গান কী?
সুরে বসানো কথা।
সুর কী?
এমন এক ধ্বনি-সমন্বয়, যার জাদুবলে প্রাণ হয়ে যায় পাখি।
এই পর্যন্ত লেখার পর ছেলেটা ভাবে, ‘গান নিয়ে আর কী বলতে পারি আমি।’ লিখতে গিয়ে, গানকে যেভাবে জেনেছে বলে তার মনে হলো আসলে সারাজীবন গান শুনলেও এই প্রথম তার এসব কথা মনে এল। তাহলে গান শুনতে শুনতে গান সম্পর্কে অন্য কোনো কথা তার মনে আসেনি?
না। সে স্মৃতি হাতড়ে গান নিয়ে তাঁর কোনো ভাবনার ইতিহাস খুঁজে পেল না। কিন্তু গান শোনার স্মৃতি, ঝাঁক ঝাঁক পাখির মতো কত অসংখ্য স্মৃতি তার মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে গান গাওয়ার স্মৃতিও। এই গাওয়া শিল্পীর গাওয়া নয়। শ্রোতার গাওয়া। সেই গাওয়া কি সবসময় প্রাণ থেকে উৎসারিত হয়েছিল? পাখির গানের মতো? তার মনে হলো, না। সবসময় প্রাণ থেকে বেরিয়ে আসেনি। হয়তো বন্ধুদের আড্ডায়, দল বেঁধে কোথাও যেতে যেতে, কত গান সে গেয়েছে! সব গান প্রাণকে প্রকাশ করেনি। কিন্তু গান শুনে চোখ জলে ভিজে যাওয়া, অতিনির্জন হয়ে যাওয়া তো ঘটেছে। সেই গানগুলো কখনো গেয়েছেও, একটা পঙক্তি ঘুরে ঘুরে সারাদিন। গলা শুকিয়ে গেছে, তবুও শেষ হয় না সে-গান। এ-রকম গান কোনগুলো?
এ-রকম গান সেই কথাগুলোর সমন্বয়, যে-কথাগুলো সুর ছাড়া বলা যায় না। সুর ছাড়া উচ্চারিত হতে চায় না। যে-কথাগুলো সুর ছাড়া বললে দৈনন্দিন কথার মাঝে বেখাপ্পা লাগে, সবাই চোখ বড় করে তাকায়। যে-কথাগুলো সুর ছাড়া বলতে লজ্জা লাগে। নাগরিক ব্যক্তিত্বে লাগে। নিজেকে ছোট মনে হয়। যেমন, কাউকে আমরা হঠাৎ হৃদয়ের বেদনা বোঝাবার জন্য বলতে পারি না, ‘কি জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়’। কিন্তু এ-কথাটি গাইতে পারি। তখন শ্রোতাও হয়তো একাত্ম হয়ে টের পান নিজের বেদনাকেও।
গান চিরদিন মনোলগ। কাউকে বলা যায় না, নিজেকেই গেয়ে শোনাতে হয়। গান শোনা বা গাওয়া, নিজের সঙ্গে নিজের যেন কথা বলা। যে-কথাটি কাউকে বলতে চায় মানুষ সে-কথাটি মানুষের পক্ষে বলা আজও অসম্ভব। কেননা আজও আমরা আমাদের বেদনাকে প্রকাশের ভাষা আবিষ্কার করতে পারিনি। গোলাপ যেমন তার কথাটি না-বলে নীরবে শুধু ফুটে থাকে এবং তার এই ফুটে-থাকাকেই আমরা ধরে নিই তার কথা, ঠিক তেমনি গান, মানুষের অন্তর্গত কথার মেটাফর হয়ে বেজে চলে আর আমরাও অনুমান করে নিই তার বলতে-চাওয়া কথাটি, তার অন্তরঙ্গ বেদনা।
কিন্তু, আসলে গান মনোলগ নয়। যিনি গেয়ে থাকেন গান, তিনি যেন কাউকেই তার গানটি বলেন না। বরং ছুঁড়ে দেন নির্জন উপত্যকার শরীরে, বাতাস তারে ছড়িয়ে দেয় মানুষের কানে কানে, আর হঠাৎ দৈনন্দিন দিনযাপনের খনি-খোঁড়া থেকে চোখ তুলে সুরে-মায়াবী উপত্যকাকে আমরা দেখি, দেখতে পাই আমিকে। আর কিছুক্ষণের জন্য হলেও হয়ে যাই বয়সহীন, সময় গড়িয়ে পড়ে কলস-উপচানো জলের মতো। কিন্তু কলস তা টের পায় না। কেননা কলস তখন নিজের অন্ধকার অন্তরে অলৌকিক এক সূর্যের আভায় উদ্ভাসিত, যেখানে প্রকাশিত হয়েছে আদিম বেদনা, যে-বেদনাকে কখনো টের পায়নি সে, দেখেনি দিবালোকে।
গান এমন এক আশ্চর্য মেটাফর যা বুঝতে আমাদের পোড়াতে হয় না কাঠখড়। গান যেন সৃষ্টিই হয়েছে সেই কথাটি বলবার জন্য যে-কথাটি বলা যায় না, বললে বলা হয় না, বললেও কেমন অস্বস্তি লাগে। আসলে বলার কথাটি কখনো বলা যেতও না, যদি-না গান থাকত পৃথিবীতে।
গান শুনে কখনো আমরা প্রশ্ন করি না। বলি না ‘বুঝতে পারিনি’। গানই একমাত্র ভাষা যা বোঝার দরকার হয় না। না-বুঝেই বোঝা যায়। গান এমন এক স্থান যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা হৃদয়ের কথাটি বলতে পারি, বলি রূপকের আশ্রয়ে। অন্য কোথাও সেটা বলা অসম্ভব। গানে সত্য বলা যায়। তাও রূপকের প্রশ্রয়ে। কিন্তু সেই মেটাফর আর মেটাফর থাকে না যখন গান প্রবেশ করে শ্রোতার হৃদয়ে। তখন তা রূপান্তরিত হয় তার আসল কথার রূপেই।
এই মনিহার আমায় নাহি সাজে।
রবীন্দ্রনাথের এই গানপঙক্তির ‘মনিহার’ কি মানুষের সকল চাওয়ার এক আশ্চর্য মেটাফর নয়?
‘এই মনিহার আমায় নাহি সাজে’ : জগৎকে চেয়েও গ্রহণ করতে না-পারার প্রতি মানুষের সহজ অথচ বেদনাদায়ক এক অভিমানবাক্য নয়?
… …
- গানের মেটাফর, গানের মেটামরফসিস || মুহম্মদ ইমদাদ - July 18, 2019
- আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু এবং আমাদের ডেজার্টেড স্মৃতির ইডেন || মুহম্মদ ইমদাদ - October 20, 2018
COMMENTS