ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১৪ || আহমদ মিনহাজ

ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১৪ || আহমদ মিনহাজ

সপ্তম প্রবাহ : অ্যান্টিইসলামিস্ট বাখান : বুদ্ধিবৃত্তিক সংকীর্ণতা : আলী সিনা অন্যান্য


কোরানের আয়াত ব্যাখ্যায় একজন তফসির প্রণেতা নিজের স্বাধীনতার লিমিট বা মাত্রা সম্পর্কে সচেতন কি না বিষয়টি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। ‘মুহকাম’ অর্থাৎ সোজাসরল আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা সেখানে একরকম হবে আবার ‘মুতাশাবিহাত্’ধর্মী আয়াতের ব্যাখ্যায় তাঁকে তাসাউফ বা সেই আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টির শরণ নিতে হতে পারে যা আরবি ভাষা, ইসলামি ঐতিহ্য ও স্থানিকতা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান ছাড়া রপ্ত করা কঠিন। এহেন আয়াতের তরজমা, টীকাভাষ্য ও ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ তফসির প্রণয়নে অনুমানের সাহায্য নেওয়া দোষণীয় নয় তবে পাঠকের কাছে পরিষ্কার হওয়া চাই যে এখানে অনুমানের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। অন্যথায় ভুল বোঝা ও ফিতনার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে।

বক্ষ্যমাণ রচনায় (*দ্রষ্টব্য তৃতীয় প্রবাহ ১ ও ২) যেমন জিন, ফেরেশতা ও নবিগণকে একালের বৈজ্ঞানিক ভাবনা ও প্রযুক্তির কল্যাণে সৃষ্ট কিছু বিষয়ের উপমায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে এ-কথা মনে রেখে, এতদসংক্রান্ত ব্যাখ্যাগুলো অনুমান নির্ভর এবং সত্য নাও হতে পারে। শুধু কোরান নয়, যে-কোনও ধর্মীয় টেক্সটের দোহাই দিয়ে রেফ্রেন্স ছাড়ার আগে এইসব খুঁটিনাটি খেয়াল করা প্রয়োজন, যা অবেলায় পৌঁছে ঠেকে শিখছি বলা যায়। আরবি কোরানে হুর ও বেহেশত প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে যেয়ে হ্যাজিলটন যেমন বলেছেন আরবি কোরানের অনুবাদ ও ব্যাখ্যার সুবাদে হুর ও বেহেশত সম্পর্কে জনমানসে যেসব ধারণা গড়ে উঠেছে তার দৃশ্যমান কোনও ভিত্তি তিনি কোরানে খুঁজে পাননি। তাঁর বক্তব্যের নির্যাস ও সেই সূত্রে লেখককৃত যৎসামান্য অনুসন্ধানের সারসংক্ষেপ বোধহয় এখানে তুলে ধরা যায় :—

পবিত্র কোরানে হুর সংশ্লিষ্ট আয়াতের সংখ্যা একডজনের কিছু বেশি হতে পারে। সূরা ‘ওয়াকিয়াহ’, ‘নাবা’, ‘দুখান’, ‘আত-তূর’, ‘আস-সাফাফাত’ ও ‘রহমান’-এ জান্নাত সংক্রান্ত বিবরণের অংশ হিসেবে হুর সম্পর্কে ইঙ্গিতমূলক কিছু ধারণা প্রদান করা হয়েছে। হ্যাজিলটন সমগ্র কোরানে মোট চারবার ‘হুর’ (*houris) শব্দটির সরাসরি উল্লেখ খুঁজে পেয়েছেন এবং বিজ্ঞ আলেমরাও এ-ব্যাপারে সহমত পোষণ করেন বলেই জানি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বঙ্গানুবাদে গমন করলে হ্যাজিলটনের দাবির সত্যতা মিলে, যদিও ফাউন্ডেশনের অনুবাদে সূরা ‘আস-সাফফাত’-র ৪৮ নাম্বার আয়াতে হুর শব্দের সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও অনুবাদক ‘আয়তলোচনা’র সাপেক্ষে ‘হুরি’ শব্দটি ব্যবহার করায় সংখ্যা পাঁচে গিয়ে ঠেকেছে, এবং এরকম আরও কিছু প্রয়োগ থাকা বিচিত্র নয়। কোরানের বাংলা অনুবাদ ঘাঁটলে হুর শব্দের দুই ধরনের নজির সচরাচর চোখে পড়ে। তরজমাকার আরবি প্রতিবর্ণায়ন (*হু’রুন ‘ঈন, বিহূ রিন্ ‘ঈন্, হূ’রুমমাক হুর-ঈন, তুত্তার’ফি ঈন ইত্যাদি) সূত্রে সরাসরি হুর শব্দ সেখানে ব্যবহার করেন নতুবা ‘জান্নাতি রমণী’ বিশেষ্যে অনুবাদ যান।

ইংরেজি তরজমায় এক্ষেত্রে বাংলার বিপরীত রীতি দৃষ্ট হয়। ইউসুফ আলীর প্রামাণ্য ইংরেজি অনুবাদে হুরের উল্লেখ পাওয়া যায় না। ইংরেজিভাষী পাঠকের কথা বিবেচনা করে হুর শব্দের তরজমায় তিনি সম্ভবত ভাবব্যঞ্জক বর্ণনাভঙ্গির আশ্রয় নেওয়া অধিক নিরাপদ ভেবেছিলেন। অগত্যা ওপরে উল্লেখিত এক ডজনের অধিক আয়াতে হুরের সুরত সম্পর্কে যেসব ইঙ্গিত রয়েছে তাকে প্রাধান্য দিয়ে আলী নিজের তরজমা সেরেছেন। আলী-র তরজমায় হুর ‘আয়তলোচনা’ (Companions With beautiful, big, And lustrous eyes), ‘সমবয়স্কা সহচরী’ (Companions of Equal Age), ‘অকলঙ্ক কুমারী’ ও ‘উদ্ভিন্ন যৌবনা’ (Virgin-pure and undefiled) ইত্যাদি বিশেষণ সূত্রে অনূদিত হয়েছে। হুর শব্দটি সরাসরি উল্লেখ না করায় মূল আরবির তুলনায় তাঁর বিবরণ সেখানে বেশ দীর্ঘায়িত বলা চলে। আসাদ এবং আলী উনালের তরজমাও মোটের ওপর আলীর প্রতিনিধিত্ব করেছে। তরজমার এমনধারা প্রবণতার পক্ষে-বিপক্ষে কিছু না বললেও হ্যাজিলটনের কথা থেকে স্পষ্ট বোঝায় যায় হুরের সুরত সম্পর্কিত বিবরণকে তিনি অতিরঞ্জন বলেই গণ্য করেছেন। তাঁর যুক্তি ও মতামত অগত্যা এখানে খেয়াল করা প্রয়োজন :—

হ্যাজিলটনের মতে হুর শব্দটি কোরানে চারবার উল্লেখিত হওয়ার সঙ্গে জান্নাতিরা সেখানে বিশেষ প্রজাতির সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হবে বলে মোহাম্মদকে অবহিত করা হয়েছে। বিশেষ এই সৃষ্টি দেখতে কেমন সে-সম্পর্কে আল্লাহ ঝেড়ে কাশেননি। ডজনাধিক আয়াতে মোহাম্মদকে তিনি সামান্য কিছু ইশারা (*আয়তলোচনা, চিরযৌবনা কুমারী ইত্যাদি) দিয়ে মৌন হয়েছেন। অনুবাদক, টীকাভাষ্যকার ও তফসির প্রণেতারা ফিতনার সম্ভাবনা সৃষ্টিকারী কোরানের ‘মুতাশাবিহাত’ শ্রেণিভুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় অতি উৎসাহী ও কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়ায় কালের গতিতে হুরের আগে-পিছে এমন বর্ণনাও সংযুক্ত হয়েছে যা কোরানের আয়াত ও শাব্দিক অর্থব্যঞ্জনা বিবেচনায় সঠিক নয় এবং জল্পনা ও অতিরঞ্জনকে প্রকটিত করে। কোরানের ইংরেজি অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় ‘স্ফীত বক্ষা’ (swelling breast or hogh-bosom; *আলী অবশ্য শব্দটি ব্যবহার করেননি) শব্দের প্রয়োগ চোখে পড়ে এবং হ্যাজিলটন বলছেন সে-রকম কোনও হুরের দেখা তিনি সেখানে পাননি। জান্নাতে গমনের পর একজন পুরুষ বাহাত্তর জন হুরি সঙ্গী হিসেবে পাবে এবং যখন মন চায় সেইসব অপ্সরার সঙ্গে রমণে লিপ্ত হতে পারবে তথাপি কোনও ক্লান্তি বোধ করবে না ইত্যাদি প্রচলিত বিশ্বাসের কোনওটাই কোরান চষে পাওয়া যায় না। সর্বোপরি ‘কুমারী’ বলতে আসলে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে তার স্পষ্ট আভাস কোরানে না থাকায় ইসলামি বইপত্রে এ-সংক্রান্ত আলঙ্কারিক যেসব বিবরণ যুক্ত হয়ে থাকে সেগুলোকে অতি-উৎসাহী মনের জল্পনা ছাড়া অন্য কিছু ঠাউরানো কঠিন হয়। হুর নামক জান্নাতি প্রাণীটি চিরন্তন যুবার (Eternal Youth) প্রতীক গ্রিক ‘কৈারোস’ (kouros) জাতীয় কিছু কি না সে-ব্যাপারেও নিজের অনুসন্ধান থেকে তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি।

প্যারাডাইজ বা জান্নাতের ক্ষেত্রে সমান কথা প্রযোজ্য। হ্যাজিলটনের বক্তৃতা ও লেখাপত্রের খবর করলে দেখা যায় কোরানে বর্ণিত জান্নাতকে অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা (*তাঁর ভাষায় Islamophobic বা ইসলামের ভয়ে কাতর ও আতংকিত জনগণ।) যেসব দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ ও ব্যাখ্যা করেন সেখানে তাঁর জান্নাত পঠন উলটো পথে মোড় নিয়েছে। আলী সিনা ‘Understanding Muhammad’ কিতাবে কোরান ও হাদিসের জান্নাত কেন্দ্রিক ধারণাকে বাইবেল ও অন্য ধর্মের সঙ্গে তুলনার ভিত্তিতে খারিজ করেছিলেন। তাঁর মতে জান্নাতে গমনকারী মানবের শাশ্বত আত্মিক অবস্থান বিষয়ে মোহাম্মদের কোনও ধারণা ছিল না! জান্নাতকে তিনি সেইসব ইহজাগতিক বস্তু দিয়ে সাজিয়েছেন যা একজন আরবের কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত কিন্তু মরুভূমির প্রতিকূল পরিবেশের কারণে সেগুলো সহজে পাওয়ার উপায় নেই। মোহাম্মদ তাই নদী, ঝর্না, উষ্ণ প্রস্রবণ, অঢেল ফলমূল, শরাবান তহুরা আর কুরসিতে আসীন হুরদের সঙ্গে দৃঢ় লিঙ্গের পুরুষের বিবাহ ও অবাধ যৌনাচারের বিবরণে জান্নাত বোঝাই করেছেন। সিনা-র ভাষায় কোরানের এই জান্নাতছক প্রচণ্ড রিপুতাড়িত ও ভোগলিপ্সু এক মনের কল্পনা! আরব গোত্রগুলোকে বোকা বানানোর জন্য মোহাম্মদ একে সফলভাবে ব্যবহার করেছিলেন এবং এখনও বিপুল সংখ্যক রিপুতাড়িত মুসলমানকে তাঁর এই বানোয়াট কল্পনা দিয়ে জঙ্গি হওয়ার উসকানি দিয়ে চলেছেন।

জান্নাতের মতো অপ্রামাণিক বিষয়ে কে ঠিক আর কে বেঠিক সে-কথা বলা শক্ত। ব্যক্তি ভেদে মতের ভিন্নতা এখানে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সিনা যেখানে কোরানের জান্নাতকে সরাসরি রিপুতাড়িত মনের বানোয়াট কল্পনা বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন হ্যাজিলটন সেখানে উলটো পথে গমন করে একে যুক্তিসংগত বলে অভিমত রেখেছেন। জান্নাত নিয়ে তাঁকে আদৌ অতি উৎসাহী মনে হয়নি, বরং তাঁর গবেষণা ভিত্তিক অনুসন্ধান ও বক্তৃতায় জান্নাত ফুটনোট হয়েই আসে, তবে ব্যাখ্যাটি ভাবনা উদ্রেক করে এবং কোরানকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে বিবেচনা করতে সহায়ক হয়। তাঁর বক্তব্য থেকে সহজে অনুমেয় জান্নাত সংক্রান্ত মামলার ব্যাপারে তিনি পৃথক ধারণা পোষণের পক্ষপাতি। তাঁর মতে কোরানের আয়াতে হুরকে কুমারী বলা হলেও জান্নাতের বিবরণ তা সমর্থন করে না। কোরানে জান্নাত পৃথিবীর অনুরূপ উর্বর, প্রজননশীল (Fecundity) ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এক স্থান। এটি সক্রিয় ও উৎপাদনশীল। হ্যাজিলটনের জান্নাত ব্যাখ্যার সঙ্গে অগত্যা এই ভাবনা যুক্ত করা যায় :—

পৃথিবীতে ইসলাম নির্ধারিত জীবন যাপনের পরীক্ষায় পাশ দিয়ে সেখানে যারা গমন করবে পুরস্কার স্বরূপ ইহজীবনে যে-সমস্ত বিষয়ে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বা সীমা আরোপ করা হয়েছিল এখন সেগুলো তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। পার্থিব জীবনের আদলে বোনা এই জান্নাতের সঙ্গে পৃথিবীর মৌলিক পার্থক্যটি হলো সেখানে ইহজগতে বিদ্যমান বস্তু সমূহের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে এমন উপাদানের অনিঃশেষ প্রাচুর্য যেমন থাকবে, বিশেষ উপায়ে সৃষ্ট নতুন প্রাণের বিচরণও জান্নাতিরা সেখানে দেখতে পাবে! জান্নাতে গমনকারী ব্যক্তি পুরোনো দেহের খোলসে সেখানে নতুন ও চিরজীবী হয়ে জন্ম নেবে। কোরানের জান্নাত তাই পৃথিবীর মতোই সক্রিয়, সৃষ্টিমুখর ও উৎপাদনশীল। জীবনের পরিশেষ ও বায়বীয়তায় বিলীন হওয়ার পরিবর্তে দ্বিতীয় জীবনের সূচনা ঘটবে সেখানে, যা হবে অনন্ত ও চিরকালীন। সূরা ‘ওয়াকিয়া’-য় ব্যক্ত ‘সম্প্রসারিত ছায়া’-র (৫৬:৩০) অনুরূপ হবে সে-জীবন :—

‘The Prophet (ﷺ) (Peace be upon him) said, ‘In Paradise there is a tree which is so big that a rider can travel in its shade for one hundred years without passing it; and if you wish, you can recite: ‘In shade long extended.’ (56.30).

‘নবিজি (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) বলেছেন, ‘জান্নাতে অতিকায় এক বৃক্ষ রয়েছে যার ছায়ায় কোনও সওয়ারি একশো বছর চলতে পারবে কিন্তু সেই ছায়া অতিক্রম করতে পারবে না; ইচ্ছে হলে ‘সম্প্রসারিত ছায়া’ (৫৬:৩০) তেলাওয়াত করতে পারো।’ — উৎস : Sahih al-Bukhari; Tafseer, Chapter No. 65, 4811; তরজমা : লেখককৃত; sunnah.com/bukhari.

সংশয়ী ও অবিশ্বাসী মন এই জান্নাতকে জল্পনা কিংবা অন্য ধর্মে অঙ্কিত স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করতে যেয়ে ভ্রান্ত বলে উড়িয়ে দিতেই পারে, কিন্তু তার আগে স্বীকার যাওয়া উচিত কোরানের জান্নাত নিজেকে আত্মিক শুষ্কতার মাঝে নিঃস্ব বা বিলীন করেনি। এই জান্নাত প্রাণের দ্বিতীয় পর্যায়ের রূপান্তরের মধ্যে গমন করার কারণে পৃথিবীর অনুরূপ কিন্তু অনেক বেশি অভিনব, সৃজনশীল ও প্রাণবন্ত; — ঠিক আল্লাহ যেমন!

দ্বিতীয় জীবনের সূচক অ-কুমারী এই জান্নাতের সঙ্গে অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের একমত হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্য ক্ষীণ। ওদিকে ইসলামিস্টদের মাঝে বাহাত্তর হুরের সঙ্গে জান্নাতের বাগানে মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজের পৌরুষ চরিতার্থে ব্যাকুল মুমিনগণও এ-ব্যাপারে সহমত হবেন না এটা নিশ্চিত। এর বড়ো কারণ প্রামাণিক হাদিস সংকলন ও তফসিরে হুর সম্পর্কে যেসব ধারণা লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো কোরানের মতো মিতভাষী নয়। ইসলামের বিকাশ পর্বে রচিত ইবনে খাতিরের তফসির এবং বিভিন্ন সময়ে আবিভূর্ত দীনী আলেম ও চিন্তাবিদগণের রচনায় জান্নাত ও হুর বয়ানের পরিধি ব্যাপক হওয়ার কারণে অ্যান্টি-ইসলামিস্টরা এই রেফ্রেন্সগুলো নিজের মতের সপক্ষে প্রায়শ উদ্ধৃত করে থাকেন, আবার জান্নাতের বাগানে হুরির সঙ্গ পেতে ব্যাকুল ইসলামিস্টরাও সমানে এসব উদ্ধৃতি যান।

জরামৃত্যুহীন দ্বিতীয় জীবনে বাহাত্তর হুরি লাভ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাসের বস্তুগত ভিত্তি কোরানে নেই এবং মোহাম্মদ দেহ রাখার তিনশো বছর পর থেকে এইসব অতিকল্পনার বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়, যার পেছনে ‘Oriental Mind Play’ অর্থাৎ প্রাচ্যবাসীর জল্পনা নির্ভর কিসসা-কাহিনির প্রতি দুর্নিবার ঝোঁক বড়ো কারণ হিসেবে ভাবা যেতে পারে, — হ্যাজিলটন এসব কথা জোর দিয়ে বললেও অতিরঞ্জনের নেপথ্যে হাদিসের ভূমিকা থাকায় ইসলাম বিদ্বেষী আলী সিনা কিংবা হুরপ্রেমী মুমিনকে এ-ব্যাপারে মত পরিবর্তনে প্ররোচিত করা শক্ত কাজ হবে তাতে সন্দেহ নেই!

প্রামাণিক হাদিস সংকলনে হুর অথবা জান্নাতি রমণী সম্পর্কে সহি হাদিসের সংখ্যা ব্যাপক নয়, বরং যয়িফ বা প্রামাণিক ভিত্তি দুর্বল এমন হাদিসের সংখ্যাই সেখানে অধিক। সহি হাদিস সমূহে বর্ণিত হুর ও জান্নাতি রমণীর বিবরণে বাড়তি কিছু বর্ণনা যোগ হলেও মোটের ওপর কোরানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ওদিকে যে-হাদিস ঘিরে বাহাত্তর হুর সংক্রান্ত গোলযোগের সূত্রপাত সেটি হাদিসের মান বিবেচনায় আত-তিরমিজির বরাতে সহি হিসেবে গণ্য এবং সে-কারণে ‘হাসান সহি গারিব’ বলে স্বীকৃত। সংগৃহীত হাদিসের মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হাদিস সংগ্রাহকরা সেকালে একাধিক ব্যক্তি বা উৎস থেকে উক্ত হাদিসের বিবরণ সংগ্রহ করতেন। হাদিস যাঁর বয়ানে বর্ণিত হচ্ছে তাঁর সঙ্গে নবির সম্পৃক্ততা, বর্ণনাকারী ব্যক্তির রাবি বা স্মরণশক্তির মান, চরিত্রের দৃঢ়তা, সত্যবাদিতা এবং কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় ইত্যাদি শর্ত সাপেক্ষে বিবরণের মান যাচাই করা হতো। গুণগত মান ও ঐক্য সম্পর্কে নিশ্চিত হলে পরে কেবল হাদিসটি তাঁরা সংগ্রহে স্থান দেওয়ার উপযুক্ত ভাবতেন। রাবি অর্থাৎ হাদিস বর্ণনাকারীর স্মরণশক্তি ও তাঁর ব্যক্তিত্বের ঐতিহাসিকতার ওপর বহুলভাবে নির্ভরশীল এইসব বিবরণ সুনির্দিষ্ট শর্ত কতখানি পূরণ করতে পেরেছে তার ওপর ভিত্তি করে হাদিসবেত্তারা সহি, গারিব, যয়িফ, মওজূ কিংবা জাল ইত্যাদি শ্রেণিতে ভাগ করে এগুলোকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। হাদিসের মান যাচাই ও উদ্ধৃত করার সময় শ্রেণিবিভাজনের এই বিষয়টি খেয়াল রাখা বিশেষ প্রয়োজন।

সংগৃহীত বিবরণের নমুনা ও প্রতি স্তরে বর্ণনাকারী ব্যক্তির রাবি বা স্মরণশক্তি সম্পর্কে অভিন্নতা নিশ্চিত করে এমন হাদিস নিখুঁত অর্থাৎ সহি রূপে ইসলামে স্বীকৃত। বিবরণ যাচাইয়ের সময় পরস্পরবিরোধী তথ্য প্রদানের পাশাপাশি কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হাদিস সচরাচর যয়িফ বা দুর্বল গণ্য হয়ে থাকে। অন্যদিকে বিবরণে কোনও সামঞ্জস্য নেই অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে নবির চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে প্রণীত হাদিস জাল নয়তো মাওযূ হিসেবে চিহ্নিত করার পাশাপাশি অগ্রাধিকার প্রদানের তালিকা থেকে ছেটে ফেলা হয়। তো এই শ্রেণিকরণে গারিব হাদিস ভিন্ন প্রকৃতির তাতে সন্দেহ নেই। মান যাচাইয়ের পর রাবির ব্যাপারে সামান্য ত্রুটি ঘটে থাকলেও অন্যান্য শর্ত বিবেচনায় সহির কাছাকাছি বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, তবে বর্ণনাকারীর সংখ্যা একজনের অধিক না-হওয়ায় নিশ্চিতভাবে নিখুঁত বলা সম্ভব হচ্ছে না এরকম হাদিসকে এহেন শ্রেণিতে ফেলে হাদিসবেত্তারা বিচার করে থাকেন। প্রখ্যাত হাদিস সংগ্রাহক আত-তিরমিজি একাধিক হাদিসের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন যার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হাদিস ‘বুখারী’ ও অন্যান্য হাদিস সংকলনে সচরাচর পাওয়া যায় না! তিরমিজির জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য বিবেচনায় নিয়ে হাদিসবেত্তারা এই শ্রেণির হাদিসকে অগত্যা ‘হাসান সহি গারিব’ অর্থাৎ এর সত্যতা একমাত্র তিরমিজির পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব বলে উল্লেখ যান।

বাহাত্তর হুরি সংক্রান্ত হাদিসের একক উৎস তিরমিজি হওয়ার কারণে ইসলামবেত্তারা এ-নিয়ে শোর মাচানোর বিপক্ষে মতামত দিয়ে থাকেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনূদিত ‘সুনান আত-তিরমিজি’তে হুরের সংখ্যা উল্লেখপূর্বক হাদিস ‘জিহাদের ফযিলত’ অধ্যায়ের ১৬৬৯ ও ‘জান্নাতের বিবরণ’ অধ্যায়ের ২৫৬৪ নাম্বারে পাওয়া যায়। হাদিসবেত্তারা প্রথমটিকে ‘হাসান সহি গারিব’ এবং দ্বিতীয়টিকে যয়িফ রূপে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়া জনমনে বিভ্রান্ত সৃষ্টিকারী ‘জান্নাত’ অধ্যায়ের ২৫৩৫ নাম্বার হাদিসের কথাও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। হাদিসগুলো বোধহয় এইবেলা পাঠ যাওয়া প্রয়োজন :—

‘মিকদাম ইবনু মা’দীকারিব (রা.) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : শহিদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ছয়টি পুরস্কার বা সুযোগ আছে। তার প্রথম রক্তবিন্দু পড়ার সাথে সাথে তাকে ক্ষমা করা হয়, তাকে তার জান্নাতের বাসস্থান দেখানো হয়, কবরের আজাব হতে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়, সে কঠিন ভীতি হতে নিরাপদ থাকবে, তার মাথায় মর্মর পাথর খচিত মর্যাদার টুপি পরিয়ে দেওয়া হবে। এর এক একটি পাথর দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছু হতে উত্তম। তার সাথে টানা টানা আয়তলোচনা বাহাত্তরজন জান্নাতি হুরকে বিয়ে দেওয়া হবে এবং তার সত্তরজন নিকটাত্মীয়ের জন্য তার সুপারিশ কবুল করা হবে।’ — সুনান আততিরমিজি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন কৃত); অধ্যায় ২৫ জিহাদের ফযিলত, ১৬৬৯; মূল বর্ণনাকারী: মিকদাম ইবনু মাদীকারিব, হাদিসের মান : হাসান সহি গারিব; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম

‘সুওয়াদ ইবন নাসর (রহ.) … আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : জান্নাতিদের মাঝে সর্বনিম্ন যে তারও হবে আশি হাজার সেবক, বাহাত্তর হাজার সঙ্গিনী। মোতী, যবরজদ এবং ইয়াকুত পাথরে নির্মিত জাবিয়া থেকে সান’আ পর্যন্ত দূরত্বের ন্যায় বিস্তৃত এক বিরাট গম্বুজ বিশিষ্ট প্রাসাদ তার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হবে।…’ — সুনান আততিরমিজি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন কৃত); অধ্যায় ৪১ জান্নাতের বিবরণী, ২৫৬৪; হাদিসের মান : যয়িফ; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম

*প্রসঙ্গবিবচেনায় আংশিক (*প্রথম অংশ; দ্বিতীয় অংশে জান্নাতে গমনের পর জান্নাতিদের বয়স ত্রিশ অথবা অন্য হাদিস গ্রন্থ অনুসারে তেত্রিশ স্থির হওয়া আনুষঙ্গিক বিবরণ রয়েছে) উদ্ধৃত এই হাদিসটি গোলযোগপূর্ণ! ফাউন্ডেশনের আরবি থেকে কৃত বঙ্গানুবাদেবাহাত্তর হাজার সঙ্গিনী কথা উল্লেখিত হয়েছে, অন্যদিকে ইংরেজি ভাষান্তরে সংখ্যাটিবাহাত্তর জন স্ত্রীঅর্থে অনূদিত হয়েছে (The least of the people of Paradise in position is the one with eighty thousand servants and seventy-two wives. দ্রষ্টব্য : Jami’ at-Tirmidhi; Chapter 38, Hadith number Eng. 2562, Arabic 2760; Source: sunnah.com) ভাষান্তরের এই গোলযোগ বিভিন্ন হাদিস অনুবাদে কমবেশি মিলে, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে বৈকি

‘আবু সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে-দলটি কিয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবে, দলের মুখমণ্ডল হবে আকাশে মুক্তার ন্যায় জ্বলজ্বলে তারকার মতো উজ্জ্বল। তাদের মধ্যে প্রত্যেক পুরুষের জন্য দু’জন করে স্ত্রী (হুর) থাকবে এবং প্রত্যেক স্ত্রীর সত্তরজোড়া জামা থাকবে। এই জামার ভিতর দিয়েও তার পায়ের জংঘার অস্থিমজ্জা দেখা যাবে।’ — উৎস : সুনান আততিরমিজি (তাহকীককৃত); অধ্যায় ৩৬ জান্নাত, ২৫৩৫; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম   

‘সুনান আত-তিরমিজি’ এমনকিছু হাদিসের খবর করে যা বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে সাধারণত দেখা যায় না। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কৃত বঙ্গানুবাদের জান্নাত অধ্যায়ে জান্নাতিদের দেহের গঠন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, যৌনক্ষমতা থেকে শুরু করে জান্নাতি পশু-পাখি-বৃক্ষের বিবরণ সংক্রান্ত ৫১টি হাদিসের ১৬টি হাসান গারিব এবং ১৩টি যয়িফ বলে হাদিসবেত্তারা চিহ্নিত করেছেন! এর মধ্যে ২৫৬৬ নাম্বার যয়িফ হাদিসের বিবরণ বেশ কৌতূহল উদ্দীপক! ভারতীয় পুরাণের কিন্নরকণ্ঠী অপ্সরা অথবা হোমারের মহাকাব্যে বর্ণিত ট্রয় যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার পথে কুহকী রমণীর জাদুকরি কণ্ঠস্বর ও মোহন সৌন্দর্যের ফাঁদে নাকাল ইউলিসিসের কাহিনি শ্রবণ করেছেন এমন মুমিন মুসলমানের মনে এই খেদ বহুদিনের, কোরানে আল্লাহ জান্নাতে এতকিছুর ব্যবস্থা রাখলেন অথচ সংগীতসুধা শ্রবণে হৃদয় তৃপ্ত করার উপায় বলে দিলেন না! ‘সুনান আত-তিরমিজি’ হুরিগণকে সে-কাজে নিয়োজিত করে সেইসব সংগীতপিপাসু জনতার মনের খেদ চিরতরে দূর করে দিয়েছেন। হাদিসটির দালিলিক ভিত্তি দুর্বল হওয়ায় যয়িফ বলে গণ্য, তবে হযরত আলী ও আবু হুরায়রার নাম উচ্চারিত হওয়ার কারণে নড়বড়ে কাঠামো সত্ত্বেও হাদিসবেত্তারা একে হাসান গারিব হাদিসের মর্যাদা দিয়েছেন। তো বিলম্ব না করে হাদিসটি এইবার পাঠ করা যাক :—

‘হান্নাদ ও আহমদ ইবন মানী’ (রহ.) … আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : জান্নাতে আয়তলোচনা হুরদের একটি সম্মেলন গৃহ রয়েছে। সেখানে তারা এমন সুরে গান গায় যে, সৃষ্টির কেউ কখনও এমন সুর শুনেনি। তারা বলে : আমরা অনন্ত সঙ্গিনী আমাদের ধ্বংস নেই; আমরা সুখ-সম্পদশালীনী, অভাব নেই আমাদের; আমরা (আমাদের মালিকদের প্রতি) তুষ্ট, অসন্তুষ্টি নেই আমাদের; মুবারক সেই ব্যক্তি যারা আমাদের এবং আমরা যাদের।’ — উৎস : সুনান আততিরমিজি (ইসলামিক ফাউন্ডেশন কৃত); অধ্যায় ৪১ জান্নাত, ২৫৬৬; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম

আল্লাহর একত্ব বা তাওহিদ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শহিদ জিহাদির মর্যাদা ও পুরস্কার সম্পর্কে কোরানে আয়াতের সংখ্যা ব্যাপক এবং হাদিসেও এর প্রতিফলন সেভাবেই ঘটেছে। আল্লাহর রাজত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহিদগণকে জান্নাতে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি কোরানে ব্যক্ত হলেও হুরদের সঙ্গে তাদের বিবাহ দেওয়ার উল্লেখ কি মিলে? হুর সংক্রান্ত ডজনাধিক আয়াতের মধ্যে সরাসরি হুরের উল্লেখ রয়েছে এরকম আয়াতগুলোয় এখানে বিচেনা করা যেতে পারে :—

‘আর তাহাদের জন্য থাকিবে আয়তলোচনা হুর, সুরক্ষিত মুক্তাসদৃশ,…উহাদেরকে আমি সৃষ্টি করিয়াছি বিশেষরূপে, … উহাদেরকে করিয়াছি কুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়স্কা,’ — আল-ওয়াকিয়াহ ৫৬:২২-২৩, ৩৫-৩৮;

‘এইরূপই ঘটিবে; আমি উহাদেরকে সঙ্গিনী দান করিব আয়তলোচনা হুর,’ — দুখান ৪৪:৫৪;

‘তাহারা বসিবে শ্রেণীবদ্ধভাবে সজ্জিত আসনে হেলান দিয়া; আমি তাহাদের মিলন ঘটাইব আয়তলোচনা হুরের সঙ্গে;’ — আত-তূর ৫২:২০;

‘সেই সকলের মাঝে রহিয়াছে বহু আনতনয়না, যাহাদেরকে পূর্বে কোন মানুষ অথবা জিন স্পর্শ করে নাই। … সেই উদ্যানসমূহের মাঝে রহিয়াছে সুশীলা, সুন্দরীগণ। … তাহারা হুর, তাঁবুতে সংরক্ষিত,’  — আর-রহমান ৫৫:৫৬, ৭০, ৭২;

উৎস : আল কোরান; ভাষান্তর : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ

উদ্ধৃত আয়াতসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে সূরা ‘দুখান’ ও ‘আত-তূর’-এর আয়াতকে জিহাদির মর্যাদা ও পুরস্কার স্বরূপ হুরের সঙ্গে বিবাহ ঘটানোর সূত্রে কমবেশি সকলে পাঠ গিয়ে থাকেন। যদিও উক্ত সূরা পাঠে সে-রকম কোনও আভাস মিলে না! অবিশ্বাসী ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী মানবগোষ্ঠীর পরিণাম সম্পর্কে নবিকে সতর্ক করার পাশাপাশি মুত্তাকিন অর্থাৎ যারা আল্লাহর একত্বে ইমান রাখেন এবং কোরান নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করেন তাদেরকে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি সেখানে ঘোষিত হয়। এখন জিহাদে শহিদ যেমন মুত্তাকিন হওয়ার গুণে জান্নাতে হুর পাবেন, যে-ব্যক্তি কোনও কারণবশত জিহাদে যোগ দিতে পারেননি কিন্তু মুত্তাকিনের বাকি সব লক্ষণ তার মধ্যে প্রকটিত ছিল তিনি জান্নাত ও হুর পাবেন না সেরকম ইঙ্গিত কোরান কিন্তু এখানে দেয়নি। বুঝের ভুল হলে পাঠক শুধরে দেবেন। ইসলামে তাওহিদ বহুরৈখিক কনটেক্সট এবং জিহাদ সেখানে প্রাণ স্বরূপ হলেও একজন জিহাদি জান্নাতে গমনের পর কী পাবেন কোরান সেটা কতক ক্ষেত্রে পরিষ্কার ঘোষণা দিলেও হুর সংক্রান্ত বিষয়ে এই ঘোষণাটি স্পেসিফিক নয় বরং ইনজেনারেল। আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়ার কারণে তাঁরা অবশ্যই হুর পাবেন, তবে বাকিরা পাবেন না বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। যে-কারণে কোরান মিতভাষে হুর বর্ণনা সেরেছে। মিতভাষটি ভঙ্গ হয় একক উৎস নির্ভর গারিব অথবা যয়িফ হাদিস সূত্রে বর্ণিত জান্নাত ব্যাখ্যায় গমনের পর। জান্নাতে বাহাত্তুর হুর বা তাদের সঙ্গে বিবাহের বিধান ইত্যাদি যারা জিহাদির জন্য নির্দিষ্ট করেন তাঁরা কমবেশি ‘সুনান আত-তিরমিজি’-র ওপর ভর করে নিদান হাঁকেন! এ-সংক্রান্ত অজস্র লেখাপত্রে ইন্টারনেট বোঝাই হয়ে আছে। পাঠক ইচ্ছে করলে মিলিয়ে নিতে পারেন।


চিত্র১২, ১৩ : ইসলামে চিত্রাঙ্কন শর্তসাপেক্ষে অনুমোদিত হলেও স্রষ্টা, তাঁর প্রেরিত নবিরসুল, তাঁদের পরিবার ঘনিষ্ট সহচরদের কোনওরূপ কাল্পনিক প্রতিরূপ অঙ্কনে পরিষ্কার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তথাপি শিল্পীরা সেই নিষেধাজ্ঞার বিশেষ তোয়াক্কা করেননি ইসলামের বৈশ্বিক সম্প্রসারণের কালপর্বে অন্যান্য কলাশাস্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিত্রাঙ্কন চর্চা যথারীতি অতুল উৎকর্ষই লাভ করেছিল তৎকালীন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় শিল্পীরা ইসলামি টেক্সটকে আশ্রয় করে ইজগৎ পরজগতের ছবি আঁকতে ইতস্তত করেননি কেবল ক্যালিগ্রাফি অথবা স্টিল লাইফ চিত্রাঙ্কনে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে বিচিত্র বিষয় নিয়ে তাঁরা ছবি এঁকেছেন তাঁদের এই দুঃসাহসিক সৃজনমুখরতায় ইসলামি চিত্রকলার পরিধি পারস্য, ইরাক, মোঘল ভারত, তুরস্ক থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল

পারস্য মধ্য এশিয়ায় তৈমুর সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ক্ষণে বৌদ্ধ চিত্রাঙ্কনরীতির প্রভাবে ইসলামি চিত্রকলায় পরকালবিদ্যার চিত্রাঙ্কন বিশেষ জনপ্রিয়তা পায় মহানবির মিরাজে গমন জান্নাত দর্শনের ঘটনা অবলম্বনে শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন সেই সময়, যেখানে তাঁর কাল্পনিক স্বরূপ অঙ্কনে তাঁরা দ্বিধা বোধ করেননি! ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞান কলাশাস্ত্রের হাজার বছর ব্যাপী সমৃদ্ধি সম্প্রসারণ শিয়া অধ্যুষিত পারস্যকে বাদ দিয়ে ভাবার উপায় নেই পারস্য প্রাচীন সভ্যতার অতুল অধিকারী হওয়ার কারণে ইসলামের বিবিধ কঠোরতাকে নিজের অনুকূলে নমনীয় করে নিয়েছে, যার প্রভাব তুরস্ক থেকে মোঘল ভারত অবধি ইসলামি শিল্পকলার বনেদ গড়ে দিতে সাহায্য করেছিল

ইসলামি কলাশাস্ত্র শিল্পকলার চর্চায় পারস্যবাসীরা এখনও সমান অগ্রবর্তী ইসলামিক ইরানের শতেক সেন্সরশিপের মধ্যে বসে হালফিল কলাশাস্ত্রের জগতে পারসিকরা নিজের সৃজনশীল চরিত্রে অতীতের মতোই সক্রিয় আর সজাগ যেকারণে একজন মাজিদ মাজিদি যখন মোহাম্মদকে নিয়ে সিনেমা বানান সেটা পারস্যের অতুল সৃজন ঐতিহ্যের গুণে সকলের থেকে পৃথক হয়ে ওঠে মাজিদ এক অনুভূতিপ্রবণ বালক মোহাম্মদকে সিনেমার পর্দায় তুলে আনেন মা আমেনা, দুধ মা হালিমা, দাদা আব্দুল মোত্তালিব আর চাচা আবু তালিবকে বড় পরিসরে ধারণ করে এই ছবি এবং কেন্দ্রস্থলে বিচরণরত বালক মোহাম্মদের প্রফেটিক লক্ষণ আপনা থেকে সেখানে কথা কইতে থাকে

হয়তো সেই সৃজনপ্রতিভা যার গুণে সংশয়দীর্ণ যুগে মারমুখী ইসলামের বাইরে নিষ্ক্রমণ নেওয়া মাজিদি মহানবির প্রতি দর্শকের আবেগ জাগিয়ে রাখেন কাবাকেন্দ্রিক প্রতিমা উপাসনা গোত্রদ্বন্দ্বে দীর্ণ সেই যুগে মোহাম্মদ কেন প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছিলেন তার আভাস সব ছাপিয়ে প্রধান হয়ে ওঠে ছবির কাহিনি মোহাম্মদের বাল্যকাল ঘিরে আবর্তিত হলেও তাওরাতে বর্ণিত পরবর্তী নবির আগমনী চিহ্ন কী হেন কারণে মক্কায় দেখা দিল তার অন্বেষণে মরিয়া ইহুদি রাবাইদের বালক মোহাম্মদের পিছু নেওয়া আর তাঁর সুরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত মোত্তালিব আবু তালিবের উদ্বেগ সিনেদৃশ্যে নতুন মাত্রা সঞ্চারিত করে বন্ধ্যা স্ত্রীর প্ররোচনায় মোহাম্মদ বিদ্বেষী হয়ে ওঠা চাচা আবু লাহাব কিংবা ধনীমানি আবু সুফিয়ানকে ঘিরে চর্চিত কোরাইশ জীবনাচারের সঙ্গে আব্দুল মোত্তালিবের দ্বন্দ্ব ছবিতে বাদ পড়ে না মোহাম্মদের নবুয়ত লাভের দশ বছর অবধি চাচা আবু তালিব জীবিতই ছিলেন তাঁর স্মৃতিচারণা সূত্রে গাথা সিনেবয়ানে মক্কা বিজয় ইসলামের সম্প্রসারণ লাভের চকিত আভাস পর্দায় তরঙ্গিত করেন মাজিদ  

শিয়া পরিবেষ্টিত ইরান ইসলামকে মোহাম্মদ আলীর উত্তরাধিকার রূপে পাঠ করতে অভ্যস্ত, মাজিদ সেখানে ব্যতিক্রম নন অগত্যা ছবির গল্প সুন্নি, সালাফি বা ওয়াহাবিদের নাপসন্দ হওয়ার সম্ভাবনা রেখেই অগ্রসর হয় পারস্যে ইসলামের প্রসার কোনওকালেই পুরাকল্পয় নিহিত সৃজনশীলতাকে বাদ দিয়ে ঘটেনি বালক মোহাম্মদের জীবনগাথাও অগত্যা পর্দায় মিথ রচনা করে যায়! মোহাম্মদের মুখাবয়ব দর্শক দেখতে পায় না কিন্তু এই বালক জন্ম থেকে পৃথক জ্যোতির্ময়, যা ছাড়া আসলে প্রফেট হওয়া যায় না, আলোক প্রক্ষেপণের কুশলী ব্যবহার আর . আর রহমানের আবহ সংগীত যোজনায় মাজিদি সেটা বুঝিয়ে দিতে কিছু বাকি রাখেননি!

দর্শকের প্রতি এই বার্তাও ছবিটি রেখে যায়, মা আমেনা দুধ মা হালিমার সঙ্গে কাটানো জীবনের অল্প কয়টি বছর হচ্ছে সেই সময় যা সারা জীবনের জন্য এই বালকের মনের বনেদ গড়ে দিয়েছিল! আমেনার সঙ্গে মোহাম্মদের সম্পর্কের রসায়নকে মায়াময় সংবেদী পবিত্রতায় হাজির করতে পারা পরিচালকের বড়ো সফলতা, যা ইতিহাসের গৎবাঁধা ছকের বাইরে ঘটে বলে নতুন এক মোহাম্মদকে দর্শক রক্তে অনুভব যায় ইসলাম প্রচারকের ঘটনাবহুল জীবনের স্বীকৃত ইতিহাসকে পৃথক পরিসরে পাঠ করেছেন মাজিদি এবং একুশ শতকের জীবনধারা তার বৈশ্বিক তাৎপর্য বিবেচনায় এমনটাই হওয়া উচিত তিনি সেই মোহাম্মদকে পর্দায় হাজির করতে পেরেছেন যাঁর অলৌকিকত্ব নিহিত ছিল বালকমনের অপার কৌতূহল সংবেদনশীলতার মধ্যে এবং কোরানের মৌল ভিত্তি সেখানেই নিহিত

ইনি সেই মোহাম্মদ যাঁর নিবিড় সখ্য কোরানের সেই আয়াতগুলোর সঙ্গে যারা নক্ষত্ররাজির কথা বলে, চন্দ্রালোকিত রজনীর কথা বলে, উষ্ণ প্রস্রবণ আর উর্বর খর্জুর বাগানের কাহিনি শোনায়, বারিবর্ষণে রুক্ষ ধরণী সজল হওয়ার বার্তা বয়ে আনে মাজিদি সেই মোহাম্মদের জ্যোতিকে সিনেপর্দায় ধারণ করেন যাঁর সঙ্গে আদিগন্ত আসমান আর চন্দ্রালোকে স্নিগ্ধ রজনীর সংযোগ অবিচ্ছেদ্য ছিল ইনি সেই মোহাম্মদ যাঁর কণ্ঠে একদিন স্রোতস্বিনী দুই দরিয়ার কথা ঘোষিত হয়েছিল যারা একে অন্যের মিলনসন্ধানী তবু তাঁদের মাঝখানে রয়েছে এক প্রতিবন্ধক যা কিনা তারা অতিক্রম করতে পারে না!  

দুই দরিয়া থেকে উপচে ওঠে মুক্তাপ্রবাল আর বালক মোহাম্মদ হেরা পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেখে উত্তাল সাগরে বিচরণশীল নৌযানগুলো যেন কার অঙুলিহেলনে অচিন সাগর পাড়ি দিয়ে অবিনশ্বরে হারায় সুগন্ধি ফুল কিংবা খোসার আড়ালে লুকানো সুমিষ্ট ফলের বাহারে চমকিত বালক টের পায় কে যেন উদয় অস্তকে নিয়ন্ত্রণ করে যায়! নিজ চক্রে আবর্তিত দিবস রজনী যেন কার সেজদায় আনত থাকে! মাজিদি সূরাআর রহমান মোহাম্মদকে পর্দায় সচল করেন এটি সেই সূরা যার আবেশবিভোর সম্মোহন আজও অমলিন সূরা আর রহমানএকদিন মোহাম্মদের কণ্ঠ দিয়ে নিঃসরণ করিয়েছিল সংগীত, ‘ফাবি আইয়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবানআর, তোমার প্রতিপালকের কোন নিয়ামতকে তুমি অস্বীকার করবে?’ পৃথিবী হচ্ছে স্রষ্টার নিয়ামত, যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে রবের উপাসনার জন্য

মাজিদির সাফল্য, ভাবব্যঞ্জনাটি তিনি পর্দায় ধারণ করতে পেরেছেন তাঁর সৃজনপ্রতিভার কারণে এই মোহাম্মদ খুবই পৃথক নির্মাণ সেব্যাপারে সন্দেহ নেই মোহাম্মদ নিয়ে বিরচিত গৎবাঁধা ছবির বাইরে কাব্যিক শিল্পকুশলতার নিদর্শনও বটে! যা স্মরণ করিয়ে দেয়, চরমপন্থী ইসলামকে ঘিরে বিশ্ব জুড়ে বিরাজিত ফিতনার যুগে শরিয়তের ফোকর গলে সুবেদী মনে ইসলামকে পাঠ যাওয়ার দুঃসাহস পারস্য আজও হারিয়ে ফেলেনি

এটা একদিক থেকে দ্বান্দ্বিকও বটে! ইসলামের শুদ্ধ কোনও রূপ যদি নিতেই হয় সেক্ষেত্রে সম্প্রসারণ যুগে চর্চিত শাস্ত্রের বেশ অর্ধেক ইসলাম সম্মত নয় বলে বাদ দিতে হয় আবার বাদ দিলে যা থাকে সেটা এক দীনহীন রুক্ষ ধর্মের ছবি তুলে আনে, যেখানে বিধান আছে কিন্তু স্বাধিকার নেই যেকারণে হয়তো যুগেযুগে ইসলামবেত্তারা কোরানের মৌল বিধান লঙ্ঘন না করে স্বাধিকারের সেই স্পেস খোঁজার চেষ্টা করেছেন যা তাঁদেরকে সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক অগ্রসর রাখে জাপানি অঙ্কনঘরানায় প্রভাবিতমিরাজনামা মোহাম্মদের জান্নাত দর্শনকে যেমন ইহজাগতিক উর্বরতা স্বাস্থ্যে প্রতীকায়িত করে আঁকা হয়েছে! ওরিয়েন্টাল এই অঙ্কনরীতি ল্যাজলি হ্যাজিলটনের উক্তির প্রতিধ্বনিও বটে;কোরানের জান্নাত মোটেও কুমারী নয়, আত্মিক পবিত্রতার শুষ্কতায় নিঃস্ব নয় এই জান্নাত পার্থিব জীবনের মতো উৎপাদনশীল, ফলপ্রসূ আর উর্বর!

হ্যাঁ, এটি সেই জান্নাত যারসম্প্রসারিত ছায়া নিচে সওয়ারি হবে সেইসব মানব যারা পৃথিবীতে অশেষ ক্লেশ সংযমের পরীক্ষা দিয়ে গেছে কেবল এই দিনটি দেখবে বলে,—এখন থেকে তারা জরামৃত্যুযাতনাহীন দ্বিতীয়জীবন শুরু করতে যাচ্ছে!

  • ব্যবহৃত চিত্রাঙ্কন ও ছবির উৎস : ১. মিরাজনামা ওরফে The Timurid Book of Ascension; PDF Edition; ২. Muhammad The Messenger of God; Director: Majid Majidi, YouTube;

মূল উৎস কোরানকে পাশ কাটিয়ে অথবা কোরানের আয়াত সম্পর্কে ব্যক্তির অভিমতকে উদ্দেশ্যমূলক উপায় চরিতার্থে ব্যবহারের প্রবণতা ইসলামে চরমপন্থী কাজকারবারকে অমোঘ করে তুলেছে। টুইন টাওয়ারে হামলার প্রাকক্ষণে মোহাম্মদ আত্তা হয়তো সে-কারণে ‘হুরিরা তোমাদের ডাকছে’ বলে জিহাদি ভাইকে বার্তা পাঠায়! জান্নাতে বাহাত্তর হুরির সঙ্গে রতিমিলনে অধীর নাবাল একদল কিশোর মূলত সেই আশায় ‘হলি আর্টিজান’-এ বীভৎস কাণ্ড ঘটাতে তিলেক ভাবে না। তাদের সবাইকে সেই হাদিস গেলানো হয় যার সত্যতা সম্পর্কে একমাত্র তিরমিজি ব্যতীত বাকিরা নীরব! ইমাম তিরমিজি স্বয়ং জীবিত থাকলে তাঁর সংকলিত হাদিসের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারে প্রীত হতেন বলে বিশ্বাস হয় না। বুখারী, মুসলিম, তিরমিজির মতো ব্যক্তিরা ইসলামের স্তম্ভ স্বরূপ। প্রত্যেকেই সত্য ও জ্ঞানের সাধক ছিলেন এবং নিজের ভুল স্বীকার বা সংশোধনে কখনও কুণ্ঠা বোধ করেননি। তিরমিজি তাঁর সময়ের পরিসরে বসে কতিপয় ব্যতিক্রম হাদিস সংগ্রহ করেছিলেন এবং নিজের ‘আকল’ ব্যবহার করে সহি বলে মত দিয়ে গেছেন, এর মানে এই নয় অন্য হাদিস সংকলন ও সর্বোপরি কোরানের কনটেক্সট বিস্মৃত হয়ে কেবল তাঁকে আঁকড়ে ধরতে হবে। যা এইসব জ্ঞানসাধকরা নিজে কদাপি অনুমোদন করতেন কি না সন্দেহ!

ইতিহাসে লেখে ইমাম বুখারী প্রতিটি হাদিস লিপিবদ্ধ করার আগে দু-রাকাত নফল সালাত আদায় করতেন। সালাত আদায়ের বিষয়টি তাঁর কাছে মেডিটেশন বা অনুধ্যানের সমতুল্য ছিল। হাদিস সংকলনের প্রাক্কালে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনায় নতজানু হতেন বুখারী। কারণ এই আত্মবিশ্বাস তাঁর প্রয়োজন ছিল একটু পরে যে-হাদিস তিনি লিপিবদ্ধ করতে যাচ্ছেন এর সত্যতা যাচাই ও উপলব্ধিতে তাঁর পক্ষ থেকে কোনও ত্রুটি বা ভ্রান্তি ঘটেনি, আর সেরকম কিছু ঘটে থাকলে স্রষ্টা যেন তাঁকে সেটা অনুভবের ক্ষমতা দান করেন। বুখারীর হাদিস পাঠে এর প্রমাণ মিলে। লিপিবদ্ধ বিবরণে তাঁর একাগ্রতা, পরিমিতিবোধ ও অভিনিবিষ্টতা প্রমাণ করে তিনি প্রতিটি হাদিসের ব্যাপারে কতটা সতর্ক ও যত্নশীল ছিলেন! যে-কারণে কোরানের পর বুখারী হচ্ছে সেই কিতাব সমগ্র মুসলিম বিশ্ব যা প্রতিদিন পাঠ যায়। তিরমিজিসহ অবশিষ্ট হাদিস সংকলকরাও অনুরূপ ছিলেন। তাঁদের আমল-আখলাক ও মর্যাদার কথা ভেবে দালিলিক ভিত্তিতে দুর্বল বা যয়িফ হাদিসকে বর্জন না করার পক্ষে আলেমরা অনেক সময় মত দিয়ে থাকেন। মিথ্যে নয়, আজকে যয়িফ বিবেচিত হাদিস নিবিড় অনুসন্ধান ও যুক্তি বিবেচনায় আগামীকাল সহি গণ্য হতেও পারে, কিন্তু সেজন্য সর্বাগ্রে উক্ত হাদিস নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেদিকে না গিয়ে কেবল বিশ্বাসের ওপর যয়িফ হাদিসের চর্চা ভ্রান্তি ও উগ্রতার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

কোরানের আয়াতকে হাদিসের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে সেই হাইপটি তৈরি করা হয়েছে যার জের ধরে বিগত কয়েক দশকে ইসলামে গোঁড়ামি ও জঙ্গিবাদের চাষাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মিলিট্যান্ট ইসলাম হচ্ছে বিষফোঁড়া, যার প্রতিক্রিয়ায় মুসলমানরা সমগ্র বিশ্বে একঘরে সম্প্রদায়ের নিয়তি বরণ করতে চলেছেন। ইসলামের দাওয়াত এহেন পন্থায় পৌঁছানো কোনও সুফল বয়ে আনে কি? বিষয়টি নিয়ে ভাবনার সময় সম্ভবত এখনও তামাদি হয়ে যায়নি। দুর্বল অথবা একক উৎস নির্ভর হাদিসের মান যাচাই না-করে নিজ মতের সপক্ষে অকাতরে ব্যবহার এবং আবালবৃদ্ধবণিতা কর্তৃক যেমন খুশি উদ্ধৃতি টানার বিড়ম্বনা হচ্ছে সেই কারণ যার বোঝা এখন মোহাম্মদকে সমানে টানতে হচ্ছে। পারস্য প্রভাবিত শিয়া ইসলামের সঙ্গে সুন্নি, তাসাউফ পন্থী সুন্নি সুফি এবং শুদ্ধতাবাদী সালাফি ও ওয়াহাবি মতের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার পেছনে এসবের ভূমিকা মোটেও নগণ্য নয়। সমস্যার সমাধানকল্পে শুদ্ধি অভিযান চালানোর যে-শোরগোল উঠেছে অনেকে সেটাকে এ্যানক্যাশ করায় বিচিত্র আকারের চরমপন্থার উত্থান ইসলামে ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। কোরান-হাদিসের ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যক্তির ‘বুঝ বা আকল’ অনুসারে মতভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক এবং এতে আতংকিত হওয়ার বিশেষ কারণও নেই। পারস্পরিক সংলাপে গমনের মাধ্যমে মতভেদ শুধরে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায় সেদিকে গমন না করায় ফ্যাসাদের মাত্রা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, আলী সিনাদের মতো অ্যান্টি-ইসলামিস্টদের কাছে নিজেকে উপহাসের পাত্র করার সুযোগ তাঁরা করে দিয়েছেন। ল্যাজলি হ্যাজিলটন কোরানকে সর্বাগ্রে বিবেচনার যে-ইঙ্গিত নিজের গবেষণায় রাখেন সেটা নিয়ে তাই ভাবা প্রয়োজন এবং ইসলামি ঘরানায় অবস্থিত আলেম-উলামা ও চিন্তাবিদদের সেখানে নিশান বরদারের দায়িত্বটি নিতে হবে।

কোরানের কনটেক্সটকে অগ্রাধিকার দেওয়া বা এ-সম্পর্কিত নতুন ধারার গবেষণার সপক্ষে আলেম-উলামা ও বিদ্বানরা আগের চেয়ে অধিক সক্রিয় হলেও হুরসঙ্গ পেতে ব্যাকুল মর্দে মুমিনদের তাঁরা সহজে প্রভাবিত করতে পারবেন বলে মনে হয় না! বাংলাদেশের কথা ধরা যাক, ইন্টারনেটে বাংলা ভাষায় কোরান-হাদিস সংক্রান্ত তথ্য ও ভাবনা সমৃদ্ধ রচনার অভাব পীড়াদায়ক হলেও বাহাত্তর হুরির যৌক্তিকতা প্রমাণে জানবাজি রেখে লড়তে প্রস্তুত মর্দে মুমিনের অভাব নেই সেখানে! বাংলার আমজনতা ইসলামি টেক্সট পাঠের ধারা এখনও রপ্ত করে উঠতে পারেননি তা বুঝে নিতে ‘উইকি ইসলাম’র পাতায় একপাক ঘুরান দিয়ে আসা যথেষ্ট মনে হয়! মূল ইংরেজির চেয়ে বাংলা সংস্করণটি এক্ষেত্রে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। দেখে সন্দেহ হয় এর পেছনে মুমিন মুসলমানরা কাজ করছেন নাকি অ্যান্টি ইসলামিস্টরা একটি সম্প্রদায়কে পচানোর জন্য ইসলামের ছদ্মবেশে পাতাটি খুলে বসেছেন! যদি সেটা মিথ্যে হয় তবে একুশ শতকে বিরাজিত এইসব মুমিনের হালত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে!

পরজগতে হুরি সম্ভোগের মাধ্যমে নিজের অপূর্ণ কামবাসনা পূরণে উতলা মুমিনরা উন্নতাবক্ষা রমণীর ছবি আর ইলাস্ট্রেশনসহ হেন রেফ্রেন্স নেই যা সেখানে ব্যবহার করেননি। অবদমিত কামবাসনায় অস্থির এই মুমিনদের ভুলভাল তথ্য পরিবেশনের উৎকট বহর দেখে অনায়াসে বোঝা যায় বাহাত্তর হুরিকে পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে তারা ইসলামের মৌল ভিত্তি কোরানকে জীবন থেকে ছেটে ফেলতে দ্বিধা করবেন না। বাহাত্তর হুরির ন্যায্যতা প্রমাণে দুর্বল দলিল এমনকি কোরানের আয়াতে উদ্দেশ্যমূলক অর্থ আরোপনেও তাঁরা দ্বিধা করেননি! ইসলামে নতুন জ্ঞানের সঙ্গে পুরাতন জ্ঞানের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে এবং তার গ্রহণযোগ্য সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত এইসব গোঁড়ামি ও চরমপন্থার উত্থান রোখা সম্ভব বলে প্রত্যয় জাগে না।

পুরোনো জামানার জ্ঞান যা ইমাম তিরমিজি ও ইবনে খাতিরে ঝিলিক দিয়ে ওঠে, অতুল পাণ্ডিত্য ও কল্পনা প্রতিভার কারণে সে-জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা অতীতে ছিল এখন আছে এবং আগামীতেও থাকবে। কোরানের রূপক নির্ভর আয়াত সমূহের রহস্য উদঘাটনের দুর্নিবার ক্ষুধা ইবনে খাতির ও তিরমিজির মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। নশ্বর দেহ বিনষ্ট হওয়ার পর বারযাখ দশায় বিদ্যমান আত্মা কীভাবে সেই দেহের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে এই বিষয়টি তিরমিজিকে কৌতূহলী করে বলেই ‘অজব আদ-ধানাব’-এর (*Fundamental Particles; দ্রষ্টব্য : সপ্তম প্রবাহ-১-এ আলোচিত প্রসঙ্গ) কথা তিনি ভাবতে পেরেছিলেন। আপাত অধিবিদ্যক কিন্তু বিজ্ঞানের জন্যও ভাবনার খোরাক দিতে সক্ষম এই ভাবুকতা তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে! ইবনে খাতিরও কোরানের একাধিক আয়াতের ব্যাখ্যায় চমকপ্রদ মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন! কিন্তু তা-বলে তাঁদের সকল ব্যাখ্যা সঠিক ও অভ্রান্ত মেনে নিতে হবে এর মানে নেই! হুর সম্ভোগে উতলা মর্দে মুমিনরা যদি বিষয়টি দ্রুত উপলব্ধি করতে না পারেন তবে ইসলামের দাওয়াত গ্রহণে মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারবেন বলে একিন হয় না।

বাহাত্তর হুর পাওয়ার আশায় উতলা মর্দে মুমিন আর আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়ার পুরস্কার স্বরূপ হুরসহ হাতে জান্নাত ধরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির মাঝে নিহিত মিথ সম্পর্কে ল্যাজলি হ্যাজিলটন অথবা ইসলাম বিষয়ে বিলকুল নাদান এই রচনাকার একা অভিমত দিচ্ছেন বিষয়টি এমন নয়। উইকিডিপিয়ার ‘List of common misconceptions’-এ পরিবেশিত তথ্যও একই সুরে কথা বলছে দেখতে পাই। পিডিয়া সংকলক হুর সংক্রান্ত ব্যাখ্যা বিভ্রাটের তথ্য পরিবেশন করতে গিয়ে অঞ্জলি নির্মলের ‘Urban Terrorism: Myths and Realities’ বহিতে ব্যক্ত মতামত উদ্ধৃত করেছেন। এন, সি আস্থানার সঙ্গে জুড়ি বেঁধে রচিত গ্রন্থে অঞ্জলি জিহাদিগণের জান্নাতে বাহাত্তর হুর লাভের ঘটনাকে মিথ হিসেবে ব্যাখ্যার পাশাপাশি জান্নাতে গমনের পর হুর প্রাপ্তির ঘটনাকে সকল পুরুষের জন্য কমন বা ইনজেনারেল বলেই মতামত দিয়েছেন। বইয়ের ৩৩ থেকে ৩৭ নাম্বার পৃষ্ঠায় নিজের মতামতের সপক্ষে লেখক তাঁর যুক্তিগুলো তুলে ধরেছেন। নাগরিক জীবনে সংঘটিত সহিংসতার প্রবণতায় জিহাদের প্রভাব ও তার কার্যকারণ অনুসন্ধানের তাগিদে রচিত বহির প্রতিটি অধ্যায় কমবেশি পাঠ-গুরুত্ব বহন করে। Google Books Archive-এ বইটি পঠনের জন্য উন্মুক্ত থাকায় আগ্রহী পাঠক সেখানে ঢু মেরে বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করে নিতে পারবেন দেখে এখানে আর উদ্ধৃতি টানছি না।

পিডিয়া সংকলকের সুবাদে পাওয়া এ্যান্টি ইসলামিস্ট ও সেক্যুলার ঘরানায় নিজের সাকিন তালাশে নিয়োজিত ইবনে ওয়াররাকের ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত নিবন্ধের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। হুর সম্পর্কে ইসলামি চরমপন্থীদের অতি-উৎসাহে পানি ঢালার লক্ষ্যে ‘গার্ডিয়ান’-এ লিখিত নিবন্ধে ওয়াররাকের বক্তব্য হ্যাজিলটন, অঞ্জলি ও বক্ষ্যমাণ রচনা থেকে দূরবর্তী নয়। অতিকল্পনায় উৎসাহী প্রাচ্যমনের দুর্বার জল্পনাকে (Oriental Mind Play) হ্যাজিলটন বাহাত্তর হুরির মিথ তৈরির নেপথ্য কারণ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। ওয়াররাকের বক্তব্য এখানে হ্যাজিলটনের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন বলা চলে! জল্পনার উৎস উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি অবশ্য ইমাম গাজ্জালি ও আল-আশ’আরি-র নাম নিয়েছেন। ইন্দ্রিয়সুখ চরিতার্থের উপাচার দিয়ে সজ্জিত জান্নাতকে উনারা বিধিসংগত বলে সেকালে মত দিয়েছিলেন। ওয়াররাকের ভাষ্য অনুসারে গাজ্জালি ও আশ’আরি-র এহেন মতামত জান্নাতে ইন্দ্রিয়সুখের প্রকৃতি কেমন হতে পারে সেই জল্পনায় আল-সুয়ুতি-র মতো শাস্ত্রবিদকে মাতিয়ে তুলেছিল! সেইসঙ্গে হুর সংক্রান্ত জল্পনার একক উৎস ও প্রেরণা রূপে ইমাম আত-তিরমিজির ‘হাসান সহি গারিব’ নামে স্বীকৃত হাদিসের অবিসংবাদিত ভূমিকার কথা ওয়াররাকের নিবন্ধেও উঠে এসেছে। এই একটি হাদিসের প্রভাব আজও এতটাই অমলিন যে এর উল্লেখ ব্যতীত হুর সংক্রান্ত কোনও আলোচনাই বোধহয় সম্ভব নয়!

ওয়াররাক অবশ্য জান্নাতে কামবাসনা পূরণের এহেন বিধি-ব্যবস্থার প্রতি ইসলামি চিন্তাবিদগণের মনোভাবকে ইতিবাচক বলেই রায় দিয়েছেন। তাঁর মতে এটা প্রমাণ করে ইসলাম Sex Positive এবং এক্ষেত্রে তার জান্নাতকেন্দ্রিক পরকালবিদ্যা খ্রিস্ট ধর্মের চেয়ে অধিক বাস্তবানুগ ও প্রাগ্রসর। চার্চশাসিত খ্রিস্ট ধর্ম আত্মিক শুষ্কতার চাপে দেহের চাহিদাকে জান্নাতে যেভাবে পিষে মেরেছে তার সঙ্গে তুলনা করলে ইসলামের জান্নাত কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে টাবুমুক্ত বলে স্বীকার যাওয়া উচিত। ইন্দ্রিয়জ বাসনাকে আত্মিক পবিত্রতার বিমূর্ত ফাঁদে সে বন্দি করেনি এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে ইসলামি জান্নাতকে ইহজাগতিক ও স্বাস্থ্যকর মানতে হয়। হ্যাজিলটনের সঙ্গে এখানে তাঁর বক্তব্যের মিল চোখে পড়ে। উপরন্তু হুরিসঙ্গে কামবাসনা চরিতার্থে বিভোর চরমপন্থী ইসলামিস্টদের জোশ ঠাণ্ডা করতে ক্রিস্তোফ লুক্সেনবার্গ রচিত ‘The Syro-Aramaic Reading of the Koran’ বহির উদাহরণ ওয়াররাক তাঁর নিবন্ধে উল্লেখ করতে ভোলেননি।

বেঞ্জামিন ওয়াকারের মতের সঙ্গে অভিন্ন লুক্সেনবার্গ কোরানে সিরিয়া অঞ্চলে প্রচলিত আরামাইক ভাষা ও শব্দার্থের প্রয়োগ নিয়ে খাটাখাটনির পর এ-সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, — বাহাত্তর হুরি সংক্রান্ত বিশ্বাসটি যেমন অতিকল্পনা বা মিথ, হুর শব্দের অর্থ অবধানেও মুসলমান সম্প্রদায় আজোবধি ভুল করেই চলেছেন! তাঁর মতে কোরানে ব্যবহৃত হুর শব্দটি সেকালে শাম দেশ (*সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান ইসরায়েলফিলিস্তিন মিলে বিস্তৃত ভূখণ্ড যা একসময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং খোলাফায়ে রাশেদীন তৎপরবর্তী উমাইদ, আব্বাসীয় অটোম্যান শাসনামলেরবিলাদ আলশামনামে পরিচিত হয়ে ওঠে আইএস সাম্প্রতিক উত্থানের সময়বিলাদ আলশামসলেভান্ট নামে ব্যাপক পরিচিত পায় ইরাকের সঙ্গে এইবিলাদ আলশামসওরফে লেভান্ট অঞ্চলে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম আইএস চরমপন্থীদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল) নামে বিদিত সিরিয়ায় প্রচলিত আরামাইক ভাষার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত! আরামাইক শব্দকোষে সাদা আঙুর (White Grapes) এবং রাইজিন (Raisin) বা কিশমিশ বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দের ভাবব্যঞ্জনাই কোরানে হুর অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, হুর সংক্রান্ত যেসব উপমা সেখানে রয়েছে তা জান্নাতে লভ্য বিশেষ প্রজাতির আঙুর ও কিশমিশের রকমফের ছাড়া অন্য কিছু নয়। অগত্যা জিহাদিরা জান্নাতে গমনের পর হুর নামে যে-বস্তু লাভ করবেন সেটা হলো সাদা আঙুর নয়তো শুকনো কিন্তু সুস্বাদু কিশমিশ!

নিজের এই দাবির মধ্য দিয়ে লুক্সেনবার্গ প্রমাণ করতে চেয়েছেন, কোরানে সেকালের সিরিয়ায় প্রচলিত খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব ব্যাপক ছিল এবং আরামাইক ভাষার ভাবব্যঞ্জনা পরে আরবিতে সংশোধিত হয়ে হুর-এ রূপ নিয়েছিল। লুক্সেনবার্গ এখানে বাইবেল সম্পর্কে মুসলমানদের পুরোনো দাবি উলটো তাদের দিকেই ছুড়ে দিয়েছেন! ইসলামি ঘরানায় অবস্থিত বিদ্বানরা সবসময় দাবি করে আসছেন আদি বাইবেল ওরফে ইঞ্জিল গ্রিক নয় বরং হিব্রু নতুবা আরামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। ক্রুশবিদ্ধ ঈসা নবির বিখ্যাত উক্তি ‘এলি এলি লামা সাবাক্তানি’ (*‘ঈশ্বর আমার, ঈশ্বর আমার, তুমি কেন আমায় পরিত্যাগ করেছ?’; মথি ২৭:৪৭) আরামাইক শব্দার্থের স্মারক রূপে নিউ টেস্টামেন্টে আজও বহাল রয়েছে! এই বাক্যটি প্রমাণ করে আদি বাইবেলের সঙ্গে সেকালের শাম তথা সিরিয়ার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের সংযোগ ছিল এবং ইসা নবি আরামাইক ভাষায় দীনের বাণী প্রচার করে গিয়েছেন। লুক্সেনবার্গ এখন সেই দাবিকে কোরানের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, অর্থাৎ তাঁর দ্রাক্ষা ও কিশমিশ তত্ত্বে বিশ্বাস যাওয়ার অর্থ হলো একজন মুসলমানকে স্বীকার করে নিতে হবে, কোরান আরবিতে প্রণীত হয়নি বরং আরামাইক ভাষার শব্দ ও ভাবব্যঞ্জনার মোহাম্মদকৃত আরবি ভাষান্তর রূপে একে গণ্য করা উচিত! সুতরাং গ্রন্থটি আদৌ ঐশী কিংবা প্রেরিত নয়!

ওয়াররাকের নিবন্ধটি আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। লুক্সেনবার্গের এই আবিষ্কার তখন জার্মান ভাষায় বহি আকারে মুদ্রিত হয়ে মাত্র বাজারে এসেছে। ‘গার্ডিয়ান’-এর প্রতিবেদন সূত্রে তিনি বিদ্বানদের নজরে আসতে শুরু করেন। এরপর বহু জল গড়িয়েছে এবং বইটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এর পক্ষে-বিপক্ষে বাদানুবাদ নেটে ঘুরান দিলে সহজেই চোখে পড়ে! ইসলামি ঘরানার একাধিক বিদ্বান লুক্সেনবার্গের বইকে ইসলাম সম্পর্কে খ্রিস্টান মহলের অপপ্রচারের ধারাবাহিকতায় নয়া সংযোজন রূপেই বিবেচনা করেন। তাঁর দাবি খণ্ডন করতে গিয়ে নিজেদের যুক্তি তাঁরা তুলেও ধরেছেন। তাঁরা মনে করেন কোরানে আরামাইক ভাষার প্রভাব থাকতেই পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সেটা আছেও হয়তো। সিরিয়ার সঙ্গে মোহাম্মদের সংযোগ হাদিস ও জীবনী ঘাটলে পাওয়া যায়। সিয়াসিত্তায় (*বুখারী, মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ ও নাসায়ী কর্তৃক লিপিবদ্ধ এবং ইসলামে স্বীকৃত ছয়টি সহি হাদিস সংকলনের সমষ্টি।) বর্ণিত বিবরণ অনুসারে শাম হচ্ছে সেই বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেখানে সভ্যতার দ্যুতি সবসময় ঠিকরে পড়েছে। নবিগণের পদচারণায় মুখর অঞ্চলটি সম্পর্কে মহানবির ভবিষ্যৎবাণীর উল্লেখ সকল হাদিস গ্রন্থেই পাওয়া যায় :—

সুনানে আবু দাউদের একটি হাদিসে (৪২৯৮) কেয়ামতের আগে সংঘটিত মহাযুদ্ধে সিরিয়ার দামেস্ক শহরের নিকটবর্তী ‘গোতা’-কে মহানবি মুসলমান সৈন্যদের উৎকৃষ্ট আশ্রয়স্থল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মাহদির খিলাফত গ্রহণ, দাজ্জালের আবির্ভাবস্থল ইত্যাদির সঙ্গে শাম তথা সিরিয়া ও পাশ্ববর্তী দেশগুলোর সংযুক্তি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। সহি মুসলিমের ২৯৩৭ নাম্বার হাদিসে দাজ্জাল দমনের জন্য প্রেরিত ঈসা নবি দামেস্ক শহর দিয়ে প্রবেশ করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। সুনান আবু দাউদের ২৪৮২ নাম্বার হাদিসটি এখন সনদ দুর্বল হওয়ার কারণে যয়িফ বিবেচিত হলেও নবি সেখানে হিজরত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলছেন, মদিনার পর আরেকটি হিজরত হবে সিরিয়ায়, যেখানে একদিন ইব্রাহিমের পদচারণা ঘটেছিল। যারা এই সময় সিরিয়ায় সমবেত হবে তারা হবে উত্তম আর বাদবাকিরা নিকৃষ্ট। সিরিয়া ও ইরাকে আইএসপন্থী জিহাদিগণের উত্থানের নেপথ্যে যয়িফ এই হাদিসের ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। আবু দাউদের পরবর্তী হাদিসটিও কৌতূহল-উদ্দীপক, যেখানে মহনবির বরাত দিয়ে ইবনু হাওয়ালা জানাচ্ছেন :—

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : শীঘ্রই ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটবে যখন জিহাদের জন্য তিনটি সেনাদল গঠিত হবে, সিরিয়ার (*সেকালের শাম) সেনাবহিনী, ইয়ামেনের সেনাবাহিনী এবং ইরাকের সেনাবাহিনী। ইবনু হাওয়ালা (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি সেই যুগ পেলে আমার জন্য কোন দলের সঙ্গী হওয়া মঙ্গলজনক মনে করেন? তিনি বললেন : তুমি অবশ্যই সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে। কেননা তখন এ এলাকাটাই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম গণ্য হবে। আল্লাহ তাঁর সৎকর্মশীল বান্দাদের এখানে একত্র করবেন। আর তুমি সিরিয়া যেতে রাজী না হলে অবশ্যই ইয়ামেনি সেনাবাহিনীর সঙ্গী হবে। তোমাদের নিজেদের এবং তোমাদের কূপগুলো থেকে পানি উত্তোলন করো। কেননা মহান আল্লাহ আমার ওয়াসিলায় সিরিয়া ও এর অধিবাসীদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন।’ — উৎস : সুনান আবু দাউদ (তাহকিককৃকত); অধ্যায় জিহাদ, ২৪৮৩; হাদিসের মান : সহি; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম

হাদিসটি পাঠের পর কিছুদিন আগেও ইরাক ও সিরিয়ায় সক্রিয় আইএস-র পৃথক দুটি দল এবং ইয়েমেনের শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের কথা চকিতে মানসপটে ভাসে বৈকি। যদিও মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে শত বছর ধরে চলমান সংঘাত, স্থানিক বাদবিবাদ ও পরাশক্তির জটিল হস্তক্ষেপের ফলাফল থেকে উদ্ভূত আইএস ও হুতির সামগ্রিক কাজকরবার বিবেচনায় এ-সম্পর্কে বাড়তি কথা না বলা সমীচীন। সেকালের শাম ও একালের সিরিয়া সম্পর্কিত সবচেয়ে সাংঘর্ষিক হাদিসটি সুনানে আত-তিরমিজির সূত্রেই পাওয়া যায়। হাদিথবিডিডটকম-র ভাষ্য অনুসারে দুর্বল সনদের অধিকারী ‘হাসান গারিব’ ও যয়িফ চিহ্নিত হাদিসটি আবু হুরায়রার বয়ানে জানাচ্ছে :—

‘আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : খোরাসানের দিক হতে কালো পতাকাবাহীগণ আবির্ভূত হবে (মাহদীর সমর্থনে)। অবশেষে সেগুলো ইলিয়া (বাইতুল মাকদিস *জেরুজালেম)-এ স্থাপিত হবে এবং কোনও কিছুই তা ফিরাতে পারবে না।’ — উৎস : সুনান আততিরমিজি (তাহকিককৃকত); অধ্যায় জিহাদ, ২৪৮৩; হাদিসের মান : সহি; হাদিস সংকলন গ্রন্থনা : হাদিথবিডিডটকম



চিত্র১৪ : অইএসআইএস  (Islamic States of Iraপ্রণীত  ‘বিলাদ আলশামস’-এ মানচিত্র Source: markandjackiephotos.com;

ইমাম মাহদীর আগমনকে কেন্দ্র করে মুসলমান সম্প্রদায়ে বিভিন্ন সময়ে চলমান ফিতনা সৃষ্টিতে তিরমিজির এই হাদিসের ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকে মত দিয়ে থাকেন। আল্লামা ইকবাল ও মোহাম্মদ আসাদ যেমন মনে করতেন আসমান থেকে উদ্ধারকর্তা আগমনের দিন বিগত হয়েছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের অবধান করা উচিত পশ্চিমা সভ্যতা হচ্ছে সেই দাজ্জাল যে তাদের গ্রীবার নিকটেই নিঃশ্বাস ফেলছে। এখন তাকে কী করে প্রতিরোধ করা যায় সেই মন্ত্রে নিজেকে বরং উজ্জীবিত করার সময় হয়েছে।

সহিসিত্তা অনুসারে শাম ওরফে সিরিয়ার গুরুত্ব এখানেই শেষ নয়, বরং সিরিয়া হচ্ছে সেই স্থান যা কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পর হাশরের ময়দান হিসেবে ব্যবহৃত হবে। হাদিসবেত্তাদের ভাষায় এটা হবে কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পর মৃত ও কবরস্থদের প্রথম সমাবেশস্থল। অতঃপর আল্লাহ এই ভূখণ্ডের গুণগত প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটাবেন এবং তাকে ঐশ্বরিক উপায়ে পরজাগতিক হাশরের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেবেন ইত্যাদি। হাদিথবিডিডটকম সূরা ‘ইব্রাহিম’র ৪৮ নাম্বার আয়াতের বরাত দিয়ে জানাচ্ছেন, ‘সেদিন পরিবর্তিত করা হবে এ জমিনকে অন্য জমিন দ্বারা এবং পরিবর্তিত করা হবে আসমান সমূহকেও এবং লোকেরা পরাক্রমশালী এক আল্লাহর সামনে হাজির হবে।’

ইসলামের এই পরকালবিদ্যা থেকে অনুমেয় কেয়ামত মানেই ইহজগতের বিনষ্টি নয়, বরং ইহজগৎকে পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে সংযুক্ত করা হবে পরজগতের সঙ্গে এবং সেক্ষেত্রে দুই জগতের মধ্যে বিরাজিত আবরণ বা আলমে বারযাখের পরিসমাপ্তিও সেদিন ঘটে যাবে। কী উপায়ে ঘটবে সেটা মানব ‘আকল’র পক্ষে বোধগম্য না হলেও একেশ্বরবাদী ধর্মের কঠোর ছকে যে-ব্যক্তি বিশ্বাস যায় তাকে এটা মেনে নিতে হবে এখন যেমন সে কাবার মাধ্যমে পরজগতের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে, কিয়ামতের অনতিপরবর্তী কেন্দ্রস্থল হিসেবে তার সংযুক্তি শাম ওরফে সিরিয়াসহ পাশ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর সূত্রেই ঘটানো হবে। এহেন গুরুত্বপূর্ণ সিরিয়ার ভাষিক প্রভাব অগত্যা কোরানে প্রতিফলিত হওয়া বিচিত্র নয় বলেই ইসলামবেত্তারা মনে করেন, যদিও এর মানে এটা দাঁড়ায় না যে থিয়োরি ফেঁদে আরামাইক ভাষাকে কোরানের ভিত্তি গণ্য করতে হবে। কারণ সেমিওটিক্সের বিচারে আরামাইক শব্দকোষে বর্ণিত ভাবব্যঞ্জক শব্দার্থবিধির সঙ্গে কোরানের আরবি ভাষা আশ্রিত বয়ানের সংযোগ নিবিড় নয়।



চিত্র
১৫ : পাকিস্তানের প্রখ্যাত প্রথম নারী চিত্রকর আন্না মূলকা আহমেদ কল্পনায় পুনরুত্থান দিবস; Source: ‘The day of Resurrection – Qiyamat’ by Anna Molka Ahmed; 1917-1994); pakistanpaedia.com.

তো যাই হোক, লুক্সেনবার্গের ‘দ্রাক্ষা ওরফে কিশমিশ’ তত্ত্ব খণ্ডনে মুসলমান বিদ্বানরা উলটো এই অভিমত রেখেছেন, তিনি আরবি শব্দের অর্থে বরং সিরীয় ভাবব্যঞ্জনা আরোপ করে প্রমাণ করতে চাইছেন যে হুর শব্দটি আরামাইক বা সিরীয়। তাঁর এই শব্দার্থ ব্যাখ্যা এটা প্রমাণ করে না হুর শব্দের সঙ্গে আরমাইক বা সিরিয়ার শুভ্র আঙুরের সম্পর্ক রয়েছে। তদুপরি খ্রিস্টান বিদ্বানদের অনেকেও লুক্সেনবার্গের তত্ত্ব পরে ভ্রান্ত বলে খারিজ করে দিয়েছেন। শব্দতত্ত্বের এইসব মাথাধরানো কচকচানিতে যেতে চাই না বিধায় পাঠককে ড্যানিয়েল কিং রচিত পেপারের (*A Christian Qur’ān? : A study in the syriac background to the Language of the Qur’ān as presented in the work of Christoph Luxenberg; academia.edu) ৬৫ থেকে ৬৮ পৃষ্ঠা অবধি ব্যাপ্ত আর্গুমেন্ট পাঠে অনুরোধ করি। উক্ত পাঠ সম্ভবত লুক্সেনবার্গের দাবির অসরাতা প্রমাণে যথেষ্ট।

এখন জিহাদিদেন জোশ নেভাতে ওয়াররাক তো উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু পরে এ-সম্পর্কে আর খোঁজখবর নিয়েছিলেন কি না সে তিনিই ভালো বলতে পারবেন। কট্টরপহ্নী ইসলামি ঘরানায় বিদ্যমান আলেম ও ইংরেজি শিক্ষিত বিদ্বানদের ব্যাপারে তিনি বা তাঁর কলিগদের মধ্যে এক ধরনের তাচ্ছিল্য সূচক মনোভাব উপচে উঠতে দেখা যায়। যদিও সময় আসলে পালটে গেছে। কট্টরপন্থী ঘরানায় অবস্থিত বিদ্বানরা বিপক্ষ মত খণ্ডনে এখন মোটেও কাঁচা নন এটা খেয়াল রাখা খুব জরুরি। ইতোমধ্যে এ-ধারায় অনেক শক্তিমান বিদ্বান ও বিতার্কিকের আবির্ভাব ঘটে গেছে। ইসলামসহ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে তাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সমীহজনক! অন্য শাস্ত্রের খোঁজখবরও ভালোই রাখেন। ইংরেজিতে বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও তাঁরা অতীতের চেয়ে সাবলীল। তো সব মিলিয়ে তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে কেবল সায়েবসুবোর বইপত্তর যথেষ্ট নয়। আরবিতে বুৎপত্তি এক কথায় ফরজ। অন্যথায় তাঁদের অ্যাটাক করতে যেয়ে নিজে নাকাল হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক।

সময়ের পটপরিবর্তনে ইসলামি জ্ঞানের প্রকৃতির মধ্যে নতুন ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হচ্ছে, গবেষণার ধারা আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। হ্যাজিলটন তাঁর গবেষণায় জান্নাত বা হুরকে নতুন প্রাসঙ্গিকতায় ব্যাখ্যা করেছেন, যা প্রমাণ করে কোরান-হাদিসে লিপিবদ্ধ টেক্সটকে যুগের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক জ্ঞান সহকারে ব্যাখ্যা ও পাঠ করা সম্ভব। এই ব্যাখ্যাগুলোর ওপর ফতোয়া জারি না করে আলোচনার স্পেস দিতে হবে, যেন কোরানে আরও নিবিড়ভাবে গমন করা যায়। কোরান-হাদিসকে আক্ষরিক অর্থে পাঠ করা এক কথা আর মৌলিকত্ব ক্ষুণ্ন না করে সমসাময়িক পটপ্রবাহ ও প্রাসঙ্গিক আয়তনে ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ পৃথক ঘটনা। মর্দে মুমিনদের কাছে এই বার্তা যদি পৌঁছানো না যায় তবে আজহারির গান ও কিসসায় ঠাসা ওয়াজ শ্রবণান্তে তেত্রিশ বছরের যুবক হয়ে জান্নাতে বিচরণের স্বপ্নেই তাঁদের বেলা কাবার হবে। আপাতত এ-পর্যন্ত। আগামী প্রবাহে জাকির নায়েকের হুরতত্ত্ব আর ওদিকে আলী সিনা ও বাদবাকিদের সম্পর্কে দু-চারকথা যোগ করে দীর্ঘযাত্রায় পরিশেষ টানতে চাই।


ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১১
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১০
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৯
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৮
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৭  
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৬ 
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you