স্মরণ-বিস্মরণের আর্কাইভ : হাওয়া সিনেমার গান ও অন্য কিছু কথা || মৌসুমী ভৌমিক

স্মরণ-বিস্মরণের আর্কাইভ : হাওয়া সিনেমার গান ও অন্য কিছু কথা || মৌসুমী ভৌমিক

স্মরণ-বিস্মরণের আর্কাইভ : হাওয়া  সিনেমার গান ও অন্য কিছু কথা :: মৌসুমী ভৌমিক [i]


২০২২-এর অক্টোবরের শেষে কলকাতায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে,  মেজবাউর রহমান সুমনের হাওয়া  সিনেমাটি দেখার জন্য মানুষের ঢল নেমেছিল নন্দন চত্বরে। অথবা বলা যায়, চঞ্চল চৌধুরীর হাওয়া দেখতে ভিড় করেছিলেন মানুষ। কিংবা এও বলা যায়, ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের যে সিনেমা, তা দেখার জন্য দর্শক এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছিল। এত রকম শিল্পকলা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা আর এত কলাকুশলীর সম্মিলিত প্রয়াসে একটি সিনেমা নির্মিত হয়, কখন যে কোন বিষয়টা সামনে আসবে, কার কাছে যে কোন দিকটি প্রাধান্য পাবে, বলা মুশকিল। সিনেমা দেখি বা না দেখি, সুমনের ‘প্রথম সিনেমার প্রথম গান’-টি খুব মনে ধরে যায় এবং এই মনে ধরার জন্য গানটি কার লেখা, কার সুর, কার গাওয়া—এত কথা জানার কোনো দরকারই পড়ে না। সিনেমা শেষ হয়ে যায়, সিনেমার সঙ্গে যুক্ত প্রায় সবার নাম ভেসে ওঠে পর্দায়। এই সিনেমার তিনটি গানের নাম আসে। এক, ‘সাদা সাদা কালা কালা’; সুরকার ও গীতিকার : হাশিম মাহমুদ; সংগীত : ইমন চৌধুরী; গায়ক : এরফান মৃধা শিবলু। দুই, ‘আটটা বাজে’;  কণ্ঠ ও দোতারা বাসুদেব বাউল; কথা ও সুর : সংগৃহীত। তিন, ‘আয় খেয়ে নে’;  গীতিকার ও রচনা : রজব দেওয়ান; কণ্ঠ : শাহজাহান মুন্সী। সংগীতের এই ক্রেডিটের তালিকায় আরো একটি সুরের কথা আছে, ‘গুলতি থিম মিউজিক’, যা ‘কফিল আহমেদের গান এবং বাংলা ঐতিহ্যবাহী গীত দ্বারা অনুপ্রাণীত’। আরো একটি গান আছে এই সিনেমায়, তার  নাম এই তালিকায় নেই, ‘জ্বালা সহে না আমার অন্তরে’; সে-কথায় পরে আসছি।

songwriter and composer maniruddin amed

গীতিকার ও সুরকার মনিরুদ্দিন আমেদ। ছবিঋণ : বিশ্বজিত দাস

হাওয়া  রিলিজের প্রায় ন’ মাস পর সমস্যা দেখা দেয় ‘আটটা বাজে’ গানটি নিয়ে। প্রথমে ২৬শে এপ্রিল ২০২৩-এ সুমনের ফেসবুকের দেয়ালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়ি শহরের শ্যামল মণ্ডল একটি মন্তব্য লেখেন : “হাওয়া সিনেমার ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটির গীতিকার ও সুরকার মনিরুদ্দিন আমেদ… দুঃখের বিষয় এই যে … তিনি তাঁর যথাযথ সম্মান পেলেন না’।  শ্যামল মনিরুদ্দিন আমেদের ছবি-আঁকার স্কুলের ছাত্র। তাঁর মন্তব্য থেকে ভারতীয় গণনাট্য সংঘর বীরভূম জেলার সদস্য বিশ্বজিত দাসের দেয়াল, সেখান থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা—খবর ছড়িয়ে পড়ে : “বাংলাদেশের জনপ্রিয় ছবি ‘হাওয়া’ নিয়ে বিতর্ক, গানে নাম নেই”।  বিশ্বজিত হাওয়ার সমস্ত কলাকুশলীর কাছে ‘লেখককে সঠিক মর্যাদা’-র জন্য আবেদন করেন, এবং পোস্টের নিচে যোগাযোগের একটি নম্বর দিয়ে রাখেন। হাওয়ার পরিচালক ও প্রযোজক তৎক্ষণাৎ টেলিফোনে মনিরুদ্দিন আমেদের সঙ্গে কথা বলেন। স্থির হয় সুমনরা শীঘ্রই আসবেন সিউড়িতে। যতদূর ভুল সংশোধন করা সম্ভব তা করবেন, লেখককে সাম্মানিক তো অবশ্যই দেওয়া হবে। পরদিন ফেসবুকে মনিরুদ্দিন আমেদের ছবি সহ একটি পোস্টে হাওয়ার সদস্যরা এই অনিচ্ছাকৃত অনুল্লেখের কারণ ব্যাখ্যা করেন—অনেক খুঁজেও তাঁরা লেখকের নাম জানতে পারেননি বলে ‘সংগৃহীত’ লিখতে বাধ্য হন। ইউটিউবে যেখানে গানটি রয়েছে, সেখানে লেখকের নাম যোগ করা হয়। খবরের কাগজে এবং টেলিভিশনের নানান চ্যানেলে সুমন সাক্ষাৎকার দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন। অতএব, সযত্নে বাঁধ দিতে চাইছেন সকলে মিলে। এর পর যদি  কথা দিয়ে কথা না রাখেন, সেটা খুবই দুঃখজনক হবে। কিন্তু তেমন আশঙ্কা করার কোনো কারণ তো দেখতে পাই না। সত্যি কথা বলতে কী, ২৮ তারিখ আমি যখন মনিরুদ্দিন আমেদের সঙ্গে কথা বলি, আমার মনে হয় উনি আসলে সুমনদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

আমার আরো একটা কথা মনে হয়েছে। যদি সব কিছু ঠিক মতন হতো, যদি কলাকুশলীদের তালিকায় মনিরুদ্দিন আমেদের নামটিও থাকতো, যদি তাঁকে এককালীন একটি সম্মানী দিয়ে হাওয়ার প্রযোজক ‘আটটা বাজে’-র স্বত্ব কিনে নিতেন, তাহলে এই যে হঠাৎ একটু আলো খেলে গেল মনিরুদ্দিনদের রোজকার মফস্বলি জীবনে, তেমন কিছু কিন্তু হতো না। এ এক রকমের ঘুরিয়ে দেখা, ঠিকই; কিন্তু এ কথাও সত্যি যে হঠাৎ একদিন ভালো-মন্দ কিছু ঘটে বলেই তো আরো কিছু ঘটে, আর আমাদের জীবন কিছুটা হলেও পাল্টে যায়।

মনিরুদ্দিন আমেদের খাতায় ‘আটটা বাজে’ গানের লিরিক

মনিরুদ্দিন আমেদের খাতায় ‘আটটা বাজে’ গানের লিরিক

কিছু প্রশ্ন থাকে, উত্তর খানিক জানা, খানিক অজানা। যেমন, এই গানটি কেমন করে বাসুদেব দাস বাউলের কাছে পৌঁছেছিল? শিল্পীর সেই ইতিহাস স্মরণে নেই, তিনি অন্যদের যে-কথা বলেছেন, আমায়ও টেলিফোনে সে-কথাই বলেন। বলেন, বহুকাল ধরে তিনি এই গানটি গাইছেন। কার গান, সে-কথা না জেনেই গাইছেন। গানটি নাকি ১৯৮৬তে লেখা। বাসুদেব দাস বাউল থাকেন শান্তিনিকেতনে, সিউড়ি থেকে সামান্য দূরে, তবু কেন তিনি লেখকের নাম জানতে পারেননি এই এত বছর ধরে? হয়তো জানবার প্রয়োজন হয়নি বলে। আজ তাহলে প্রয়োজন হচ্ছে কেন? কারণ, আমার মনে হয়, মনিরুদ্দিন আমেদের জগৎ থেকে বাসুদেব দাস বাউলের জগতে একটি গান যে নিয়মে পৌঁছতে পারে, কারো না কারো কণ্ঠবাহিত হয়ে বা মেলার পথ ধরে, আর যেভাবে বাসুদেবের জগতে গানটি মনিরুদ্দিনকে বাদ দিয়েও স্থান করে নিতে পারে, সেই একই গান যখন বাসুদেবের জগৎকে অতিক্রম করে হাওয়ার জগতে গিয়ে পৌঁছয়, তখন লেনদেনের নিয়ম খানিক পাল্টে যায়। এ জগতে স্বীকার-অস্বীকারের সঙ্গে নাম যশ আর অর্থ জড়িয়ে আছে।

মনিরুদ্দিন আমেদের গান জনপ্রিয় লোকশিল্পী স্বপ্না চক্রবর্তী গেয়েছেন, রেকর্ডও করেছেন নাকি (‘ময়ূরাক্ষীর বান ছুটেছে নদী কাঁদো রে’ বলে সেই গানটি আমি অনেক খুঁজেও ইন্টারনেটে পেলাম না, কোনো কোণে লুকিয়ে আছে হয়তো)। তিনি সিউড়িতেই থাকেন। ১৯৯৬-এ বোলপুর প্রসার ভারতীর সঙ্গে যুক্ত শিল্পী আমিনূর রশিদ দূরদর্শনে মনিরুদ্দিন আমেদের লেখা ঈদ-মিলাদ-উন-নবির একটি গান গেয়েছিলেন (দিনক্ষণ সব মনিরুদ্দিনের খাতায় লেখা আছে); এছাড়াও স্থানীয় অনেক শিল্পী আসরে-অনুষ্ঠানে, মেলায়-উৎসবে ওঁর গান গেয়েছেন, রেকর্ডও করেছেন। তাঁরা কতদূর স্বীকৃতি দিয়েছেন গীতিকার-সুরকারকে? কার্তিক দাস বাউল তো নাকি ‘আটটা বাজে’ গানটিই গেয়েছেন। কখনো কোনো সাম্মানিক পেয়েছেন কি তিনি এঁদের কাছ থেকে? না পেয়ে থাকলে কোনো ক্ষোভ আছে কি? অবশ্যই আমি এমন কোনো কথা মনিরুদ্দিন আমেদকে জিজ্ঞেস করিনি, কারণ তা অশোভন হতো। এই সব মানুষ তো মনিরুদ্দিনের আপনজন, স্বপ্না চক্রবর্তীর ভাই তাঁর সহপাঠী ছিলেন, আমিনূর রশিদকে তিনি চাচা বলতেন। একটা কথা আমার মনে হয়েছে যে নিজের এই জগতে মনিরুদ্দিন এতটাই নিশ্চিন্তিতে থাকেন, সেখানে কে স্বীকৃতি দিলো বা দিলো না, তাতে খুব কিছু যায় আসে না। আর সে-জগতে স্বীকৃতির ধরনধারণও কিছুটা ভিন্ন। তুলনায় সুমনের হাওয়া  এক দূরতর দ্বীপ। সেখানে স্বীকৃতি না পেলে মনে ক্ষোভ জাগে : সকলের যদি নাম থাকে, তাহলে মনিরুদ্দিনের নেই কেন? তাঁরই গান গেয়ে আর কারো নাম হবে, অর্থ হবে, এ কেমন? এই প্রশ্ন লেখক থেকে তাঁর পরিবারের, ছাত্র, বন্ধু, পড়শির—একটা গোটা সমাজের। স্বীকৃতি এলে তাই সকলেরই গর্ববোধ হয়।

ধীরাজ উদ্দীন ফকির
তবে, নাম থাকলেই একজন শিল্পী আমাদের স্মরণ-বিস্মরণের আর্কাইভে থেকে যান কি না, থাকলেও কীভাবে থাকেন, এই কথাটিও মনে আসে। ধরা যাক, তিতাস। এক বিস্তৃত চরের বুকের ওপর গোল হয়ে পড়ে আছে এক টুকরো শীর্ণ নদী; নদীও না ঠিক, চরের উপর নদীর স্মৃতিচিহ্ন পড়ে আছে যেন। দিগন্তে এতই আলো যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এমন এক সাদাকালো প্রায়-স্টিললাইফ দিয়ে শুরু হয় ঋত্বিক ঘটকের ১৯৭৩-এর চলচ্চিত্র, তিতাস একটি নদীর নাম। তারপর বোঝা যায়, সব স্থির হয়ে যায়নি এখনো। ক্যানভাসের ভিতর থেকে উঠে আসে একটি গান, ‘তোমার আজব লীলে, লীলে দেখে লাগে ভয়’; সেই গান সমগ্র  চরাচর ব্যাপ্ত করে ফেলে, ধীরে ধীরে ক্যামেরা চলতে শুরু করে, দূরের নৌকার রেখা স্পষ্ট হয়, ওদিক দিয়ে কেউ হেঁটে যায়, বৃষ্টি নামে মাটির উপরে। আর স্ক্রিনের বাঁদিকের কোণে  সিনেমার ক্রেডিট একে একে জ্বলে নেভে, নেভে জ্বলে। ‘উপন্যাসের প্রকাশক পুঁথিঘর লি. (ফিল্ম কপিরাইটপ্রাপ্ত), মূল নেপথ্য গায়ক ধীরাজ উদ্দীন ফকির, সংগ্রহ সংগীত দিয়ে সাহায্য করেছেন হরলাল রায়, সংগীতে যন্ত্র বাজিয়েছেন আলাউদ্দীন লিটল অর্কেস্ট্রা… নেপথ্যে গান করেছেন ধীরাজ উদ্দীন ফকির…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্রেডিটের তালিকায় ধীরাজ উদ্দীনের নাম তিন অথবা চার নম্বরে আসে, তিনি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই নামোল্লেখ একভাবে আর্কাইভে রেকর্ড রাখাও বটে। ফকির লালন সাঁই-এর নাম নিয়ে তো চিন্তা নেই, এক তো তিনি লালন, তাছাড়া শুরুর সাড়ে তিন মিনিট ধরে গোটা গানটাই বাজে, সাঁইজি ধীরাজ উদ্দীন ফকিরের উচ্চারণে ধরা থাকেন, স্ক্রিনে আলাদা করে তাঁর নাম লিখতে হয় না। ধীরাজ উদ্দীনের আরো দু’ টুকরো গান আছে। একটি একটি কাহিনির অংশ। যখন কিশোরের নতুন বউ চুরি হয়ে যায় আর কিশোর পাগল হয়ে যায়, তখন পাশের নৌকায় গান হচ্ছে ‘আল্লার ঐ লীলা রে, কে বুঝিতে পারে’ (আমার অনুমান, যিনি গান করেন ঐ দৃশ্যে, তিনিই ধীরাজ উদ্দীন—হয়তো কোথাও এই কথা লেখাও আছে)। অন্যটি অনন্ত যখন চলে যায়, বাসন্তী যখন বৃষ্টিতে পুড়ে যাচ্ছে, তখন। বুক-ফাটা হাহাকারের মতন গেয়ে ওঠেন ধীরাজ উদ্দীন ফকির—‘ও তোর আপন দোষে সব হারালি’। এইসব কিচ্ছা কাহিনি বা বিচ্ছেদীর সুর কোন বড় গানের অংশ, কার গান, কার রচনা, তা ভাবার বা জানার দরকার পড়ে না। এইসব গানে আলাদা করে রচয়িতার স্বাক্ষর থাকে না, এ গান তিতাসের জলে মীনের মতনই সহজাত, আসে যায় বাতাসে মিলায়। তাছাড়া, যখন এই সিনেমা নির্মিত হয়েছিল, সেই ১৯৭২-৭৩-এ, তখন এতশত কথা বলার প্রয়োজনও হতো না। তখন ‘উপন্যাসের প্রকাশক পুঁথিঘর লি. (ফিল্ম কপিরাইটপ্রাপ্ত)’ পর্যন্ত পৌঁছেছিল আমাদের রাইট্‌স্‌-সচেতনতা। আজ হলে আমাদের ভাবতে হবে, কার লেখা ছিল ব্যালাডধর্মী গানটি? ঋত্বিক কার থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন ঐ গানটি রাখার আগে? কে গাইছেন এই গান? ডুবকি বাজাচ্ছেন কে? বিশেষ করে, অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি হলে এসব কথা সব ঠিকঠিক জেনে নিতেই হবে (এটা অবশ্য শুধুমাত্র শিল্পীর অধিকারের কথা ভেবে করা, এমন না। রেকর্ড কোম্পানি বা প্রডিউসার পরে বড় কপিরাইটের মামলায় পড়তে চাইবে কেন? নিট লাভ হলো, এর ফলে একটা নিয়ম শৃঙ্খলায় সবাই বাঁধা থাকে, এবং সেটা আসলে ভালো)।

ধীরাজ উদ্দীন ফকির (?)

ধীরাজ উদ্দীন ফকির (?)। ছবি ইন্টার্নেট থেকে নেয়া

যদি এই অনুমান ঠিক হয় যে সিনেমায় ধীরাজ উদ্দীন ফকির নিজেই নৌকায় বসে ‘আল্লার ঐ লীলা রে, কে বুঝিতে পারে’ গেয়েছিলেন, যেমন যুক্তি তক্কো গপ্পে  রণেন রায়চৌধুরীর ‘নমাজ আমার হইল না আদায়’, তাহলেও প্রশ্ন থাকে : কে ছিলেন ধীরাজ উদ্দীন ফকির? আমি যেটুকু জেনেছি, কেউ সেই বিষয়ে কিছু লিখে রাখেননি, ঋত্বিক নিজেও সম্ভবত কোনো তথ্য জানিয়ে যাননি। ধীরাজ উদ্দীন ফকির রণেন রায়চৌধুরীর মতন ঋত্বিক ঘটকের সমাজের অংশ ছিলেন না, হয়তো সিনেমা বানানোর সময় কেউ তাঁকে নিয়ে এসেছিল, তারপর তিনি আবার নিজের জগতে ফিরে যান। হতে পারে, না-ও হতে পারে। আমি অনুমান আর আর্কাইভাল রেকর্ডিং নিয়ে কাজ করার সামান্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলছি। এও আমি জানি যে এসব অনুসন্ধানে লেগে থাকতে হয়, খুঁজেই যেতে হয়। পরিচালক অনুপ সিং ১৯৯৭-৯৮ নাগাদ ঋত্বিকের ওপর তাঁর ডকু-ফিচার, নেইম অফ আ রিভার  করার সময় নাকি অনেক খুঁজেও কিছু জানতে পারেননি। যতদিন জানা যাবে না, ততদিন পর্যন্ত মানুষ ধীরাজ উদ্দীন ফকিরের জীবন, জগৎ এবং ইতিহাস থেকে বিযুক্ত (disembodied) হয়ে আমাদের ধীরাজ উদ্দীন ফকির একটি ঘরহীন নাম, একটি অমোঘ কণ্ঠ এবং হয়তো-বা এক টুকরো ফুটেজ হয়ে, ঘর পাবার অপেক্ষায় থেকে যাবেন।

হাশিম মাহমুদ

হাশিম মাহমুদ। সাদা সাদা কালা কালা গানের গীতিকার ও সুরকার

হাশিম মাহমুদ। গীতিকার ও সুরকার। ছবি ইন্টার্নেট থেকে নেয়া

নাম থাকলেও বিভ্রান্তি হয়। ধরা যাক কার্তিক দাস বাউল। মনিরুদ্দিন আমেদ বলেন, কার্তিক দাস বাউল ওঁর ‘আটটা বাজে’ গানটি গেয়েছেন। বাসুদেব দাসও বলেন সেই কথা। আমি যে-কার্তিককে চিনি, গুসকরার কার্তিক, জর্জ লুনোর সংস অফ দ্য ম্যাডমেন (১৯৭৯) থেকে মিঠুন চক্রবর্তীর বিগ বস-এর দীর্ঘ পথে যাত্রা করা কার্তিক, যার সঙ্গে আমরা বাউল ফকির উৎসব করেছি বছরের পর বছর কলকাতার যাদবপুর-শক্তিগড়ে, সে আমাদের বন্ধু। তাকে ফোন করি। কার্তিক খানিক তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, ‘আটটা বাজে? না দিদি, ও অন্য কার্তিক দাস, লাবপুরের’। আমাদের কার্তিক তারপর বলে, ‘এখন দিনকাল অন্যরকম হয়ে গেছে, শ্রোতারা বলে, একটা মহাজনের পদ গাও। কোন পদ? না, সাদা সাদা কালা কালা’।  তা তো ঠিকই। হাশিম মাহমুদ তো আর ‘মহাজন’ নন। আবার তিনি মনিরুদ্দিনও নন। মনিরুদ্দিনের সমাজও ভিন্ন, গানও ভিন্ন, গানের শ্রোতাও ভিন্ন। আমরা কলকাতা বা ঢাকাকে কেন্দ্র ভাবি বলে মনে হয় মনিরুদ্দিন বুঝি প্রান্তিক, কিন্তু  কলকাতা-ঢাকা-চট্টগ্রাম-শান্তিনিকেতন-সিলেট-লন্ডনের বাইরেও তো অনেক দুনিয়া আছে। আমার মনিরুদ্দিনকে ওঁর জগতে দিব্যি আনন্দে আছেন বলেই মনে হয়েছে। তুলনায় হাশিম মাহমুদকে বিষণ্ণ লাগে। তিনি তির্যক, সাবভার্সিভ, তাঁকে ধরা যায় না, তিনি ধরা পড়তে চানওনা। [ii] ‘তোমায় আমি খেলতে পারি বাজি’ গানটি গাইবার সময় তাঁর গভীর কালো চোখে কৌতুক ঝিলিক দিয়ে যায়। কিন্তু কোথাও একটা ব্যথাও রাখা আছে হাশিম মাহমুদের ভিতরে, সেটা অনুভব করা যায়। যেমন ব্যথা রাখা আছে আমাদের শহর আর সময়ের বুকে। উঠতি যুবকের ঝাঁক বা পুরনো ব্যান্ডমেট বা শ্রোতা ছাড়া হাশিম মাহমুদ কিন্তু অসম্পূর্ণ। হাওয়ার জন্য সুমন তাঁকে খুঁজে পান যখন, তখন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। সুমন আমায় বলছিলেন, ‘এইসব ক্যাম্পাসে যারা গান করে, তাদের কী হয়? একবার হারিয়ে গেলে কেউ জানে না। তার বাসায় কেউ যায় নাই, সে কোথা থেকে আসছে… এই শহরটা কী অদ্ভুত না? কেউ একজন হারায়ে গেলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। চিন্তা করেন যে, যে-মানুষটার সাথে আমার সাত আট বছর কেটে গেছিল, সেই মানুষটার বাসা কোথায় আমি জানতেও চাই নাই’। সুমনের কথায় আমারও বিষণ্ণ লাগে আর আমি নিজের স্মরণ-বিস্মরণের আর্কাইভের ভিতরে হাবরা অশোকনগর থেকে আসা ভক্তদাসকে খুঁজি। [iii] তিনি আসতেন আমার বাসায়, আমার রাস্তায়, আমি বছরের পর বছর তাঁকে শুনেছি। তারপর লকডাউন হলো, রাস্তাঘাট সুনসান হয়ে গেল, আবার ট্রেন চালু হলো, ভক্তদাসের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকলাম, তিনি আর ফিরলেন না। আমি তাঁর খোঁজে তাঁর জীবন থেকে বিযুক্ত কণ্ঠ আর টু-ডাইমেনশনাল ইমেজ নিয়ে হাবরা-অশোকনগরের ট্রেন ধরে নানা জায়গায় গেলাম, অনেককে জিজ্ঞেস করলাম, অন্ধ বাউলদের, চায়ের দোকানে, জড়িবুটির কারবারিকে, কিন্তু তাঁকে কেউ চিনতো বলেই মনে হলো না। তখন আমিও ভাবলাম যে ভক্তদাসকে আমি কতটুকু চিনতাম? লকডাউনের পর আমাদের নতুন কোনো অধ্যায় শুরুও হলো না, কিছু শেষও হলো না, কোনো closure হলো না।

দীন দিলের দ্বন্দ্ব

বাসুদেব দাস বাউল

ভক্তদাস বাউল। ছবিঋণ : The Travelling Archive

বাসুদেব দাস বাউল যে ‘আটটা বাজে’-র লেখকের নাম জানতেন না, আমাদের কার্তিক সেই কথাটা মানতেই চায় না। তারপর সে বলে, ‘দেখেন দিদি, মানুষ তো কত কথাই বলে। ওই যে পবন গেয়েছিল দিল কি দয়া হয় না, সেদিন শিলাজিৎ বললো, ওটা দিল নয়, কথাটা দিন। আমরা তো এতকাল দিলই গেয়ে আসছি। কোথায় পায় মানুষ এই সব কথা, কে জানে’? ঝপ করে গুসকরার কার্তিক দাস বাউল একটি অন্য গানের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে আমাদের কথার ভিতরে। কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকও নয়। পবন দাস বাউলের ‘দীন দুনিয়ার মালিক খোদা দিল কি দয়া হয় না’ গানটার ক্ষেত্রে ১৯৭৯-র রিয়াল ওয়ার্ল্ড-এর রেকর্ডে লেখা হয়েছিল traditional, সংগৃহীত না, তবে প্রচলিত।

স্যাম মিলস আর পবন দাস বাউলের 'রিয়াল সুগার' অ্যালবাম

স্যাম মিলস আর পবন দাস বাউলের ‘রিয়াল সুগার’ অ্যালবাম। ছবি ইন্টার্নেট থেকে নেয়া

১৯৭৮-৭৯ নাগাদ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়, ঘুটিয়ারি শরিফ-এর মাজারে একদল ফকির এই গানটি গাইছিলেন। পবন দাস বাউল সেখানে সেই গান শুনে লিখে নেন, পবনের পার্টনার মিমলু সেন-এর আত্মজীবনীমূলক বাউলস্ফিয়ার-এ সেই কথা লেখা আছে আর মিমলু আমায় চিঠিতেও সেকথা লেখেন। [iv] বাকিটা তো ইতিহাস। স্যাম মিলস আর পবন দাস বাউলের রিয়াল সুগার  অ্যালবামের এই গান বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানেই বাঙালির বাস, যেখানেই সিলেটের মানুষের বাস, সেখানে তো বটেই, আবার ওয়ার্ল্ড মিউজিকের চক্করেও এই গান ঘুরে বেড়ায়। মিমলু লেখেন যে, যুক্তরাজ্যের রিয়াল ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস যখন অ্যালবাম বার করে তখন সেই দেশের নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত কপিরাইটের বিষয় দেখে নিয়ে, যথাযথ স্বীকৃতি এবং কন্ট্র্যাক্ট তৈরি করে তবেই অ্যালবাম বেরোয়। এই গানটির ক্ষেত্রে কার নাম দেবেন? পবন জানতেন না তো। তাই তিনি traditional লেখেন, যার ফলে লেখকের প্রাপ্য রয়ালটি ওদের Performers Rights Society-তে জমা পড়ে। এদিকে গানটি রিলিজের কিছুদিন পর কানাডা থেকে কেউ একজন রেকর্ড কোম্পানিকে লেখেন যে তাঁর এক আত্মীয় একটি সিনেমায় এই গানটি গেয়েছিলেন অনেক কাল আগে, ওই তিন-চারের দশকে। সেই পত্রলেখক দাবি করেছিলেন যে গানটি ‘মাহিম চৌধুরী’র লেখা, একথা মিমলু আমায় ইমেলে লেখেন। ইন্টারনেটে খুঁজে আমি মাহিম চৌধুরীকে পাই না, দিল কি দয়ার নানান ভার্শন পাই। আমায় বরাবরই গানের যাত্রাপথ আর বিবর্তনের গল্প খুব টানে। কানাডার সেই চিঠিটির কী উত্তর দিয়েছিল রিয়াল ওয়ার্ল্ড আমি জানি না, তবে এ নিয়ে খুব বেশি দূর কথা যে এগোয়নি তা বোঝা যায় কারণ গানটির লেখকের নাম নিয়ে কোথাও কোনো চর্চা  সহজে চোখে পড়ে না। চর্চা যদিও কিছু হয়েছে, তবে তা আড়ালেই থেকে গেছে।

বাসুদেব বাউল। উইকিপিডিয়া ইমেইজ সোর্স

বাসুদেব বাউল। উইকিপিডিয়া ইমেইজ সোর্স

বাংলাদেশের তরুণ শিল্পী ফাতেমা তুয যাহরা ঐশী এই গানটি রেকর্ড করেছিলেন ২০১৪-তে, চমৎকৃত হতে হয় ওঁর কণ্ঠের জোশ আর দক্ষ গায়ন শুনে। অন্তর্জালে আমি এলোমেলো ব্রাউজ করতে করতে ঐশীর দুটো রেকর্ডিং পাই, [v] একটিতে গানের সূত্র ‘সংগৃহীত’ লেখা, অন্যটিতে লেখকের নাম দেওয়া আছে, কামাল উদ্দিন পাশা। সমাজমাধ্যমে ঐশীকে খুঁজে নিয়ে জিজ্ঞেস করি তিনি কামাল উদ্দিন পাশার কথা কী করে জানলেন। উত্তরে ঐশী আমায় ১৯৪৫-এর একটি সিনেমার গানের ইউটিউব লিঙ্ক পাঠান, [vi] সিনেমার নাম অভিনয় নয়, গানের নাম ‘দীন দুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না’, লেখক মোহিনী চৌধুরী, সুর গিরীণ চক্রবর্তী, শিল্পী ঝর্ণা দে। সে-গানের কথা পবনদের গানের থেকে কিছুটা ভিন্ন আর সুর লয় অনেকটাই অন্যরকম। গানের description বা বিবরণের শেষে লেখা : মূল গান, কামাল উদ্দিন পাশা (১৯০১-১৯৮৫)।  মূল গান একজনের হলে গান আর-একজনের লেখা হয় কী করে? না কি, সিনেমার জন্য মোহিনী চৌধুরী সিলেটের মরমী কবি কামাল উদ্দিন পাশার গানের ওপর ভিত্তি করে একটি গান লিখেছিলেন? স্যাম আর মিমলুর সঙ্গে কথা হয়, কীভাবে সিনেমা থেকে বাউল ফকির মহলে এক একটা গান এসে পৌঁছয়, কীভাবে পথে ঘুরতে ঘুরতে গানটি বিবর্তিত হতে থাকে, কীভাবে আবার তা সিনেমায় ফিরে যায় অন্য রূপে, যেমন দিদারুল হোসেন দিদারের ২০০২-এর চলচ্চিত্র, বিপদজনক-এ। [vii] ঝর্ণা দে’র গানের তলায় অনেক মন্তব্য দেখি, কথাটা দিন না দীন না কি দ্বীন? পবন দাস বাউলের ‘মনগড়া ভুল’-এর কথাও লেখেন কেউ কেউ। কামাল উদ্দিন পাশার মূল গানটা নাকি ছিল, ‘দ্বীন দুনিয়ার মালিক খোদা, এত কষ্ট সয় না, তোমার দীনকে দয়া হয় না’—‘নাকি’ বলছি কারণ তাঁর মূল বই আমি দেখিনি। একই গানের বা কবিতার বা অন্য যে-কোনো টেক্সটের বিভিন্ন ভার্শন তো হয়। এখন, কেন তা হয়, তার কোনো একটাই কারণ আসলে থাকে না। এই গানে দ্বীন-দীনের দ্বন্দ্ব থেকে মনে হয়, তাহলে কি সিনেমার প্রয়োজনে গানটির ধর্মীয় অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে ‘দীন দুনিয়ার মালিক তোমার দীনকে দয়া হয় না’ করা হয়েছিল? সেখানে কিন্তু ‘খোদা’ নামটিও বলা হচ্ছে না। হয়তো সিনেমার পাত্রপাত্রীদের জন্যই এই পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল? মজা এই যে, ফকিরদের কাছ থেকে শেখা পবনের গানে কিন্তু তাহলে কিছু ভুল যেমন যোগ হয়েছে, কিছু লাইন আবার মূল গানের দিকে ফিরেও গেছে, কারণ তিনি গেয়েছেন, ‘দীন দুনিয়ার মালিক খোদা, তোমার দিল কি দয়া হয় না’। ঝর্ণা দে’র গানের তলায় শ্রোতাদের কারো কারো মন্তব্যে দেখি পবনের ‘মন-গড়া’ গান নিয়ে তাঁদের  আপত্তি, মোহিনী চৌধুরী-ঝর্ণা দে’কে পেয়ে তাঁদের মনে হয় যে এতদিনে মূল গানটি পেলাম। এখন ‘মূল’ কোনটা? মূল গান যদি সিলেটের কামাল উদ্দিন পাশার হয়ে থাকে, তাহলে সুনামগঞ্জের ধ্বনি কোথায় মোহিনী চৌধুরী-ঝর্ণা দে’র গানে? সে-গান অবশ্যই সুন্দর, কিন্তু তাতে কামাল উদ্দিন পাশার অঞ্চলকে তো পাই না। কামাল উদ্দিনের ‘মূল’ গানটি তাহলে কেমন ছিল?

ভক্তদাস বাউল

ভক্তদাস বাউল। ছবিঋণ : The Travelling Archive

সবকিছুকে মন-গড়া, ইচ্ছাকৃত এবং উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভুল বলে ধরলে ইতিহাসের অনেক বাঁকের গল্প আমরা আসলে মিস করে যাই। কিছু রস থেকেও বঞ্চিত হই। পবন দাস বাউলের ঘুটিয়ারি শরিফের ফকিরদের কাছে এই গান শেখার গল্পে একটা চার্ম আছে, তারপর স্যাম মিলসের সেই গানের সঙ্গে জড়িয়ে-পড়া আর তাঁর নিজের মতন গ্রুভ তৈরির ভিতরে একটা ভ্রমণের স্বাদ পাওয়া যায়। স্বাদ নিতেও তো শিখতে হয়। মানছি যে, তারপরেও আমাদের যার যার নিজের পছন্দ থাকবেই। কারো ঝর্ণা দে’কে, কারো ঐশীকে, কারো হয়তো সুনামগঞ্জের কোনো ফকিরকে বেশি ভালো লাগবে। সবাই থাকুন তাঁর নিজের নিজের দুনিয়ায়, অসুবিধা তো নাই কোনো। আমি শুধু বলবো যে, যেমন ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’-র ক্ষেত্রে হলো, গীতিকার সুরকারের নাম জানা মাত্র সমস্ত অনিচ্ছাকৃত ভুলের সংশোধন করতে শুরু করলেন হাওয়ার পরিচালক-প্রযোজক, তেমনি আজ রিয়াল ওয়ার্ল্ড আর পবন দাস বাউল আর স্যাম মিলসেরও ‘দিল কি দয়া’-র ইতিহাসটুকু তাঁদের যাবতীয় রেকর্ডে এবং আর্কাইভে সংশোধন করে লিখে রাখা উচিত, traditional-এর বদলে মোহিনী চৌধুরী আর কামাল উদ্দিন পাশার নাম নথিভুক্ত করা উচিত এবং কারো যদি এই গানের জন্য রয়ালটি প্রাপ্য হয়, তাহলে PRS-এর বদলে তাঁকেই সেই রয়ালটি পৌঁছে দেওয়া উচিত। কথা হচ্ছে, আশি-পঁচাশি বছর পর কে একটা গানের জন্য রয়ালটি দাবি করতে পারেন?

সহে না জ্বালা অন্তরে
কাজ করলে ভুলও হবেই আর সব ভুল যে ইচ্ছাকৃত নয়, এ কথাও সত্যি। কিন্তু কিছু ভুলের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে আর একটু পরিশ্রম করলেই সেই ভুলটুকু এড়ানো যেত। এ দোষে আমরা সবাই দোষী, পরে আক্ষেপ হয় শুধু। হাওয়ার নির্মাতাদের আমি বলবো, মনিরুদ্দিন আমেদের জন্য এন্ড-টাইটেল সংশোধন করবেন যখন, তখন যেন আরো একটা ভুল সংশোধন করে দেন। ব্যাপারটা ঠিক ভুল নয়। এটা একটা ভুলে যাওয়ার ঘটনা। এই লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, হাওয়ায় চতুর্থ একটি গান আছে, ‘জ্বালা সহে না আমার অন্তরে’। গানটি আরো অনেক শব্দের সঙ্গে মিশে থাকে, অনেকটা ধীরাজ উদ্দীন ফকিরের  ‘আল্লাহর এই লীলা রে কে বুঝিতে পারে’-র মতন। একটু পিছনে চলে যায়, আবার সামনে উঠে আসে। হয়তো স্রেফ এক মিনিটেরই গান। কিন্তু একবার শোনামাত্র সেই সুর আমায় কামড়ে ধরে।

শাহজাহান মুন্সি। বাউল সংগীতশিল্পী

শাহজাহান মুন্সি। বাউল সংগীতশিল্পী। ছবি ইন্টার্নেট থেকে নেয়া

গল্পে তখন সবাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, মাঝিরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। ‘ওই ছেমরিটা কই রে? আর ইবা?’ সবাই এখন বুঝতে পারে যে গুলতি আর ইবার মধ্যে কী যেন একটা টান তৈরি হয়েছে। এমন কথোপকথনের ভিতরেই এই গান শুনতে পাওয়া যায়। তারপর দেখা যায় গুলতি হেঁটে যাচ্ছে, আর ইবা তাকিয়ে আছে তার দিকে আর গুলতি ফিরে তাকায় একবার। ইবা একটা সিগারেট ধরায়। এইটুকুই, শুধু এইটুকুই। আর কিছু না। বাতাসে একটা গান ভাসে আর চোখে জ্বালা জ্বালা করে। ‘বন্ধু প্রেম ও বিচ্ছেদের জ্বালা সহে না আমার অন্তরে’। এইটুকুই শুধু, লাইনগুলো ঘুরে ঘুরে আসে। আমি ক্রেডিটে গিয়ে দেখি, এই গানটি সেখানে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। সুমনকে সেই মধ্যরাতেই আমি মেসেজ করি :  এই গান কার গাওয়া? কার লেখা? সুমন উত্তর দেন, শাহজাহান মুন্সীর। কার লেখা? বলেন ক্রেডিটে দেওয়া আছে, এখন মনে করতে পারছি না। আমি লিখি যে ক্রেডিটে ঐ গানের কথা তো লেখাই নেই।

তারপর আমি অনেক খুঁজে গানটির একটি রেকর্ডিং পাই শাহজাহান মুন্সীর গাওয়া, কোনো এক আসরে, সাউন্ডের কোয়ালিটি খুব একটা ভালো নয়। [viii] কিন্তু তাতে কিছু হয় না, শুনতে অপূর্ব লাগে। সিনেমার রেকর্ডিং এটি নয়। সেখানে গান হয় কেবল দোতারার সাথে। ইউটিউবের রেকর্ডিং-এ গানের শেষে ভণিতায় শুনি রজ্জব আলি দেওয়ানের নাম। পরে মেঘদলের শিবু কুমার শীল আমায় বলেন যে, শাহজাহান মুন্সী একদিন স্টুডিওতে এসে কয়েকটা গান গেয়ে রেখে গিয়েছিলেন সুমনের জন্য। আমি বুঝি যে এটা একটা ডিরেকটরিয়াল প্রোসেস, কিছু কিছু জিনিস জড়ো করে রাখা, পরে তার থেকে জায়গা মতন এটা নিয়ে ওটা নিয়ে ফিল্মের ধ্বনিচিত্রের ক্যানভাস সাজানো হবে। ঋত্বিক ঘটক যেমন রণেন রায়চৌধুরীকে দিয়ে অনেক গান গাইয়ে রেখেছিলেন প্রথম সাক্ষাতের দিন; রণেন একটা করে গান করেন আর ঋত্বিক বলেন, ‘আহা শালা তো বেশ গায়…’! [ix] অনুপ সিং যখন নেইম অফ আ রিভার-এর কাজ করছিলেন ঋত্বিকের ওপর, কানাই দাস বাউলকে আমি দেখেছি গানের পর গান গেয়ে যাচ্ছেন স্টুডিওতে। সুমন নিজেও গানের মানুষ, অনেক প্রিয় গান তিনি তাঁর প্রথম কাজে রাখতে চেয়েছিলেন, বুঝতেই পারি। কলেজজীবনের গান, হয়ত আরো আগে শোনা সব গান। অনুমান করি, শাহজাহান মুন্সী তাঁর প্রিয় শিল্পী। সেদিনের রেকর্ডিং থেকেই ওই গুলতি-ইবার টান ভালোবাসার ওপর তিনি রজ্জব আলী দেওয়ানের বিচ্ছেদী গানটি পেতে দেন, কিন্তু ক্রেডিট লেখার সময় সেই কথাটা লিখতে ভুলে যান।

আমার যত না মনিরুদ্দিনের গানকে সংগৃহীত বলা নিয়ে আপত্তি—কারণ যতক্ষণ পর্যন্ত ওঁরা জানতেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত গানটি সংগৃহীতই ছিল—তার চেয়ে বেশি আপত্তি এই ভুলে যাওয়া নিয়ে। কেন এমন ভুল করবো আমরা? এমন একটা মুহূর্ত তৈরি করলো যে-গান, তার কথা লিখতে বেমালুম ভুলেই গেলাম?

পুনশ্চ : রজ্জব আলী দেওয়ান

রজ্জব আলী দেওয়ান। ছবি ইন্টার্নেট থেকে নেয়া

রজ্জব আলী দেওয়ান। ছবি ইন্টার্নেট থেকে নেয়া

শাহজাহান মুন্সীর গলায় রজ্জব আলী দেওয়ানের অন্য আর-একটি গান সিনেমার শুরুতেই রয়েছে, ‘আয় খেয়ে নে বেহেশতের সেই সরাবন তহুরা’। সে এক চরম গান। [x] এর টান ‘জ্বালা সহে না’-র মতন নয়, এই গান মনের বন্দর ছেড়ে মগজের দিকে যাত্রা করে। সেই যাত্রাপথে, ভাসা-ডোবার কালে পার্বতী বাউলের গলায়ও এই গানটি আমি পেয়ে যাই, আর দাঁড়িয়ে পড়ে শুনি। [xi] কবীরসাধক, চলচ্চিত্রনির্মাতা, লেখক, শিল্পী এবং ‘আজব শহর’ ওয়েবসাইটের নির্মাতা, শবনম ভিরমানির আর্কাইভে পার্বতীর গানটি রাখা দেখি। সেখানে পদকর্তার নাম লেখা রয়েছে, রজ্জব ফকির। এখন, দেওয়ান তো ফকির না। রজ্জবকে কেউ কেউ রজবও লেখেন, কিন্তু রজ্জব আলী দেওয়ান তো রজ্জব ফকির ছিলেন না। এও কিছুটা দীনকে দ্বীন আর দ্বীনকে দীন করার মতন লাগে আমার। লেখক ও গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলছিলেন, “আমি জেনেছি যে, তিনি নিজে তাঁর নামের সঙ্গে ‘দেওয়ান’ যুক্ত করেন। কারণ, তাঁর সময়ে ‘দেওয়ান’ উপাধিধারী গায়ক অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, যেমন খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ান। এই জনপ্রিয়তার কারণে তিনিও দেওয়ান উপাধি ধারণ করেন। যতটুকু জানা যায়, দেওয়ান উপাধি প্রথম ব্যবহার করেন ঢাকার বামনসুর গ্রামের আলফু দেওয়ান। তাঁর সন্তান ও শিষ্যরা এই উপাধি ব্যবহার করে চলেছেন”। আমার বন্ধু সাউন্ড-রেকর্ডিস্ট আলী আহসান আমাকে বলেন, ‘বৃহত্তর ঢাকার বয়াতিদের প্রধানত দুটো পদবি — সরকার আর দেওয়ান। এই পদবির মাজেজা জানা নেই। ফকিরি অন্য ধারা। ফকিরি ধারার সাধকের খাবারে মাংস থাকে না। দেওয়ান, সরকার—উনারা মাংস খান। এটা অনেক তফাতের একটা’। শবনম যত্ন করে কাজ করেন, পার্বতীও, তাই কেন তাঁরা দেওয়ানকে ফকির লিখলেন, ভাবি। নাম পাল্টে গেলে অনেক ইতিহাসও তো পাল্টে যায়।


[i] এই লেখাটির জন্য আমি শবনম সুরিতা এবং ডয়েচে ওয়েল রেডিওকে কৃতজ্ঞতা জানাই। ওঁদের জন্যই আমি একটা লেখা লিখতে শুরু করি, ওঁদের প্রয়োজন ছিল ৭০০-৮০০ শব্দের একটি লেখা, ‘আটটা বাজে’ গানটি নিয়ে। আমার লেখায় প্রায় তিন হাজার শব্দ বেশি হয়ে যায়! আমি অনেকের সাহায্য নিয়ে এই লেখাটি লিখেছি। আনন সিদ্দিকা, শিবু কুমার শীল, মেজবাউর রহমান সুমন, বিশ্বজিত দাস, জালাল আমেদ, মনিরুদ্দিন আমেদ, কার্তিক দাস বাউল, মিমলু সেন, স্যাম মিলস, সঞ্জয় শিকদার, ফাতেমা তুয যাহরা ঐশী, মিলনভাই (মাহফুজ আলম), আলী আহসান, সায়মন জাকারিয়া, অনুপ সিং, মধুজা মুখার্জি, মৈনাক বিশ্বাস—সকলকে আমার ধন্যবাদ জানাই। ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে দেখিয়ে দেবেন আশা করি।

[ii] ‘সাদা সাদা কালা কালা, https://www.facebook.com/charupintu.artistbd/videos/549898636830458

[iii] ভক্তদাসের গান আর গল্প এখানে রয়েছে : https://www.thetravellingarchive.org/record-session/jadavpur-kolkata-2-february-2014-bhakta-das/ এবং https://www.thetravellingarchive.org/record-session/jadavpur-kolkata-30-may-2010-bhakta-das/

[iv] Mimlu Sen, Baulsphere (Noida: Random House India, 2009)

[v] ঐশীর দুটো ভার্শন : https://www.youtube.com/watch?v=fid8KfKp7tY,https://www.youtube.com/watch?v=nPRw66Rol-E

[vi] অভিনয় নয় সিনেমার গান https://www.youtube.com/watch?v=zEr5c71xQMw

[vii] বিপদজনক সিনেমায় দিল কি দয়া, https://www.youtube.com/watch?v=gRjw9qN6YtU

[viii] সহে না জ্বালা অন্তরে https://www.youtube.com/watch?v=wJTYTQwcl6c

[ix] রণেন রায়চৌধুরীর গানের ভূবন, কলকাতা: বই-চিত্র ও লোক সরস্বতী, ২০০৯, পৃ. ৬৭

[x] আয় খেয়ে নে, রজ্জব আলী দেওয়ানের কন্ঠে https://www.youtube.com/watch?v=h6N7pxKebM0 আয় খেয়ে নে, শাহজাহান মুন্সীর গলায় https://www.youtube.com/watch?v=nAFCKrr2E8Q

[xi] পার্বতী বাউল-এর গান https://www.youtube.com/watch?v=kKQmS_Lzf54


মৌসুমী ভৌমিক গান করেন এবং লেখেন। তিনি ভারত, বাংলাদেশ এবং লন্ডনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। www.thetravellingarchive.org-এ তাঁর কাজের নমুনা দেখতে/শুনতে পাওয়া যায়।

গানপারে মৌসুমী ভৌমিক ইন্টার্ভিয়্যু

গানপারে হাওয়া
আড্ডায় হাওয়াবঞ্চিত যুবকেরা
মেঘদলে এ হাওয়া, হাওয়ায় মেঘদল

COMMENTS

error: