কাইল্লাগুডা || কল্লোল তালুকদার

কাইল্লাগুডা || কল্লোল তালুকদার

কালিগুটা হাওর। স্থানীয় উচ্চারণে ‘কাইল্লাগুডা’। এই দিগন্তবিস্তৃত সবুজ সমুদ্র দেখে তার বর্ষার রূপ কল্পনা করাও কঠিন। বর্ষায় প্রকৃত প্রস্তাবেই সে পরিগ্রহ করে সাগরের রূপ।

ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হাওরের বর্ণও বদলে যায়। বর্তমানের এই সবুজ রঙ মাসখানেক পর থেকে ক্রমশ সোনালি বর্ণ ধারণ করবে। অকাল বন্যার কবলে না-পড়লে ধানকাটা শেষ হওয়ার পর মাঠভর্তি কেবল খড়কুটো। তারপর আসে প্লাবন। তখন তার চেহারা আমূল পাল্টে যায়। হাওরপাড়ের গ্রামগুলো ছাড়া সবকিছু যায় তলিয়ে। তখন বিস্তীর্ণ চরাচরে কেবল জলধি; তার মধ্যে গ্রামগুলি যেন একেকটা দ্বীপ।

প্রথম বর্ষায় বানের জলে পলি থাকায় পানির রঙ হয় ঘোলাটে। আকাশে যখন মেঘের ঘনঘটা, তখন হাওরের সাদা রঙ নিমিষেই বদলে গিয়ে হয়ে যায় মিশমিশে কালো। ভয়ালদর্শন! বাতাস একটু জোরে বইতে থাকলে দেখা দেয় “চান-কপালি” ঢেউ, যার ভয়াল ছোবলে ভেঙে যেত কৃষকের ঘরবাড়ি। আগের দিনে ঢেউয়ের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য গ্রামের পাশে সৃষ্টি করা হতো হিজল-করচের সবুজ বেষ্টনী। বর্তমানে এই এলাকার বেশকিছু গ্রামে নির্মিত হয়েছে কনক্রিটের সুরক্ষাপ্রাচীর।

শরতে হাওর গাঢ় নীলবর্ণা। আকাশ আর হাওরের সীমারেখা ঘুচে গিয়ে যেন মিলেমিশে একাকার। এরপর শীতে পানি সরে গিয়ে আবার জেগে ওঠে উর্বর মৃত্তিকা।

এই ‘কোমলে কঠোরে মিশ্রিত’ হাওরের পরিবেশ-প্রতিবেশের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে হাওরবাসীর জীবন। অগণিত মানুষের হাসিকান্না তথা যাপিত জীবনের গল্প মিশে আছে এই হাওরের বাতাসে-পানিতে-মাটিতে!

একসময় এই কালিগুটা হাওরের একটি কুখ্যাতিও ছিল। বর্ষায় দিনে-দুপুরে এই হাওরে ডাকাতি হতো। আষাঢ় মাসের ভাসা পানিতে পাল উড়িয়ে নাইওরী নৌকা যখন এই হাওর পাড়ি দিত, তখন জলদস্যুরা প্রায়শই হানা দিয়ে লুটপাট করত। তাই রাতে তো প্রশ্নই ওঠে না, দিনের বেলায়ও হাওর পাড়ি দেওয়ার সময় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সদা সতর্ক থাকতে হতো। সামর্থ্যবানেরা নিরাপত্তার জন্য বন্দুকও সঙ্গে রাখতেন। কারণ হাওরের জলদস্যুরা ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান’ না-হলেও কম ভয়ঙ্কর ছিল না।

অনেকদিন পর গত শনিবার কালিগুটাকে দু-চোখ ভরে দেখে এলাম। পালতোলা সোয়ারি নৌকায় মায়ের সঙ্গে আমিও দু’বার মামাবাড়ি নাইওর করেছি। যাত্রাপথে এই হাওরও পাড়ি দিতে হয়েছে। প্রথমবারের কথা একেবারেই ঝাপসা হয়ে গেছে, তবে দ্বিতীয়বারের (১৯৮১ সালে) কথা এখনও বেশ মনে আছে। যদিও কোনো অঘটন ঘটেনি, তবু হাওরপাড়ি দেওয়াকালে মাঝিমাল্লাদের টানটান উত্তেজনা, সতর্কতা ও আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতির কথা স্পষ্ট মনে আছে।

কালিগুটা আমার গ্রামের বাড়ি থেকে তেমন-একটা দূরে নয়। এটি আমাদের পাগনার হাওরের নিকটাত্মীয়। আগের দিনে “বর্ষায় নাও, আর হেমন্তে পাও” সম্বল ছিল বলে এই সামান্য দূরত্বকেও হয়তো অনেক মনে হতো। কিন্তু যাতায়াতব্যবস্থায় প্রভূত উন্নয়ন ঘটায় এইটুকুন দূরত্ব এখন কোনো বিষয়ই না।

গত শনিবারে গ্রামের বাড়ি ছয়হারা থেকে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। হাওরের মেঠোপথ ধরে। গ্রামের দক্ষিণ সীমানা কানাইখালী পার হয়ে কামারগাঁও, লক্ষ্মীপুর, নাজিরনগর, কাশিপুর, হটামারা ও উদয়পুর প্রভৃতি পাগনার হাওরস্থিত গ্রামের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলি। এরপর দিরাই থানার বিখ্যাত আয়লার বিল। ৩০ মিনিটেরও কম সময়ে পৌঁছে গেলাম বাংলাবাজার। আমার বাড়ি থেকে দূরত্ব মাত্র ৮.৭৫ কিমি! কিন্তু ঘুরপথে যাতায়াত করতে হয় বলে মনে হয় যেন কত দূরে!

এরপর বাংলাবাজার থেকে কালিগুটার উত্তরপাড় ধরে স্বজনপুর, রামজীবনপুর, সাদিরপুর, গাজিয়ারগাঁও, সমীপুর, নয়াগাঁও, বলনপুর প্রভৃতি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘোরাঘুরি। কালিগুটার দক্ষিণপাড়ে পেরুয়া, কিন্তু দৃষ্টিসীমার বাইরে। ফেরার পথে ভাটিবাংলার বর্ধিষ্ণু গ্রাম খাগাউড়া থেকেও ঘুরে এসে আয়লার বিলে মধ্যাহ্নভোজন।

এই অঞ্চলটি ৫নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাবসেক্টরের অধীন ছিল। কালিয়াগুটা হাওর দিরাই থানায় আর পাগনার হাওর জামালগঞ্জ থানার অন্তর্গত। দুই থানায় অবস্থিত হলেও এই অঞ্চল একই সাংস্কৃতিক বলয়ের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের নয়মৌজার সঙ্গে কালিয়াগুটা হাওরপাড়ের মানুষের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এখানে এসে তা আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করলাম। দেখি, সবাই সবার পরিচিত, আত্মীয়! কিন্তু বাড়ির এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও বলা যায় এখানে আমি আগন্তুক। তাই আমার কাছে যেন সবই নূতন!

… …

কল্লোল তালুকদার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you