সিএটি-র স্তালিনবিচার ও উদ্ভূত পরিস্থিতি || শিবু কুমার শীল

সিএটি-র স্তালিনবিচার ও উদ্ভূত পরিস্থিতি || শিবু কুমার শীল

সিএটি নির্মিত, কামালউদ্দীন নীলু নির্দেশিত ‘স্তালিন’ নাটক দেখে দর্শকদের একাংশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক, প্রাসঙ্গিক। আমি অন্য অনেকের মতো সেখানে উপস্থিত ছিলাম, ফলে চাক্ষুষ ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করেছি। আমি যতক্ষণ ছিলাম নাটকের তথ্য বিকৃতি আর সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডা এসব নিয়েই হইচই করছিল সবাই। আমার কাছে ‘স্তালিন’ নাটকের চেয়ে ‘স্তালিন’ নামের ব্যক্তিটিকে বিচার করবার মাপকাঠিটি উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়েছে, তাই এই লেখা।

নাটক শেষ হবার পর কলাকুশলীদের কুর্ণিশ করা পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা পুরো অডিয়েন্স জুড়ে এক ধরনের গম্ভীর আবহ বিরাজ করছিল। যদিও এটি একটি স্ল্যাপেস্টিক কমেডি, নাটক চলাকালীন কোনো হাসির রোল আমি লক্ষ করিনি। ক্যানো সেই ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।

যা-ই হোক, নাটক দেখে বেরিয়ে যেতে যেতে কিছু দর্শক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিল। তারা বলছিল, সাম্রাজ্যবাদের দালাল, এনজিওর টাকায় বানানো নাটক, তথ্যবিকৃতি ইত্যাদি বেশ উচ্চস্বরে। কিন্তু সেখানে ঘৃতাহুতি দিলেন স্বয়ং কামালউদ্দীন নীলু । থিয়েটার হ্যলের অভ্যন্তরের গেটের সামনে তিনিও একইভাবে উচ্চস্বরে নিজেকে বড় মার্ক্সিস্ট দাবি করছিলেন। দুই পক্ষই টেম্পার ল্যুজ করায় বেশ অপ্রীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়। আমার যেটা মনে হয়েছে, এসব না করে লিখিতভাবে এই নাটকের কন্টেন্ট নিয়ে প্রতিবাদ করা যেত। অপরদিকে নাটক কর্তৃপক্ষ একটা মুক্ত আলোচনার প্রস্তাব রাখতে পারত। এসব না করে মাথা গরম করাটা সমীচীন হয়নি।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জোড়াতালি দেয়া ‘স্তালিন’ নাটকটি দেখার পর কেবল এটাই মনে হয়েছে যে এই নাটকের ইন্টেনশন ভালো না। কেবল স্তালিন নয় গোটা মার্ক্সিজম, কম্যুনিজম, লেনিন, মাও সে তুং সহ সকল ব্যক্তি ও তত্ত্বের বিরুদ্ধেই এই নাটক। স্তালিন সম্পর্কে পশ্চিমা প্রপাগান্ডাই এর প্রধান উপজীব্য।

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার ঝড় শুরু হয় নাটকশেষে থিয়েটারহ্যলের সামনে। একপক্ষ চিৎকার করেছে আরেকপক্ষ না করলেই পারত। নীলুভাই শাউট করেছেন এবং নিজেকে বড় মার্ক্সিস্ট প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এই নাটক আমেরিকান এম্বাসি ছাড়া কোনো মার্ক্সিস্ট-এর পক্ষে বানানো সম্ভব না। আরেকটা ব্যাপার, মহাত্মা স্তালিনকে নিয়ে নির্মিত নাটক ইশ্যুটি ঘিরে এই বিতর্ক-বিতণ্ডায় একটা আজব জিনিশ লক্ষণীয়। সবাই নাটক বন্ধের কথাকে ইশ্যু করে এড়িয়ে যাবার ভান করছে। কেউ বলছে না নাটকের কন্টেন্ট নিয়ে।

স্বীকার করছি এটি হয়তো একজনের ইন্টারপ্রিটেশন মাত্র। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে, একটি মতবাদ বা একটি তত্ত্বকে ঘিরে যদি বহুস্তরের ইন্টারপ্রিটেশান হাজির করা যেত তখন হয়তো দর্শক নিজেই তার পছন্দসই ইন্টারপ্রিটেশনটা পিক করত। তা না করে একরৈখিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী প্রপাগান্ডা ভর করেই এই নাটকের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে।

ঐতিহাসিকতা বাদ দিলে এই নাটকের আখ্যান অত্যন্ত স্থবির আর প্রিটোল্ড-এ ভরপুর, নাটক শুরুর আগের উন্মুক্ত পারফর্মেন্স অংশের বক্তব্যে যা মানুষ বুঝে ফেলে। ফলত দর্শকের মধ্যে আর কোনো রহস্য থাকে না। একটা পূর্বানুমান নিয়েই হ্যলে প্রবেশ করে দর্শক।

নাটকের লাইট, সেট অত্যন্ত আধুনিক; কেবল অভিনয় পুরাতনী মেলোড্রামায় ভরপুর। প্রজেকশনে কিছু ফিল্মের অংশবিশেষ দেখানো হয়েছে যা জাক্সটাপোজ ছাড়া কিছুই না। এমন না যে এই বিষয়গুলো থিয়েট্রিক্যালি দেখানো যেত না। এই নাটককে গ্রহণযোগ্য করার জন্য অন্যান্য সূত্রের মতো স্তালিনের মেয়ের লেখা মেমোয়ারের সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে যাতে দর্শক এতে আস্থা খুঁজে পায়। যদিও পুরো নাটকে কোনো কাহিনিগত উত্থান-পতন নেই কেবল তথ্য দেয়া ছাড়া। এটিও বেশ দূর্বলতর দিক এই নাটকের। সংগৃহীত সংগীত নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই।

তারপরও বলব যারা নাটকটি দেখেননি তাদের অবশ্যই দেখা উচিত এই কারণে যে মার্ক্সবাদ বা কম্যুনিজমকে এত বছর পরেও কত সনাতনী জায়গা থেকে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে তা নিজ চোখেই দেখতে পাবেন। আজকের জিয়োপলিটিক্স আর ৫০ বছর আগের জিয়োপলিটিক্স যে এক নয় বা এর ভেতরে যে কত বদল ঘটে গেছে তা কামালউদ্দীন সাহেব জানেন না।

এ নাটকে ইতিহাস আছে কিন্তু ঐতিহাসিকতা নেই। ফিকশন হিসেবে এই নাটক কেবল কিছু তথ্যের দাসত্ব করে গেছে। আমি কোনো গল্প খুঁজে পাইনি এখানে যে-কারণে এটাকে ফিকশন বলব। কেবল তথ্য দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। আর স্তালিন সম্পর্কে সমস্ত নেগেটিভ তথ্যগুলোই এক করে একটা খিচুড়ি বানিয়েছেন নাট্যকার।

… …

শিবু কুমার শীল
Latest posts by শিবু কুমার শীল (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you