এই শীতে, এমন শীতের রাতে, আলোয়ানে গা পেঁচায়ে রাস্তার ধারের কোনো চায়ের টঙদোকানে দেহ-চুপসানো জবুথবু বসে থেকে আগুনগরম চা পানের তুলনীয় ফুর্তি দ্বিতীয় কিছুতে নেই। নিতান্ত ছোট্ট চা-দোকান, সস্তার দুই-চারিখান খাস্তা বিস্কুট বোয়েমে রাখা বা পানবিড়িডিসপ্লে-বাকশের ওপর ঝুলন্ত কয়েক লরি চিপসের প্যাকেট, তোলা-উনোনে একজোড়া কেৎলির শীৎকার হিশহিশ শব্দে যেন শীত তাড়াতেসে। যেন শীত একটা পাখি, উঠানের রোদে মেলে দেয়া ধান খুঁটে খেয়ে যেতে এসেছে সেই শীতশালিখ, কেৎলিটা যেন সপ্তমশ্রেণি-পড়ুয়া কিশোরী যে কিনা পাখিশিসের তীক্ষ্ণচেরা সুরে সেই শালিখটিরে তাড়াইতেসে প্রাণপণ। দোকানটার দুইপাশ ছাপড়ার ঘের দেয়া আর দুইপাশ খোলা, আবদ্ধ পাশটায় একটা হাতলছাড়া বেঞ্চ ও অনাবশ্যক একখানা টেবিল যার উপরিভাগের তক্তা টাল-খাওয়া আর পায়া চাইরটা ব্যাঁকানো। উনোনে উতরোল কেৎলি। একটা ট্রে জুড়ে সার-ধরিয়ে-রাখা কাপ আধডজন। চায়ের ঘ্রাণের সঙ্গে মিষ্টি শো শো শব্দ। অগ্নিহৃদিনির্গত সুশ্বাসধ্বনি। ইতিউতি ঘন ও গোল হয়ে বসে আছে লোক জনা-সাতেক, পরস্পর পরিচিত নয় সকলেই, দুয়েকজন পরিচিত পরস্পর হয়তো, তবু কথা বলে চলেছে তারা কুটকাট সকলে পরস্পর। প্রসঙ্গের গাছপাথর ছাড়া কথাবার্তা। শাবনুরের প্রসবোত্তর শরীরস্বাস্থ্য থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার উদাহরণীয় গণতন্ত্র। কোনোকিছুই আলাপটপিক হিশেবে বেশিক্ষণ স্থির থাকছে না। রাজনীতি, রোজগারপাতি, অসুখবিসুখ, যুদ্ধাপরাধ, জাদুটোনা, নায়ক-নায়িকা, শাহবাগ-শাপলা, টকশোয়ার থেকে শুরু করে শীতের সাংঘাতিকতা এমনকি চা-দোকানির সংসারগপ্পো ইত্যাদি নানান ছুঁতানাতা ধরে কথার পিঠে কথা। এমন শীতের রাতে, সখা হে, এমনও গভীর ঘন গহনগামী শীতে …
এমন শীতের রাতে, সুনসান সান্দ্র কুয়াশায়, সদরসড়ক ধরে সোজা হেঁটে যেতে পারলে ভালো হতো অনির্দেশ্য কোনো অচেনায়। একটা-কোনো স্বল্পমেয়াদী নিরুদ্দেশে একবার এই শীতে বেড়িয়ে আসতে পারলে মন্দ হতো না। গায়ে থাকত ঘনবুনট উলের ভারী স্যুয়েটার, তার উপরে চাপানো মস্তপানা শাল, গলায় মাফলার। একটা মাঙ্কিক্যাপও অবশ্য থাকা চাই। শীত যাতে সহজ সূত্রে না-পারে প্রবেশিতে, মেহমান শীতের যথেষ্ট মর্যাদা যেন বজায় থাকে, তেমনতর প্রতিরোধক ব্যবস্থা। তারপরও যেটুকু প্রবেশিবে, এরপরও জোব্বাজাব্বা ভেদি শীত প্রবেশিবে যেটুকু, পথিমধ্যে নিশাচরা চা-দোকানির দ্বারস্থ হইলে সেই শীতজনিত জটিলতার উপশম সম্ভব। হাত-পা খানিক সেঁকে নেয়া যাবে সেই শীতসখা চা-দোকানির জ্বলন্ত অথবা আংরাচাপানো উনোনের গা ঘেঁষে বসে, একপেয়ালা চা আর একশলা চুরট নেয়া যাবে আয়েশ করে, এবং দস্তানা খুলে হাতজোড়া চা-কাপের চামড়ায় চেপে রেখে হাতের তালু রক্তচঞ্চল করে তোলা যাবে কিছুটা। হাতের তালু যুক্ত করে পরস্পর ঘষে ঘষে যথেষ্ট বিদ্যুৎপ্রবাহ শরীরে প্রেরণ ও উষ্ণতা সরবরাহ সম্পন্ন হলে, টেবিলের একপাশে পেয়ালা আলগোছে রেখে, চা-দোকানির পয়সাটা মিটিয়ে ফের নামা যায় রাস্তায় চেনা কোনো নিরুদ্দেশের পানে। যেমন যাচ্ছিলাম, যেমন রোজ চুমকিবিহীন একাপথে যেতেছি, শীতার্ত চলিয়াছি নিরুপম ঘনঘোর শীতানুসন্ধানী, ধীরে ধীরে একটু একটু করে সেই অমোঘ অনিবার্য অভিমুখে, একটু একটু করে এই শীতের ভেতর দিয়ে এক চিরশীতের চরাচরে, এক অনিঃশেষ ঋতুহীনতার দেশে।
লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS