো মিলন চায়নি! মিলনের ছলে মিলন-বিরহিত দূরত্বে নিজের নিরাময় খুঁজেছে। অন্যের থেকে নিজেকে পৃথক প্রমাণের মাঝে খুঁজে ফিরেছে সুরক্ষার আয়ুধ। মানুষ প্রকৃত মিলনকামী কোনওদিন ছিল না। মানব বিরচিত সভ্যতা চিরকাল নিজদোষে দূরত্বসূচক। প্রাচীরবন্দি অন্ধ অভিশাপ। যে-দূরত্ব তাকে প্রাণের উৎস থেকে দূরের করেছিল সেই দূরত্ব এখন ফাঁদ হয়ে তাকে ঘরের সীমানায় আটক থাকার বিধান জারি করেছে। দূরত্ব দিয়ে ঘেরা মানবপ্রাচীরে যুগে-যুগে এভাবেই দেখা দিয়েছে ফাটল। অঙ্কুরিত হয়েছে রক্তবীজের ঝাড়। বেহুলা-লখিন্দরের নিশ্ছিদ্র বাসর ছারখার হয়েছিল সর্প-দংশনে। নিজেকে অন্যের থেকে পৃথক ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণের ক্ষুধা থেকে যে-দূরত্ব মানুষের সমাজে অমোঘ হয়েছিল সেটি এখন দুর্যোগরূপে লোকালয়ে নেমেছে। মানুষের হাতের মানচিত্রে তাই বাসা বেঁধেছে করোনা। অজানা অণুজীব সংকেত দিচ্ছে অতিমারি ও মন্বন্তর। দূরত্বের অভিশাপে মানুষ যুগে-যুগে সকলের মরণের কারণ হয়েছে। এখন, সেই দূরত্বের পরীক্ষায় জয়ী না হলে তার মরণ নিশ্চিত।
…
মানুষের জীবনে দূরত্ব নতুন কাহিনি নয়। তথাপি তিন ফুট দূরত্বে পৃথক থাকার নিদান শুনে সে এখন দিশেহারা! দূরত্ব বজায় রাখার চাপে দেহ কম্পিত। দেহকে বাঁচিয়ে রাখার ফিকিরে ব্যস্ত মন বাহু ও চোখের মুদ্রায় উদ্বাহু উদয়শঙ্কর। বেশি নয়, তিন ফুট দূরে থাকার বিধান সে নিতে পারছে না। প্রিয়জন থেকে তিন ফুট দূরে সরে থাকা, মনে হচ্ছে এরচেয়ে এভারেস্টচূড়ায় আরোহন অনেক সহজ। দূরত্ব ভঙ্গকারী মানুষের ভিড়ে বাজার ও সমাবেশ সয়লাব। ভিড়াক্রান্ত সড়কে তিন ফুট টিকানো যাচ্ছে না। রেস্তোরাঁয় নিমিষে ধসে যাচ্ছে দূরত্ব মেপে চলার সীমানা। মন্দির-মসজিদ-গির্জা-প্যাগোডায় ঘনীভূত লোকের চাপে তিন ফুট দূরত্ব শূন্যে বিলীন। দুঃসময়ের ক্ষণে দূরত্বপ্রিয় মানুষ দূরত্ব বজায় রাখার এই বিধান মেনে নিতে মনে হচ্ছে ঘোর অনিচ্ছুক!
অগত্যা, একে-একে নিভে যাচ্ছে দূরত্ব বিপন্নকারী আয়োজন। বিদ্যালয়ে শিশু ও যুবাদের কলরব থেমে গেছে মারির শঙ্কায়। নেতা-ফেতা কোন চুলোয় গেছে সে-খবর রাখার ফুরসত নেই কারও। বাকপটু জনসভা স্থবিরজাতক। বিবাহ নেই। উৎসবের উৎসব নিভে গেছে অশুভ জাদুকরের টোকায়। শকটে উঠার লোক নেই। ঝলমল বিপণিবিতান পাষাণমূক। প্রেক্ষাগৃহ ভূতুড়ে শ্মশান। সামাজিক দূরত্ব মানার চাপে নিথর মানুষের কলরব। মানুষ ক্রমশ সরে যাচ্ছে মানুষের থেকে। এর নাম হচ্ছে সঙ্গনিরোধ। পাগল কবি তবে কাকে ডাকবে এখন : —
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মত পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মত মনে পড়ছে
সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও!
[দাঁড়াও : শক্তি চট্টোপাধ্যায়]
না, গ্রাম ও নগরে পাশে দাঁড়াবার মতো লোক নেই করোনাদিনে। জনপদে ঘুরে-ঘুরে নিদান হাঁকছে চকদার,— আপাত অনিশ্চিত কাল অবধি কোনওকিছু চলবে না। কেউ কারও পাশে দাঁড়াবে না। সবাই ঘরে থাকুক তিন ফুট দূরত্বের নিয়মে।
করোনাকাল কুলভাসী বান অথবা ঘূর্ণিতাণ্ডব নয় যে মানুষ একে-অন্যের পাশে দাঁড়াবে। এই আকাল সে-আকাল নয় যেন নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে মানুষ পাশে দাঁড়িয়ে যাবে। মাটির অতলে ঘুমন্ত রাগী মোষের হঠাৎ পাশ ফিরে শোয়ার ক্ষণ এটি নয়, যাকে ভূকম্পন বুঝে ভয়চকিত মানুষ একে অন্যের পাশে ঠিক দাঁড়াবে। গুলি-বোমা-কার্তুজের উৎসবে লাশের মিছিল কিংবা দেশহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সহজ মানবতা করোনাকালে বিলকুল বেমানান। করোনায় মানুষ অস্পৃশ্য। লাশ ছোঁয়া যাচ্ছে না। সহাবস্থান পারমাণবিক বোমার মতো বিপজ্জনক। হাতে হাত রাখা অথবা করমর্দন বিপজ্জনক। আলিঙ্গন বিপজ্জনক। সমাবেশ ভয়াবহ বিপজ্জনক। করোনা বড্ড ছোঁয়াচে। ওটা সংক্রামক। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। হায় মানুষ! অদৃশ্য অণুজীবের সংক্রাম ঠেকাতে স্বেচ্ছায় নিজেকে সে অস্পৃশ্যের ঘোষণা দিয়েছে!
বেসিনে জলের ফোয়ারায় স্যানিটাইজারমাখা বালকের হাত করোনা ঝরাতে ব্যাকুল। অণুজীব তাকে বন্দি করেছে আলফাঘরে; আরেকবার ফিরিয়ে নিয়েছে শৈশবে। করোনা নয়, বালক ঝরাতে চাইছে বিষাদ। বাইরে বের হতে না পারার বিষাদ। একলা থাকার বিষাদ। ভয়ে কাতর হওয়ার বিষাদ। ঘৃণায় ফেটে পড়তে না-পারার বিষাদ। অসহায়, বিপন্ন ও পরাধীন হয়ে থাকার বিষাদ। মানুষ হয়ে মানুষকে ভালো বাসতে না পারার বিষাদ। মানুষ হয়ে জন্মলাভের তিক্ত যত বিষাদ। কবি ভর করেছে বালকের মাথায়। তার জন্য হয়তো আবুল হাসান নামে কবি তিন ফুট গর্তে সেঁধিয়ে যাওয়ার আগে লিখে রেখে গেছেন এই এপিটাফ : —
যেন আমার এখন সবকিছুকেই অবহেলা করার সময়
উপেক্ষা করার সময়
যেন আমি এখন জ্যোৎস্নায় অনন্তকাল
আলুথালু বসে থাকব, এই আমার একমাত্র কাজ।
এই আমার একমাত্র অমলধবল চাকরী আর কিছু নয়
আর কিছুকেই আমি আনন্দিত উদ্ধার ভাবি না।
সুতরাং সবজির বাগান থেকে সাপের সঘন ফণা বেড়ে উঠুক, ক্ষতি নেই
হামিদুর তার বৌ নিয়ে কক্সবাজারে যাক
জল শকটের শাদা রূপচাঁদা মাছ ধরুক বিছানায়!
আমি তাতে আশ্চর্য হবো না।
করতলে কুয়াশা লাগিয়ে কোনো কিশোরী বালিকা কেঁদে উঠুক
রাত্রিবেলা, আমার কী?
কিশোরেরা কালো মৌমাছির মতো কুঞ্চিত কুঁইফল নিয়ে
লোফালুফি করুক শহরে, মরে যাক
আমি তাতে চোখও দেবো না। আমি জানি
এই সব কিছুর মূলেই রয়েছে রগরগে জীবনযাপন।
আর সব রগরগে জীবনযাপন মানেই পতনবিলাসী শিল্প!
সমাজ মাত্রই একটা মাথামোটা মানুষের
হুলুস্থূল মিলিত প্রবাহ!
আর তোমরা যাকে চাকরি বা প্রফেশন বলো,
উন্নতি ও অভ্যুত্থান, তারা
আমার বিশ্বাসে আজ একবিন্দু অনলের লকলকে
অজস্র বিস্তার ছাড়া আর কিছু নয়।
আর কিছুই নয়।
[অবহেলা করার সময় : আবুল হাসান]
পৃথিবীতে আবার ফিরে এসেছে অস্পৃশ্য হওয়ার দিন। পরস্পর থেকে দূরে থাকার দিন। পৃথক হওয়ার দিন। আলফাঘরে সঙ্গবিহীন একলা থাকার দিন। মারি বহনকারী অণুজীব মানব-বিরচিত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। সে এই সভ্যতার মতোই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। অন্যের থেকে নিজেকে পৃথক রাখার মাঝে মুক্তি খোঁজে। সে এই মানুষের অনুরূপ ঘোর আত্মবাদী। সভ্যতার মুকুরে প্রতিবিম্বিত মুখগুলোর অনুলিপি হচ্ছে এই করোনা। তাদের মতোই আত্মকামী সে। ঘরে-ঘরে নিদান হাঁকছে চকদার,— ‘সঙ্গ থেকে বিরত থাকুন। মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার স্বার্থে মানুষ থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। স্বতন্ত্র থাকুন। পৃথক থাকুন। নিজেকে আলফাঘরে বন্দি রাখুন। এখন থেকে একলা থাকুন। একলা ঘরে বসে একলা মানুষ কেবল নিজেকে ভালোবাসুন।’
জলে প্রতিবিম্বিত নিজের মুখচ্ছবি দেখে বিমুগ্ধ নার্সিসাসকে বহন করে এনেছে করোনা। মানুষকে সে নগ্ন করে দিচ্ছে। অকপট হতে বলছে তাকে। ভান ও ছলনার বেড়াজাল কেটে আভরণহীন হওয়ার প্রেরণা দিতে জনপদে আঘাত হানছে। এতদিন যে-কথাটি মানুষ মুখ ফুটে বলতে পারেনি অথবা ইনিয়েবিনিয়ে প্যাঁচ কষে বলেছে, এতদিন যে-কথা বলতে গিয়ে থেমে গেছে অথবা ঝোঁকের বশে বলে ফেলার দায়ে অন্যরা তাকে একঘরে করেছে,— বহুদিন পর মানুষ সেই কথাটি মানুষকে বলছে; মারির দাপটে মনের সকল বাঁধন টুটে গিয়েছে বলে হয়তো এক মানুষ নিঃসংকোচে অন্য মানুষকে ‘নার্সিসাস’ হতে ডাক দিচ্ছে।
করোনা তাই গজব নয়। খোদার পাঠানো সৈনিক নয়। মানুষ এতদিন যা-ছিল যেমন ছিল যেভাবে ছিল অথবা এতদিন ধরে যে-ব্যাধি লালন করছিল দেহে, অদৃশ্য অণুজীব সে-ব্যাধির জমাট বিস্ফোরণ। এতদিন পর মানুষ তার সত্যিকার নাম ধরে নিজেকে ডাকছে। নিজেকে অস্পৃশ্য ঘোষণায় অকপট হয়েছে, ‘আসুন, আমরা সবাই ঈশ্বরের মতো একা ও অস্পৃশ্য হই। আদিলগ্নে আমরা তা-ই ছিলাম। নন্দনকাননে ঈশ্বরের মতো একা আর অস্পৃশ্য ছিলাম। আসুন সকলে মিলে আরেকবার ঈশ্বর হই। তাঁর মতো একা ও অস্পৃশ্য রাখি নিজেকে। অকৃপণ সম্মোহনের বিভূতিতে আসুন সবাই একা হই, পৃথক হই, এবং অস্পৃশ্যতায় সুরক্ষিত ঈশ্বর হই দুঃসহ ক্রান্তিকালে!’
…
মানুষকে অস্পৃশ্য করে তোলে যে-মারি জগতে তার ইতিহাস অনেক পুরাতন। প্লেগ কম্পিত রেখেছিল কয়েক শতক। প্লেগের অণুজীব ব্ল্যাক ডেথ চতুর্দশ শতকে ইউরোপ মহাদেশে মরণ ডেকে এনেছিল। বিড়াল ও ইঁদুরের খাদ্যশৃঙ্খল অনুভবে ব্যর্থ মানুষের অবিমৃষ্যকারিতায় দেখা দিয়েছিল অতিমারি। যিশু-অনুসারীদের মনে কেন যেন বিশ্বাস প্রগাঢ় হয়েছিল বিড়াল হচ্ছে অশুভ শয়তানের সহচর। মহাদেশ জুড়ে গণহারে বিড়াল নিধন ঘটেছিল সেকালে। নিধনের পরিণামে দশক ধরে প্লেগ দেখা দিলো। চলমান মারির দাপটে মহাদেশের অর্ধেক লোক সাবাড় হয়েছিল তখন। কলেরাকে সঙ্গী করে প্লেগের অণুজীব বিউবনিক নাম নিয়ে উনিশ শতকের চিন দেশে পুনরায় দেখা দিয়েছিল। দুই দশকের অতিমারির চোটে চিন ও ভারতে সাবাড় হয়েছিল দেড় কোটি লোক। প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে যুঝতে অক্ষম ছন্নছাড়া লোকালয় ও আবাসন ছিল সে-মারির কারণ।
গেল শতকের আশির দশকে বিভীষিকা হয়ে আঘাত হেনেছিল মারণব্যাধি এইডস। নেপথ্যে ছিল আফ্রিকা মহাদেশের শিকারি কোনও গোত্র। এসআইভি (simian immunodeficiency virus) অণুজীবে আক্রান্ত শিম্পাঞ্জিকে শিকারের পরে ভক্ষণ করেছিল গোত্রের কেউ। হতে পারে শিকার হওয়ার ক্ষণে শিম্পাঞ্জির দ্বারা আহত হওয়ায় মানবদেহে সংক্রাম ঘটিয়েছিল অণুজীব। মানুষের দেহে এসআইভি অণুজীব সংক্রমণের ইতিহাস অবশ্য আরও পুরাতন। বিগত শতকের দ্বিতীয় দশকে কঙ্গো বেসিনে প্রথম হানা দিয়েছিল সে। অতিমারি হয়ে গ্রাস করেছিল আফ্রিকা মহাদেশ। সে-সময় অণুজীবের প্রকৃতি ও লক্ষণ জানার উপায় ছিল না। ইনফ্লুয়েঞ্জার মারণ ঠেকাতে বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত ছিলেন। ষাটের দশকে নীরব সেই ঘাতক পুনরায় ফিরে এসেছিল। আফ্রিকা থেকে হাইতি হয়ে ঢুকে পড়েছিল মার্কিন দেশে। রোগের কারণ যথারীতি কিছু বোঝা যায়নি তখন। অন্ধ বিভীষিকা রূপে এইচআইভি (human immunodeficiency virus) মানবদেহে আজও বিরাজিত। নিযুত লোকের দেহে তার সংক্রাম জারি রেখেছে নীরব ঘাতক।
জগতের সুমহান প্রাণিকুলের সঙ্গে মানুষের সংযুক্তির পুরাতন ছক এতদিনেও বিশেষ পাল্টায়নি। মানবদেহে অণুজীব সংক্রমণের এটি গণ্য কারণ। প্রাণিদেহকে নিজের সম্পত্তি ভেবে বলাৎকারের সংস্কৃতি মানুষ আজও ছাড়তে পারেনি। অবাধ প্রাণী হত্যা, অবাধ প্রাণী ভক্ষণ, বন্য প্রাণীর অবাধ গৃহায়ন ও যথেচ্ছ খামারায়ন, প্রাণী-অঙ্গ দিয়ে মানব-অঙ্গের অবাধ প্রসাধন, অবাধ বিনোদনে প্রাণিদেহের ব্যবহার ও বিপণনে মানবসমাজ এখনও নির্দয়। ইউভাল নোয়াহ হারারি, একালের প্রণম্য ইতিহাসকার, শিকারযুগ থেকে কৃষিযুগে পা রাখা মানবসভ্যতায় বন্য ও সামুদ্রিক প্রাণীর গণ-অবলুপ্তির মর্মভেদি বিবরণ পাঠে বাধ্য করেছেন মানুষকে।
চাষবাস ও বসতির জন্য জমি দরকার, জমির আবার মালিক থাকা দরকার, খাবারে বৈচিত্র্য-বিলাস ও ভিন্নতা থাকা দরকার,— রকমারি ‘দরকার’-এর চাপ গণ-অবলুপ্তির মূল কারণ ছিল সেই সময়। দ্বিতীয় অবলুপ্তির শুরু হয় শিল্পযুগের আগমনে। প্রোটিন ও নিত্যনতুন পণ্যের চাহিদা মিটানোর বাহানায় উজাড় করা হয়েছিল নদী-বনভূমি। প্রাণিদেহ অবলুপ্তির মানবসৃষ্ট পন্থা আজও বহমান। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিচরিত প্রাণীদের খামারায়নে সঙ্গী হয়েছে ‘zoonotic diseases pose’-এর মড়ক। বিচিত্র প্রজাতির প্রাণীদেহে জিনগত অভিযোজন, রূপান্তর ও সহাবস্থানের দোষে জন্ম নিচ্ছে ক্ষতিকর অণুজীব, প্রাণী থেকে মানবে দ্রুত ছড়াচ্ছে সংক্রমণের বিভীষিকা।
করোনা, যেমন ধারণা করা হয় উহানের পশুখাদ্যের বাজারে বিচিত্র প্রজাতির প্রাণীদের গণ-সহাবস্থানের দোষে মানুষের দেহে ছড়িয়েছে। অণুজীবের গবেষক জনাথন বেল প্রাণিদেহের সঙ্গে মানবদেহের এহেন সহাবস্থানকে Viral Soup সৃষ্টির ভাগাড় বলে নিদান হেঁকেছেন। প্রাণিচক্রে মানুষের যথেচ্ছ অনুপ্রবেশ ও হস্তক্ষেপ অনাহুত উপদ্রব বৈ অন্য কিছু নয়। বেল সোজাসাপ্টা বলেই দিয়েছেন, “So live animals, lots of species and cramped conditions— it’s a recipe for disaster.” মারি-অতিমারি প্রাণীর দোষে ঘটে না। মারি দেখা দেয় প্রাণিচক্রে অণুজীবের সহজ বিচরণশৃঙ্খলে আহাম্মক মানুষের অনুপ্রবেশ ও অযাচিত হস্তক্ষেপ ঘটানোর দোষে। এর নাম হচ্ছে ‘দূরত্ব’। অন্যের জীবনচক্র অনুভব করতে না পারার দূরত্ব, যার ভয়াবহ পরিণাম ‘করোনা’!
জগতে মারির শেষ নেই। ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরা, যক্ষা, বসন্ত, সার্স, মার্স, ইবোলা, ডেঙ্গু কত শত ছোঁয়াচে মারির প্রকোপে মানুষের জীবনে সঙ্গবিহীন হওয়ার দিন ফিরে-ফিরে দেখা দিয়েছে। দূরত্বপ্রিয় মানুষ মারির প্রকোপকালে নিজেদের মধ্যে জরুরি দূরত্ব বজায় রাখতে পারেনি। সেই দোষে উজাড় হয়েছে জনপদ! মানুষ কেন ‘সত্যের মতো বদমাশ’ সেটা বোঝা যায় মারি দেখা দিলে। যে-অণুজীব এই মারির জনক তার প্রাদুর্ভাব ঘটলে বোঝা যায় জগৎ চলে কার হুকুমে। করোনাকাল দেখা দিলে মানুষের মনে বোধের উদয় ঘটে। সে তখন বোঝে, জগৎ মানুষের হুকুমের চাকর নয়। কল্পনার আবির-গুলানো ঈশ্বর সেই জগতের অধিপতি নয়। জগৎ নিজেই নিজের ঈশ্বর। প্রকৃতি নিজস্ব ছকে তাকে ভাঙে-গড়ে। অণুজীবরা সেই ভাঙা-গড়ায় খেলার সারথী। খুদির রাজত্ব তাই জগতের শেষ কথা। সে-রাজ্যের জাহাপনা খুদির সমবায়ে বিরচিত। বৃহৎ ও জায়মান যত কিছু তারা সবে খুদির কারণে আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে জগতে। বৃহৎ নিকাশ হয় খুদির কল্যাণে। মানুষের জন্ম সেও খুদি থেকেই। করোনাভাইরাস সে-খুদির মহিমায় চমকিত। জগৎজুড়ে যার হুকুমবাজি, তিন ফুট দূরত্বের কসরতে তাকে রোখাটা কঠিন। এক করোনা বিদায় নিলে অন্য করোনা দেখা দেবে নতুন রূপে। অণুজীবের এই হুকুমবাজি মানুষের তাই সবার আগে বোঝা প্রয়োজন।
করোনামারির দিনে জপমালা হাতে বালক নিজেকে ঘরে বন্দি করেছে। হুকুমবাজ শব্দতরঙ্গে খানিক দিশেহারা তার মন! বালকের কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে করোনাদিনে পাওয়া হুকুমবাজ শব্দের ফেনা : ‘করোনাভাইরাস’, ‘কোভিড-১৯’, ‘সুপার স্প্রেডার’, ‘প্যানডেমিক’, ‘অতিমারি’, ‘থার্মাল স্ক্যানার’, ‘টেস্ট কিট’, ‘পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই)’, ‘আইসোলেশন’, ‘সঙ্গনিরোধ’, ‘সোশ্যাল আইসোলেশন’, ‘সামাজিক-নিরোধ’, ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স’, ‘সামাজিক দূরত্ব’, ‘প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন’, ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’, ‘সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন’, ‘স্বেচ্ছাবন্দি’, ‘এতেকাফ’, ‘লকডাউন’, ‘শাটডাউন’, ‘জনতা কার্ফু’, ‘ঘরে থাকো, বেরিয়ো না’। হুকুমবাজ শব্দের স্রোতে দিশেহারা বালক খাবি খাচ্ছে ভয়কাতর শব্দের চক্করে। তার দেহ বিপন্ন; মন নিজের পরিণাম ভেবে অসহায়। এর নাম হচ্ছে ‘অনিশ্চয়তা’। এর নাম ‘দূরত্ব’।
হ্যাঁ, দূরত্ব নিজের থেকে; পরিবার ও প্রিয়জন থেকে; সমাজ ও সামাজিকতা থেকে; অনুষ্ঠান ও আনুষ্ঠানিকতা থেকে; হয়তো-বা এইসব যা তাকে মানুষ করেছিল তার সবকিছু থেকে। এর নাম ‘সন্দেহ’। সন্দেহ নিজেকে; ভালোবাসি এমন প্রিয়জনকে; পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া অচেনা আগন্তুককে; ভিড়ে পল্লবিত জনতাকে। এর নাম ‘অবিশ্বাস’। অবিশ্বাস নিজেকে ও প্রিয়কে; প্রতিবেশী ও সহকর্মীকে; বাজার ও চিকিৎসালয়কে; সরকার নামে ঘোষিত বাক্যনবাব ক্ষমতাযন্ত্রকে; এবং, অবিশ্বাস হাওয়াকলে উৎপাদিত গুচ্ছ-গুচ্ছ কথামালায়, যেটি তাকে একদিন মানুষের ওপর বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল, এখন সেই ‘বিশ্বাস’-এর ওপর তার যত অনাস্থা ও অবিশ্বাস!
করোনা নামের বল্লেবাজ প্যানডেমিক বা অতিমারি হয়ে বাতাসে ভেসে-ভেসে ধরায় নামেনি। সে নেমেছে প্যারানয়েড হয়ে। মানুষ যেন অতীতে বহুরূপে নেমে আসা মারি-মহামারি-অতিমারির সঙ্গে মিল করে তাকে পাঠ করতে পারে। যেন বোধগম্য হয়,— মানুষ হচ্ছে শিখরছোঁয়া বাতুল ক্রীড়নক। তার বিদ্যার নাম ‘অহঙ্কার’; বিজ্ঞান ‘অবিবেচক’; ব্যক্তি বা পরিবার ‘প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন গোঁয়ার’; সমাজ ও সামাজিকতা ‘জড়ীভূত পাষাণ’; মানবিকতা ‘কেবল তার নিজের জন্য’। অতিমারি ফিরেছে এই উপলব্ধি উসকে দিতে,— নিজেকে ‘মহান’ গণ্যকারী মানুষ আদতে বাতিকদুষ্ট কীট। তার অর্থনীতি স্ব-কাম দুষ্ট। পরার্থপরতা মর্ষকামী। রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি ধর্ষণে উদ্যত। রাষ্ট্রযন্ত্র আধিভৌতিক প্রেত। সংস্কৃতি স্বেচ্ছাচারী। ধার্মিকতা বানোয়াট। অনুভব ও সংবেদন কথার ফুলঝুরি। মানুষ সেই বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি যেটি তাকে পৃথক করেছে যে-প্রকৃতির অংশরূপে একদিন সে বিকশিত হয়েছিল তার সবকিছু থেকে। মানুষের দেহের ভিতরে মনের বসতি; সেই মন তাকে এতদিন পৃথক হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছে। প্রাণের সন্নিকটে যাওয়ার বাহানায় কী করে দূরত্ব দিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হয় সেটা শিখিয়েছে। আর এইভাবে নিষ্ক্রান্ত হতে শিখিয়েছে সেইসব স্মারক চিহ্নের থেকে যাদের সমবায়ে প্রাণবান এই পৃথিবী বিরচিত।
…
করোনাকালে দূরত্ব বজায় রাখার জরুরি নিদান তাই মানুষের জন্য অশনিসংকেত। করোনার প্রকোপ হয়তো সহসা থেমে যাবে। মানুষ তবু ইচ্ছে করলেও ফেরত যেতে পারবে না অতীতে ফেলে আসা দিনগুলোয়। করোনা তাকে অহর্নিশ তাড়া করে ফিরবে। কোনওকিছু আগের জায়গায় বহাল থাকবে না মারি শেষ হলে। দূরত্বসূচক ঘড়ির কাঁটাগুলো ইচ্ছে করলেও পেছনে ঘুরিয়ে দিতে পারবে না কোনও জাদুকর। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দূরত্ব সময়চক্রে বাড়তে থাকবে এটা নিশ্চিত। করোনামারি দেখা দেওয়ার আগে যা-কিছু অন্যের থেকে মানুষকে পৃথক করে রেখেছিল মারি শেষে তারা একে-একে অচল গণ্য হবে। মানুষের এই বেঁচে থাকার অর্থনীতি, সরকারব্যবস্থা ও রাজনীতি, সমাজ-সামাজিকতা ও সংস্কৃতি, তার এতদিনের খাদ্যাভ্যাস ও বিনোদন,— সবকিছু অকার্যকর হওয়ার দোষে গলেখসে ধুলায় মিশে যাবে। যেন কিং লিয়ার! নিজের ভুলে যে এখন নিজেই বিপন্ন! যা-কিছু মানুষের জীবনে বিজড়িত ছিল এতদিন আসন্ন আগামীতে তারা প্রত্নতত্ত্বের খোরাক হবে, আর ইতিহাসকারের জন্য রেখে যাবে স্মারক।
করোনাদিন শেষ হলে হুকুমবাজ নতুন শব্দের আবির্ভাব গতি পাবে মানববিশ্বে। গোটা কয়েক দশক, বড়জোর এই চলতি শতকের পরিসীমায় ঘরবন্দি বালকটিকে আর মানুষ বলে চেনা নাও যেতে পারে। তাকে তখন চিনে নিতে হবে নতুন কোনও পরিচয়ে। বালকের শব্দশেখার অভিধানে অবিরত ঘাই তুলবে এখনও ‘মৃদুমন্দ’ কিন্তু ভবিষ্যতের ‘সপাট’ শব্দগুলো : — ‘অটোমেশন’ — দরকারি পণ্য ও সেবা ঘরে পৌঁছে দেবে ‘অটোমেশন’; ‘ভার্চুয়াল রিয়েলিটি’ — সমুদয় প্রয়োজন সারতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঘরে বসে মানুষ তৈরি করে নিতে পারবে সে-কাজের পরিবেশ।; ‘সিন্থেটিক মিট’ — জৈব ও প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপন্ন পশুখাদ্য ক্ষতিকর অণুজীবের ভাগাড়। মাংসের খিদে মিটাতে কারখানা থেকে সোজা ঘরে পৌঁছে যাবে পশুখাদ্য। ব্যাধি-মারির শঙ্কাবিহীন আর প্রয়োজনীয় প্রোটিনের স্বাদে-গুণে ভরপুর ‘সিন্থেটিক মিট’।; এবং, হয়তো আগামীদিনের পণ্য ও খাদ্যের নতুন পৃথিবীতে খাপ-খাওয়ানো মানুষ ক্রমে তার ‘মানুষ’ পরিচয় হারিয়ে পাল্টে যাবে ‘না-মানুষ’-এ!
করোনামারি শেষ হলে বায়বীয় বাস্তবতার জগতে মানুষের বসতি পাকা করার আওয়াজ আরও জোরালো হবে নিশ্চয়। মানুষের জৈবঅঙ্গ ক্রমে প্রতিস্থাপিত হবে যান্ত্রিক-অঙ্গকে নিজের দেহে জুড়ে নেওয়ার কারণে। জৈবমানব থেকে রূপান্তর ও অভিযোজনের মানবসৃষ্ট বিবর্তনের ফলে একালের মানুষ আসন্ন আগামীতে নতুন প্রাণীতে রূপান্তরিত হবে; সে হয়ে উঠবে অজৈব ‘যন্ত্রমানব’। জৈব-সভ্যতায় মানুষের ভুলের কারণে যে-দূরত্ব রচিত হয়েছে, যে-দূরত্ব বিপন্ন করে তুলেছে প্রাকৃতিক বিবর্তনের স্বাভাবিক জৈব-শৃঙ্খলা,— সেই শৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া মানুষ নিজের পতন রুখতে পারবে না। একালের প্রযুক্তি ও প্রগতির গতি আশু সেই বিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী বটে!
বালকের শব্দশেখার কসরতে করোনাদিনের দুর্যোগের মধ্যেও বেনোজলের মতো ঢুকছে আগামী পৃথিবীর সংকেতভরা শব্দরাশি : — ‘আর্টিফিশিয়্যাল ইন্টেলিজেন্স’, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’, ‘ডিপ লার্নিং’, ‘মেশিন লার্নিং’, ‘সিমুলাক্রাম’, ‘সদৃশতা’, ‘রোবট’, ‘সাইবর্গ’, ‘চ্যাটবুট’, ‘বিটকয়েন’, ‘ট্রান্সহিউম্যান’ বা ‘যন্ত্রমানব’। শব্দগুলো পাল্টে দিচ্ছে এতদিনের চেনা পৃথিবী ও প্রকৃতির চেহারা। জৈবিক দোষ-গুণের সমাবেশে বিরচিত প্রাণী ও মানুষের চিরচেনা সামাজিক বৃত্ত টলে উঠছে। আলফাঘরে বসা করোনাকাতর বালক এখনও জানে না কী ভবিতব্য অপেক্ষা করছে তার জন্য? মানুষের মৃত্যু ঘটেছে শুনে সে কি দুঃখিত হবে তখন? নিটশে ‘ঈশ্বর মৃত’ বলে নিদান হেঁকেছিলেন। আশ্চর্য হলেও এটা হয়তো অমোঘ,— ‘মানুষ মৃত’ এই ঘোষণা থেকে সভ্যতা খুব বেশি দূরে নেই। আজ নাহয় কাল কেউ বলতেই পারে, ‘মানুষ মৃত।’
বালক এখনও অবোধ। জানে না পৃথিবীতে মানুষ থাকার দিন ফুরাল বলে! স্মারকস্তম্ভ হতে চলেছে তার যাবত কালের অর্জন। জৈবঅঙ্গ ও কারুকাজের খোলস ছেড়ে নতুন খোলসে হাজির হতে যাচ্ছে সে! নিজের অতীত কৃতি ধারণ করেই তার পরতে-পরতে যুক্ত হতে চলেছে ‘না-মানুষ’-এর বেশ। আগামী পৃথিবীর সেই মানুষ হয়তো ‘ট্রান্সহিউম্যান’ নামে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে। অনিবার্য সে-পালাবদলের সংকেত হয়ে করোনা পৃথিবীতে আঘাত হেনেছে। পুরনোকে বাতিল করে নতুনের বার্তা উড়াতে বড় ঝড়ের প্রয়োজন হয়। করোনা তার প্রথম সূচনা।
সত্য বটে, করোনা সূচনা মাত্র। বরফযুগের জমাট বরফ সাইবেরিয়া থেকে হিমালয় জুড়ে দ্রুত গলছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেরিয়ে আসছে নতুন অণুজীব। তারা অদৃশ্য; চোখে দেখা যায় না, কিন্তু মানবজাতিকে সাবাড় করে দেওয়ার শক্তি রাখে। ওদের সঙ্গে লড়াই করা জরুরি, নাকি লড়াই যেন করতে না হয় সেই ব্যবস্থার পথে হাঁটা জরুরি, মানুষের সেটা আগে ঠিক করে নেওয়া চাই। অদৃশ্য অণুজীব নিয়ে চমৎকার করে লিখেছেন বার্নার্ড ডিক্সন। মুখ ফসকে কঠিন কথাটি বলে দিয়েছেন সহজ করে, “Microbes, not macrobes, rule the world.” অতুল কীর্তির অধিকারী মানুষের মতো বৃহৎরা নয়, অণুজীবরাই জগতের শাসক। ডিক্সনের কথার মর্ম বোঝার সময় হয়েছে মানুষের। নতুন যুগের মানব হওয়ার পথে নিজের ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সময় হয়তো এখনও ফুরিয়ে যায়নি। নতুবা এখন যা-কিছু নিজের পরিচয় ও স্বীকৃতি বলে মানুষের কাছে গণ্য, তার কোনওকিছু টিকে থাকবে না আগামীদিনের সেই ধরায়!
লেখাটা পাঠশেষে একটা গানপারভাষ্য
অন্তর্গত অসহনীয় অকহতব্য অশান্তি নিয়া চারপাশে এমন লেখাই খুঁজছিলাম আমরা যা ডামাডোলের এই বাংলাপাণ্ডিত্যের হাঁকডাকের বাইরে একটা স্থিতধী বেদ হাজির করে, সেয়ানা পাতিকাকের আচরণের বাইরে বেরোয়, বেদনার বাদ্যটা বাজায় বেদনাবিনীত উপায়ে। এমন প্রতিবেদনার ভাষ্যই তো বেদব্যাসের ভাষাভূখণ্ডের মানুষেরা বানাবে কথা ছিল। অথচ চারপাশে এত পণ্ডিতম্মন্য গণ্ডমূর্খামি আর গুণ্ডামিতে লেখাপত্র আবিল যে প্রলয় বন্ধ হবে না জেনেও অন্ধ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। যেই কথাগুলা আধিপত্যশীল তথ্যপ্রস্তুতকারী মিডিয়া কালকে এমনিতেই হাজির করবে, সেইগুলারই আগাম ধ্বনি শুনি তরুণ চিন্তকদেরও মুখে। এর মধ্যে আখাম্বা স্লাভো জিজেকের রগড়-করা স্টাইলের বাংলা ভাঁড়ামো তো সর্বত্র অনুসৃত হতে দেখি। কিন্তু রগড়টাই খালি, জিজেকের পড়াশোনাটা বাংলাখোর তরুণ সমাজচিন্তিতরা আজও ধরেছে দেখলাম না। আহমদ মিনহাজের এই লেখাটা এর মধ্যে পেয়ে যেন লটারি জিতে নেয়ার আনন্দ হলো। মনে হচ্ছে যেন ঘোড়ার ডিমগুলাকে এইবার তোড়ায় বেঁধে একটু ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে নেয়া যাবে বেশ অনেকদিন। সময়টাকে একটা ভাষা দেয়া যাবে এইভাবে। কেউ হয়তো নজর করবে না, আমরা যারা নজর করতে পারলাম এইটা আমাদের নগদ লাভ, আমাদের সামনের দিনগুলায় জীবাণুযুদ্ধের সঙ্গে যুঝতে যেয়ে এইটা সাহায্য করবে এ আমরা পাঠশেষে লেখাটা নিয়া হাজারও কথার ভিড়ে স্বীকার করতে পারি। দিনের বেলায় ভাতঘুমের আগে বা স্টাকড-আপ কোয়ারেন্টিনদিনের অলস কোনো হতবুদ্ধ অবসরে বা রাত্তিরে নিন্দ যাবার আগে লেখাটায় একবার ঢুঁ দিয়া আসতে পারি। দিনরাইত হিন্দি সিনেমা আর নেটফ্লিক্সের রাহসিক-রগরগি সিরিজ দেখে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশি দিন গুজরান করছি আমরা সবাই, নিশ্চয় তাতে ব্যাপক কোনো ব্যাঘাত ঘটাবে না এই লেখা, খালি উন্মত্ত বলদের মতো প্রহরে প্রহরে প্রতিপলে ফেবুস্ট্যাট দাগা আর ধুমধাড়াক্কা ছায়াছবিদিনযাপনের পাশাপাশি খানিক প্যজ দিয়ে একদেড়টা বাংলা-আর্বি-উর্দু-ককরবক ভাষায় লেখাপত্রও তো পড়ে নিতে পারি এই বিচ্ছিন্ন নির্জন অভাবিত ফুরসতে। এবং দীর্ঘ রচনা যারা পড়ে উঠতে পারেন না জিন্দেগিতে, যে-কথাটা আজকের সোশ্যালি-কানেক্টেড অধিকাংশ কবিসাহিত্যিকদের কমন ডায়লগ যে তারা লাম্বাডাম্বা লেখা পড়তে পারেন না, তারাও যদি কিছু ধৈর্য খর্চা করে লেখাটা পড়েন তাতে আমাদেরই লাভ হবে; কেননা আমাদের অবিচল আশা তাদের হাতবাহিত গঞ্জনা-গালিগালাজের বাইরেও স্থৈর্যসম্পন্ন অল্পকিছু রচনা আমরা পাবো। করোনা ক্যাটাস্ট্রফি এবং এর অভিঘাতজনিত দুনিয়াক্রাইসিস নিয়া ফাইজলামি-ফিচলামি আর টুনটুনিশিল্পমার্কা ট্যুয়িস্টের টেন্ডেন্সি থেকে বেরিয়ে যেন ফুলপাখিপিপীলিকা আর সাপবেজিতিমিডলফিনটাকেও মাথায় রাখি আমাদের বাকি জিন্দেগির প্রত্যেকটা বাক্য মুসাবিদায়, এইটাই হোক না-হয় কোভিড-নাইন্টিনের এই মৃত্যুকালিমাকাতর সময়ের সৃজনানুসন্ধানীদের শপথ। আর আমাদের হতভম্ব বোবা দশাটাকে এই লেখার মাধ্যমে একটু বোধগম্য আকারে গানপারে হাজির করা যাচ্ছে ভেবে আমাদেরও ভাল্লাগছে, বেশ কর্তব্যনিষ্ঠ দায়িত্বসম্পাদনকারীর শান্তি লাগছে, এই সুযোগটা লেখক আমাদেরে দিয়েছেন দেখে সহস্র ফুট দূরে থেকে অ্যারাব কেতায় লেখকের হস্তচুম্বন করি, এই মর্যাদাটা গানপার চালানোর সুবাদে পেলাম বলে এই সাইটের সঞ্চালনায় আরও প্রগাঢ় হলো আমাদের মায়া। গানপারে এমন লেখাই নিয়মিত যত্ন করার স্বপ্ন দেখি যা চারপাশে ফ্যাশনেবল লেখালেখির বাইরেকার একেকটা খিড়কি খুলে দেয়। দিনশেষে ফ্যাশনসর্বস্ব লিখিয়েরা ঝাঁকেঝাঁকে স্ট্যাটাস দাগায়, স্ট্যাটাসক্যুর তরফদারি করে বেড়ায়, ট্রেন্ডসেট করে দেয়া লেখালেখি তো অনলাইনবাংলায় গরহাজির। নিশ্চয় আরও কিছু কথা বলা যাবে, গানপারের নিয়মিত অবদায়ক-লেখকরাই বলবেন আশা করা যাচ্ছে, লেখাটা পড়ে সেরে। সেই পর্যন্ত। — গানপার
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS