ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১৩ || আহমদ মিনহাজ

ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১৩ || আহমদ মিনহাজ

সপ্তম প্রবাহ : অ্যান্টিইসলামিস্ট বাখান : বুদ্ধিবৃত্তিক সংকীর্ণতা : আলী সিনা অন্যান্য


এ-কথা বিদিত বেঞ্জামিন ওয়াকার তাঁর কিতাবে (The Foundation of Islam) ইসলামের মৌলিক ভিত্তি অনুসন্ধানে নেমে মোহাম্মদ প্রচারিত দীনকে সকল শাস্ত্র ও দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে মানব সভ্যতার জন্য নেতিবাচক ঘটনা রূপে হাজির করেছিলেন। ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান-স্থাপত্য ও শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য বিচার শেষে গ্রেকো-রোমান এবং প্রধানত খ্রিস্টীয় ভাবধারার অনুকরণ থেকে উৎসারিত এক সভ্যতা রূপে ইসলাম তাঁর বোধে ধরা দিয়েছিল। কোরানে সূরার কাঠামো ও ভাষিক উৎস, ইসলামি ধর্মতত্ত্বের স্বরূপ ও বিবর্তন, স্থাপত্য ও শিল্পকলা থেকে আরম্ভ করে মহানবির অন্তঃপুরের খবর নিতে ব্যগ্র ওয়াকারের বই এখানে নিজের থেকেই ক্লিয়ার করে, আবু সুফিয়ানের বংশধর ছাড়াও একাধিক মুসলমান শাসক পরিস্থিতির ফেরে সেই সময় ইসলামে গমন করলেও খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মীয় ভাবধারার প্রতি তাঁদের দুর্বলতা ও অতীত সংযোগ কমবেশি সকল যুগে বহমান ছিল। আবু সুফিয়ানের পুত্র আমির মুয়াবিয়া খ্রিস্টান ভাবধারায় গভীরভাবে উজ্জীবিত ছিলেন। তাঁর পুত্র এজিদও তা-ই! যুক্তিসংগত কারণে তাঁদের শাসনামলে ইসলামি প্রখাচার ছাপিয়ে খ্রিস্টান ভাবধারার প্রভাব ঠিকরে উঠতে সময় নেয়নি। ওয়াকার মনে করেন মক্কা থেকে বিশ্বজয়ী হওয়ার বাসনায় বেরিয়ে পড়া মুসলমান সেনাপতিদের সভ্যতা বিষয়ে কোনও ধারণাই ছিল না। বহির্গমনের সুবাদে এই প্রথম সভ্যতা নামক কালচারের সঙ্গে তাঁরা নিবিড় হতে থাকেন এবং একে রপ্ত করার নেশা তাঁদের পেয়ে বসেছিল। রাজ্য শাসনের ধারা থেকে আরম্ভ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্পকলার প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে প্রাচীন সভ্যতার উৎকর্ষ অধ্যয়নের পাশাপাশি ভোগবিলাসী জীবনধারার অনুকরণের মধ্যে আত্তীকরণের সেই ছাপ সহজেই চোখে পড়ে। ইসলামের সম্প্রসারণ ঘটানোর উদ্দেশে দেশে-দেশে হানা দেওয়ার পর তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন কোরান-হাদিসের বাণী কপচানোর সঙ্গে বাহুর জোর খাটিয়ে ইসলামি রাজ্য ও খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও ইহুদি-খ্রিস্টান-প্যাগান চর্চিত সভ্যতার ধারা রপ্ত করতে না পারলে জাতে উঠা মুশকিল হবে। অগত্যা ওয়াকার এই মতে পৌঁছান, ইসলামের ফ্রেমে বন্দি থেকেও বাস্তববাদী ও ইহজাগতিক মনোভাব গ্রহণ করার কারণে সেকালে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান-সংস্কৃতির প্রতি অঙ্গে অভিনব অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, অন্যথায় মরুভূমির বুকে উটের রাখাল হয়ে আর ক্যারাভান লুটের কাজকারবারে তাঁদের জীবন তামা হতো।

ওয়াকারের ব্যাখ্যাকে যদি সত্য ধরি তাহলে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে মুসলমান শাসকরা (উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে) ইসলামের মৌল বিধানে মোটের ওপর বিরাজিত ছিলেন না সেটা আপনা থেকে প্রমাণ হয়ে যায়। তাঁরা যেহেতু ইসলামে নির্ধারিত বিধানে অটল থাকার পরিবর্তে সমন্বয় অথবা ক্ষেত্রবিশেষে তাকে উপেক্ষা করেছিলেন, সেক্ষেত্রে সভ্যতায় যুগান্তকারী অবদান রাখলেও কোরান-হাদিসের দোহাই দিয়ে যেসব অপকীর্তি তাঁরা করেছেন সেগুলোর দায় আল্লাহ ও মোহাম্মদের ওপর বর্তায় না। দায় এখানে সেইসব ব্যক্তির ওপর চাপে যাঁরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার অজুহাতে এর মূল সংবিধানকে যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করেছেন অথবা এর পরিবর্তে নতুন বিধি (*সুশাসক বাদশাহ আকবর প্রবর্তিত ‘দীন-ই-ইলাহি’ ইত্যাদি) চালু করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। সুতরাং এটা ধরে নেওয়াই যায়, মসনদে থাকার রাজনীতি ও ভোগবিলাস চরিতার্থে হাজার শতাব্দী ধরে ইসলামের মৌল বিধানের প্রয়োগ আর মোহাম্মদ ও চার খলিফার যুগে কোরানের ছকে সমাজ পরিচালনার মাঝে বিলক্ষণ তফাত ছিল। খেলাফতে ফিরতে ব্যাকুল সালাফি ওরফে আসলাফ এবং ইসলামি প্রথাচারে মক্কিযুগে চর্চিত উপসনারীতি ছাড়া বাদবাকি সবকিছুর মূলোচ্ছেদ ঘটাতে অটল ওয়াহাবিরা এই তফাতটি আজও স্বচ্ছতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করতে পারেননি। অন্যদিকে সালাফি ইসলামের বিপরীত স্রোতে অবস্থিত সুন্নি ও শিয়া ধারায় বিরাজিত সুফি ওরফে তাসাউফপন্থীরা আমজনতার কাছে পার্থ্যকটি পরিষ্কার তুলে ধরতে পেরেছেন সে-রকম প্রমাণও যথেষ্ট নয়। সালাফি, সুফি ও ওহাবি ঘরানার সঙ্গে কৌশলগতভাবে সম্পৃক্ত মধ্যপহ্নী সংস্কারবদীদের অবস্থাও সেখানে তথৈবচ! তাঁদের এই সামগ্রিক অক্ষমতার কারণে চরমপন্থী ইসলামের উত্থান গতি পেয়েছে এবং প্রতিক্রিয়া স্বরূপ অ্যান্টি-ইসলামিস্টরাও ঝাঁকে-ঝাঁকে জন্ম নিচ্ছেন।

ইসলামি জীবনাচারের ভিত্তি সুন্নাহ অর্থাৎ ইমান-আকিদা-আদাব-তাকওয়ার অনুশীলন এবং স্রষ্টার মৌল প্রকৃতির আধ্যাত্মিক অন্বেষণ সংশ্লিষ্ট জ্ঞানচর্চায় মুসলমানরা অবদান রেখে চলেছেন সেটা সকলেই স্বীকার করেন। অন্যদিকে ইহজাগতিক জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত মানব-বিরচিত শাস্ত্রের অনুশীলন ও সেখানে সৃজনশীল অবদান রাখার যজ্ঞেও তাঁদের অবদান ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত। সমাজে বসবাস করার স্বাভাবিক নিয়মে সুদীর্ঘ কালপর্ব জুড়ে তাঁরা অন্যের থেকে নিয়েছেন এবং নিজেরা সেখানে বিনিময়ী হতে কার্পণ্য করেননি। এতদসত্ত্বে ইসলামি জীবনধারা ও সংস্কৃতি চর্চার হাজার বছরের ইতিহাসে যে-ছিদ্র বিরাজমান থেকে গেছে সেটা হলো একজন মুসলমানের জীবনে মৌল উৎস কোরান তার আত্মপরিচয়কে কীভাবে নির্ধারণ করে সে-রূপরেখা ইসলামি ঘরানায় সক্রিয় বিদ্বানরা জগতের সকল মতপথের মানুষের কাছে স্বচ্ছতার সঙ্গে পৌঁছে দিতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে বোকাসোকা কিছু প্রশ্নের ছলে বোধহয় খানিক বিস্তারিত হওয়া যায় :—

প্রশ্ন হলো মুসলমান বলতে মানুষ কাকে বুঝবে? ফিতরাতে অটল থাকার জন্য কোরান ও হাদিস নির্ধারিত বিধান যার সঙ্গী তার নাম কি মুসলমান? জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি ফিতরাতে অটল থাকলেও অন্য ধর্মে বিরাজিত ব্যক্তিকে কি নামে ডাকবে মানুষ? দু-জাহানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ব্যক্তি কি মুসলমান? নাকি শুধু আল্লাহর কোরান ও নবির হাদিসে স্বীকৃত দু-জাহানে বিশ্বাসী লোকটি মুসলমান? মুসলমান বলতে আসলে কাকে বুঝবে মানুষ! কোরানে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত স্বাধীনতার সীমানা আমল করে যার দিন কাটে সে যদি মুসলমান হয়, স্রষ্টা কর্তৃক শর্তাধীন স্বাধীনতাকে অন্য ধর্মে বিরাজ করেও যে-ব্যক্তি স্বীকার যায় সে কি মুসলমান নয়?

ধরায় মানুষের জীবন পরীক্ষার অধীন এবং এর ফলস্বরূপ পরজগতে তার জন্য রয়েছে পুরস্কার, এই বিশ্বাসে ভর করে যার দিন কাটে সে ব্যক্তিটি তাহলে কে? স্রষ্টার প্রতি ইমান, প্রেরিত বার্তাবাহকদের প্রতি আদাব, এবং ঐশী বাণী কর্তৃক নির্দিষ্ট আচারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ব্যক্তির পরিচয় সেখানে কী? প্রতিকূল পরিস্থিতির চাপে কোরান-সুন্নাহা নির্ধারিত জীবন থেকে সরে এসেছে এমন লোক কি মুসলমান গণ্য হতে পারে? জীবন স্রষ্টার পরিকল্পনার অধীন এবং দুঃখ-কষ্ট-জরার শৃঙ্খলে বাঁধা, এই সত্যটি যে কবুল করেছে তাকে মুসলমান মানতে আপত্তি কোথায়? ইহজীবন অশেষ দুর্ভোগ ও যাতনার ভাগাড় জেনে সেখান থেকে উঠে আসতে উদ্যমী লোক কি তাহলে অন্য কেউ, সে কি মুসলমান নয়?

আপাত সরল এই প্রশ্নগুলো একে অন্যের অনুরূপ মনে হলেও তারা আসলে অনুরূপ নয়। প্রতিটি প্রশ্নে নিহিত বৈশিষ্ট্য উত্তম মানুষ রূপে সমাজে নিজের আত্মপরিচয় নির্ধারণের তরিকা বাতলে দিলেও উত্তম মানুষ আর উত্তম মুসলমান সম্ভবত এক বস্তু নয়। উত্তম মুসলমান এখানে সেই ব্যক্তির উদাহরণ হয়ে আসে যে কিনা বুঝ হওয়ার পর থেকে তাওহিদের চিহ্ন ফিতরাতে নিজেকে অটল রাখতে পেরেছে, যেখানে তার সমগ্র সত্তা কোরান নির্দেশিত স্রষ্টার বিধান ও উপাসনায় নিমগ্ন থাকে ও সেই অনুসারে জীবন কাটায়। মুসলমান হচ্ছে সেই লোক যাকে এটা মেনে নিতে হচ্ছে, সে এমন এক মালিকের ক্রীতদাস যাঁর অস্তিত্ব আজও প্রমাণিত নয় এবং ভবিষ্যতে প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ! দ্বিতীয়ত, মালিক ও তাঁর বিধি-বিধান সম্পর্কে যিনি তাকে অবহিত করেন তাঁর কথার বিশ্বাসযোগ্যতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়, তথাপি একে প্রমাণিত ধরে শেষ নিঃশ্বাস অবধি ক্রীতদাসের জীবন কাটাতে সে বাধ্য। ইহজাগতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও যুক্তির পরিপন্থী সুকঠোর নিয়তিবাদের এই শৃঙ্খলে সে যদি বিশ্বস্ত ও অটল থাকে তাহলে সে মুসলমান; অন্যথায় সে হয়তো উত্তম মানুষ কিন্তু মুসলমান নয়। সোজা কথা, যে-ব্যক্তি খাঁটি মুসলমান হতে পেরেছে সে আপনা থেকে সাচ্চা ইনসানে পরিণত হয়, কিন্তু যে তা নয় সে ইনসান হিসেবে খাঁটি হলেও ইসলামের পরিভাষায় তাকে মুসলমান বলার সুযোগ ক্ষীণ। যারপরনাই সদৃশ প্রশ্নগুলোর মধ্য থেকে একজন ব্যক্তিকে (*যে কিনা মুসলমান হতে চায়) সেগুলো বেছে নিতে হবে যা তাকে সবার আগে মুসলমান হওয়ার সুযোগ করে দেবে। ইনসান হতে চাইলে আগে মুসলমান হওয়ার পরীক্ষায় তাকে পাশ যেতে হবে, অন্যথায় উত্তম ইনসান হওয়া সত্ত্বেও সে-ব্যক্তি কাফের রয়ে যাবে।

তো এই দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করি তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কোরানের বিধান অনুসারে মুসলমান বলতে কী বুঝব? নামে মুসলমান কিন্তু কামে অন্য কিছু, এমন মুসলমানের স্পষ্ট রূপরেখা ইসলামি জ্ঞানচর্চায় কি সত্যি ধরা পড়ে? তর্কের খাতিরে সালাফি মতে মাথা ঝুঁকিয়ে নবি ও ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’র যুগকে প্রকৃত মুসলমান ও ইনসানের নিদর্শন গণ্য করি, সেক্ষেত্রে মুসলমানি দীনের সম্প্রসারণ কাল থেকে এখন অবধি ইসলামে যাঁরা অবদান রেখে গেলেন এবং দীনচর্চায় জারি থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্পকলায় সমৃদ্ধ ইসলামি স্বর্ণযুগ উপহার দিলেন, সেইসব ব্যক্তি কি উত্তম মুসলমান ছিলেন না? নাকি এটা মানতে হবে, সন্দেহাতীতভাবে তাঁরা উত্তম মানুষ ছিলেন এবং ইসলামের জন্য প্রাণপাত করে গেছেন কিন্তু প্রকৃত মুসলমান হওয়ার কঠোরতা জীবনে সকল ক্ষেত্রে বহন করতে পারেননি? ঘটনা যদি সেরকম হয়ে থাকে তাহলে একালের কট্টর থেকে উদারপন্থী বিদ্বানরা যখন ইসলামি স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন সেখানে তার ভিত্তি নিয়ে মনে গোল বাঁধে।

প্রশ্ন জাগে বৈকি, — কোন স্বর্ণযুগকে বিদ্বানরা ফিরিয়ে আনতে চাইছেন? নবি থেকে ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’ অবধি সম্প্রসারিত যুগ অথবা পরবর্তী অনধিক হাজার বছর ধরে আবর্তিত যুগ? বিষয়টি স্বচ্ছতার সঙ্গে বিশ্লেষিত না হওয়ার ফলে আসলাফ হতে মরিয়া ব্যক্তি তার যুগ-কাল-পরিপার্শ্ব খারিজ করে খেলাফতের খেজুর পাতায় ছাওয়া কুটিরে ফেরত যেতে চায়! অন্যদিকে তাসাউফে বিশ্বাসী ব্যক্তি খেলাফত থেকে সমগ্র ইসলামি স্বর্ণযুগের পরিধির মধ্যে বসে নিজেকে মুসলমান বলে দাগায়। আবার তাওফিক হমিদের মতো সংস্কারপন্থী মডারেট সম্পূর্ণ বিপরীত ও প্রতিকূল জীবনধারার মধ্যে বিরাজিত ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বিপরীতের সঙ্গে সহাবস্থান এবং ক্ষেত্রবিশেষে আপসের মাধ্যমে মুসলমান শব্দটিকে পাঠ যেতে উতলা হন। যেখানে শাহাব আহমেদের মতো ব্যক্তিও বিরাজ করেন যিনি যুগ-কাল-দেশাচার ভেদে বিকশিত ইসলামের সকল শাখা-প্রশাখাকে অতিকায় ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের সমষ্টি রূপে চিহ্নিত করেন এবং তার সকল স্বরূপকে একত্র করে দীনিয়াত ও ইনসানিয়াতের সংজ্ঞা বুঝে নিতে চান। এইসব মতবিরোধের কারণে ইমানে অঙ্গীভূত মুসলমান ও মুসলমানে দ্রবীভূত ইনসানের সুস্পষ্ট দাড়াদিশা ইসলামি ঘরানায় সক্রিয় বিদ্বানরা বিপুল আমজনতার নিকট হাজির করতে পেরেছেন কি না সে-প্রশ্নটি অমীমাংসিত রয়ে যায়!

এ এমন এক সমস্যা যার কারণে পশ্চিম তথা সমগ্র বিশ্বে অন্য ধর্মে বিশ্বাস করেন এমন মানুষ ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’ বাক্যে আপত্তি জ্ঞাপন করেন নতুবা তাদের মনে এ-নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। মুসলমানের সংজ্ঞাটি যেহেতু পরিষ্কারভাবে তাদের নিকট পৌঁছানো হয় না কাজেই মুসলমান বলতে কট্টর ও ফিতনাবাজ সম্প্রদায়ের ছবি তাদের চোখে ভাসে যারা পশ্চাদপদ এবং ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও যুদ্ধ ভালোবাসে! এমনকি সেখানে রিচার্ড ডকিন্সের মতো সুবেদী ব্যক্তির দেখা মিলে যাঁরা এখন ইসলামকে যুদ্ধবাজ ধর্ম ছাড়া দ্বিতীয় বিশেষণে ভাবতেই পারেন না! নিজের আত্মপরিচয় স্পষ্ট করতে না-পারার জের ধরে বিশ্ব জুড়ে মুসলমানদের দল-উপদলে বিভক্ত হওয়া এবং নিজের মতের অনুকূলে কোরান-হাদিসকে ব্যবহার করার প্রবণতা তালগোল পাকানো সেই পরিস্থিতির জন্ম দিয়ে চলেছে যার দায়ভার এখন আল্লাহ ও মোহাম্মদকে বহন করতে হচ্ছে! এই ডামাডোলের তোড়ে অন্য ধর্মে বিশ্বাস করেন, সংশয়ী বা নস্তিক, সেক্যুলার ও উদারপন্থী, সর্বোপরি ফেমিনিস্ট … কারও অবসর নেই তলিয়ে দেখার ধরায় ধর্ম প্রচারের ধারাবাহিকতায় আবিভূর্ত কোরান আসলে মুসলমান ও ইনসানকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকে এবং সেখানে গোলযোগ তৈরির কার্যকারণ ও দায়ভার সত্যিকার অর্থে কাদের ঘাড়ে বর্তায়! ফ্যাসাদ এখন জটিল ও মাটির গভীরে শিকড় ছড়ালেও কোরান নির্ধারিত মুসলমানের সংজ্ঞা মানুষের অন্তরে বিদ্বানরা যদি পৌঁছে দিতে না পারেন সেক্ষেত্রে মুসলমান সম্পর্কে বিদ্যমান নেতিবাচক মনোভাবের ধারা পালটানো সম্ভব বলে বিশ্বাস হয় না!

মানব স্বভাবের ভালোমন্দ সম্পর্কে ঘটনাবহুল কোরানে অসংখ্য আয়াত রয়েছে, তবে সত্যিকার মুসলমানের সংজ্ঞা খুঁজতে অধিক দূরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, সূরা ‘বাকারাহ’-র ২৪৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ সেই ইশারা ব্যক্ত করেন :—

‘কে সে, যে আল্লাহকে করজে হাসানা প্রদান করিবে? তিনি তাহার জন্য উহা বহুগুণে বৃদ্ধি করিবেন। আর আল্লাহ সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করেন এবং তাঁহার পানেই তোমরা প্রত্যানীত হইবে।’ — উৎস : বাকারাহ; ;২৪৫; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ

‘Who is he that will loan to God a beautiful loan which God will double unto his credit and multiply many times? It is God that giveth (you) want or plenty and to Him shall be your return.’ — Source: The Holy Quran; Translated by A. Yusuf Ali; quranyusufali.com.

‘করজে হাসানা’ অর্থাৎ সুদবিহীন ঋণদানের প্রসঙ্গ কোরানের একাধিক সূরায় (*‘মায়িদাহ’ ৫:১২; ‘আল-হাদিদ’ ৫৬: ১১, ১৮; ‘তাগাবূন’ ৬৪:১৭) ঘটনাছক মেনে উল্লেখিত হয়েছে। আলী সিনা ও তাঁর ভক্ত আশেকানগণ অবশ্য বান্দার কাছে আল্লাহর এই ঋণ চাওয়ার ঘটনা নিয়ে ঠেসমারা বাক্যবাণ আর ঠাট্টা-বিদ্রুপে নেট সয়লাব করে ছেড়েছেন। যদিও ‘করজে হাসানা’ একদল লোভী মানুষ কর্তৃক প্রণীত দাদন ও মহাজনি প্রথার ছকে বন্দি মুক্তবাজার অর্থনীতি নামক সামাজিক ব্যবস্থায় অবশিষ্ট মানুষগুলোর ক্রমাগত উচ্ছন্নে যাওয়া ও শোষিত হওয়ার শৃঙ্খলকে উপহাস করে যায়! সুদভিত্তিক ঋণচক্রে মানুষকে বেঁধে ফেলা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ইসলাম এ-ব্যাপারে কঠোর। হাদিস ঘাঁটলে এই প্রমাণ মিলে মোহাম্মদ সুদকে বিচিত্র নিরিখে পাঠ করেছেন, যেখানে কৃষিপণ্য বাজারে আসার পথে শস্তা দামে ক্রয় করা ও বাজারে বাড়তি মূল্য ধার্য করে বিক্রি করাকে জঘন্য কাজ বলেই নিন্দা করে গেছেন। তাঁর ‘লাতন’ সেইসব লোকদের প্রতি ছিল যারা ফটকাবাজ ও মধ্যস্বত্বভোগী, যারা ন্যায্যমূল্যে বাজারে পণ্য সরবরাহের পরিবর্তে মধ্যপথে বাড়তি মূল্য সংযোজন ও তা উশুল করে, এবং একালের হাদিসবেত্তারা একে সুদের সঙ্গে মিল করেই পাঠ যান ও ‘হারাম’ গণ্য করেন। এখন বাংলাদেশের মতো ইসলামের ধ্বজাধারী কোনও রাষ্ট্রে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যক্তিরা মুসলমান যদি হয়েও থাকেন এবং জীবনে কারও কোনও উপকার করে থাকেন, ইসলামি শরিয়ার বিচারে তাদের অপরাধের মাত্রা তাতে কমে যাবে না।

সেমিটিক ধর্মের ইতিহাসে সুদ ভিত্তিক লেনদেনকে অপরাধ হিসেবে কোরান প্রথম গণ্য করল এমন নয়, ইহুদি সম্প্রদায় সুদ ভিত্তিক লেনদেনের ছকে সুবিধাজনক ব্যাখ্যা (*নিজ গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে সুদ নিষিদ্ধ তবে অন্যদের সঙ্গে চলতে পারে ইত্যাদি।) তৈরি করে নিলেও তাওরাতের পাতা উলটালে সুদ সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা চোখে পড়ে :—

‘যদি আমার লোকেদের মধ্যে কেউ দরিদ্র হয় এবং তুমি তাকে কিছু টাকা ধার দাও, তাহলে ওই টাকার ওপর কোনও সুদ দাবি করো না অথবা তাকে সুদ দিতে বাধ্য করো না। সুদ দিয়ে যে টাকা দেয় তার মতো ব্যবহার করো না।’ — তাওরাত; যাত্রা পুস্তক; ২২:২৫;

‘তাকে তোমরা ধার দিতে পারো এমন কোনও অর্থের ওপর সুদ তার কাছ থেকে নিও না। …  তাকে ধার দিয়েছ এমন কোনও অর্থের ওপর কোনও সুদ তার কাছ থেকে নিও না এবং তাকে বিক্রি করছে এমন খাদ্য থেকে লাভ করার চেষ্টা করো না।’ — তাওরাত; লেবীয় পুস্তক; ২৫:৩৬-৩৭;

‘তুমি যখন কোনও ইসরায়েলীকে কিছু ধার দাও, তখন সুদ ধার্য করো না। টাকা, খাবার, বা অন্য যা-কিছুই সুদ আদায়ে সক্ষম তার ওপরে তোমরা সুদ ধার্য করবে না। তোমরা কোনও বিদেশির কাছ থেকে সুদ নিতে পারো, কিন্তু তোমরা কোনও ইসরায়েলীর কাছ থেকে সুদ নিও না। — তাওরাত; অন্যান্য বিধিসকল; ২৩:১:১৯-২০;

‘সেই লোক অপরের অবস্থার সুযোগ নেয় না। কেউ ধার চাইলে সে বন্ধক দিয়ে তাকে ধার দেয়। আর ধার শোধ করলে তাকে সেই বন্ধক ফিরিয়ে দেয়। … সে কাউকে টাকা ধার দিলে সুদ নেয় না। সেই সৎ লোক খল হতে অস্বীকার করে। … সেই দুষ্ট সন্তান সুদের লোভে ঋণ দিয়ে সুদ দিতে বাধ্য করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে সেই দুষ্ট পুত্র বাঁচবে না। সে জঘন্য কাজ করেছে বলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। এবং তার মৃত্যুর জন্য সেই দায়ী হবে।’ — তাওরাত; যিহিস্কেল; ১৮:৪:৭-৮, ১৩;

উৎস : পবিত্র তাওরাত; বঙ্গানুবাদ; উৎস : পিডিএফ সংস্করণ

সুদভিত্তিক লেনদেন ও ‘করজে হাসানা’ বিষয়ে তাওরাত ও কোরান প্রায় অভিন্ন স্বরে নিদান হাঁকলেও তাওরাতে নিষেধাজ্ঞার মাত্রা তীব্র নয়। ইহুদি সম্প্রদায়, গরিব অসহায় এবং ক্রীতদাসদের বেলায় ধার দেওয়ার নামে সুদ গ্রহণকে সেখানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কোরানে নিষেধাজ্ঞার ডিগ্রি যেমন চড়া, সুদ ভিত্তিক সকল প্রকার লেনদেন সর্বজনীনভাবে ‘হারাম’ বলে রায় প্রদানের সঙ্গে ‘করজে হাসানা’-র চর্চায় জারি থাকতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আলী সিনা-রা একে ঠাট্টাতামাশার খোরাক করে তুলতে পারেন কিন্তু তমসুকের চক্রে বাঁধা সমাজব্যবস্থায় আমজনতার পেপার মানি বা কাগুজে মুদ্রার ফাঁস গলায় ঝুলানোর কুফল তো মার্ক্স সফলভাবেই ব্যাখ্যা করে গেছেন এবং তাঁর ব্যাখ্যার প্রাসঙ্গিকতা আজও অমলিন। কাগুজ মুদ্রার বিকল্প হিসেবে অধুনা ইলেকট্রনিক ট্রানজেকশন বা বিট কয়েন ইত্যাদির প্রচলন পুরাতন সেই ফাঁসের নতুন সুরত ছাড়া অন্য কিছু নয়। সুদভিত্তিক অর্থনীতির ঘুণপোকা মানুষকে কী করে দেউলিয়া ও অসহায় করে তুলেছে সেটা করোনা মহামারির কারণে টাকার মূল্য হ্রাস ঠেকাতে মরিয়া বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য দাতাসংস্থার সুদভিত্তিক লেনদেনকে নতুন ছকে সচল করার তৎপরতার দিকে দৃষ্টি দিলে অনায়াসে টের পাওয়া যায়!

ইসার সময়ে প্যাগান রোমানদের সঙ্গে মিলে ইহুদি সম্প্রদায় ব্যবসার যে-ধারা চালু রেখেছিল সেখানে চক্রাকারে বাড়তি মূল্য সংযোজন ও তা উশুল করা হতো, এই অশুভকে ধ্বংসের মিশন নিয়ে তিনি ধরায় গমন করেছিলেন। মোহাম্মদের চেয়ে ঈসার নিদান কোনও অংশে কম কঠোর ছিল না যখন তিনি লেনদেনের কলুষিত ব্যবস্থা উচ্ছেদের লক্ষ্যে স্রষ্টা ও তাঁর প্রেরিত বার্তাবাহকের নামে বিদ্রোহের নিশান উড়ান। ‘মথি’র অধ্যায় ১০-এ ক্ষমা, করুণা ও মানবিকতার অমলিন প্রতীক স্বভাব ভবঘুরে ঈসার অগ্নিশিখাসম উক্তিনিচয় এইবার পাঠ করা যাক :—

‘অতএব, যে-কেউ লোকদের সামনে আমাকে স্বীকার করে, আমিও আমার স্বর্গস্থ পিতার সামনে তাকে স্বীকার করব। কিন্তু, যে-কেউ লোকদের সামনে আমাকে অস্বীকার করে, আমিও আমার স্বর্গস্থ পিতার সামনে তাকে অস্বীকার করব। তোমরা মনে কোরো না, আমি পৃথিবীতে শান্তি দিতে এসেছি; আমি শান্তি দিতে নয়, বরং খড়গ দিতে এসেছি। কারণ আমি বাবা ও ছেলের মধ্যে, মা ও মেয়ের মধ্যে এবং শাশুড়ি ও পুত্রবধূর মধ্যে বিভেদ জন্মাতে এসেছি। আসলে, একজন ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরাই তার শত্রু হবে। যে-কেউ তার বাবা অথবা মাকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে, সে আমার শিষ্য হওয়ার যোগ্য নয়; আর যে-কেউ তার ছেলে অথবা মেয়েকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে, সে আমার শিষ্য হওয়ার যোগ্য নয়। আর যে-কেউ নিজের যাতনাদণ্ড তুলে নিয়ে আমাকে অনুসরণ না করে, সে আমার শিষ্য হওয়ার যোগ্য নয়। যে-কেউ নিজের জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করে, সে তা হারাবে এবং যে-কেউ আমার জন্য নিজের জীবন হারায়, সে তা রক্ষা করবে।’ — উৎস : মথি; ১০:৩২৩৯; পবিত্র বাইবেল; জেডাব্লিউডটওরগ

ইসার উক্তিনিচয় অন্যভাবে সূরা ‘বাকারাহ’-য় স্রষ্টা কর্তৃক সৃষ্টির কাছে ঋণ চাওয়ার ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। ‘করজে হাসানা’ কোরানের মনোহর রূপকের একটি যেখানে একেশ্বরবাদী ধর্মের কঠোর ছক থেকে বেরিয়ে স্রষ্টা আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট বান্দার কাছে কোমলস্বরে ধার চাইছেন! মনে প্রশ্ন জাগে যিনি সকল ‘অভাব থেকে মুক্ত’ তিনি ধার চাইতে যাবেন কেন? উত্তরটি সরল, ধার চাওয়ার ছলে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্ট জীবের আনুগত্যের পরীক্ষা নিয়ে নিচ্ছেন। স্রষ্টার একত্বের প্রতি বিশ্বাস এবং যেসব নির্দেশনা মুসলমান হওয়ার শর্ত বলে তিনি কোরানে নির্দিষ্ট করে দিলেন তার প্রতিটি ধরায় আগমনের পর নিজের মধ্যে সে সচল রাখতে পেরেছে এটা নিশ্চিত হতেই যেন ‘করজে হাসানা’-র কথা আল্লাহ তাঁর বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন! তিনি কিছু গুণ তাকে ধার হিসেবে দিয়েছেন এবং সে যদি কাজে না লাগায় তবে গুণগুলো তিনি ফিরিয়ে নেবেন; পক্ষান্তরে সে যদি এগুলোর অনুশীলনে নিজেকে সচল রাখে তাহলে সেখানে নতুন কিছু যোগ হতেও পারে। বান্দাকে মানুষ রূপে ধরায় পাঠানোর সময় তাওহিদের গুণসূচক যেসব বৈশিষ্ট্য তিনি কোডিং করে দিলেন সেগুলোর সমষ্টি এই ‘করজে হাসানা’। বান্দা যদি ‘করজে হাসানা’-কে সচল রাখে তাহলে বোঝা যাবে ইবলিশ তাকে বিগড়ে দিতে পারেনি এবং সে ‍মুসলমান হওয়ার পথেই হাঁটছে।

মনে রাখতে হবে ইসলামে আল্লাহর সঙ্গে তাঁর সৃষ্টির সংযুক্তি বেদের পরব্রহ্মর মতো শর্তবিহীন নয়। বৈদিক পরব্রহ্ম উদাসীন নির্বিকার। বোঝা মুশকিল বৃহৎ নির্বিকারে সৃষ্টির গতি আসলে কী করে হবে। এই দুর্ঘটের কারণে সনাতন হিন্দু ধর্মে পরব্রহ্মর নির্যাস শোষণ করে মানুষ যাঁর কাছে চাইতে পারে সেরকম ভগবানের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছিল। হিন্দু ধর্মে বাসনা শূন্য কর্মফল হচ্ছে ‘করজে হাসানা’-র প্রতীক। সে-ব্যক্তি উত্তম হিন্দু যে ফলের আশা না করে ব্রহ্ম উপাসনায় নিজেকে উৎসর্গ করে এবং তার সকল জাগতিক কর্মে তার প্রকাশ ঘটায়। ইসলামে এর প্রকাশরীতিটা কেবল ভিন্ন। এই একেশ্বরবাদ সৃষ্টিকে সচেতনভাবে নিরীক্ষণ করে। সৃষ্টি যদি ঘড়ি হয়ে থাকে তবে তার প্রতিটি কলকব্জা ঠিকঠাক কাজ করে কি না সে ব্যাপারে স্রষ্টার প্রখর নজর জারি থাকায় এহেন ঈশ্বরে নিজের মন সুস্থির করা কঠিন। বেদে সৃষ্টির উদ্দেশ্য অস্পষ্ট প্রহেলিকার মেঘে ঢাকা থাকে। কোরানে সৃষ্টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দ্বারা র্নিধারিত, যেখানে আদর্শ মানব হওয়ার মধ্যে বনি আদমের দায়িত্ব ফুরিয়ে যায় না, তাকে স্রষ্টা প্রদত্ত ও নির্ধারিত গুণসমূহ জীবনের প্রতি পদে সক্রিয় রাখতে হয়, কারণ স্রষ্টা তাকে এগুলো ধার দিয়েছেন ব্যবহারের জন্য, তিনি যখন ফেরত চাইবেন পুরোটা চাইবেন। কাজেই এ-কথা বলা যায় ‘করজে হাসানা’-র জন্য নিজেকে যে উপযুক্ত করতে পেরেছে সে হচ্ছে সাচ্চা মুসলমান।

সিনাদের সমস্যা হচ্ছে তাঁরা মুসলমানের সংজ্ঞা আর যুগযুগান্তর ধরে সেই সংজ্ঞার বিচ্যুতিকে পৃথক পরিসরে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আজও উপলব্ধি করেন না। ‘আকল’-এর এই সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতার কারণে মোহাম্মদ প্রচারিত ইসলাম তাঁদের কাছে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হয়েই আসে। ধর্মের মৌল বাণী আর তার অজ্ঞতা প্রসূত অথবা উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার এক কথা নয়। জগতে প্রচারিত সকল ধর্মের বেলায় এটা সমান প্রযোজ্য। অপ্রমাণিক বিশ্বাসের ওপর দাঁড়ানো এই টেক্সট আর তার উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারকে পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করতে না পারলে ফিতনা মিটে না। মনে রাখা উচিত, বিজ্ঞানকে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থে ব্যবহারের দায়ভার বিজ্ঞানীরা যখন রাষ্ট্রসংঘ ও রাজনীতির ওপর চাপান সকলে তা বিনা বাক্যে মেনে নেয়। অথচ জিহাদের নাম করে ইসলামের মৌল বাণীর উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ নিয়ে রাষ্ট্রসংঘ ও রাজনীতির দিকে আঙুল তুললে সিনাদের মতো অনেকে সেখানে মারমুখী হয়ে পড়েন! তাদের মনোজগতে এই তরঙ্গটি ওঠে না, কোরানে গমন করে আগে জিহাদের পটপ্রবাহ যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন, তারপর না হয় মিলিয়ে নেওয়া যাবে জিহাদের নাম করে বিশ্বে এখন যা চলছে তার কতটা কোরান সম্মত আর কতখানি অজ্ঞতা প্রসূত গোঁড়ামি ও মসনদ কেন্দ্রিক রাজনীতির উপজাত! এমনকি যাঁরা কোরান জিহাদ সম্পর্কে কী বলেছে সেই খোঁজে সেখানে গমন করেন তাঁরা মোহাম্মদের জীবনকাল ধরে সংঘটিত যুদ্ধ-বিবাদকে আক্ষরিক ও প্রচলিত ছকে ধরে পাঠ যান, ফলে বর্তমানে চলমান জিহাদের প্রকৃতির সঙ্গে নবির জীবন দশায় সংঘটিত ঘটনাবলীর পার্থক্যটি তাঁদের ভাবনায় সেভাবে ধরা পড়ে না।

কোরানের বাণী ও নবির হাদিস সূত্রে পাওয়া বিধানের সঙ্গে শাসক কর্তৃক এর বিপরীত ব্যবহার, সম্পূর্ণ পৃথক দুই ঘটনাকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে সকল দায়ভার যাঁরা আল্লাহ ও মোহাম্মদের ঘাড়ে চাপাতে ইচ্ছুক তাঁরা সত্য অনুসন্ধানের পন্থাকেই গলা টিপে হত্যা করেন। ইসলাম সমালোচক আয়ান হিরসি আলী’র কথাটি তাই প্রনিধানযোগ্য, — ইসলামের মৌল বাণীর দার্শনিকতা আর ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে সৃষ্ট প্রেক্ষাপটকে পৃথক পরিসরে ভাগ করে আলোচনার সময় হয়েছে। যুগের বিবর্তনে তারা পৃথক গতি লাভ করায় বিষয়টি বিবেচনা না করে ইসলামকে যাঁরা কামান দাগতে বসেন তাঁরা খেয়াল করে উঠতে পারেন না কোরানের মৌল বাণী কী করে এর রাজনীতিকায়নকে সবসময় কনডেম করে যায়। সুতরাং মসনদে জারি থাকার বাহানায় কোরান ও নবির মৌল বিধান কখন কীভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং এর ফলে মুসলমান শাসকরা কেন ইসলামে চরমপন্থার উত্থানে ভূমিকা রেখে গেছেন বা এখনও রাখছেন ইত্যাদি ভাবনা অনুসরণ করে যদি অগ্রসর হওয়া না যায় তবে বুঝের ভুল শুধরে নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। আলী সিনা-রা কাজটি করেন কি না সে-প্রশ্ন তাই ওঠে।

ইসলামকে ধরা থেকে বিদায় করার মিশনে অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে গোলযোগ থাকার বড়ো কারণ হচ্ছে তাঁদের পঠন-পাঠনের উৎস কোরান-হাদিসের তরজমা ও ইংরেজি সায়েবসুবো বিরচিত বইপত্রের ওপর প্রধানত নির্ভরশীল। এই পঠনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য কিন্তু মানুষের বিশ্বাস ও আবেগ যেসব বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হয় সেখানে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে সুবিবেচনা জরুরি। অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের কতজন আয়াত ধরে কোরান আরবিতে পাঠ করে থাকেন এবং এ-সংক্রান্ত ব্যাখ্যা-মতামত যাচাই শেষে নিজের সিদ্ধান্ত হাজির করেন সে-সন্দেহ অগত্যা মন থেকে মুছে ফেলা কঠিন হয়।

পঞ্চম প্রবাহের দ্বিতীয় ভাগে আলোচিত কোরান পাঠ ও তরজমার প্রসঙ্গটি এখানে স্মরণ না করে পারছি না। তরজমা সূত্রে কোরান পাঠ করতে যেয়ে কতরকম গোল বাঁধে তার বাখান তুলে ধরার সময় কোরান গবেষক ল্যাজলি হ্যাজিলটনের কথা বাদ পড়ে গিয়েছিল। কোরান পাঠ ও তার শাব্দিক অর্থব্যঞ্জনা উপলব্ধি ও উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মূল আরবির সঙ্গে অনূদিত ভাষ্যের ব্যবধানের কথা ভাবতে গিয়ে তাঁর কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। হ্যাজিলটনের মতে পার্থক্য গভীর এবং ক্ষেত্রবিশেষে সত্যি মর্মান্তিক! প্রায় দশ বছর আগে Ted Talk-এ হাজির হয়ে নিজের সেই অভিজ্ঞতার বয়ান অনধিক দশ মিনিটের এক বক্তিমায় তিনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন! মোহাম্মদ কেমন লোক ছিলেন সেই অনুসন্ধানের ইতিহাস অজ্ঞেয়বাদী হ্যাজিলটন তাঁর ‘The First Muslim’ গ্রন্থে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। পশ্চিম গোলার্ধের গবেষক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে মোহাম্মদ আসাদের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন। আসাদ যে-কথাগুলো কোরানের স্ব-কৃত তরজমার ভূমিকায় বলে গিয়েছিলেন হ্যাজিলটন সেখানে সমস্যার আরও গভীরে প্রবেশ করেছেন। আমরা যারা আরবি জানি না বলে তরজমানির্ভর কোরান ও তার ব্যাখ্যা পাঠে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি তাঁর বক্তব্য সেখানে মূল আরবি অর্থব্যঞ্জনার সাপেক্ষে কোরান অধ্যয়নে প্ররোচিত করে যায়। জানি না ইসলামকে ধরা থেকে বিদায় করার মিশনে তৎপর আলী সিনারা প্রবীণ এই বিদূষীর হাড়ভাঙা শ্রমের খবর আদৌ রাখেন কি না!

ল্যাজলি হ্যাজিলটনের কোরান পাঠ আমাদের জানায় কী করে মাত্র ২৯টি শব্দের সমষ্টি কোরানের উদ্বোধনী সূরা ‘ফাতিহা’ তরজমায় সত্তুর বা তারও অধিক শব্দে গড়ায় এবং এটা নিয়ে ভাবনা করা কেন গুরুত্ববহ! তাঁর বক্তব্যের সুবাদে ‘ফাতিহা’-র তরজমায় গমন করে দেখি অর্থব্যঞ্জনা ধারণের প্রয়োজনে ইউসুফ আলীকে সেখানে ৭২টি শব্দ খরচ করতে হয়েছে। মোহাম্মদ আসাদ ৮৬ শব্দে তরজমার কাজ সেরেছেন। আলী উনাল কৃত সাম্প্রতিক তরজমায় শব্দ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬! বঙ্গভাষীরা অবশ্য সেদিক দিয়ে ভাগ্যবান। কোরানের ‘মা’ বলে বিদিত সূরার তরজমায় বাংলা অনুবাদককে পাগলপারা হতে হয়নি। ফাউন্ডেশনের তরজমায় শব্দ সংখ্যা ৪২ এবং বাকিগুলোও অধিক নয়, যা মূলের নিকটবর্তী। আরবি থেকে বিভিন্ন ভাষায় তরজমার সময় মূল শব্দের অর্থ ও ভাবব্যঞ্জনা স্পষ্ট করার প্রয়োজনে অনুবাদে অধিক সংখ্যক শব্দ না জুড়ে উপায় থাকে না! এহেন ভাষান্তর দূষণীয় নয় তবে শব্দের এই ক্রমবৃদ্ধি অর্থব্যঞ্জনার সঙ্গে অনেক সময় দূরত্ব তৈরি করে এবং অনুবাদকের অতিকল্পনার দোষে মূল শব্দের অর্থ পালটে যায় নতুবা সেখানে অতিরঞ্জন ঘটে; যারপরনাই আরবি কোরানের সঙ্গে তরজমাকৃত কোরানের ফারাক অমোঘ হওয়ার সঙ্গে ফিতনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শত-শত বছর ধরে ঘটনাটি ঘটনা ঘটে আসছে এবং এভাবে ইসলামকে কেন্দ্র করে জনমনে এমনসব ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যার বস্তুগত ভিত্তি গভীর নয় বা কোরানে গমন করলে তার কোনও হদিশ মিলে না!

মনে রাখা জরুরি, সাহিত্যগুণ ধারণ করলেও কোরান কিন্তু কবিতা বা সাহিত্য পদবাচ্য কোনও বস্তু নয়। কবিতার অনুবাদে একজন অনুবাদক মূল ভাবব্যঞ্জনা ধারণ করতে যেয়ে ভাবানুবাদের সাহায্য নেন, ক্ষেত্রবিশেষে অতিরঞ্জনও সেখানে ঘটে যায়। এসব নিয়ে সাহিত্যিক বাদানুবাদ থাকলেও কবিতা যেহেতু মানুষের বিশ্বাস ও জীবন প্রণালীকে নিয়ন্ত্রিত-নির্ধারিত করে না, জনমানসে এর প্রভাবের মাত্রা সংগত কারণে গভীর বা আমলে নেওয়ার মতো সাংঘাতিক ঘটনা হয়ে ওঠে না। ধর্মীয় টেক্সট সেখানে খুবই পৃথক বিষয়। গীতা-বাইবেল-কোরানের মতো ধর্মীয় টেক্সটের প্রতিটি বাক্য মানুষের বিশ্বাস, প্রথাচার ও মূল্যবোধ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি অনুষঙ্গে প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি তাকে নির্ধারণও করে যায়। কোরানের শব্দ ও বাক্যাংশকে জীবনের ভিত্তি গণ্য করে ধর্মটি যারা পালন করেন এবং যাদের এ-ব্যাপারে দ্বিমত অথবা আপত্তি থাকে তারা এইসব শব্দ ও বাক্যের ব্যাখ্যা অনুসারে নিজের ধারণাটি স্থির করে নেন। সুতরাং কোরানের কোনও একটি শব্দ অথবা আয়াতের তরজমা ও ব্যাখ্যা থেকে এমন ধারণা গড়ে ওঠা মোটেও বিচিত্র নয় যা হয়তো মূল গ্রন্থের সঙ্গে সম্পর্কই রাখে না।

ধর্মীয় গ্রন্থ অনুবাদের মৌলিক সমস্যাটি এখানে প্রকট হয়ে ওঠে। যেমন কোরান তরজমায় আক্ষরিক হতে গেলে এর সুরমাধুর্য ও ধ্বনিব্যঞ্জনার মারাত্মক হানি ঘটে। অন্যদিকে ভাবানুবাদ ও অনুমানের সাহায্যে অগ্রসর হতে গেলে মূল অর্থব্যঞ্জনার অঙ্গহানি ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ফলে উভয়ের মাঝামাঝি ভারসাম্যে স্থির হয়ে তরজমা করতে না পারলে বিপদ এড়ানো মুশকিল হয়ে পড়ে। আলী, আসাদের মতো উচ্চমানের অনুবাদকরা সে-চেষ্টায় ত্রুটি করেননি, তারপরেও কোরানে ‘মুতাশাবিহাত্’ বা নিগূঢ় ব্যাপার-স্যাপার সংশ্লিষ্ট আয়াতের অনুবাদে তাঁরা যে কঠিন গাড্ডায় পড়েছিলেন হ্যজিলটনের গবেষণায় বিষয়টি ওঠে আসে। তাঁর বক্তব্য শ্রবণ করলে বোঝা যায় কোরানের বিশ্বজনীন অনুবাদ ও তফসিরে ঘটনাটি কমবেশি ঘটে চলেছে! আলী সিনাদের মতো কট্টরপন্থী ইসলাম বিদ্বেষীরা কিবোর্ডে বাটন চাপার সময় এই বিষয়টি কতটা কী বিবেচনা করেন সে-সন্দেহ থেকেই যায়! অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের বাখানের সঙ্গে জুড়ে এ-সংক্রান্ত কিছু কথা মনে হচ্ছে পরের প্রবাহে বলাটাই সমীচীন হবে।


ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১১
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১০
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৯
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৮
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৬
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you