সপ্তম প্রবাহ–২ : অ্যান্টি–ইসলামিস্ট বাখান : বুদ্ধিবৃত্তিক সংকীর্ণতা : আলী সিনা ও অন্যান্য
গত পর্বে আমরা আলী সিনা অবধি অগ্রসর হয়ে জিরান নিয়েছিলাম। সিনা-কাণ্ডের পরিশেষ যেহেতু টানা হয়নি অগত্যা সেখান থেকে শুরু করা সমীচীন। মার্কিনদেশি সুফিভাবিক বিদ্বান হামজা ইউসুফের কার অ্যাক্সিডেন্টের পাল্লায় পড়ে মৃত্যুর অতি নিকট (NDE বা Near Death Experience) থেকে ঘুরে আসা, সুস্থ হওয়ার পর খ্রিস্ট থেকে মোহাম্মদে গমন এবং ইসলাম প্রমোটার রূপে হাজির হওয়ার ঘটনা নিয়ে আলী সিনা-র ব্যাখ্যা-মতামত অর্থাৎ বিষয়টি সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা পেতে আগ্রহীরা বিগত প্রবাহে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। অ্যান্টি-ইসলামিস্ট টেক্সট ও অনলাইন এ্যাক্টিভিজমে সিনা অন্যতম ভরকেন্দ্র বটে! এই ধারায় আরও যাঁরা সক্রিয় রয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে দু-চার কথা বলার আগে সিনা প্রসঙ্গের যথাবিহিত সমাপ্তি ঘটানো প্রয়োজন বিধায় হামজা ইউসুফকে সেখানে সংযুক্ত করে অগ্রসর হতে চাই।
আরেকবার স্মরণ করা যাক, পাঠকের প্রশ্নের উত্তরে আলী সিনা তাঁর মোটামুটি দীর্ঘ লেখার শুরুতে জানিয়েছিলেন নেটে হামজা ইউসুফের খবর তিনি নিয়েছেন, তবে তাঁর NDE সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বিবরণ সেখানে খুঁজে পাননি। দুর্ঘটনার অনতিপরবর্তী অভিজ্ঞতা যাপনকালে তিনি কি পরজগৎ ঘুরে এসেছিলেন? জান্নাত ও দোজখের অভিজ্ঞতা কি তাঁর হয়েছিল? হয়ে থাকলে সেটা কেমন ছিল? হামজা যেহেতু মুখ ফুটে সেরকম কিছু বলেননি অগত্যা সিনা ধারণা করেন মোহাম্মদের মতো তিনিও নরকে গমন করেছিলেন এবং সে-কারণে কিছু বলতে পারছেন না ইত্যাদি। সিনা-র স্বভাবসুলভ এই চাকুবাজির খাসলতকে আপাতত পাশ কাটিয়ে ঘুরে দেখা যায় হামজা ইউসুফ কী হেন কারণে হঠাৎ মোকাম বদলে ইসলামে গমন করলেন, এবং এখন কেনই-বা মুত্যুর মতো ভীতিকর বিষয় নিয়ে নেটদুনিয়ায় ঘুরে বেড়ান!
মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন বিষয়ে হামজা ইউসুফের লেকচার ‘ডেথ’, ‘গ্রেভ’, ‘আফটার লাইফ’ ইত্যাদি সিনা তাঁকে নিয়ে লিখতে বসার বহু আগে থেকে নেটে ঘুরছে। সেইসঙ্গে হামজার নিজস্ব ওয়েবসাইট এবং বিশ্বের শীর্ষ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথাবার্তার ক্লিপস তো রয়েছেই। সিনা অনলাইনে ছড়ানো-ছিটানো কন্টেন্টগুলোয় কতটা কী ক্লিকবাজি করেছেন তাঁর বক্তব্য থেকে সে-বিষয়টি স্পষ্ট হয় না। যদিও তাঁর লেখার ভাষা থেকে বোঝা যায় পাঠকের পাঠানো প্রশ্নের সুবাদে আলী সিনা এটা ধরে নিয়েছিলেন হামজা ইউসুফ প্লেটো বর্ণিত মৃত অথবা একালের বিবেচনায় ‘কোমা’য় চলে যাওয়া লোকটির মতো পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছিলেন এবং সেই অবস্থায় পরলোকে একচক্কর ঘুরান দিয়ে এসেছেন! সিনা-র বিচারে হামজার এই বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমত এ-সম্পর্কে তিনি কিছু বয়ান করেননি অথবা ঝাপসা যা বলেছেন তার সঙ্গে অন্যদের অভিজ্ঞতার মিল চোখে পড়ে না! দ্বিতীয়ত হামজা মুখ ফুটে না-বললেও অনুমানে ধরে নেওয়া যায় পরজগৎ ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল এবং সেটা মোহাম্মদ বর্ণিত জগতের অনুরূপ, সেক্ষেত্রে সিনা মনে করেন তিনি মিথ্যাচার করছেন; কেননা ‘মালাকুত’ বা আল্লাহর রাজ্য সম্পর্কে ইসলামের বিবরণী এ-সংক্রান্ত অন্য বিবরণীর সঙ্গে খাপ খায় না এবং যুক্তিছকে সাজালে নকল, বানোয়াট ও অজ্ঞতার স্মারক মানতে হয়।
সিনা সরাসরি বলেননি তবে তাঁর ভাষ্য থেকে অনুমেয়, অন্য অনেকের মতো NDE-র অভিজ্ঞতাকে তিনি মস্তিষ্কের আপাত নিষ্ক্রিয় কোষে সক্রিয় হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রমজনক Bad Signals-র নমুনা রূপে পাঠ যেতে অধিক আগ্রহী। এখানে অবধানের বিষয় হলো সুফিভাবিক হামজা ইউসুফ কোথাও দাবি করেননি মারাত্মক সেই দুর্ঘটনার জের ধরে তাঁর জীবনে দেখা দেওয়া ট্রমার দিনগুলোয় তিনি সরাসরি আল্লাহর রাজ্য ‘মালাকুত’-এ গমন করেছিলেন এবং জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি দর্শনের অভিজ্ঞতায় ভরপুর হয়ে ধরায় ফেরত এসেছেন। নেটে ছড়ানো ইউটিউব ক্লিপসগুলো পাঠ গেলে বরং এটা পরিষ্কার হয়, কিশোর বয়সে সংঘটিত দুর্ঘটনা তাঁর জীবনে বিভীষিকার রূপ নিয়েছিল এবং মোটের ওপর ছয় মাস ইহজাগতিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে তিনি এক প্রকার বিচ্ছিন্ন বা সংযোগরহিত ছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর তাঁর মনে মৃত্যুচিন্তা ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ভাবনা তীব্র হয় এবং সেই সূত্রে তিনি কোরান হাতে নেন এবং সমীকরণ মেলানোর মতো করে একসময় ইসলাম কবুল করেন।
সিনা তাঁর লেখায় ইঙ্গিত করেছেন ১৮ বছর বয়সে NDE-র অভিজ্ঞতায় হতবিহ্বল হামজা র্যামন্ড মুডির বই পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ইসলামে গমনের মধ্য দিয়ে নিজের অধঃপতনকে তিনি চূড়ান্ত পরিণতি দান করেছেন। তথ্য পরিবেশন শুরুতে সিনা ছোটখাটো দুটি ভুল করেছেন। প্রথমত হামজার NDE-র অভিজ্ঞতা আঠারো নয় সতেরো বছর বয়সে ঘটেছিল। আটারোয় পা রাখার ক্ষণে তিনি ইসলাম কবুল করেন। দ্বিতীয়ত র্যামন্ড মুডির বই সম্পর্কে নিজের মুগ্ধতার কথা লেকচারে উল্লেখ করলেও তাঁর ইসলামে গমনের পেছনে মুডির হাত ছিল না। বিবিসির সঙ্গে বাতচিতে হামজা ক্লিয়ার করেন, মারাত্মক দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরার পর মার্টিন লিংস-র ‘দ্য বুক অব সার্টেনিটি’-তে বর্ণিত নিশ্চয়তার জগৎ সম্পর্কে তাঁর বদ্ধমূল ধারণা টলে ওঠে; মনে হতে থাকে তিনি ঘুমে ছিলেন এবং এই দুর্ঘটনা তাঁকে জেগে উঠার সংকেত দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে? প্রশ্নের উত্তরটি বিবিসি ও অন্য গণমাধ্যমে হামজা বহুবার দিয়েছেন, যার সারকথাটি হলো :—
দুর্ঘটনা ও অনতিপরবর্তী ট্রমার দিনগুলোয় যখন তাঁর সবকিছু গুবলেট হতে বসেছে তখন মনে হয়েছিল আরেকটি জগৎ ঝাপসা কুয়াশার মতো তাঁর চেতনায় তরঙ্গ তুলছে। ঘটনাটি অনেকটা লুইস ক্যারলের ‘এ্যালিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর অনুরূপ। ছোট্ট এ্যালিস খরগোশের গর্তে উঁকি দিতে গিয়ে পা হড়কে সেখানে পড়ে যায় আর নিমিষে আরেকটি জগৎ তার চোখের সামনে জীবিত হয়ে ওঠে এবং তাকে সে-জগতে বাধ্য হয়ে অংশ নিতে হয়। খরগোশের গর্তকে পাঠক এখানে দুটি পৃথক জগতের মধ্যে বিরাজিত পর্দা, অন্তরায় বা বারযাখ যা-খুশি ভাবতে পারেন। পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকলে আরেকটি জগৎ সেখানে সক্রিয় হতে থাকে। তো কথা হলো ফিকশনের ছোট্ট খুকি এ্যালিসের মতো হামজা সেই জগতে প্রবেশের পর সেখানকার কাজ-কারবারে শরিক হওয়া ও পুনরায় ধরায় ফেরত আসার দাবি একবারও করেননি। ল্যাজারাসও করেনি। কিংবা বিয়াত্রিচের প্রেমে মগ্ন কবি দান্তের মতো উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎ কবিবর ভার্জিলের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটেনি। বাইবেলের ছকেবোনা ‘ডিভাইন কমেডি’-তে রক্তমাংসে জীবিত দান্তে কবি ভার্জিলের হাত ধরে নরকে গমন করেন, অতঃপর পরিশুদ্ধি বা পার্গেটোরিতে যান এবং অবশেষে স্বর্গে প্রিয়তমাকে বিহার করতে দেখে তাঁর হৃদয়ে ফানাফিল্লাহর অনুভূতি জাগ্রত হয়। জনশ্রুতি অবশ্য রয়েছে দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ রচনার নেপথ্যে কোরান বর্ণিত ‘আলমে বারযাখ’-এর সবিশেষ প্রভাব ছিল; যদিও যতদূর মনে পড়ছে তাঁর মহাকাব্যে মোহাম্মদ ও হযরত আলী-কে বদসুরত ড্রাগন বা এহেন কিছু রূপে তিনি উপস্থাপন করেছিলেন। বিবরণটি সম্ভবত প্যারাডাইজের প্রাথমিক স্তরে গমনাগমনের ক্ষণে দান্তে বয়ান করেন। স্বর্গে জায়গা করে নিলেও বেচারা মোহাম্মদের শান্তি মিলেনি। তাঁকে সেখানে কদাকারভাবে উপস্থাপন করেন দান্তে। তথ্যে ভুল হয়ে থাকলে পাঠক শুধরে দেবেন, বহুদিন আগে পড়া এবং এখন আর ফিরে পড়ার সময় জোটানো কঠিন।
হামজার এহেন কোনও অভিজ্ঞতা ঘটেনি। যে-বিষয়টি তাঁকে অবিরত উত্যক্ত করেছিল সেটা হচ্ছে, নিজের চেতনতরঙ্গে দ্বিতীয় কোনও জগতের উপস্থিতি তিনি টের পাচ্ছিলেন কিন্তু সেটা কী সে-সম্পর্কে মস্তিষ্ক তাঁকে সূত্র যোগান দিতে পারছিল না। ইসলাম গমনের সুবাদে অতঃপর তিনি ‘আলমে বারযাখ’ সম্পর্কে অবহিত হলেন এবং এই বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ তাঁর মনে অবশিষ্ট ছিল না যে প্রতিবন্ধক আবরণীর অন্তরালে অপার্থিব এক জগৎ বিরাজিত। আবরণী যেদিন ঘুঁচে যাবে সেদিন আল্লাহর রাজ্য বা ‘মালাকুত’ সকলের নিকট দৃশ্যগোচর হয়ে উঠবে। সূরা ‘মুমিনু’ন’-এর আয়াত আরেকবার পাঠ করা যাক, ‘যখন উহাদের কাহারও মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন সে বলে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় প্রেরণ করো,’…‘যাহাতে আমি সৎকর্ম করিতে পারি যাহা আমি পূর্বে করি নাই।’ না, ইহা হইবার নয়। ইহা তো উহার একটি উক্তি মাত্র। উহাদের সম্মুখে বারযাখ থাকিবে উত্থান দিবস পর্যন্ত।’ — উৎস : আল–মুমিনু’ন ২৩:৯৯–১০০; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
পরজগৎ বিদ্যমান, এই ভাবনা প্রবল হওয়ার ফলশ্রুতিতে লিংস-এর নিশ্চয়তার জগৎ ত্যাগ করে হামজা এবার কোরানে গমন করেন এবং আঠারো বছরে পা রাখার সময় ইসলামে শরিক হন। দ্বিতীয় দশকের গোঁড়ায় (দ্রষ্টব্য : Brushes with Death: Hamza Yusuf; Heart and Soul; BBC.co.uk, 2002) ধারণকৃত এই বাতচিত সিনা-র সম্ভবত চোখে পড়েনি। হামজা সেখানে কোরানের কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি মৃত্যু সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি অর্জনে তাঁকে সাহায্য করার জন্য মার্টিন হাইডেগারের কাছে বরং নিজের ঋণ স্বীকার করেছেন। হাইডেগার হামজার বেশ প্রিয় প্রসঙ্গ। মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের কোরান বর্ণিত ব্যাখ্যার সঙ্গে ধীমান এই দার্শনিকের নাম তিনি নিজের লেকচারে (*দ্রষ্টব্য : ‘Death’) স্মরণ করেন বৈকি।
আলী সিনা তাঁকে সোজা নরকে পাঠিয়েছেন ভালো কথা, কিন্তু পাঠানোর আগে ভদ্রলোকের প্রোফাইল একবার দেখে নিলে ভালো করতেন। উইকিপিডিয়া তাঁকে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে বর্ণনা করলেও সেখানে তাঁর ইসলাম গ্রহণের জার্নিটা উঠে আসেনি। ওয়েবসাইটে হামজা তাঁর নিজের পরিচয় সংক্ষেপে সেরেছেন। গণ্যমাধ্যম তাঁকে একসময় কাভার করেছে, যদিও সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে মন্তব্য ও মতামতের বাইরে বাড়তি কিছু সেখানে পাওয়ার উপায় নেই। Middle East Eye নামক রাজনৈতিক সাময়িকী সম্ভবত একমাত্র যেখানে তাঁর ইসলামে গমনের পটপ্রবাহ সংক্ষেপে উঠে এসেছে। উক্ত সাময়িকীতে মুদ্রিত বিবরণ পাঠকের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন, কারণ অ্যান্টি-ইসলামিস্ট আলী সিনা এমন এক ব্যক্তিকে কলমের খোঁচায় খারিজ করেছেন যাঁর সম্পর্কে অন্তত তাঁর জেনে নেওয়া উচিত ছিল।
এখন ঠিক মনে পড়ছে না সিনা তাঁর ‘Understanding Muhammad’ বইয়ে অথবা অন্যত্র হামজা প্রসঙ্গ টেনেছিলেন কি না! যদি টেনে থাকেন তাহলে তাঁর অজানা থাকার কথা নয়, মিলিট্যান্ট ইসলামের যুগে হামজা ইউসুফ ইসলামি বিদ্যাচর্চার প্রচলিত ঘরানায় বিচরণ করলেও তাঁর মধ্যে ইসলামের নম্র স্বরূপ ফুটে ওঠে যেটি ইহজগৎ ও পরজগৎকে নিজস্ব উপলব্ধি সহকারে পাঠ যায় এবং বিশ্বে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে চায়! প্রথম দিককার লেখাপত্রে অন্তত এই ঘরানার ব্যক্তিদের প্রতি সিনা-কে সহনীয় আচরণ করতে দেখেছি, যদিও হামজার NDE-কে কামান দাগতে গিয়ে সেই নমনীয়তার পরোয়া তিনি করেননি। সম্ভবত আলী সিনা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ইসলামি বিশ্বে জীবিত অথবা বহু আগে পরলোকে গমনকারী দ্বিতীয় কোনও চিন্তাশীল ব্যক্তি অবশিষ্ট নেই যাঁকে তিনি গোনায় ধরতে পারেন। অবশ্য সিনা টাইপের নিশ্চয়তাবাদীরা সকল যুগে মোটের ওপর এরকম আচরণই করে থাকেন।
নিশ্চয়তাবাদের দুটি ধারা সচরাচর জগতে বিদ্যমান থাকে। একটি ধারায় আস্তিক্যবাদীরা বিচরণ করেন এবং অন্য ধারায় নাস্তিক্যবাদীর দেখা মিলে। দুটি ধারা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন উক্ত ধারায় অবস্থান গ্রহণকারী ব্যক্তি বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গিকে অনুমোদন প্রসঙ্গে নিজের সহিষ্ণুতা ও উদারতা হারিয়ে ফেলেন। এমনকি যাঁরা উক্ত ধারায় অবস্থান করেন না যেমন অজ্ঞেয়বাদী অথবা সংশয়ী, তাঁরাও এহেন মানসিকতায় অটল হতে থাকলে বদ্ধতার সমস্যা সেখানেও প্রকট হয়ে ওঠে। ‘গীতা’-র দূরবর্তী প্রতিধ্বনি হলেও সুখে-দুঃখে নির্বিকার এবং নিজের কর্মফল অনুসারে ভালো-মন্দ যাই ঘটুক তাকে মেনে নেওয়ার কথা স্টোয়িক দর্শনের পুরোধা পুরুষ এ্যাপিকটেটাস জোর দিয়ে বলে গিয়েছিলেন। অটোম্যাটন বা স্বয়ংক্রিয়তার ভিতর দিয়ে বহমান জগতে মানুষ হলো শেক্সপিয়ারে নটে! মঞ্চে অভিনয় করে যাওয়া তার নিয়তি সে-ব্যাপারে সন্দেহ নেই। রোমে ক্রীতদাস হয়ে জীবন পার করে দেওয়া এ্যাপিকটেটাস সে-নিশ্চয়তার ছকে শেষ নিঃশ্বাস অবধি অটল ছিলেন! এই অটলতা ঈর্ষা উদ্রেক করলেও সমস্যার জন্ম দিয়ে যায়। ব্যক্তির জীবনে এরকম নিয়তিবাদ দুর্ভোগ ডেকে আনে এবং অন্যের দ্বারা নির্মমভাবে ব্যবহৃত ও শোষিত হওয়ার ক্ষেত্রটিকে অবারিত করে। জন্ম পরিচয়ে গ্রিক ও কর্মের সুবাদে রোমান ক্রীতদাস এ্যাপিকটেটাসের জীবন ছিল যার সাক্ষাৎ প্রমাণ!
ঘটনাটি সম্ভবত সত্য, ইতিহাসে লেখে কাজে ভুলচুক ঘটায় এ্যাপিকটেটাসের মালিক একদিন সাংঘাতিক খেপে গিয়ে তাঁর পা ধরে মোচড়াতে শুরু করে। দায়িত্ব এবং দায়িত্বহীনতা উভয় ক্ষেত্রে সমান উদাসীন এ্যাপিকটেটাস অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে মালিককে বোঝানোর চেষ্টা করেন, সে যদি এরকম করতে থাকে তবে তার ঠ্যাংটা ভেঙেই যাবে। রাগ মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মালিক তখন সেই দশায় পৌঁছে গেছে। ফল যা হওয়ার কথা ছিল সেটাই ঘটেছিল সেদিন। এ্যাপিকটেটাস আওয়াজ শুনলেন এবং বুঝতে পারলেন তাঁর ঠ্যাং সত্যি ভেঙে গেছে! দুঃসহ সেই যন্ত্রণার মধ্যে নিজের ভাঙা হাঁটু একনজর দেখে নিয়ে মালিককে উক্তি করেছিলেন, ‘হলো তো! আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম এটা ঘটবে!’ প্রতিরোধহীন আত্মসমর্পণের ফাঁদবন্দি এই নিশ্চয়তা যেমন কারও কোনও উপকারে আসে না, প্রতিরোধের নাম করে হিংস্র সক্রিয়তাও দুর্ভোগ বাড়ায়। সুতরাং ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। যে-মতেই মানুষ তার জীবনকে ছকে নিন-না-কেন, এ-ছাড়া তার পক্ষে সত্যিকারের মানুষ হওয়া সম্ভব বলে প্রত্যয় জাগে না। কথাগুলো বলার মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে হামজা ইউসুফ বিশ্বাসের নিশ্চয়তায় গমন করলেও এখনও সম্ভবত ভারসাম্যে দাঁড়িয়ে থাকার জায়গাটি হারিয়ে ফেলেননি, কিন্তু প্র্যত্যাখানের নিশ্চয়তায় থিতু সিনা সে-ভারসাম্য ইতোমধ্যে হারাতে বসেছেন!
তাঁরা দুজনেই নিশ্চয়তাবাদী হলেও দুজনের ‘আকল’ ও সহিষ্ণুতার মাত্রায় পার্থক্য ঘটে গেছে। আমেরিকায় হামজার নিজের হাতে গড়া ‘জৈতুন কলেজ’ সেখানকার মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে মোটামুটি ভালোই পরিচিতি পেয়েছে। পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে পরিকল্পিত লেকচার সিরিজ শ্রবণ করলে বিদ্যার স্নিগ্ধ রূপ সেখানে চোখে পড়ে। ‘জৈতুন কলেজ’ প্রচলিত মাদ্রাসা নয়। ইসলামিক লিবারেল আর্ট, থিওলজি ও সায়েন্সের পৃষ্ঠপোষক রূপে নিজেকে সে তুলে ধরে। ইসলামের বিধি লঙ্ঘন না-করে সকল প্রকার শাস্ত্রের চর্চা সেখানে চলে। স্মরণ রাখতে হয় হামজা ইউসুফ ইসলামি বিশ্বে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীর প্রচল ঘরানায় বসবাস করলেও নিজেকে ইসলামের স্বর্ণযুগের সঙ্গেই সংযুক্ত রাখতে পেরেছেন, যেখানে তাঁকে ইমাম গাজ্জালি আচ্ছন্ন করে রাখেন, যাঁর ‘সুখের রসায়ন’ (Alchemy of happiness) নিয়ে চার ঘণ্টা ধরে পাঠ ও লেকচার দিতে তিনি ক্লান্তি বোধ করেন না! এবং এটা সেই স্বর্ণযুগ যাকে পাঠ যাওয়ার কথা ড. তাহা হোসেইন একসময় জোর দিয়ে বলে গিয়েছিলেন।
হামজা পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ইসলামের সংঘাতমুখর অবস্থানের বিরোধী, অন্যদিকে পুঁজিবাদ, প্রচলিত গণতন্ত্র, সামরিক শাসন, মিলিট্যান্ট ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতার কড়া সমালোচকও বটে। পুঁজিবাদ ও আধুনিক সভ্যতার বিপক্ষে যখন কথা বলেন সেখানে তাঁর সঙ্গী হয় ‘বুখারী শরীফ’ এবং অনেক সময় বব ডিলানের ‘গীতকলি’। বব ডিলানকে তিনি তাঁর মতের সপক্ষে নিশ্চয় পাঠ যান কিন্তু এতে বিচলিত হওয়ার কিছু ঘটে বলে মনে হয় না। ব্যক্তির সৃষ্টিকে নিজ মতের অনুকূলে পাঠ যাওয়ার অধিকার পাঠকের রয়েছে, ঠিক যেরকম যার এটা পছন্দ নয় সেখানে বিপক্ষ মত হাজির করার ষোলআনা অধিকার তার রয়েছে। নিশ্চয়তা কবুল করতে গিয়ে কট্টর ও কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষে পরিণত হওয়ার ফাঁদ থেকে বাঁচতে হলে এই একমাত্র পথ যার চর্চা অধিক হওয়া প্রয়োজন!
সুতরাং হামজা যখন কলেজের পাঠ্যক্রমে ‘শরিয়ার বিজ্ঞান’, ‘বই কী করে পাঠ যেতে হয়’, ‘জ্ঞানের সংকট’, ‘আলোচনা বলতে আসলে কী বোঝায়’ ইত্যাদি ভাবনা থেকে লেকচার সেশন সাজান তখন প্রচল ঘরানা থেকে তাঁকে আলাদা করে চেনা সহজ হয়। এরকম ভাবতে পারা সৃজনশীলতার পরিচায়ক! তাঁর লেকচার বিন্যাসের ধরন ও পাঠদান পদ্ধতি বৈদিক যুগের ভারতবর্ষে বিদ্যমান গুরুকেন্দ্রিক টোল আর মধ্যযুগে বিশ্বের নানা প্রান্তে সচল ইসলামিক মাদ্রাসার ছবিকে মনে করায়। ‘বই কী করে পাঠ যেতে হয়’ লেকচারটির কথা ধরা যাক, কোরান পাঠ দিয়ে যার শুরু হয় ইসলামি শাস্ত্রের অলিগলি ঘুরে তার ইতি ঘটে পার্সি শেলীর কবিতাপাঠের মধ্য দিয়ে। না, কোনও চটক নেই, জঙ্গিপনা নেই, আদেখেলপনা নেই, হেইট স্পিচ নেই, কিন্তু রয়েছে নিরলে বসে ভাবা আর মতবিরোধে গমনের মতো উসকানি।
লেকচারটি শ্রবণের পর প্রথমে যা মনে জাগে সেটি হলো, চটকদারির দুনিয়ায় এখনও কিছু ঘটনা ঘটে যেটি বিদ্যার গভীরে ঢোকে সুগন্ধ খোঁজে! মিথ্যে নয়, আলী সিনা-র লেখাপত্তর পাঠে একসময় মন চমকে উঠত! অথচ এখন? অতিরিক্ত মশলা ও ঝালে ঠাসা বাজে চাটনি ভেবে মুখে দিতে রুচি হয় না। এরচেয়ে একজন হামজা ইউসুফের নিশ্চয়তাবাদী ও সিদ্ধান্তমূলক লেখা পাঠ বা লেকচার শ্রবণ ঢের ভালো, কেননা সেখানে স্নিগ্ধতার সঙ্গে মতবিরোধে ঘটার মতো উসকানিও বিদ্যমান থাকে। অন্যের তুলনায় কোরান কেন বা কী কারণে শ্রেষ্ঠ ওসব জানার জন্য উইথ চ্যাপ্টার নাম্বার এন্ড রেফ্রেন্স সমেত হাজির জাকির নায়েক ও তাঁর মতো তার্কিকরা যথেষ্ট। হামজা চ্যাপ্টার নাম্বার এন্ড রেফ্রেন্সের কারবার করেন বলে মনে হয়নি। ইসলাম প্রমোটার হিসেবে তাঁর কাজ হচ্ছে ভাবনার রসদ সরবরাহ ও এর বনেদ তৈরিতে অবদান রাখা। কাজটি ইসলামকে খারিজ করতে বদ্ধপরিকর আলী সিনা অনায়াসে করতে পারতেন। হায়! মিলিট্যান্ট ইসলামিস্টের মতো মিলিট্যান্ট নাস্তিক হতে গিয়ে তিনি সেই গুণ হারিয়েছেন!
ঠিক জানা নেই বিশ্বে এই মুহূর্তে হামজার ‘জৈতুন কলেজ’-এর মতো প্রতিষ্ঠান আলী সিনা-রা গড়ে তুলতে পেরেছেন কি না যেখানে নিশ্চয়তাসূচক নাস্তিক্যবাদের চর্চা সংবেদনশীল নমনীয়তার সাহায্যে ঘটানো হয়। পাঠকের জানা থাকলে বলবেন। যেমন ঠিক জানা নেই, বৈদিক হিন্দুশাস্ত্রের চর্চায় নিবেদিত রমনা মহর্ষি, নিসর্গদত্ত মহারাজ, ওশো রজনীশ, সদগুরু প্রমুখের নাম অথবা স্মৃতির স্মারক প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা বিবেকানন্দ একসময় যে-ছকে রামকৃষ্ণ মিশনের বিদ্যাচর্চার ধারা স্থির করে গিয়েছিলেন সেটা এখন সেই ঔজ্জ্বল্য ধারণ করে কি না! আর আমাদের ‘শান্তিনিকেতন’? তারই-বা অবস্থা কেমন? রবীন্দ্রনাথ বিগত হওয়ার পর শান্তিনিকেতন কি তার মিলনসন্ধানী স্নিগ্ধতা ও ঔজ্বল্য আজও ধারণ করে? ঠিক জানা নেই। নিজের বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনযাপন ওশো রজনীশকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও তাঁর আশ্রমে বিদ্যাচর্চার পরিধি বহুমাত্রিক ছিল বলেই জানি। ইসলাম, রাবেয়া বসরি ও সুফি মতবাদ বিষয়ক ওশোর লেকচার সিরিজে সেই গুণ ছিল যা ভিন্ন পথের পথিক হামজায় অনেকাংশে মেলে। জ্ঞানের শরণ মেগে যাঁরা সত্যের খোঁজ করেন তাঁদের নিশ্চয়তাবাদে সমর্পণ তাই কোনও অপরাধ নয়, একটা-না-একটা মতে মনকে স্থির করে নিতে হয়, কিন্তু সেখানেও অন্যকে প্রয়োজনীয় ভাবা ও তার জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখা জরুরি, নয়তো চটক আর গালিগালাজে সব ভণ্ডুল হতে থাকে।
পাঠককে এই ছবি ধরিয়ে দিতে চাইছি বলে হামজা ইউসুফের ইসলাম বিষয়ক জার্নির সারসংক্ষেপ তথ্যবিবরণীর ধাঁচে পরিবেশন জরুরি মনে করি। Middle East Eye-এ তাঁর এই ভ্রমণবিবরণী পাঠের সময় মনে হচ্ছিল বহুদিন পর ইসলামের সেই সময়টি চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল, যখন ইমাম বুখারী হাদিস সংগ্রহ ও সহি-জাল যাচাইয়ে মধ্য এশিয়া থেকে কায়রো-মক্কা-বাগদাদ অবধি অক্লান্ত ঘুরছেন! আত-তিরমিজি, গাজ্জালি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, আল-ফারাবি, উমর অথবা ইয়াহিয়া সোহরাওয়ার্দী প্রমুখরা এভাবেই দেশ-দেশান্তর করতেন আত্মিক মুক্তির তালাশে! সেই তালাশ এখনও হারিয়ে যায়নি এই কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেই যেন হামজা ‘গাজ্জালি কেন এখনও প্রাসঙ্গিক’ তার বাখ্যা তুলে ধরেন। যাহোক, কথা আর না বাড়িয়ে Middle East Eye সাময়িকী সূত্রে তাঁর সফর বৃত্তান্তে এই ফাঁকে ঘুরে আসা যাক :—
ইসলাম সম্পর্কে হামজা ইউসুফের তালাশের সূত্রপাত ঘটে লন্ডন শহরে গমন ও মরক্কোর প্রখ্যাত সুফি সাধক আবুল হাসান আলী আস-শাদিলি প্রতিষ্ঠিত সুফি তরিকায় বয়েত গ্রহণের মাধ্যমে। জনান্তিকে বলে রাখি, মরক্কোর শাদিলি সুফি তরিকার সঙ্গে মার্কিনিদের সংযোগ ঐতিহাসিক। সত্তুরের হিপি-বিটনিক বিস্ফারের ধাক্কায় মার্কিন যুবক-যুবতীরা একদিকে যেমন চিন ও ভারতবর্ষে ব্যাপকহারে গমন করে, তাদের একটি অংশ পাড়ি জমায় মরক্কোয়, মূলত শাদিলি সুফিভাবে আত্মিক প্রশান্তি লাভের টানে। এ-প্রসঙ্গে গিলিজ ম্যাককিনন-এর ‘হিডেয়াস কিঙ্কি’ (Hideous Kinky) ছবিটির কথা মনে পড়ছে। হিপি-বিটনিক বিস্ফারের মরক্কোমুখী স্রোতের উচ্ছল প্রবাহের দিনগুলোয় আত্মিক প্রশান্তি লাভের খোঁজে মার্কিনি এক তরুণী সেখানে গমন করে ও জনৈক মরক্কোদেশি যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। তরুণীর এই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে ম্যাককিনন ছবিটি তৈরি করেছিলেন। কেট উইন্সলেটের সহজাত অভিনয়পটুতা আর শাদিলি সুফি তরিকার ঝটিতি উপস্থাপন মিলেঝুলে ছবিটি মন্দ ছিল না। হামজার ইসলাম গ্রহণ ও শাদিলির খবর করতে লন্ডন গমন থেকে বোঝা যায় মরক্কো তাঁর মনে ততদিনে মন্দীভূত হিপি বিস্ফারের সূত্রেই জায়গা করে নিয়েছিল।
লন্ডনবাসের টানা চার বছর শাদিলি সুফিভাবিক লোকজনের সঙ্গে হামজার উঠবস নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। তাঁদের কাছে এই তরিকার অগ্রগণ্য দীক্ষাগুরু আবদালকাদির আস-সুফির খবর তিনি পান। আস-সুফির মুরিদ হতে হামজা অতঃপর আরব আমিরাতে গমন করেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যায়তনে কাটে কিছুদিন। আরবি ভাষা রপ্ত করার ধারাবাহিকতায় মুয়াজ্জিন ও পরে ইমামের দায়িত্বও সেখানে পালন করেন। আস-সুফির সঙ্গে ইসলামের মৌল কিছু বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে হামজা শাদিলি-সঙ্গ ত্যাগ করে পাড়ি জমান আফ্রিকায়। ইসলামের স্বরূপ সন্ধানে আলজেরিয়া, মরক্কো ও নানা দেশ ঘোরেন। আত্মিক মুক্তির তালাশে দেশ-বিদেশ করার দিনগুলোয় হামজা অবশেষে মৌরিতানিয়ায় পা রাখেন এবং মোরাবিত আল-হাজ্ মোহাম্মদ ফাহফু ও আব্দুল্লাহ বিন বেহ-র সংস্পর্শে আসার পর তাঁর আত্ম-অন্বেষণ কিনারা খুঁজে পায় এবং ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর ‘জৈতুন কলেজ’ গড়ার কাজে নিয়োজিত হওয়ার পাশাপাশি আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামি চিন্তাবিদ রূপে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে যায়। হান্টিংটনের পশ্চিম ও আরব সভ্যতার দ্বন্দ্ববিদীর্ণ টেক্সটের অভিঘাত অবশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদের মতো হামজাও ধারণ করেন, তবে সেখানে তাঁর ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
সংক্ষিপ্ত এই পরিচয়পর্ব যে-জার্নি তুলে ধরে সেটা থেকে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না ইসলামিক টেক্সটে তাঁর সংযুক্তি সফর, অনুসন্ধান ও বিচার পদ্ধতির ভিতর দিয়ে গমন করায় অতীতে বিদ্যার্জনের যে-চল ইসলামে নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা ছিল, এই জার্নি বিলুপ্তপ্রায় সেই ধারাকে যেন নতুন করে আবার ফিরিয়েও আনে! তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান, — দৈহিক মৃত্যু ও পরজাগতিক উত্থান সংক্রান্ত জটিল ধাঁধার সুরাহায় ইসলাম অন্যদের চেয়ে সুষ্পষ্ট (Clear cut) ব্যাখ্যা তাঁকে দিতে পেরেছে, যা তাঁর সেই সময়ের অভিজ্ঞতার নিকটবর্তী। বিষয়টি উপলব্ধি করার মতো মানসিক অবস্থা তাঁর তখন ছিল না; পরে কোরান পাঠ ও সমীকরণ মিলাতে বসে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে, চেতনাবিনাশী মৃত্যুর স্বাদ তিনি পেয়ে গেছেন এবং মৃত্যু-পরবর্তী জগতের ছবি রুহ বা নফসের রহস্যময় আচরণ অবধানের সুবাদে তাঁর জীবনে ঘটে গেছে। বিষয়টিকে তিনি একজন ব্যক্তির ‘আধ্যাত্মিক মৃত্যু’ (Spiritual Death) হিসেবে তুলনা করেছেন, যেখানে কায়াকে জগতে নিথর রেখে আত্মার পরজগতে সফর ও পুনরায় কায়ায় ফেরত আসার ঘটনাকে অযৌক্তিক ভাবা হয় না।
হামজার বক্তব্য বিষয়টি পরিষ্কার করে, ট্রমাদশায় গমনসূত্রে ইসলামে বর্ণিত মালাকুতের সঙ্গে সম্পৃক্তি তাঁকে মৃত্যু কী এবং মৃত্যুকে কেন ভয় পাওয়ার কিছু নেই সেই যুক্তি অবধানে সহায়তা করেছিল। এ-ব্যাপারে তাঁর কথাবার্তা নতুন বা অভিনব এমন নয়। বৈদিক ও বৌদ্ধ-জেন ধর্মবেত্তারা তো রয়েছেনই, অন্যদের সঙ্গেও তাঁর বক্তব্য সেখানে মোটের ওপর অভিন্ন। তাঁর বক্তব্য ও যুক্তি বিরচনের নির্যাস সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে :—
মৃত্যু ভয়ের বিষয় নয় বরং এটা হচ্ছে মুক্তি! জাগতিক বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার উপলব্ধি জাগ্রত হলে সমর্পণের অনুভব চিত্তে সচল হয়। মৃত্যুকে ভয় পাওয়া নয় বরং তার কাছে নতি স্বীকার করলে মন বিনীত ও শান্ত হয়ে আসে এবং বিশ্বাসের এটা হচ্ছে সারকথা। মৃত্যুকে অনিবার্য ধরে নিলে বিক্ষোভ-বেদনা ও উদ্বেগের উপশম ঘটে। মরণের ভয় মানুষকে আতঙ্কিত রাখায় মানসিকভাবে সে বিষয়টি সহজে মেনে নিতে পারে না এবং তার মনে ক্ষোভ, আতঙ্ক ও মৃত্যু থেকে কী করে পালানো যায় বা তাকে প্রতিরোধ করা যায় ইত্যাদি ফন্দিফিকির জন্ম নেয়। অথচ মৃত্যু একমাত্র যা তাকে অন্যের দ্বারা প্রতি পদে প্রভাবিত ও শৃঙ্খলিত হওয়ার ছক থেকে মুক্তি দিতে পারে। ধরার জীবন মানুষের জন্য সুখের নয় বরং এটা হলো শাস্তি ও পরীক্ষাগার। নিয়মবদ্ধ জীব রূপে নিজের দেহকে সে এখানে খাটাতে বাধ্য হয় এবং সেখানে ব্যর্থ হলে ইহজাগতিক জীবন যেমন তার জন্য দুর্ভোগ ও অশান্তি ডেকে আনে, যদি সে পরজগতে বিশ্বাস রাখে সেখানেও গতি সুখের হয় না। যে-কারণে দৈহিক মৃত্যুতে সব শেষ এটা ভাবার চেয়ে একে মানুষের এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর (Transformation) বলে ধ্যান করতে পারলে মৃত্যুভীতি মন থেকে বিদূরিত হয়। NDE-র মধ্য দিয়ে হামজার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল বিধায় নিজের দৈহিক সীমাবদ্ধতার উত্তরণ ও রূপান্তরকে ইসলামের মালাকুতে গমনের মাঝে তিনি খুঁজে নিয়েছেন।
জৈবগুণে গঠিত দেহের এই রূপবদল অস্বীকার যাওয়া হামজার ভাষায় হচ্ছে কুফা (*কুফর) বা প্রত্যাখ্যান এবং ইসলামে সেটা কুফরির স্মারক। মানুষ চিরজীবী নয় এবং যে-লোক নিজের দৈহিক জীবনের অবসান ঘটার ভয়ে ভীত অথবা সেটা মেনে নিতে পারে না অথবা মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে দেহের পৃথক গতি অস্বীকার করে সে হচ্ছে কাফের। মৃত্যুর কাছে নতিস্বীকার ও সমর্পণ হলো উপায় যা মানুষকে উদ্বেগ ও বিক্ষোভ থেকে মুক্ত করার সঙ্গে স্বাধীন করে তোলে। জাগতিকতা তখন তার ওপর বোঝা হয়ে চেপে বসতে পারে না। মরতে হবে সেই কথা স্মরণ রেখে সে জাগতিক কাজগুলো করে যায়। যে-কারণে মৃত্যু সম্ভবত একমাত্র অভিজ্ঞতা মানুষ যেটি কারও দ্বারা প্রভাবিত, নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত না হয়ে নিজে যাপন করে থাকে। হিন্দু বৈদিক ধর্ম থেকে সকল ধর্মে মৃত্যুকে তাই প্রাণীজগতের জন্য অপরিহার্য নিগমন রূপে গণ্য করা হয়েছে। প্রাণীর জীবনে পরিশেষের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কেননা সমাপ্তি ছাড়া প্রভাবিত ও নির্ধারিত হওয়ার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি মিলে না। ‘Death’ নামক লেকচারে হামজা তাই হাইডেগারের নাম স্মরণ করে উপসংহার টানেন :—
Heidegger goes to the radical proposition that you, that your death Act will be the only real thing that you ever do, that was determined by anybody else; that every act that you do in your life is because you’ve been influenced by your parents by your peers by your education by your society; it is death alone that will be uniquely yours. No one will teach you how to do that, no one will show you that path, you take it on your own, and so that is your one true act that can be absolutely volitional. You can die ad that is really a harmony in Islamic understanding. — Source: Hamza Yusuf: Lecture Session on Death; Islam On Demand Channel, YouTube.
হামজা তাঁর ইসলামবিশ্বাসে বাড়তি যা যুক্ত করেছেন সেটা হলো, মৃত্যু আল্লাহ থেকে প্রদত্ত আশীর্বাদ, যার মাধ্যমে নশ্বর জীবনে যতি টেনে অবিনশ্বর জগতে মানুষের যাত্রা ঘটে! অবিনশ্বরে গমনের পর কায়াধারী দেহের সেই রূপবদল ঘটে যায় যার কোনও বিনাশ নেই এবং সেটাই হচ্ছে তার প্রকৃত স্বরূপ। এখানে শুধু মনে রাখা চাই, অবিনশ্বর এই রূপান্তরের ক্ষণে তার কর্মফল অনুযায়ী সে স্রষ্টা কর্তৃক শাস্তি অথবা পুরস্কারে ভূষিত হবে, সুতরাং নেক আমলের বিষয় মাথায় নিয়ে নশ্বর জীবন কাটানো উচিত, যা একমাত্র ‘মরতে হবে ও স্রষ্টার সম্মুখীন হতে হবে’ এই বোধ ধারণ করে যে-লোক জীবন কাটায় তার পক্ষে পালন করা সম্ভব।
হামজার বক্তব্যের নির্যাস ও যুক্তিধারা নতুন কিছু না হলেও আলী সিনা তাঁর লেখায় এসব নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেননি। মোহাম্মদের গালিগালাজে বড়ো অংশ খরচ করার ফাঁকতালে হুমায়ুন আজাদের মতো পটকা ফাটিয়ে রায় হেঁকেছেন, — দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় আত্মার পরলোক গমন ও ফেরত আসা সম্ভব নয় ইত্যাদি। তাঁর মন্তব্য বালখিল্য কারণ ভারতীয় বৈদিক দর্শন ও যোগসাধন তরিকায় দেহকে চেতনহীন অবস্থায় রেখে আত্মার অনুরূপ দেহ ধারণ করে অন্যত্র গমন ও পুনরায় দেহে ফেরত আসা ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর বাতচিতের ইতিহাস রয়েছে এবং ইসলামের তুলনায় সে-টেক্সটের পরিধি ব্যাপক। এটা ঠিক, বস্তুবাদী ও ইহজাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ঘটনাটি সম্ভব নয়। কিন্তু কেন সম্ভব নয় সেই সিদ্ধান্তে আসতে হলে সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও ব্যাখ্যা থাকা চাই। সমস্যা হলো বিজ্ঞান এ-সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় প্রদান সমীচীন ভাবে না। কেন ভাবে না তার যুক্তিগুলো এই ফাঁকে ভাবা যেতে পারে :—
প্রথম কারণ, রক্তমাংসের দেহে বিজ্ঞান ‘আত্মা’ নামধারী কিছু আজও খুঁজে পায়নি! আত্মা কী বা সেটা কেমন করে দেহে আসা-যাওয়া করে এইসব বায়বীয় ব্যাপার নিয়ে বলার এখতিয়ার সে তাই থিওলজির ওপর ছেড়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, সচেতনা বা ‘কনশাসনেস’ মানুষে কেমন করে সক্রিয় থাকে অথবা এর উদ্ভব সম্পর্কে নির্ধারক সিদ্ধান্তে সে আজও পৌঁছাতে পারেনি। মস্তিষ্ককে যদি সচেতনা উৎপাদন ও সংরক্ষণের ভরকেন্দ্র বিবেচনা করি সেক্ষেত্রে ব্রেইন ডেথ (Brain Death) অথবা ‘কোমা’-য় চলে যাওয়ার মতো অবস্থায় অনেকের যেসব অভিজ্ঞতা ঘটে সেগুলো সচেতনার প্রকারভেদ না অন্যকিছু ইত্যাদি নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য ঠোকার মতো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এখনও কেউ হাজির করতে পারেননি। আবার মস্তিষ্ককে সচেতনার আধার ধরে নিলে দেহের মৃত্যু ঘটার ফেরে সচেতনাও বিলুপ্ত হওয়ার কথা। তৃতীয় কারণ, জন্মমৃত্যু থেকে শুরু করে জগতে সক্রিয় কতিপয় ঘটনা সচেতনা নাকি স্বয়ংক্রিয়তা সে-নিয়ে বিজ্ঞানে মতভেদে রয়েছে। যে-কারণে বিজ্ঞানকে এখানে নিজের মতের সপক্ষে ব্যবহার ঝামেলা বাড়ায় এবং এহেন কর্ম বিপজ্জনক বটে। ‘কনশাসনেস’ একটি জটিল প্রপঞ্চ। সিনা-র নির্ধারণবাদী যুক্তিছকে আঁটানোর অবস্থায় সে পৌঁছায়নি। যদি কখনও পৌঁছায় সেদিন জীবন-মৃত্যুর ইতিহাস পালটে যাবে এবং সে সম্পর্কে এখন কিছু বলা মুশকিল।
হামজা যদি বিজ্ঞানের জায়গা থেকে নিজের থিওলজি দাঁড় করাতেন তবে সেটা বিপজ্জনকভাবে ভ্রান্ত কাজ হতো। ভদ্রলোক বিবেচক। তিনি বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ টানলেও তাঁর ভরকেন্দ্র থিওলজি, এমনকি দর্শনকে বেশ সতর্কতা সহকারে তিনি ব্যবহার যান। যে-বিশ্বাস তিনি লালন করেন তার বিচারে নামার ক্ষেত্রে এই সতর্কতা দরকারি ছিল। হামজার বিশ্বাস ও যুক্তি বিরচনের পদ্ধতিকে এইসব প্রসঙ্গের সুবাদে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সিনা-র ছিল, এতে তাঁর বক্তব্য সুবেদী ও তর্ক-বিতর্কের পরিসর চওড়া হতো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি এর ধারেকাছে অবস্থান করেন না। হামজাকে কাটতে তাঁর অবলম্বন হয় বাইবেলের এক টুকরো থিওলজি, যাকে একজন ইসলামি ধর্মবেত্তা নিজের ইসলাম কেন্দ্রিক ‘দেহ, আত্মা ও পুনরুত্থান’ বিষয়ক থিওলজি দিয়ে কাটতে পারবেন না এমনটি একবারও মনে হয়নি। এসব কারণে সিনা-র তর্কপদ্ধতি বদ্ধতার নামান্তর, যেখানে যুক্তির ফটকাবাজি ও একপেশেমি থাকলেও বিদ্যার কলসি ভো ভো ফাঁকা। কথায় বলে ভরা কলসি নড়ে কম, আর খালি কলসি বাজে বেশি। তাঁর হয়েছে সেই অবস্থা।
সিনা দার্শনিকতা ও কল্পনা প্রতিভার ক্ষমতায় গরিব সেটা বুঝতে এই একটি উদাহরণ মনে হয় যথেষ্ট! বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, — না, তিনি চার্বাকদের মতো নন! চার্বকরা স্রষ্টা ও পরজগৎকে বাতিল করতে গিয়ে শক্ত যুক্তি ঠুকতে পেরেছিলেন। ওশো রজনীশের কোনও এক লেকচারে শুনেছিলাম বোধহয় এবং কথাটি মনে ধরেছিল, যেখানে ওশো মত দিচ্ছে, — ইহজগৎ ও পরজগতের মামলায় চার্বাককে সকলের আগে পাঠ যাওয়া উচিত, কারণ তাঁরা ‘না’ দিয়ে বিচারটা শুরু করেছে! স্রষ্টা, পরজগৎ ও আত্মার সেই জগতে গমন ইত্যাদি কেন ‘অবান্তর’ এই যুক্তিগুলো যে-ব্যক্তি লবজ করতে পারেনি তার পক্ষে ইহজীবনে ‘স্রষ্টা, আত্মা, পরজগৎ’ কেন বা কী কারণে ‘অবান্তর নয়’ সে-ভাবনায় গমন করা সম্ভব হয় না। ভেদবিচার ‘নাই’ থেকে শুরু না হলে ‘আছে’র সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো কঠিন। সৃষ্টি নিজেই তো ‘নাই বা শূন্য’ থেকে শুরু হয়! সুতরাং ‘কেন নাই’ ভাবতে না পারলে ‘নাইয়ের অতীত’ স্রষ্টা কেন ও কী কারণে বৈধ তা বুঝে ওঠা যায় না। শুরুতে ‘আছে’ ধরে যুক্তি ফাঁদতে বসলে ধর্মান্ধতা বরং অনিবার্য হয় সেখানে।
আলী সিনা-য় এইসব দার্শনিক বিবেচনার বালাই চোখে পড়ে না! যে-কারণে তাঁর যুক্তি ও দলিল-দস্তাবেজ ঘাগু থিওলজিয়ানের পক্ষে ধা করে কেটে দেওয়া বাঁ হাতের খেল! একপেশে ছকে কোরান-হাদিস আর সাহেবি কিতাব পাঠ করে ইসলাম খারিজের মামলা বিপজ্জনক। সিনা-র বইপত্র পাঠের সময় আমার নিজের এই জ্ঞান ছিল না। সময়ের সঙ্গে খানিক হয়েছে বলে বাতিল করার চেয়ে সংযোগসূত্র যাচাই কাজের বলে মানি। ধর্মকে বাতিল বা মূলোচ্ছেদ করা যায় না, তবে বহুবিধ পন্থায় প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ থাকে। নিশ্চয়তায় বিদ্যমান অনড় স্বভাবকে নমনীয় করে ফলপ্রসূ সংলাপে গমন কেবল সেখান থেকে সম্ভব। খ্রিস্ট ধর্মে ঘটনাটি ঘটেছে বলে চার্চ এখন নাস্তিক্য মতের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বাতচিতে দ্বিধা করে না। দালাই লামার সঙ্গে সংলাপের উদ্দেশে যেমন একদল বিজ্ঞানী তিব্বত সফরে যান এবং থিওলজি ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সংলাপ উভয় পক্ষের অংশগ্রহণে বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আগ্রহী পাঠক নেটে সেই সংলাপের খোঁজ নিতে পারেন।
সিনা তাঁর লেখাপত্তরে মোহাম্মদকে নকলি ও চৌর্যবৃত্তির দায়ে বিদ্ধ করেছেন। একুশ শতকে জ্ঞানের যে-ধারা বইছে সেখানে এই অভিযোগ কানে ক্লিশে শোনায়! কে কার কাছ থেকে নিয়েছে, কার দ্বারা কে প্রভাবিত হয়েছে, কে কাকে আত্মসাৎ করে নাম কিনেছে এই বিচার অন্য শাস্ত্রের জন্য প্রাসঙ্গিক হলেও আল্লাহর চিরায়ত মৌল স্বরূপ ও একত্বের বাণী প্রচারে নিবেদিত ইতিহাসে এর বিশেষ মূল্য আছে কি? মামলা যদি হয় স্রষ্টার একত্ব বা তাওহিদের বাণী কে কীভাবে তুলে ধরেছেন তবে যত উৎস (*খ্রিস্ট পূর্ব বা পরবর্তী সময়ে) যেখানে এই বাণীর উল্লেখ ও অনুশীলনের নজির রয়েছে তারা একে অন্যকে আত্মসাৎ করতে বাধ্য। কোরান দুটি বিষয় একাধিক আয়াতে স্পষ্ট করে :—
এক. ধরার প্রতিটি প্রান্তে আল্লাহ তাঁর বাণীর বার্তাবাহক দূত পাঠিয়েছেন, যেন জনপদগুলো ইবলিশের ‘আকল’ দ্বারা প্রভাবিত বাণীর সঙ্গে তাঁর বাণীকে একত্র বা বিকৃত না করে। এবং দুই. যুগযুগান্তে তিনি একাধিক ঐশী কিতাব তাঁর বাণী-প্রচারকের মাধ্যমে প্রেরণ করেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকটি সম্পর্কে লোকে এখন জানে; বাকিগুলো সময়ে চিরতরে অবলুপ্ত হয়েছে অথবা পালটে গেছে যে তাকে আর আদি বাণীর স্মারক রূপে পাঠ যাওয়া কঠিন। হ্যাঁ, ইচ্ছে করলে তালিকা তিনি দিতে পারতেন কিন্তু তাঁর কাছে এর মূল্য নেই, কারণ স্রষ্টার বাণী প্রচারের ধারায় ইবলিশের অব্যাহত অনুপ্রবেশ ও বাণীর বিকৃতি সাধনের ঘটনা পুরোনো হওয়ার কারণে তালিকা সেখানে গুরুত্ব রাখে না। যারপরনাই আপাত কয়েকটি কিতাবের নাম টেনে তিনি পরিসমাপ্তি টেনেছেন।
এভাবে ভাবতে পারলে এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী ধর্মে বিরাজিত ফেরকা ও বিবাদকে প্রচলিত ভেদবিচারের বাইরে গিয়ে যাচাইয়ের পরিসর তৈরি হয় এবং সেটা হওয়া প্রয়োজন। বেদ থেকে কোরান অবধি ধর্মীয় টেক্সটে স্রষ্টার স্বরূপ সম্পর্কে বক্তব্য বিচিত্র পথে গমন করলেও মনে রাখতে হবে একাধিক জায়গায় তাদের মধ্যে অভিন্নতা প্রকাশ পায়। তাই বলা চলে, স্রষ্টার একত্ব ও মৌল প্রকৃতি নিয়ে বিরোধ একেশ্বরবাদী ধর্মের পরস্পরকে নকল করার ঘটনা ঘিরে দানা বাঁধেনি, বরং তাওহিদের প্রকৃতি ও উপাসনারীতি সম্পর্কে মতের ভিন্নতা তাদেরকে কলহে লিপ্ত থাকতে বাধ্য করে। যে-সমস্ত চিহ্নের সূত্র ধরে তারা স্রষ্টার একত্ব ব্যাখ্যা করে সেগুলো নিয়ে পারস্পরিক মতভেদ ও তার রাজনৈতিক ব্যবহার ক্রুসেডের তিক্ত ইতিহাসকে বারবার ফিরিয়ে এনেছে। পবিত্র স্থানের মতো চিহ্ন (*যেমন ধরা যাক জেরুজালেম বা মসজিদুল আকসা) এখানে সাংঘর্ষিক স্মারক হয়ে আসে যাকে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান পৃথক ঐতিহাসিক ঘটনা-পরম্পরায় পাঠ যায় এবং এর ওপর নিজের কায়েমিস্বত্ব রয়েছে দাবি করে। চিহ্নটি তারা কে কার কাছ থেকে ধার করেছিল ও পরে সুযোগ বুঝে পালটে ফেলেছে এইসব ছাপিয়ে স্রষ্টা কাকে এর জন্য মনোনীত করেছিলেন এবং সেখানে কে কতখানি মূল ঘটনা নিজের অনুকূলে বদলে নিয়েছে ইত্যাদি প্রসঙ্গ ধরে বিবাদ তুঙ্গে ওঠে। ইতিহাসের পাঁজিপুথি ঘেটে এইসব তুলনার ওপর অগ্রসর বিচার পদ্ধতি তাই ফিতনা বাড়ায় এবং কারও কোনও কাজে আসে না। প্রচলিত পদ্ধতিতে মামলা সুরাহার সময় উপলব্ধিটি আসলে বাদ পড়ে যায়।
স্রষ্টার একত্ব বিষয়ে একেশ্বরবাদী টেক্সটের এইসব মতভিন্নতা ও কার্যকারণ নিয়ে তাই তর্ক জারি থাকা প্রয়োজন। প্রত্যেকে যে যার গ্রন্থ অনুসারে মতের প্রচার করুক, পরস্পরকে খণ্ডন করতে তর্কে লিপ্ত থাকুক, মানুষকে নিজ মতের অনুকূলে টানার জন্য শক্ত যুক্তি ও ব্যাখ্যা হাজির করুক, এবং নির্বাচনের ভার মানুষের হাতে ছেড়ে দিক। পরস্পরের প্রতি সহিঞ্চু হয়ে ধর্মগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংলাপ ও বিতর্কের ঘটনা যত ঘটবে ফিতনা প্রশমিত হয়ে বিচারজ্ঞানের পরিধি সম্প্রসারিত হতে থাকবে। একুশ শতকের জ্ঞানভিত্তিক সমাজে এটা ঘটানো প্রয়োজন। তথাকথিত ওয়াজ নয় বরং বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকলের অংশগ্রহণে সংলাপ ও তর্কবিতর্ক হওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষিত সমাজের গণ্ডিতে একে সীমাবদ্ধ রেখে দিলে ফিতনার প্রশমন ঘটবে না, আমজনতার ‘বুঝের’ উপযোগী করে তর্কবিতর্ক আর মতভেদের নির্যাসকথা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। সেই ছড়িয়ে দেওয়ার যজ্ঞে প্রচলিত বৈজ্ঞানিক পন্থা অনুসারে ধর্মের ভেদবিচারে সংশোধনী আনা জরুরি। নিজের বক্তব্যের সপক্ষে বিজ্ঞানসহ অন্যান্য শাস্ত্রকে ব্যবহারের যে-প্রবণতা থিওলজিতে ইদানিং প্রকট হতে দেখা যায় সেটা তার জন্য বিপজ্জনক ফাঁদ। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে সে ব্যবহার করবে সাম্প্রতিক পটভূমি ও জ্ঞানের অগ্রগতি উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা থেকে, কিন্তু নিজের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে যথাসম্ভব পাশ কাটিয়ে যাওয়া উত্তম। অনুরূপভাবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও অভিমতের সাপেক্ষে বৈধ বা অনুকূল হলো না দেখে বক্তব্য থেকে সরে আসা থিওলজির সাজে না। ইসলামে হারাম-হালাল বিষয়ে কারযাভীর বক্তব্যের সারকথা বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টি এভাবে ভাবা যেতে পারে :—
ইসলামে হারাম বা নিষিদ্ধ জিনিস সম্পর্কে Degree of Differences অর্থাৎ লঘু-গুরু মাত্রাভেদ রয়েছে এবং সে-অনুসারে হারাম বিষয়ক নির্দেশনা একজন মুসলমানের মেনে চলা উচিত। কোরানে পরিষ্কার নিষেধ রয়েছে এমন জিনিসকে যুগ-কাল ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের অজুহাতে পালটে ফেলার অনুমতি ইসলাম দেয় না। জীবন রক্ষাকারী প্রতিষেধক আবিষ্কার, প্রাণ সংশয় অথবা বাধ্য হয়ে মদ্যপান কিংবা শূকরের মাংস ভক্ষণ আর নিজের মনোবাসনা পূরণের জন্য এর সপক্ষে ব্যাখ্যা হাজির করা ইসলামের বিচারে এক কথা নয়। শাহাব আহমেদ যেমন তাঁর বইয়ে (*দ্রষ্টব্য : ‘What is Islam?…’) মদ্যপানের চর্চাকে ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যাখ্যার আলোকে একপ্রকার বৈধতা দানের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাতে সেটা বৈধ হয়ে যায় না।
শাহাবের বই থেকে জানা যায়, ইবনে সিনা ভক্তদের সঙ্গে রাত্রিকালীন মজলিশে আইন ও ওষুধী বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার ক্ষণে অল্পবিস্তর সুরা পান করতেন এবং এ-বিষয়ে তাঁর নিজস্ব যুক্তিও ছিল। ইসলামের বিকাশকাল থেকে আজওবধি এরকম অসংখ্য ঘটনার নজির থাকলেও মদ্যপান তাই বলে ইসলামের বিচারে হালাল হয়ে যাবে না। কোরান যাকে সুনির্দিষ্ট ঘটনাপ্রবাহের নিরিখে নিষিদ্ধ মত দিয়েছে তাকে হালাল ভাবার সুযোগ ইসলামে নেই। উদাহরণের খাতিরে ধরা যাক, ‘সহি’ বলে বিদিত হাদিস কোনও কারণে মদ্যপানকে বৈধ মত দিয়েছে বা সেরকম ইঙ্গিত রেখেছে, এর মানে এই নয় এখন থেকে মদ হালাল গণ্য করতে হবে, বরং কোরানের কনটেক্সটে হাদিসের ‘সহিত্ব’ গৌণ হয়ে যাবে। কারণ, কোরান ও মোহাম্মদকে অনুধাবনে হাদিস ও সিরা জরুরি হলেও কোনও বিধান নয়। সহি হাদিস একটি ঘটনার ক্ষেত্রে বিধান গণ্য হতে পারে যার কোনও ইঙ্গিত কোরানে সেভাবে পাওয়া যায় না অথবা ইঙ্গিত থাকলেও তার ওপর ভর করে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন। মুনাফিকি, সুদের কারবার, শূকর ভক্ষণ ও মদ্যপানের মতো ঘটনায় অপরাধের মাত্রা কবিতা, গানবাজনা কিংবা ছবি আঁকার সমতুল নয়। শরিয়ার বিজ্ঞান সেখানে Degree of Differences-এর নিরিখে ঘটনার বিচার করে এবং গুরুতর ও লঘু অথবা শর্ত সাপেক্ষে বৈধ বা হালাল বলে দাগায়। কাজেই ইসলামের ইতিহাসে ইবনে সিনা-র অতুল অবদান থাকতে পারে কিন্তু নিজের মনোবাসনা মিটানোর প্রয়োজনে তাঁর এই মদ্যপান বৈধ হয়ে যায় না! রোজ হাশরে আর পাঁচজনের মতো তাঁকেও এর জন্য জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে।
মদ্যপান বা শূকরের মাংস ভক্ষণ ইত্যাদি ব্যাপারে ইসলাম কেন কঠোর তার জবাব পেতে হলে তাওরাত থেকে কোরান অবধি ঘটনাপ্রবাহ অবধান করা প্রয়োজন, অন্যথায় নিষেধাজ্ঞার কার্যকারণ উপলব্ধি করা মুশকিল হয়। এখন ইহুদি বা খ্রিস্টান মতে বিশ্বাসী ব্যক্তির ক্ষেত্রে সেই ‘বুঝ’ একভাবে ঘটবে, ইসলামে বিশ্বাসী ব্যক্তির অনুসন্ধানে তা পৃথক মাত্রায় ধরা দেবে। এবং, নিরপেক্ষ মন নিয়ে যিনি উক্ত ঘটনাপ্রবাহ যাচাই করতে যাবেন সেখানে কে ঠিক আর কে বেঠিক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো তাঁর কাছে দুরূহ মনে হবে। উক্ত ব্যক্তির বিচারিক পদ্ধতি এমন কোনও প্রামাণিকতা সেখানে খুঁজে পাবে না যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটিকে সঠিক ও অন্যটিকে বেঠিক রায় দিতে পারেন! ঘটনার তদন্ত ও বিশ্লেষণ শেষে বড়োজোর যুক্তির তুলাদণ্ডে যাকে ভারী মনে হবে তার দিকে তিনি ঝুঁকতে পারেন। অথবা ইসলামবিশ্বাসী কোনও ব্যক্তিকে যদি মদ্যপান ও শূকরের মাংস বৈধ প্রমাণ করতে হয় তবে তাঁকে সেই ব্যাখ্যা হাজির করতে হবে যেটি কোরানের আয়াতকে পরিষ্কার ‘বোঝার ভুল’ বলে সুনির্দিষ্ট যুক্তি সহকারে প্রমাণ করতে সক্ষম। ব্যক্তি যদি সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ও ব্যাখ্যা দিতে পারেন তবে শরিয়া নিজের মত পালটাতেও পারে। আমার সীমিত জ্ঞান অনুসারে আজ অবধি এরকম ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই। পাঠকের জানা থাকলে সংযোজন করবেন সেই আশায় সিনা নিয়ে বাকি কথা পরের পর্বে হোক।
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১০
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৯
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৮
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৬
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS