দ্বিতীয় প্রবাহ : কোরানে জ্ঞানের গভীরতা–অগভীরতা এবং মিসিং আয়াত ও প্রসঙ্গমূলক টেক্সট
এটা কমবেশি সকলের জানা, ইসলাম-পূর্ব কবিতায় পৌত্তলিক কন্টেন্টের বাড়াবাড়ির কারণে মূলধারার ইসলাম এই কাব্যচর্চাকে সবসময় বাতিল রায় দিয়ে এসেছে। কবিতাচর্চার ব্যাপারে কোরান-হাদিসের সীমারেখা বিবেচনায় স্রষ্টা ও প্রেরিত নবিগণের শংসা গায় এবং ইসলামি জীবনবোধের সারার্থ তুলে ধরে এমন কবিতা ছাড়া বাদবাকি কবিতা বাতিল বা গৌণ বলে সচরাচর বিবেচিত হয় সেখানে। মূলধারার ইসলামের দাবি অনুসারে কোরান একমাত্র টেক্সট যার ভাষাশক্তি ও মাধুর্য জগতের সকল কবি ও কবিতাকারকে অনায়াসে অতিক্রম করে যায়; যদিও কোরান কবিকৃত কোনও রচনা নয় এবং কবিতার রূপময় জগতকে প্রমোট করার জন্য মহানবির কাছে জিবরাইল ওহি নিয়ে হাজির হননি। মোহাম্মদের জন্য কবিদের প্রত্যাখ্যান সেকালে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের কারণে এমনিতেও জরুরি ছিল। আল্লাহর বাণী প্রচারের মিশন নিয়ে হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে আসার পর গোত্রের লোকজন তাঁকে বাতুল কবির কাতারে ফেলে বিবেচনা করতে শুরু করে। আরব গোত্রপিতাদের এই মনোভাব নিরসনে কোরানের একাধিক আয়াতে মোহাম্মদের প্রাণান্ত বাকবিভূতির পরিচয় মিলে :—
‘বিভ্রান্ত লোকরাই কবিদের অনুসরণ করে।’ ‘তুমি কি দেখো না যে, তারা প্রতি ময়দানে উদভ্রান্ত হয়ে ফিরে?’ ‘এবং এমন কথা বলে, যা তারা করে না।’ — আশ-শো’আরা ২৬:২২৪-২২৬;
‘আমি রসুলকে কাব্য রচনা করিতে শিখাই নাই এবং ইহা তাহার পক্ষে শোভনীয় নয়। ইহা তো কেবল এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কুরআন;’ — ইয়াসিন ৩৬:৬৯;
‘উহারা ইহাও বলে, ‘এই সমস্ত অলীক কল্পনা, হয় সে উহা উদ্ভাবন করিয়াছে, না হয় সে একজন কবি। অতএব সে আনয়ন করুক আমাদের নিকট এক নিদর্শন যেরূপ নিদর্শনসহ প্রেরিত হইয়াছিল পূর্ববর্তীগণ।’ — আম্বিয়া ২১:৫;
‘উহাদেরকে ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনও ইলাহ্ নাই’ বলা হইলে উহারা অহংকার করিত। এবং বলিত, ‘আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের ইলাহগণকে বর্জন করিব?’ — সাফফাত ৩৭:৩৫-৩৬;
‘উহারা কি বলিতে চাহে সে একজন কবি? আমরা তাহার মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেছি।’ বলো, ‘তোমরা প্রতীক্ষা করো, আমিও তোমাদের সঙ্গে প্রতীক্ষা করিতেছি।’ — আত তূর ৫২:৩০-৩১;
‘ইহা কোনও কবির রচনা নয়; তোমরা অল্পই বিশ্বাস করো,’ — হাক্কা ৬৯:৪১;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
কোরানের আয়াত সহকারে ‘বাতিল ও নতুন’-এর সংঘাতমুখর প্রস্তাব নিয়ে মক্কার গোত্রপিতাদের সম্মুখে যে-ব্যক্তি সেই সময় হাজির হয়েছিলেন তাঁকে গোত্রশাসিত আরব সংস্কৃতিতে অভিনব ও পার্থক্য নির্ধারণকারী ঘটনা মানতে হয়। আল্লাহ প্রেরিত পথপ্রদর্শক ও বার্তাবাহক রূপে মোহাম্মদের নিজেকে দাবি করার ঘটনা কোরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রপিতারা ধর্মদ্রোহের সমতুল্য অপরাধ হিসেবে সেকালে গোনায় নিয়েছিলেন। বিপরীত বিশ্বাস ধারণ করায় গোত্রপিতারা তাঁকে ব্লাসফেমির প্রবর্তক রূপে চিহ্নিত করেন সেই সময়। মোহাম্মদকে কোরাইশরা যখন বাতুল কবি ঠাউরায় তখন তিনি কেন কোনও কবি নন বরং ঐশী আদেশের প্রচারক রসুল এবং সেটা প্রমাণের জন্য কবিতার বিপক্ষে অবস্থানটি তাঁকে নিতে হয়েছিল। বিষয়টিকে এখন যেরকম পূর্ব-পরিকল্পিত মনে হয় সেকালের ঘটনাধারা বিবেচনায় তাকে পরিস্থিতি তাড়িত বলেই মানতে হয়। অর্থাৎ ইসলাম প্রচারের শুরুর দিনগুলোয় মক্কাবাসীরা যদি মোহাম্মদকে নবি বলে স্বীকার যেত তাহলে কবিতা-গানবাজনা-চিত্রাঙ্কন ও শরাবান তহুরার ওপর বিধিনিষেধের খড়গ হয়তো এত তীব্র আকারে নেমে আসত না।
মনে রাখা প্রয়োজন, ইতোপূর্বে অবতীর্ণ ঐশী গ্রন্থের তুলনায় কোরানে ওহি নাজিলের ধরন বহুল পরিমাণে ঘটনা নির্ভর ছিল। ঘটনা ঘটে এবং তার সাপেক্ষে ওহি হাজির হয় অথবা জিবরাইল মারফত আল্লাহ সংশোধনী পাঠান। মক্কার চারধারে ছড়ানো প্যাগান গোত্র, অদূরবর্তী খ্রিস্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর ওহি প্রাপ্তির ধারা নিয়ে অগত্যা সংশয় জাগ্রত হয়েছিল এবং তাঁকে বাতুল ও স্বপ্নগ্রস্ত কবি দাগাতে তারা দুবার ভাবেনি! মোহাম্মদের ঘটনাবহুল জীবনে সংঘটিত ঘটনা ও ধারা বুঝে তাঁর রিঅ্যাক্ট করার বিষয়টি এখানে তাই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।
আরব অঞ্চলের গোত্রশাসিত জীবনে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অপরাধ প্রবণতা, বহুগামীতা এমনকি শিশুমৈথুনাবেশ বা পিডোফেলিয়ার খুচরো ঘটনা কমবেশি ছিলই। মোহাম্মদকে শুরুতে এই ঘটনাগুলোর ওপর অতটা রুষ্ট হতে দেখা যায়নি। গোত্রশাসিত জীবনের ছকে তিনি নিজেও আয়েশাকে নয় বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন। ইসলামের সমালোচনা করতে যেয়ে যেসব লোক ডাট মেরে ইসলামবিদ্বেষী (Islam Hater) বলে নিজেকে জাহির করেন তাঁরা বিবাহের ঘটনাকে মোহাম্মদের পিডোফেলিয়ায় আসক্তির উদাহরণ রূপেই প্রচার করে থাকেন। যদিও মোহাম্মদের সঙ্গে আবু বকরের বন্ধুত্ব ও নবির প্রতি তাঁর ভালোবাসা, গোত্রশাসিত রাজনীতির ধারা, সেকালের প্রথাচার এবং বালিকা বয়স থেকে প্রখর বুদ্ধির অধিকারী আয়েশার সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বের প্রতি নবির সহজাত আকর্ষণ ইত্যাদি বিচারে এই বিবাহকে পিডোফেলিয়া দাগানো ইসলামবিদ্বেষীদের অতিরঞ্জিত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে মন ওঠে না। সে যাই হোক, বহুগামিতা কিংবা নানাবিধ বিষয়ে মোহাম্মদের এই নমনীয় মনোভাব পরে আর বজায় থাকেনি; বিশেষভাবে মদিনায় হিজরত ও শক্তি অর্জনের পর কোনও কিছু আর আগের জায়গায় ছিল না!
কমপ্লেক্সটা এখানেই! ঘটনার ধারাবাহিকতায় মোহাম্মদ যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন এবং মদিনাস্থ বিত্তবান ও প্রভাবশালী ইহুদি গোত্র সমূহের দাসে পরিণত আনসারদের আনুগত্য অর্জনের ফলে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় করলেন তখন থেকে কোরানে টেক্সটের ধাঁচে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। মক্কাপর্বে যে-টেক্সট ক্ষণে-ক্ষণে নমনীয় সুরে আপসরফার গুঞ্জন উঠায়, মনিদাপর্বে তার ভাষাকাঠামোয় শাসনের সুর প্রবল হয়ে বাজে। ইসলাম প্রচারের সূচনাপর্বে মোহাম্মদ দ্রুত সেই অবস্থায় পৌঁছাতে পারেননি যে তাঁর হয়ে কোরান আরবদের জীবনধারা কেমন হওয়া উচিত সেটা নির্ধারণ করে দেবে। তাঁর নমনীয় মনোভাব অনুসারে কোরান নমনীয় রূপ ধারণ করে গোত্রপিতাদের সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত ছিল। বিষয়টি উপলব্ধির খাতিরে ৫৩ নাম্বার সূরা ‘আন-নাজম’-এর উদাহরণ পেশ করা যায়। সূরার ১৯ ও ২০ নাম্বার আয়াতের ওপর ভর করে সালমান রুশদি তাঁর ‘শয়তানের পদাবলি’ আখ্যানের প্লট খাড়া করে কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন বলে অনেকে ধারণা করেন, উক্ত আয়াত ঘিরে বিতর্ক তাই বহুদিনের পুরোনো। ইসলামসমালোচকদের দাবি অনুসারে ‘আন-নাজম’-এ সংকলিত ১৯ ও ২০ নাম্বার আয়াত নাকি অরিজিনাল নয়, বরং অরিজিনাল আয়াত আল্লাহ প্রেরিত ওহি সংশোধনের ধারায় কোরান থেকে পরে মুছে দেওয়া হয়েছিল!
বাতচিতের কোনও এক ক্ষণে মক্কাবাসীর প্রিয় তিন উপাস্য দেবী লাত, মানাত ও উজ্জা সম্পর্কে গোত্রপিতারা মোহাম্মদের মনোভাব জানতে চেয়েছিল। উত্তরে মহানবি তিন দেবীকে আল্লাহর মধ্যস্থতাকারী প্রতিনিধি রূপে শংসাবচনে অভিষিক্ত করেন বলে পুরাতন ইতিহাসে লেখে। কোরানে ‘মিসিং’ নামে গণ্য সে-আয়াতে নবি নাকি উক্তি করেছিলেন, ‘These are the exalted gharāniq, whose intercession is hoped for.’ অর্থাৎ তারা তো গরিমাপূর্ণ সেইসব সারসপক্ষী যাদেরকে মধ্যস্থতাকারী রূপে আশা করা যায়। এই বচন ইঙ্গিত উঠায় মক্কাবাসীর হৃদয় জয় করার জন্য পৌত্তলিক দেবীগণকে ‘নাকচ’ করার পরিবর্তে আপাতত আল্লাহর কন্যা বা সাকার বিগ্রহ রূপে তাদেরকে তিনি বিবেচনা করতে প্রস্তুত ছিলেন। ১৯ ও ২০ নাম্বার আয়াতের সংশোধিত প্রলম্বন হচ্ছে ২৩ নাম্বার, যা ঘটনার গতিক বুঝে মোহাম্মদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে :—
‘এইগুলি কতক নামমাত্র যাহা তোমাদের পূর্বপুরুষগণ ও তোমরা রাখিয়াছ, যাহার সমর্থনে আল্লাহ কোনও দলিল প্রেরণ করেন নাই। তাহারা তো অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, অথচ তাহাদের নিকট তাহাদের প্রতিপালকের পথনির্দেশ আসিয়াছে।’ — উৎস : আন–নাজম; ৫৩:২৩; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
আয়াতটি মনে দ্বন্দ্ব তৈরি করায়। যে-দেবীগণের বৈধতার ব্যাপারে আল্লাহ নিজে দলিল প্রেরণ করেননি অথবা যারা মক্কাবাসীর কুফরি মনের অনুমানমূলক কল্পনা থেকে সৃষ্ট, আল্লাহ কেন যেচেপড়ে তাদের ‘প্রতিপালক’ হওয়ার দায় নিচ্ছেন! যুক্তির নিরিখে অবশ্য ভাবা সম্ভব, জগতের স্রষ্টা হওয়ার সুবাদে মক্কাবাসীর মনের মণিকোঠায় সৃষ্ট দেবীগণ সম্পর্কে অনুমানের স্রষ্টা আল্লাহ নিজে ছিলেন। কিন্তু আল্লাহকে মক্কাবাসীর মনের নিয়ন্তা গণ্য করলে সেই মনে দেবীর উৎপত্তি ঘটানোর জন্য তাদের দায়ী করা সংগত কি না প্রশ্নটি ওঠে। অন্যদিকে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু তার ‘আকল’ বা বিবেক-বিচারবোধে তিনি বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া হস্তক্ষেপ করেন না, সুতরাং মক্কাবাসীর মনে সৃষ্ট প্রতিমা উপাসনার মনোভাব জাগ্রত হওয়ার দায় তাঁর ওপর বর্তায় না। সুতরাং ২৩ নাম্বার আয়াতে কুফরির স্মারক দেবীগণের উপাসনায় নিবেদিত মক্কাবাসীর ‘প্রতিপালক’ রূপে আল্লাহর নিজেকে জাহির করার বিষয় ঘটনার ধারা বুঝে মোহাম্মদের রিঅ্যাক্ট করার প্রবণতাকে সামনে নিয়ে আসে। গোত্রপিতাদের তিনি প্রবোধ দিতে চেয়েছিলেন, — দেবীগণ দালিলিক নয় সে-কথা ঠিক তবে আল্লাহ যেহেতু কাফের-মুমিন সকলের প্রতিপালক সুতরাং মক্কাবাসীর উচিত ভ্রান্ত উপাসনা বাদ দিয়ে সত্য পথে ফেরা! এই বাককুশলতা একদিক থেকে কোরানের অনন্যতার বহিঃপ্রকাশ! ইতিহাসে এই প্রথম গায়েবি থেকে আগত একটি গ্রন্থের সন্ধান মিলে যেটি ইহজাগতিক ও ডিপ্লোম্যাটিক। কোরানের সমতুল্য ডিপ্লোম্যাসি ইতোপূর্বে ধরায় প্রচারিত কোনও সেমিটিক ঐশী গ্রন্থে পাওয়া যায় না। ফলে রুশদির মতো নাদান আখ্যানকারকে সেটা আকর্ষণ করতেই পারে।
ইতিহাসে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বিদিত মিসিং আয়াত যা কিনা শয়তানের প্ররোচনায় মোহাম্মদের মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে এসেছিল বলে বিদিত সালমান রুশদি সে-আয়াতের খবর উইলিয়াম ম্যুরের বই থেকে প্রথম পেয়েছিলেন বলে জানি। ম্যুর আবার মিসিং আয়াতের উৎস রূপে প্রথম যুগের তফসির প্রণেতা আত-তাবারির কথা নিজের বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তাবারি তাঁর তফসিরে তথ্যের লিপিকার হিসেবে মোহাম্মদের আদি জীবনীলেখক ইবনে ইসহাকের নাম নিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন মিসিং আয়াতের আদি উল্লেখ ইবনে হিশাম-এ প্রথম পাওয়া যায়; হিশাম সেখানে তাঁর শিক্ষাগুরু ইবনে ইসহাক সূত্রে ঘটনার বিবরণ পেশ করেছিলেন। শাহাব আহমেদ তাঁর ‘Before Orthodoxy: The Satanic Verses in Early Islam’-এর প্রথম খণ্ডে (*অকালমৃত্যুর কারণে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি) আয়াত মিসিংয়ের অনুসন্ধানী আলোচনায় যেসব অভিমত রেখেছেন তার সারসংক্ষেপ এই বেলা পরিবেশন করা যায় :—
বিশ্বব্যাপী মুসলমান সম্প্রদায় ও বিদ্বানগণ এখন আর এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন না। ইবনে ইসহাক, আত-তাবারি বা ইবনে হিশাম শুধু নয়, প্রাচীন যত উৎসে এর বিবরণ পাওয়া যায় সেইসব উৎসের পরবর্তী সংস্করণগুলোয় ঘটনাটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইসলাম প্রচারের আদি যুগ বা প্রথম দুশো বছর বিশ্ব জুড়ে মুসলমান সম্প্রদায় মহানবির জীবনে শয়তানের প্ররোচনায় ভুল আয়াত উচ্চারণের ঘটনাকে সত্য বলে স্বীকার গিয়েছে। পরবর্তী দুশো বছরের ইতিহাসে একই সম্প্রদায় সে-ঘটনাকে মিথ্যা ভাবতে শুরু করে এবং সময়ের পালাবদলে বিভিন্ন উৎস থেকে উক্ত ঘটনার বিবরণ মুছে দেওয়া হয়। বিবরণ বিলোপের পেছনে শাহাব ‘To protect Muhammad’-এর মনস্তত্ত্বটি যেমন খুঁজে পেয়েছেন, সেইসঙ্গে কোরান, মোহাম্মদ ও ইসলামকে ঘিরে সৃষ্ট ক্ষমতা সংরক্ষণের রাজনীতির যোগসূত্র নিজের বইয়ে উল্লেখ করতে ভোলেননি। মোহাম্মদ আসাদের পুত্র বিশিষ্ট বিদ্বান তালাল আসাদকে উদ্ধৃত করে নিজের বইয়ে শাহাব তাই মন্তব্য ঠুকেছেন :—
Orthodoxy, in other words, is not merely an intellectual phenomenon: it is also social phenomenon—it is, as Talal Asad has famously said, ‘not a mere body of opinion, but a distinct relationship—a relationship of power. — Source: Before Orthodoxy: The Satanic Verses in Early Islam by Shahab Ahmed; 2017; Google Books Archive.
মিসিং আয়াত বিষয়ক সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব তদন্তের ছলে শাহাব তাঁর বইয়ে ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্র করে Orthodoxy বা গোঁড়ামির চর্চা সময়ে কীভাবে প্রবল আকার ধারণ করেছে সেই ইতিহাস তথ্য-প্রমাণ সহকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর এই বইটি Google Books Archive-এ সুলভ ও পাঠের জন্য উন্মুক্ত। কথা হলো মিসিং আয়াত বিষয়ক তথ্যের উৎস যেখান থেকেই আসুক, শয়তানের প্ররোচনায় ভুল আয়াত উচ্চারণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে বিস্তর জল ঘোলা হয়েছিল। উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য রেফ্রেন্স ঘাঁটলে বোঝা যায় আরবি ভাষার সেমিওটিক্স অনুসারে gharāniq শব্দ প্রকৃত অর্থে কী বোঝায় সে-নিয়ে মতান্তর ও বাদানুবাদ আজও তামাদি হয়নি।
ওহি বা রেভেলেশন আসার ঐতিহাসিক ধারার সঙ্গে এহেন সংশোধনী খাপ খায় কি না এই প্রশ্নটি সন্দেহবাদীরা প্রায়শ উত্থাপন করেন এবং সংশোধনীর পদ্ধতি নিয়ে খ্রিস্টান ও ইহুদিগণের মাঝে আপত্তির অন্ত নেই। খ্রিস্টান অ্যাপোলজিস্ট ও বিতার্কিক স্যাম শামাউন ইবনে ইসহাকের আদি রেফ্রেন্স এবং মুসলমান ও অন্যান্য লেখকরা এ-সম্পর্কে যেখানে যতটুকু বিবরণ দিয়েছেন তার নমুনা দাখিলপূর্বক ‘Muhammad and the Daughters of Allah: A Summation of the Evidence for the Satanic Verses’ নামে লম্বা একখান পেপার ফেঁদেছেন। অনলাইনে প্রকাশিত সেই পেপারে দাখিলকৃত উৎসের সত্য-মিথ্যা যাচাই ও বিবেচনার ভার শামাউন পাঠকের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। আগ্রহী পাঠক ইচ্ছা করলে নেটে তাঁর এই পেপারের খোঁজ নিতে পারেন।
ঘটনার গতিক বুঝে গায়েব থেকে ওহি নাজিল হওয়া এবং সেই ওহি সংশোধনের পদ্ধতি কোরানকে সহিসরল ধর্মগ্রন্থ থেকে জটিল ও বহুমুখী সোশিও-পলিটিক্যাল ইভেন্ট করে তুলেছিল তাতে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। ওহিপ্রাপ্ত নবিগণের মধ্যে মোহাম্মদ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যাঁকে রক্তেমাংসে জীবন্ত মানুষ রূপে কোরানের প্রতি পাতায় পাঠক বিচরণ করতে দেখেন। কালের ধারায় তাঁর ঐতিহাসিকতা সে-কারণে বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করেছে। যদিও মুসা-ঈসার ঐতিহাসিকতা নিয়ে পণ্ডিতমহলে সন্দেহ ও মতভেদ রয়েছে। বাইবেল বিশেষজ্ঞ বার্ট এহেরম্যান যেমন লম্বা সময় খ্রিষ্টে দিন যাপন শেষে সম্প্রতি মত দিয়েছেন, — ইতিহাসবিখ্যাত ঈসা নবি জগতে এসেছিলেন বলে তাঁর এখন আর প্রত্যয় হয় না! তারচেয়ে বড় কথা বাইবেল ও খ্রিস্টান ধর্ম কালের গতিতে যে-সুরত ধারণ করেছে সেখানে ঈসার থাকা বা না-থাকায় কিছু যায় আসে না! ইহুদি থেকে আলাদা হওয়ার পর খ্রিস্ট ধর্মের যে-সূত্রপাত বাইবেলের নবতর সংস্করণ নিউ টেস্টামেন্ট সূত্রে ঘটেছিল সেখানে ঈসা কাল্পনিক চরিত্র এবং খ্রিস্টান ধর্মের রূপকার বলে যদি কাউকে ধরতেই হয় তিনি সেন্ট পল; সুতরাং ঈসা was found more fictional than real when we search him in history to prove his authenticity as the father of Christianity.
এহেরম্যানের এই দাবি অন্যভাবে মুসলমান সম্প্রদায়ে প্রচলিত ধারণাকে উসকানি দিয়ে যায়; মুসলিম আমজনতা বিশ্বাস করে বাইবেল ও ইঞ্জিল আদতে এক গ্রন্থ নয়, বাইবেলে চিত্রায়িত যিশু আর ইঞ্জিলে বর্ণিত ঈসা মসীহও অগত্যা এক ব্যক্তি নন, উপরন্তু ‘জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভিকটাস, নাম্বারস ও ডিউটেরনমি’ এই পাঁচ পুস্তকের সমষ্টি আদি বাইবেল ওরফে ওল্ড টেস্টামেন্ট ওরফে তাওরাত হিব্রু ভাষায় অবতীর্ণ হয়ে থাকলে নিউ টেস্টামেন্ট বা নতুন বাইবেল গ্রিক ভাষায় রচিত হয় কী করে, যদিও মুসলানরা বিশ্বাস করে প্রকৃত ইঞ্জিল হিব্রু নয় বরং আরামাইক ভাষায় রচিত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক, যা সময়ের সঙ্গে বিকৃত আকার ধারণ করে গ্রিক বাইবেলের আকার ধারণ করেছে। ঈসার বারোজন প্রেরিত শিষ্যের একজন সাধু বার্নাবা ওরফে বার্নাবাস (Barnabas) কর্তৃক বর্ণিত সুসমাচারকে মুসলমান সম্প্রদায় এক্ষেত্রে গোনায় ধরেন। বার্নাবাসের সুসমাচার সম্ভবত একমাত্র যা বর্তমানে প্রচলিত বাইবেলের সম্পূর্ণ বিপরীত বয়ান হাজির করে। এই সুসমাচারের সঙ্গে কোরানে চিত্রায়িত ঈসা নবি ও খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কিত ইসলামি ভাষ্যের সাদৃশ্য থাকায় মুসলমানরা একে বিলুপ্ত ‘ইঞ্জিল শরীফ’-এর সঠিক ভাষ্য মনে করেন। খ্রিস্টীয় চার্চ অবশ্য বার্নাবাস বিরচিত গসপেলকে মূলের বিকৃতি হিসেবেই দেখে এবং ইসলামি মতের সঙ্গে সমন্বয় ঘটাতে কোনও এক সময় এর অবলুপ্ত মূল ভাষ্যে হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল দাবি করে। মূল ভাষ্যটি এখন খুঁজে পাওয়া যায় না! এর পরিবর্তে সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতকে ইতালিয় ও স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত দুটি পাণ্ডুলিপির খবর মিলে, — যার মধ্যে স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত সংস্করণটি পূর্ণাঙ্গ নয়, আংশিক।
বিতর্ক থাকলেও সাধু বার্নাবাসের সুসমাচারটি প্রায় সব ভাষায় অনূদিত ও ইসলামি শাসনামলে ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল। বাংলা ভাষায় কবি আফজাল চৌধুরী এর ভাষান্তর করেছিলেন এবং তাঁর অনূদিত সংস্করণটি নেটে সুলভ। সত্তুর দশকে হিপি-বিটনিক-হাংরি প্রভাবিত নিরাশা ও নাস্তিতে নিমজ্জিত স্যাড জেনারেশন কাব্য-আন্দোলনের রোমান্টিক খোঁয়ারির সঙ্গে সম্পৃক্ত ও পরে বঙ্গদেশি প্রগতির ভাষায় ‘মৌলবাদ’-এ বয়েত গ্রহণকারী আফজাল চৌধুরীর অনুবাদটি প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য। তরজমায় আরবি শব্দ ও ইসলামিক পরিভাষা ব্যবহার করায় মনে সন্দেহের উৎপত্তি ঘটলেও ইংরেজি তরজমার সঙ্গে গুরুতর ভিন্নতা চোখে পড়েনি। যারপরনাই তাঁর অনুবাদকে মূলানুগ মানতে হয়। বার্নাবাসের সুসমাচার ঈসা নবির ধরায় আগমন, বাণী প্রচার, মোহাম্মদের উল্লেখ, নকল ঈসার (*গাদ্দার জুদাস ইসকারিওট, যার চেহারা ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে হবহু ঈসার আদলে বদলে দেওয়া হয়েছিল বলে ইসলাম দাবি করে।) ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং প্রকৃত ঈসার জান্নাতে ঊর্ধ্বারোহন, কিছুদিনের জন্য ধরায় পুনরাগমন ও জান্নাতযাত্রা থেকে শুরু করে প্রায় সকল দিক দিয়ে ইসলামি ভাষ্যের প্রতিধ্বনি হওয়ায় মনে দ্বন্দ্ব জাগে বটে, বাইবেল পড়ছি তো (!), নাকি কোরানের ভাষ্য শুনছি! কেয়ামতের পর মৃতদেহের পুনরুত্থান বিষয়ে কোরান ও বাইবেলের বক্তব্য খুবই পৃথক! যদিও বার্নাবাসের সুসমাচারে সেই বিবরণটি পাই যা কোরানের সঙ্গে কার্যত অভিন্ন :—
‘…আত্মা এবং দেহ মানবেন্দ্রিয়যোগে আল্লাহর বন্দেগি করে; আত্মা শুধু দেখে এবং হুকুম দেয় বন্দেগির, কেননা, আত্মা খাদ্য গ্রহণ করে না, উপোস থাকে না, [আত্মা] বিচরণও করে না, সর্দি-গর্মি বোধ করে না, রোগে ভোগে না, আর মারাও পড়ে না; কারণ আত্মার মৃত্যু নেই; দৈহিক কষ্ট তাকে ভোগ করতে হয় না, ভৌত উপাদানের জন্য দেহকে যা ভুগতে হয়।…তাহলে কি ন্যায়সঙ্গত হলো, আমি বলছি, কেবল আত্মাই বেহশতে যাবে, দেহ যেতে পারবে না, আল্লাহর বন্দেগিতে যে এতটা প্রাণপাত করল?’…পিতর বললেন, ‘হে মুর্শিদ, যে-দেহ আত্মাকে পাপে প্রবৃত্ত করল, জান্নাতে তার প্রত্যাবর্তন উচিত নয়।’…ঈসা বললেন, ‘কী বলছ হে, আত্মাকে বাদ দিয়ে দেহ পাপ করে কীভাবে? নিশ্চয়ই তা সম্ভব নয়। অতএব তুমি দেহকে আল্লাহর করুণা থেকে বঞ্চিত করে আত্মাকে সরাসরি দোযখে পাঠাতে চাও?’ — উৎস : বার্নাবাসের বাইবেল; ১৭৩, বেহেশতে মানবদেহ; ভাষান্তর : আফজাল চৌধুরী; বাংলাদেশ কো–অপারেটিভ বুক সোসাইটি, চট্টগ্রাম; পিডিএফ সংস্করণ।
ইংরেজি ভাষ্য :
The soul and the body with sense of man serve God: the soul only seeth and commandeth the service, because the soul, eating no bread, fasteth not, [the soul] walketh not, feeleth not cold and heat, falleth not sick, and is not slain, because the soul is immortal: it suffereth not any of those corporal pains which the body suffers at the instance of the elements. Is it, then, just, I say, that the soul alone should go into paradise, and not the body, which hath wearied itself so much in serving God?’…Peter answered: ‘O master, the body, having caused the soul to sin, ought not to be placed in paradise.’…Jesus answered: ‘Now how shall the body sin without the soul? Assuredly it is impossible. Therefore, in taking away God’s mercy from the body, thou condemnest the soul to hell. — Source: The Gospel of Barnabas; 173; Translation: Lonsdale and Laura Ragg, 1907; PDF Edition.
রোজ কেয়ামতের দিন কবর থেকে মৃতদেহের পুনরুত্থান বিষয়ক বার্নাবাসের বাখান প্রচলিত বাইবেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও ইংরেজি ভাষ্য সহ কবি আফজাল চৌধুরীর সুখপাঠ্য অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করার বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। পাঠককে আগেভাগে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, বক্ষ্যমাণ রচনার সপ্তম প্রবাহে (১ ও ২) গমনের পর এ-সংক্রান্ত বিস্তৃত আর্গুমেন্টের সম্মুখীন তাঁরা হবেন! অ্যান্টি ইসলামিস্ট আলী সিনা-র অভিমত খণ্ডনকে ঘিরে বিস্তারিত সে-বয়ান পাঠের ক্ষণে বার্নাবাসকে যেন তাঁরা একবার হলেও স্মরণ করেন। সে যা-ই হোক, ইহুদা ডি নেভো, জুডিথ কোরেন, রবার্ট স্পেনসার বা ড্যান গিবসন প্রমুখ মোহাম্মদের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয় জানিয়ে কিতাব-টিতাব লিখলেও বিদ্বানদের বৃহৎ অংশ তাঁদের দাবিকে যুক্তি সহকারে খারিজ করেন বিধায় আপাতত ধরে নেওয়া যায় মোহাম্মদের বিদ্যমানতা কেবল সত্য ঘটনাই নয়, ইতিহাসে বর্ণিত ঘটনার গতিধারা বিবেচনায় তিনি বাস্তববাদী ও দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন। ইসলামের নবি মিথোলজি নিয়ে খেলেন স্বয়ং নিজেকে মিথ করে তোলার জন্য এবং এক্ষেত্রে কোরান তাঁকে সাহায্য করে বৈকি!
আল্লাহ প্রেরিত কিতাবের মধ্যে এই গ্রন্থটি একমাত্র যা জাগতিক ও পরজাগতিক উভয় জগতে নিজেকে সফলভাবে সংযুক্ত করতে পেরেছিল। ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী ‘গীতা’ মানবাত্মার আত্মিক উৎকর্ষ ও আধ্যাত্মিক ঊর্ধ্বারোহনের বিবরণে অতুল হতে পারে কিন্তু জাগতিকতা সেখানে পরিত্যাজ্য গণ্য হয়, যার ফলে ‘মনুসংহিতা’ ছাড়া হিন্দু মানুদের ইহজাগতিক জীবনে সংযুক্ত থাকা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে ওঠে। যাবুর, তাওরাত কিংবা বাইবেল রোমাঞ্চকর মোরাল স্টোরি রূপে কৃতির অধিকারী হলেও জাগতিক ও পরজাগতিক জীবনের দ্বন্দ্বে জেরবার মানুষের জন্য সুস্পষ্ট নিশানা নিয়ে হাজির হতে পারে না। নিশান ঠিক করার কাজে ইহুদিদের জন্য সিনাগগ আর খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে চার্চ ভরসা হয়ে ওঠে। ঈসা নবি প্রচারিত ধর্ম যতটা বিবলিক্যাল তার চেয়ে বেশি চার্চিক্যাল। এইসব বিবেচনায় কোরান বাস্তবিক ঘটনা। দুনিয়া ও আখেরাতে নিজেকে সফলভাবে সংযুক্ত রাখতে পারায় মানবজীবনে ঈশ্বরের ভূমিকা আসলে কেমন হতে পারে তার পরিষ্কার ছবি সেখানে মিলে।
ইসলামে আল্লাহর সত্যিকার স্বরূপ জানা না গেলেও তিনি অনন্ত ও মোহাম্মদের মাধ্যমে জগতে সক্রিয়, এবং তাঁকে বায়বীয় ভাবার উপায় নেই! সাত-আসমানের ওপরে তাঁর অবস্থান কোরান নির্ধারণ করে। সোজা কথায় জাগতিক ঘটনার ইশারা বা নিদর্শন কোরানে থাকে কিন্তু সে-সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য-উপাত্ত ও গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সেখানে পাওয়া যায় না। টেক্সটের মূল্য বিচারে সমালোচকরা অনেকে তাই ঐশী গ্রন্থটিকে অগভীরতার স্মারক মনে করেন। তফসির বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়া মোহাম্মদের জীবনে সংঘটিত ঘটনার সমাহার এই টেক্সটকে অতিরিক্ত কিছু ভাবা বা তার মহার্ঘতা অনেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।
গীতায় শ্রী কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে যেসব ডায়ালগ সংঘটিত হয় সেখানে ঈশ্বরের সঙ্গে মানবাত্মার সংযোগ বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য লাভ করায় ঘটনার ভূমিকা বা গুরুত্ব সেভাবে বজায় থাকে না। আলোচনা দার্শনিক গভীরতায় প্রবেশ করায় ‘মহাভারত’ থেকে গীতাকে যখন স্বতন্ত্র উপনিষদ রূপে বের করে নিয়ে আসা হয় তখন তার বিচিত্র সংস্করণ সৃষ্টি হতে থাকে এবং হিন্দু ধর্মের গুণবিচারে এটা কোনও সমস্যা নয়। অষ্টাবক্র মুনি বিরচিত ‘গীতা’ হয়তো আদি গীতার সর্বোৎকৃষ্ট রূপ! তার মানে এই নয় পরে যাঁরা এর নতুন সংস্করণ নিয়ে হাজির হলেন তাঁরা ফেলনা। বিচারটা এখানে ঘটে জ্ঞানের গভীরতায় বেদব্যাস সূত্রে প্রাপ্ত আদি সংস্করণকে কতখানি প্রাঞ্জলতা সহকারে তাঁরা ব্যাখ্যা করে উঠতে পেরেছেন তার ওপর। অর্থাৎ গীতায় ব্যক্ত ঈশ্বরের সঙ্গে মানবসত্তার সংযোগ নির্ভর করে দার্শনিক গভীরতার সাহায্যে সাত শতাধিক শ্লোকে বিন্যাস্ত টেক্সট কে কতখানি গভীরভাবে অনুধ্যান করতে পেরেছেন তার ওপর। বায়বীয় এক পরজগতে মানবীয় বোধের ঊর্ধ্বারোহনের ভিত্তিতে ‘গীতা’ তার মূল্য নিরূপণ করায় প্রতিটি শ্লোক সেখানে যোগধ্যান বা মেডিটেশনের স্মারক হয়ে আসে। এই গুণবিচারে ‘গীতা’ একরৈখিক গভীরতার স্মারক হলে কোরানকে বহুরৈখিক অগভীরতার নিদর্শন মানতে হয়।
কোরান ‘অগভীর’ শুনে আঁতকে ওঠার কিছু নেই বরং এই অগভীরতা তার শক্তি। মানবজীবনে সংঘটিত হেন বিষয় নেই যা রেফ্রেন্স হয়ে সেখানে উঁকি মারেনি! এখন যে-ব্যক্তি এইসব রেফ্রেন্সের অতল খুঁজতে চায় কোরান তাকে সেখান থেকে এক্সিট নিতে বলবে, কারণ কোরান মূলত ঘটনাবহুল টেক্সট, প্রতিটি ঘটনা সেখানে চিহ্ন বা নিদর্শন রেখে যায় কিন্তু চিহ্নগুলার অর্থ ব্যাখ্যার দায় নিজের ঘাড়ে নেয় না। ‘গীতা’ ও কোরানের ব্যবধান এদিক দিয়ে মৌলিক; — বেদের উপনিষদ বা তফসির রূপে ‘গীতা’ ব্যাখ্যা করে, পক্ষান্তরে কোরান ব্যাখ্যার দায়িত্ব ব্যক্তির ঘাড়ে চাপায়। এখান থেকে কোরান প্রসঙ্গমূলক বা রেফ্রেন্সিয়াল টেক্সটে পরিণত হয়, যার কাজ ব্যাখ্যা করা নয় বরং লোকজনকে দিয়ে ব্যাখ্যা করানো। এহেন কারণে কোরান ইসলামের মৌল ভিত্তি হলেও তাকে ব্যাখ্যা করে যেসব হাদিস-ফিকাহ-তফসির ও দার্শনিক আলোচনা অর্থাৎ সমুদয় ব্যাখ্যা-ব্যাখ্যানের সমষ্টিরূপে মুসলমান সম্প্রদায় কোরানকে নিজের জীবনে আপন ভাবে।
এ-কথা তাই বলা যায়, একজন মুসলমান আসলে কোরানে থাকে আবার থাকেও না! কোরান তার কাছে ডিরেকশন, যেদিকে গমন করতে পারলে আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত নবি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব; কিন্তু আল্লাহ বা নবি আসলে কী বস্তু তার হদিশ পাওয়ার জন্য যা-কিছু উভয় রেফ্রেন্সকে বুঝতে সাহায্য করে সেগুলোর কাছে তাঁকে ফিরতে হয়। তো আসা-যাওয়ার চক্করে ঘুরতে-ঘুরতে সেই ব্যক্তি ইন্টারপ্রিটেশন থেকে উৎসারিত সমুদয় টেক্সটে রঙ্গিলা হয় এবং শেষতক নিজেকে মুসলমান নামে দাগায়। কোরান স্বয়ং কোনও জ্ঞান হয়ে ওঠে না কিন্তু জ্ঞান সে তৈরি করায়; অধিকন্তু জ্ঞান তৈরির এই প্রক্রিয়া চলমান হওয়ার কারণে কোরানে অবস্থান সত্ত্বেও সেখান থেকে এক্সিট নেওয়া ছাড়া মুসলমানের পক্ষে সময়ের স্রোতে পরিবর্তনশীল জীবনধারায় তাল মিলানো মেহনতের কাজ।
সমস্যা হলো অনেক বিজ্ঞ মুসলমান কোরানের প্রসঙ্গমূলক টেক্সট হওয়ার জায়গাটি ধরতে পারেন না এবং সাহাবাদের আমলে বিরাজিত খিলাফতে ফেরত যেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, যে-খিলাফত যুগের ধারায় এখন আর বিরাজ করে না। এটা মাথায় নেওয়া তাই প্রয়োজন, — কোরান হলো রেফ্রেন্স যেখানে ঘটনাগুলা ঘটেছিল; এখন এইসব ঘটনার মর্তবা বা নিগূঢ় অর্থ বোঝানোর ঠেকা মোহাম্মদ বা আল্লাহর নেই; সুতরাং যে-ব্যক্তি এইসব বুঝতে আগ্রহী দায়িত্বটা সেখানে তাকে নিজের কাঁধে নিতে হবে। তার জন্য কোরানের ইশরাত বা ডিরেকশন হলো অনুসন্ধান। ‘নিশ্চয় ইহার মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য চিন্তার খোরাক রয়েছে।’ — আপাত নিরীহ বাক্যবন্ধ বিজ্ঞানী আবদুস সালাম থেকে আম-আদমি সকলের জন্য সেখানে প্রযোজ্য। অগত্যা তাঁরা ভাবতে বাধ্য হন, — কথাটা মিথ্যা নয়! কোরান রেফ্রেন্স বলে দিয়েছে, এখন দাড়াদিশা পাওয়ার কাজে নিজের জ্ঞানগম্যি ব্যবহার করা উত্তম এবং সেখানে দরকার হলে সুদূর চীন দেশ অবধি যাওয়া লাগতেও পারে।
কোরান এভাবে (*চটজলদি একটি অবিন্যাস্ত তালিকা যদি করি) বৈদিক মুনি-ঋষিদের অনুধ্যানের ফসল বেদ ও উপনিষদের সারনির্যাস শ্রী কৃষ্ণের গীতা; ব্যাদবেসের মহাভারত; বৈদিক পরব্রহ্ম নিয়ে বিরচিত বাদ্রায়নের ব্রহ্মসূত্র; গৌতম বুদ্ধের বাণীর ঝুড়ি ত্রিপিটক; রাজা মিলিন্দ ও বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের সওয়াল-জবাবমুখর মিলিন্দপঞ্হ; মহাতার্কিক দিঙনাগের প্রমাণাসমুচ্চয়; জৈন ধর্মের রূপকারদের মাঝে অগ্রবর্তী মহাবীরের আগমস; কৌটিল্যর অর্থ ও নীতিশাস্ত্র; বাৎসায়নের কামসূত্র; শঙ্কারাচার্যের অদ্বৈতবিচারের স্মারক আত্মবোধ ও বিবেকচূড়ামণি; মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে প্যাপিরাস কাগজে সাংকেতিক লিপি (হায়েরোগ্লিফিক্স) সহযোগে চিত্রায়িত পিরামিড টেক্সট দ্য বুক অব ডেড; প্লেটোর বহুল পঠিত বাখান রিপাবলিক ও সিম্পোজিয়াম; সমগ্র মধ্যযুগের জ্ঞানকে একা নির্ধারণকারী অ্যারিস্টটলের পলিটিক্স, এথিকস অথবা মেকানিক্স; লাওৎস-এর ধীশক্তিজারিত মধুর প্রবচনগুচ্ছ তাও–তে–চিং; জীবনের অর্থ, নৈতিক অনুশাসন ও দণ্ডনীতি বিষয়ক উপদেশের সমাহার কনফুসিয়াসের রচনাবলী; খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে সবিশেষ মৌলিক সেন্ট অগাস্টিনের দ্য সিটি অব গড; জেন মাস্টার ডোগেনের সত্যসন্ধানী ব্যাখ্যার নির্যাস সবজেনজো; ভর্তৃহরীর নীতিশতকম ও বাক্যাপাধ্যায় বা সিনট্যাকটিক ইত্যাদির মাঝে নিহিত জ্ঞানের গভীরতাকে নিজে অগভীর থাকার শক্তি দিয়ে অতিক্রম করে যায়।
সে অতিক্রম করে অমিত প্রতিভাবান ইমাম গাজ্জালির তাহাফুত আল–ফালাসিফাহ ছাড়াও শরিয়া-ফিকাহ-সুফিবাদ ও সংগীত বিষয়ক বিচিত্র রচনাসম্ভার; ইবনে সিনার দ্য বুক অব হিলিং ও দ্য মেটাফিজিক্স; ইসলামি রেনেসাঁর ফসল ইবনে রুশদ-এর তাহাফুত আল–তাহাফুত বা দ্য ইনকোহিরেন্স অব দ্য ইনকোহিরেন্স; আল-ফারাবির পিথাগোরাস-প্রভাবিত সংগীতজ্ঞানের স্মারক দ্য গ্রেট বুক অব মিউজিক; ইবনে খালদুনের বিজ্ঞতার পরিচয় আল মুকাদ্দিমা; রুমির মসনবি শরীফ; গণিতজ্ঞ-জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও কবি ওমর খৈয়ামের মরমি জাগতিকতার প্রবাহণ রুবাইয়াত; আল্লামা ইকবালের ‘খুদি’ তত্ত্বের অভিজ্ঞান আসরারে খুদি-র মতো প্রভাবশালী চিন্তা আর অনুধ্যানের জগৎ।
প্রসঙ্গমূলক টেক্সট হওয়ার সুবাদে কোরান অতিক্রম করে দেকার্তের স্ব-চেতনসত্তা কেমন করে জগতের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া সারে তার পদ্ধতি বিষয়ক আলোচনা ও মৌল দর্শন সম্পর্কিত অনুধ্যান; বল-শক্তি-মাধ্যাকর্ষণ ও আলোর গতিবিধি যাঁর চেতনার দখল নিয়েছিল সেই ‘ল অব মোশন’-এর অমর প্রণেতা আইজাক নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা; লিবনিজের ব্রহ্ম-মামলা নিয়ে বিরচিত নাতিবৃহৎ মোনাডোলজি; উইলিয়াম ব্ল্যাইক-এর নিজস্ব ঈশ্বরভাবনায় স্ব-চিত্রিত লিথোগ্রাফির স্মারক দ্য বুক অব উরিজেন; যুদ্ধ ও সহিংসতার ঘূর্ণিপাকে রাজা-প্রজা ও দণ্ডনীতির মনোজ্ঞ বাখান থমাস হবসের লেভিয়াথান; মেকিয়াভেলির চাণক্যনীতির নব্য সংস্করণ দ্য প্রিন্স; ফরাসি বিপ্লবে ইশতেহারে পরিণত রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট; ইমান্যুয়েল কান্টের মানবচর্চিত জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখায় প্রভাব বিস্তারকারী ভাবুকতার স্মারক ক্রিটিক অব পিওর রিজন এবং দ্য মেটাফিজিক্স অব মোরাল সহ অন্যান্য রচনা।
বুকমার্কিং করার প্রক্রিয়ায় কোরান অনায়াসে পেরিয়ে যায় হেগেলের জ্ঞানবিধ্বংসী ভাবনায় আজোবধি প্রাসঙ্গিক ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিট ও দ্য সায়েন্স অব লজিক; বোধিসত্ত্বর নবীন ব্যাখ্যায় রঙিন শোপেনহাওয়ারের দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল; জীবনচক্র সম্পর্কে প্রচলিত জ্ঞানের ইতিহাস তছনছ করে দেওয়া অন্বেষণ ডারউইনের অন দ্য অরিজিন অব স্পেশিস ও ডিসেন্ট অব ম্যান; মুদ্রা ও শ্রেণিশাসিত সমাজে উদ্বৃত্ত শ্রমসৃষ্টির কারিকুরি উদঘাটনের জন্য যুগে-যুগে প্রাসঙ্গিক কার্ল মার্কসের ডাজ ক্যাপিটাল; সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের অস্থির আস্তিবাদী ভাবুকতায় কম্পিত ফিয়ার এন্ড ট্র্যাম্বলিং; নিৎশের সীমা-অতিক্রমী অনুধ্যানের মহাকাব্যিক বাখান দাজ স্পোক জরাথুস্ত্র ও বিয়ন্ড গড অ্যান্ড ইভিল; ফ্রেজারের ধর্মীয় আচার-উপাসনা আর জাদুটোনা বিষয়ক অতিকায় অনুসন্ধানের ইতিহাস দ্য গোল্ডেন বাউ; ফ্রয়েড-য়ুং-ভাকনিন-মাস্টারসন থেকে হালের জর্ডান পিটারসন অবধি বিস্তৃত মানবমনের চেতন-অবচেতনে সক্রিয় শত-হাজার বছরের প্রাতিস্বিক ও সামষ্টিক স্মৃতির মিথস্ক্রিয়ার ফসল থেকে জারিত মনোদৈহিক জটিলতার প্যাঁচাল; হাইডেগারের সত্তার আবির্ভাব ও বিদ্যমানতার রহসঘন অনুসন্ধানী তদন্ত বিয়িং অ্যান্ড টাইম ও ব্ল্যাক নোটবুক্স; নিউটনের শর্তাধীন স্থান-কালের জগৎ যেখানে গমনের পর ভেঙে পড়ে সেই বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের রূপকার, আলো বহনকারী কণা ফোটনকে কল্পনা ও যুক্তি বিরচনে আখ্যানতুল্য চরিত্র দানকারী, এবং কণাবাদী বলবিজ্ঞান ও মহাকাশ বিজ্ঞানে এখনও সমান প্রাসঙ্গিক আলবার্ট আইনস্টাইনের বুদ্ধিদীপ্ত বচনে চমকিত আইডিয়াজ অ্যান্ড অপনিয়িন্স-এ ব্যক্ত জ্ঞানের জগৎ।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বচনে আপাত অগভীর কোরানের ভাষাকাঠামো হয়তো অতিক্রম করে যায় ধীমান গণিতবিদ কুর্ট গোডেলের ‘কোনও কিছু সম্পূর্ণ নহে’ বিষয়ক গাণিতিক যুক্তি বিরচন, যেটি প্রমাণ করেছিল গণিতের শর্ত মোতাবেক গাণিতিক প্রতিপাদ্য ‘স্ববিরোধী’ হতে পারবে না এবং প্রতিপাদ্যে প্রাপ্ত ফলাফল অগত্যা একইসঙ্গে সত্য ও মিথ্যা হতে পারে না; স্ববিরোধী নয় এমন প্রতিপাদ্য হচ্ছে স্থিতিশীল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ (Consistent) এবং সে-কারণে ভ্রুব (Constant); তবে উক্ত শর্তের বাইরে অবস্থান করে এ-রকম সকল প্রতিপাদ্য সুসংহত বা ধ্রুব নয় এবং সেহেতু তারা অসম্পূর্ণতার (Incompleteness) দ্যোতক, যেমন মানববিরচিত জ্ঞান ও যুক্তি ইত্যাদি; কোরান এভাবে অতিক্রম করে যায় ভাষাদর্শনের পথিকৃৎ গ্রন্থ ভিটগেনস্টাইনের ট্র্যাকট্যাটাস লজিকো ফিলসফি; মানবসত্তার ধরায় আগমন ও অস্তিত্ব যাপনের বিবমিষা ও ক্লেশ থেকে মুক্তিসন্ধানী সার্ত্রের ইহজাগতিক কথামালা বিয়িং এন্ড নাথিংনেস; নিজের ভাবনা ও বিচারবোধের সদা সচল পরিমার্জনা মানবসমাজে কীভাবে চেতনার পালাবদল ঘটায় সেই ইতিহাসের লিপিকার থমাস কুন-এর স্ট্রাকচার অব দ্য সায়েন্টিফিক রেভ্যুলুশন; মিশেল ফুকো-র মানবজ্ঞান ও জ্ঞানের শৃঙ্খলাকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো পাল্টি জ্ঞান দ্য ওর্ডার অব থিংস ও ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন; মানুষ কেন সচেতন (Conscious) তার সুদীর্ঘ অনুসন্ধানের ইতিহাসে রচিত শত-হাজার গ্রন্থের মধ্যে এখনও মনোজ্ঞ জুলিয়ান জেইন্স রচিত দ্য ওরিজিন অব কনশাসনেস; পদার্থ ও মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম সৃজনশীল ভাবুক জন আর্চিবল্ড হুইলার-এর এক্সপ্লোরিং ব্ল্যাকহোলস ও জিওনস ব্ল্যাকহোলস অ্যান্ড কোয়ান্টাম ফোম-এ বাঁধাই অতুল জ্ঞানের স্মারক সমূহকে।
অথবা তুলনামূলক অতি সাম্প্রতিক রিচার্ড ডকিন্সের দ্য সেলফিশ জিন; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রণী তাত্ত্বিক মার্ভিন মিনস্কির সাবলীল বাখান দ্য সোসাইটিজ অব মাইন্ড; আত্মজীবনীর ছলে মস্তিষ্কবিজ্ঞান তথা ব্রেইন অ্যানাটমির বিকাশ ও অগ্রগতির সুখপাঠ্য বিবরণে ঠাসা এ্যারিক ক্যান্ডেলের ইন সার্চ অব মেমোরি; আচরণবাদী অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল কাহনেম্যানের চমৎকার ধীশক্তির পরিচায়ক থিঙ্কিং ফাস্ট এন্ড স্লো; ইউভাল নোয়াহ হারারির মনোজ্ঞ বিবরণে সুখপাঠ্য মানবেতিহাস স্যাপিয়েন্স : অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব হিউম্যানকাইন্ড ও হোমোডিউজ; মস্তিষ্কের জটিল সড়কে মানব-আচরণের বৈচিত্র্য অনুসন্ধানে ব্রতী রবার্ট সেপোলস্কির অতিকায় গ্রন্থ বিহেভ; জরা ও মৃত্যুকে চিরতরে খতম করতে ব্যগ্র এবং নিৎশের মানবজাতি সম্পর্কে নৈরাশ্য পালটে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ টেকনো-ম্যানিক রে কর্জওয়েল-র পাগলাটে ও সৃজনশীল প্রস্তাবনায় সবাক দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার, যা মানবদেহের হার্ডওয়্যারকে ক্রমশ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নতুন মানব সম্প্রদায়ের (Transhuman) বিকাশ ঘটানোর স্বপ্নে বিভোর; এবং ‘গাইয়া’ অর্থাৎ নিজ-হতে-সক্রিয় ধরিত্রী দেবীর (Self regulated Earth) সঙ্গে মানব বিরচিত কর্মকাণ্ডের সংঘাত ও সহাবস্থানের উপায় সন্ধানে সক্রিয় শতবর্ষী পরিবেশ বিজ্ঞানী জেমস লাভলক বিরচিত গাইয়া : অ্যা নিউ লুক অন লাইফ অ্যাট আর্থ, দ্য রিভেঞ্জ অব গাইয়া এবং আপাত সর্বশেষ গ্রন্থ নোভাসিন ছাড়াও বিশ্বে এখন অবধি আকারে-প্রকারে বিচিত্র ও বহু দূরগামী যত জ্ঞান পয়দা হয়েছে অথবা আগামীতে পয়দা হবে তাদের মধ্যে নিহিত দ্বান্দ্বিক গভীরতাকে নিজে অগীভর থাকার শক্তি দিয়ে কোরান অতিক্রম করে যায়!
এই অগভীরতা ইশরাত বা দিকনিশান ব্যক্তিকে নিজে খুঁজে নিতে বলে। সে নিজ থেকে কিছু ব্যাখ্যা করে না তবে অন্যকে ব্যাখ্যা দিতে বলে। প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে মৌন হেসে উত্তর সন্ধানের ইশারা উঠায়। এটা সেই ‘অগভীরতা’ যে নিজে অগভীর কিন্তু অন্যকে গভীরতা সন্ধানী হওয়ার তাগাদা দেয়, এবং এ-মতো কৌশলে স্থির থাকার কারণে একুশ শতকে পা রাখার পরেও লোকে কোরান নিয়ে ভাবে ও তর্ক করে, স্বীকার-অস্বীকার যায় এবং যারপরনাই এই টেক্সটের প্রভাব ও ভাবমূর্তি জোরালো হতে থাকে! পৃথিবীতে যত টেক্সটের দেখা মিলে তার মধ্যে কোরানকে তাই অভিনব মানতে হয়। মানবজীবনের সমুদয় চিহ্নকে সে সমবেত করে এবং এইসব চিহ্ন সম্পর্কে জ্ঞানতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় অগভীর হওয়ার কারণে প্রতিপক্ষের সন্দেহ-সংশয় ও উপহাসের জবাবে নিজেকে মহাফেজখানা হিসেবে তুলে ধরে! অর্থাৎ কোরান সেই মহাফেজখানা যেখানে জ্ঞান স্বয়ং সশরীর হাজির নেই তবে তার সূত্র ও ইশারা সংরক্ষিত বটে! এর মাধ্যমে বার্তাটা সে দিতে থাকে, — জ্ঞান তৈরি ও তাকে ব্যাখ্যা করা তার কাজ নয়, বরং ঐশী গ্রন্থ রূপে জ্ঞান তৈরির সূত্র ও উৎস জড়ো করা তার দায়িত্ব, যেন লোকে অনুসন্ধান বা অন্বেষণে গমন করতে পারে। সুতরাং প্রচলিত অর্থে কোরান কোনও জ্ঞান নয় কিন্তু যেসব পন্থা বা উপায় অবলম্বনে জ্ঞান তৈরি হয় তার নিশানা।
মোহাম্মদের জীবনে যে-কারণে ‘অজ্ঞতা’ মোটেও কোনও সীমাবদ্ধতা ছিল না, যেমনটা তাঁর বিরোধীরা প্রায়শ বোঝাতে চান। ‘অজ্ঞতা’ তাঁর জন্য লজ্জা বা হীনম্মন্যতার স্মারক হওয়ার পরিবর্তে শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। মানবসংসারে রক্তমাংসের মানুষ হতে গেলে যা লাগে তার সকল উপাদান ইসলামের বার্তাবাহকের মধ্যে সুলভ ছিল। তিনি ঈসা নবির মতো সন্ন্যাসী বা ভবঘুরে ছিলেন না। সংসারজীবন নির্বাহের জন্য একজন লোকের দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও প্রয়োজনবোধে কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়া প্রয়োজন এবং মোহাম্মদ সে-দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেননি। অন্য লোকের মতো তাঁর জীবনে ভালোলাগার ঘটনা ঘটেছে, মনখারাপের ঘটনাও নিতান্ত কম ছিল না। ঘটনা অনুসারে প্রতিক্রিয়া সেভাবে ব্যক্ত করেছেন। শৈশবে পিতৃমাতৃহীন হওয়ার অনুভূতি তাঁকে সারাজীবন তাড়া করে ফিরেছে। কোরানে এতিমদের প্রতি মোহাম্মদের অসীম দরদের মূলে এই ঘটনা নির্ণায়ক কারণ বটে! অনাদর-অবহেলায় অন্যের দাস হয়ে জীবন কাটানোর মর্মবেদনা তাঁকে ক্রীতদাসের আজাদি নিয়ে ভাবিয়েছে। খাদিজার ব্যবসাবাণিজ্য সামাল দিতে গিয়ে মানুষের ওয়াদাভঙ্গ, ছলচাতুরি ও সুদখোরে পরিণত হওয়ার পরিণতি স্বচক্ষে দেখেছেন বলে এইসব ব্যাপারে কঠোর মনোভাব পোষণে কোরান দ্বিধা রাখেনি। সোজা কথায় মানুষকে তিনি ভালোবেসেছেন আবার কঠোর আচরণেও কুণ্ঠিত হননি। বুকে টানতে দ্বিধা ছিল না, প্রয়োজনে দূরে ঠেলে দিতে অথবা আক্রমণাত্মক হতেও কালক্ষেপ ঘটেনি। মঞ্জিলে পৌঁছানোর জন্য প্রতি পদে তাঁকে কৌশলী হতে হয়েছিল; চুক্তি, আপস ও সন্ধি অথবা চুক্তিভঙ্গের সিদ্ধান্ত সেই কৌশলের অংশ রূপে কোরানে আয়াতের-পর-আয়াতে ব্যক্ত হয়।
একজন নবি বহুগুণে গুণান্বিত হওয়ার পরেও মানবিক দোষগুণ ও সীমাবদ্ধতার প্রতীক এই ম্যাসেজটা তাওরাতের পর কোরানে সবচেয়ে ক্লিয়ার পাওয়া যায়। কওমকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনে মোহাম্মদ তাই মূসাকে পদে-পদে স্মরণ করেন; আর কওমের লোকের সঙ্গে বিরোধ ও সংঘাতের মুহূর্তে ইব্রাহিম, লূত থেকে ঈসা পর্যন্ত নবিত্বের সুদীর্ঘ ইতিহাস অমোঘভাবে তাঁর মনে উদিত হয়। সংসারজীবনে তরঙ্গিত মোহাম্মদ অজ্ঞ বা আনপড় ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি সংসারজ্ঞানে জ্ঞানী, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ। আদর্শ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে জয় লাভের জন্য একজন সেনাপতির অনুপ্রেরণা-সঞ্চারী ও বাস্তবজ্ঞানের অধিকারী হতে হয়। যোদ্ধা মোহাম্মদ সে-গুণ রপ্ত করেছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষকে একচুল ছাড় দেওয়া সমরনীতির নিয়মে পড়ে না। কুরু-পাণ্ডবের মহারণে পাণ্ডবদের মন্ত্রণাদাতা শ্রী কৃষ্ণ তো বটেই, যুদ্ধ-বিগ্রহ যার মোটেও পছন্দ নয় সেই ধর্মপরায়ণ সত্যবাদী যুধিষ্ঠির প্রতিপক্ষের ওপর জয়লাভের বাসনায় কাণ্ডজ্ঞানশূন্য আচরণ প্রদর্শনে দ্বিধা করেননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শক্তিমান প্রতিপক্ষ শিক্ষাগুরু দ্রোণাচার্যের মনোবলে চিড় ধরানোর জন্য তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে মিথ্যা সংবাদ প্রদান অথবা মহাবীর কর্ণের সঙ্গে অর্জুনের ঘোর শক্তি পরীক্ষার ক্ষণে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য আচরণ ধার্মিক ও সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। মোহাম্মদ সেই নীতি অনুসরণ করেছেন। কোরানে ইসলামের প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ ও জিজিয়া’ এই কারণে সিগনিফিকেন্ট ঘটনায় পরিণত হয়েছিল :—
‘যাহারা ইমান আনে, হিজরত করে এবং নিজেদের সম্পদ ও নিজেদের জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে তাহারা আল্লাহর নিকট মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, আর তাহারাই সফলকাম।’ — আত-তাওবা ৯:২০;
‘বলো, ‘তোমাদের নিকট যদি আল্লাহ, তাঁহার রসুল এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয় তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের স্বগোষ্ঠী, তোমাদের অর্জিত সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, — যাহার মন্দা পড়ার আশংকা করো এবং তোমাদের বাসস্থান, — যাহা তোমরা ভালোবাসো, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত’। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ — আত-তাওবা ৯:২৪;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
যে-লোক নিজেকে কখনও ‘কাফির, মুশরিক, মুনাফিক’ ভাবেনি তাকে সেটা ভাবতে প্ররোচিত করা এবং তার বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা রণনীতির অংশ রূপে কোরানে অমোঘ হয়েছিল। ‘বাতিল ও নতুন’, ‘সত্য ও মিথ্যা’, ‘মুশরিক ও মুসলমান’, ‘কুফর/কাফির ও তাওহিদ’, ‘ওয়াদা এবং ওয়াদার বরখেলাফ’ ইত্যকায় পরস্পর বিপরীত টেক্সটের সমাবেশ ছাড়া মোহাম্মদের পক্ষে কদাপি সে-উচ্চতায় পৌঁছান সম্ভব হতো না যেখানে আরোহনের ঘোষণা নিয়ে হেরা গুহা থেকে তিনি একদিন কম্পিতদেহে বেরিয়ে এসেছিলেন। আপাত দৃষ্টিতে পন্থাটি নিষ্ঠুর মনে হতে পারে কিন্তু মিশন সাকসেস করার যুদ্ধে সকলই জায়েজ। কোরানে এইসব টেক্সটের প্রয়োগ স্লেজিং বা অশিষ্ট বাক্য প্রয়োগের অংশ কি না তা এইবেলা বিবেচনা করা যেতে পারে :—
ক্রিকেট খেলার মাঠে এবং মাঠের বাইরে প্রতিপক্ষের মনোসংযোগে ফাটল ধরানোর জন্য খোঁচা দিয়ে কথা বলা এমনকি অশিষ্ট বাক্যের প্রয়োগ একাধারে উপাদেয় ও কার্যকরী বিবেচিত হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট খেলোয়াড়রা এই কাজে পারদর্শী এবং তাঁদের দেখানো পথে বাকিরাও নিন্দনীয় ধারাটিকে উপাদেয় শিল্প করে তুলেছেন। মনোসংযোগে চিড় ধরানোর চর্চা ক্রিকেটে ব্যাপক হলেও ফুটবল থেকে শুরু করে রেসলিং ও অন্যান্য সকল খেলায় কমবেশি চলে। ম্যারাডোনার পরে ফুটবলের ইতিহাসে সবচেয়ে নিখুঁত ও শৈল্পিক মাঝমাঠের খেলোয়াড় স্বভাব শান্ত জিনেদান জিদান (*পেলে, পুসকাস, মেসি, রোনালদো বা হালের জোয়ান ছোকরা এমবাপের মতো অতুল ক্ষিপ্রগতির ফরওয়ার্ড বলে জাল ঢোকায় কিন্তু ফুটবল নামের খেলাটি তৈরি হয় মাঝমাঠ আর মাঠের বাম ও ডান কোণ বরাবর জর্জ বেস্ট বা গারিঞ্চার মতো যেসব অসাধারণ খেলোয়াড় সারাক্ষণ দৌড়ায় তাদের চোখ জুড়ানো বোঝাপড়ার বদৌলতে এবং সেখানে জিদানের তুলনা কেবল পাগলা ম্যারাডোনার সঙ্গে হতে পারে।) প্রতিপক্ষ ইতালির সঙ্গে বিশ্বকাপ ফাইনালের উত্তেজনাময় মুহূর্তে যখন নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছেন তখন মার্কো মাতেরাজ্জি তাঁর কানে জিদানের পরিবার নিয়ে যে-খোঁচাটা দিল ফ্রান্সের জন্য সেটাই কাল হয়েছিল!
শান্তসুবোধ ও মিতভাষী জিদান সেদিন খেলার ফাঁকে মাতেরাজ্জিকে কানে-কানে বলেছিলেন, ‘খাড়াও, কাপটা জেতার পর আমার জার্সি তোমারে দিয়া দিমু।’ মাতেরাজ্জি সেয়ানা টাট্টু, জিদানকে উত্তর করেছিল, ‘জার্সিতে কাম নাই দোস্ত। তার পরিবর্তে তোমার বহিনকে পাঠিয়ে দিলেই চলবে।’ তালজ্ঞান হারিয়ে ছয় ফুট লম্বা জিদান মাতেরাজ্জিকে মাথা দিয়ে তখন যে-ঢুসটা মেরেছিলেন খেলার ছন্দে বারোটা বাজাতে সেটাই যথেষ্ট ছিল। জিদানকে রেফারি লাল কার্ড ঠুকতে দেরি করেনি। ইতিহাসের অন্যতম সেরা আ্যটাকিং মিডফিল্ডার জীবনের শেষ ম্যাচে খেলা অসমাপ্ত রেখে মাঠের বাইরে গেলেন আর ছন্দহারা ফ্রান্সকে কুপিয়ে ইতালি এই সুযোগে কাপ নিজের করে নিলো।
জিদানকাণ্ড নিয়ে পরে যে-ঝড় উঠেছিল সেটা আর নিছক ইমোশনের জায়গায় থাকেনি। মাতেরাজ্জিকে সে-জন্য রেসিস্ট ও Muslim-Hater আখ্যার দায়ভার মাথায় নিতে হয়েছিল। সমালোচকরা তখন এই পয়েন্টে সোচ্চার ছিলেন, — মাতেরাজ্জি এমন কুপ্রস্তাব দিতে পেরেছে তার কারণ নিছক আবেগ বা মুহূর্তের উত্তেজনা নয়, জিদানকে সে আসলে মানুষ বলে গণ্য করে না! সে জানে প্রাক্তন ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ার সঙ্গে জিদানের নাড়ির যোগ অবিচ্ছেদ্য। পৈতৃক সূত্রে সে একজন আরব মুসলমান এবং মুসলমানিত্বের স্মারক নিজ দেহের প্রতি অঙ্গে বহন করে ও সেটা নিয়ে বিব্রত বোধ করে না দেখে মাতেরাজ্জি এমনটি করার সাহস পেয়েছিল! জিদান যদি শ্বেতাঙ্গকুলে জন্মগ্রহণ করত তবে মাতেরাজ্জি তাঁকে স্লেজিংয়ের আগে দুবার ভাবত ইত্যাদি। ঘটনা পরে মিটমাট হলেও প্রতিপক্ষকে অশিষ্ট বাক্যে মার্কিং করার পেছনে সমাজ-ইতিহাস কী করে জাগ্রত ও বিস্ফোরক আকার ধারণ করে সেটা অবধানে জিদানকাণ্ডই যথেষ্ট!
মোহাম্মদের প্রতিপক্ষ প্যাগান ও আহলে কিতাবধারী ইহুদি-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বৃহৎ অংশকে ‘ভ্রান্ত বিশ্বাসের অনুসারী’ এবং সে-কারণে ‘কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও জাহান্নামী’ ইত্যাদি অনুভূতি ক্ষুণ্নকারী বিশেষণে দাগানো স্লেজিং বা অশিষ্ট বাক্যে তাদের আত্মবিশ্বাস চুরমার করার কৌশল ছিল কি না সে-বিষয়ে ইসলামের পক্ষ-বিপক্ষ লোকজন ভাবনা করেছেন বলে মনে হয় না। উপমা-উৎপ্রেক্ষার ছলে কোরানে ব্যবহৃত শব্দ স্লেজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে থাকতেও পারে এবং পবিত্রতার ধারণা থেকে ছুটি নিয়ে বিষয়টি খোলা মনে যাচাই করা উচিত।
তো স্লেজিং বা প্রতিপক্ষকে উত্যক্ত করার এই শিল্পে বিদগ্ধজনের আপত্তি থাকলেও পক্ষ-প্রতিপক্ষের লড়াইকে এটা মনঃস্তাত্ত্বিক চালবাজির ঘটনায় রূপদান করে। খেলার মতো অ-রাজনৈতিক ঘটনা তখন রাজনীতির সঙ্গী হতে বাধ্য হয়। ইংল্যান্ডের সঙ্গে ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ জেতার পর লর্ডসের ব্যালকনিতে ভারতীয় কাপ্তান এবং আপাদশির ভদ্রলোক সৌরভ গাঙ্গুলী যখন গায়ের জার্সি খুলে দুই হাতে বনবন করে ঘোরান তখন বিজয় উদযাপনের দৃশ্যটি ক্রিকেট ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে আসে! নিয়মপ্রিয় ইংরেজদের মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়া লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের শত বছরের ঐতিহ্য ও শালীনতাকে গাঙ্গুলীর এমনধারা আচরণ মারাত্মক জখম দিয়ে বসে, যেহেতু অতীতে কেউ এ-রকম কাণ্ড করেনি বা করার কথা ভুলেও মনে স্থান দেয়নি।
‘ক্রিকেট রাজা-রাজড়া ও নিপাট ভদ্রলোকের খেলা’ অথবা ক্রিকেটসাহিত্যের জনক নেভিল কার্ডাসের কাব্যিক লিখনশৈলীর ভিতরে সফর করার দরুণ খেলাটার অনুপম বহুমাত্রিকতার নাড়িনক্ষত্র পাঠে যারা বিমোহিত হয়ে পড়েন তাদের কাছে গাঙ্গুলীর শোভনতা-বিপন্নকারী আচরণকে বেখাপ্পা মনে হওয়া স্বাভাবিক। যদিও আমার ধারণা, নেভিল কার্ডাস স্বয়ং জীবিত এবং লর্ডসে হাজির থাকলে গাঙ্গুলীর অ-ক্রিকেটীয় আচরণকে তৃতীয় মাত্রায় ঠিক ব্যাখ্যা করে উঠতেন। কারণ লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সৌরভ গাঙ্গুলীর উদোম গায়ে বিজয় উদযাপন ধাম করে বিগত দুশো বছর ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ফলাফলকে চোখের সামনে হাজির করায়।
ইংরেজরা তাদের উদ্দেশ্যমূলক মনোবাসনা চরিতার্থে তখন যা-কিছু নিষিদ্ধ, অনুচিত ও অ-সভ্যতা বলে মার্কিং করেছিল লর্ডসের ব্যালকনিতে উদোম গায়ের গাঙ্গুলী সেইসব ‘টাবু’-র দাঁতভাঙা জবাব হয়েই আসে। ইংরেজদের বুটের নিচে শতবছর পিষ্ট ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজনের মনে গাঙ্গুলীকাণ্ড তাই রিলিফ বোধ ও শোধ নেওয়ার আরাম বহায়। ইংরেজরা এখন আর দৃশ্যত ভারতীয়দের প্রতিপক্ষ নয়; সময়ের পালাবদলে লন্ডন শহর উপমহাদেশের লোকজনের কাছে বহু বছর যাবত সেকেন্ড হোম বলে বিবেচ্য। অন্যদিকে ক্রিকেট-অর্থনীতি ও রাজনীতির পটপরিবর্তনে ভারত এখন ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে জুড়ি বেঁধে ‘এলিট ক্লাব’-এর সদস্য রূপে নিজেকে বিশ্বে জাহির করে। যা প্রকারান্তরে খেলাটাকে এলিট ও প্রলেতারিয়েতের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মাঝে গমন করতে বাধ্য করেছে। ভারতের মোড়লগিরির দাপটে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও অন্যান্য সদস্যের মনে তাই বিক্ষোভজনিত স্লেজিং বা খিস্তি-খেউর গত কয়েক দশকে স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে বলা যায়।
এটা সত্য, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সক্ষমতায় অনেক তফাত, কিন্তু দুই দেশ যখন ময়দানে মুখোমুখি হয় তখন দর্শকরা নিজের অজান্তে খোঁচা মারা কথা আর অশিষ্ট বাক্যে শান দিতে শুরু করে; এবং খেলার উত্তেজনাকর মুহূর্তে ভিরাট কোহলি-র জিহ্বা ব্যাদান, যা হয়তো তিনি সহজাত অভ্যাসের দোষে প্রায়শ যত্রতত্র ঘটান, তাঁর এই আচরণ অশেষ কটুক্তি ও খিস্তির স্মারক হতে থাকে। খেলায় হারজিত সেখানে বড়ো কথা নয়, অশিষ্ট বাক্যে কে কতখানি পারঙ্গম সেই প্রতিযোগিতায় উভয় দেশের দর্শক নিজেকে শহিদ করেন। আপাত দৃষ্টিতে ছেলেমানুষী মনে হলেও এর মধ্যে ভারতভাগের ঐতিহাসিক ঘটনা নীরবে সক্রিয় থাকে! প্রতিবেশী দুই দেশের মাঝে বড় ও ছোট ভাই সুলভ যত ব্যাপার অতীতে ঘটেছে অথবা প্রতি পদে ছোট ভাইকে অযাচিত শাসন ও শাসানির যেসব প্রবণতা এখনও বিদ্যমান তারা দগদগে ঘায়ের মতো সচল হয় সেখানে। খেলা তখন নিছক উপলক্ষে পরিণত হয় আর ওদিকে কঠিন বাক্যবাণে একে অন্যকে একহাত নেওয়ার খেলা প্রাধান্য লাভ করে। এই বাকযুদ্ধ মানুষের ইতিহাসে গোত্রছক-শাসিত বৈশিষ্ট্যের স্মারক যা সে আজও নিজেদেহে ধারণ ও বহন করে চলেছে। ‘গাইয়া তত্ত্ব’-এর রূপকার জেমস লাভলক যেমন তাঁর ‘The Revenge of GAIA’ গ্রন্থে বিষয়টিকে যথার্থ বাক্যচয়নে চিহ্নিত করেছেন :—
I think that we reject the evidence that our world is changing because we are still, as that wonderfully wise biologist E. O. Wilson reminded us, tribal carnivores. We are programmed by our inheritance to see other living things as mainly something to eat, and we care more about our national tribe than anything else. We will even give our lives for it and are quite ready to kill other humans in the cruellest of ways for the good of our tribe. We still find alien the concept that we and the rest of life, from bacteria to whales, are parts of the much larger and diverse entity, the living Earth. — Source: The Revenge of GAIA by James Lovelock, Penguin Books, 2006; PDF Edition.
লাভলক কিছু বাড়িয়ে বলেননি। মানুষ নামমাত্র নিজেকে বিশ্বজনীন মানবসত্তার অংশ ভাবে! নিজেকে সে ধরণী মায়ের সন্তান ভাবলেও ধরিত্রী স্বয়ং সক্রিয় ও জীবিত সত্তা এমন কথা কদাচিৎ স্বীকার যায় ও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ‘মাদার আর্থ’ নিয়ে বন্দনা পুথিপাঁজির জগতে ব্যাপক হলেও মানুষ এখনও দেশ-জাতি-সম্প্রদায় পরিচয়ের আড়ালে চিরাচরিত ট্রাইবাল বা গোত্রশাসিত জীবনছকে কাল কাটায়। ক্রিকেট খেলা নিয়ে স্লেজিংয়ে লিপ্ত হওয়ার ক্ষণে এই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সে। বাংলাদেশী ও ভারতীয় ন্যাশনালিটির মাঝে যাপিত লোকজনের মধ্যে স্লেজিংয়ের ঘটনা দূর ইতিহাসে তারা যখন ছোট-বড়ো গোত্রে বিভক্ত ছিল এবং তুচ্ছ বিষয়ে কলহ-বিবাদে জড়িত হওয়ার জের ধরে একে অন্যের সঙ্গে টোটা-বল্লম-তীর-ধনুক সহযোগে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে তামাদি হতো, এখন ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে পুরোনো সেই ইতিহাসটি মুহূর্তে সক্রিয় হয় সেখানে!
প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের মধ্যে মানসিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও বহু বছর আগের ঘটনাও যে আসলে তামাদি হয় না বরং সময়ের সঙ্গে সজাগ ও সচল হয়ে ওঠে, লর্ডসে গাঙ্গুলীকাণ্ড সেই সত্যকে পুনরায় সামনে হাজির করেছিল। দৃশ্যটি কেবল ভারতবাসীর মনে রিলিফ বয়ে এনেছিল এমন কিন্তু নয়, বাংলাদেশ থেকে শ্রীলংকা সকলে এর সঙ্গে কমবেশি সম্পৃক্ত বোধ করেছিল। সৌরভ গাঙ্গুলী হয়তো মুহূর্তের উত্তেজনাবশে সেদিন কাণ্ডটা ঘটান কিন্তু তাঁর এই কাণ্ড পরোক্ষভাবে ঐতিহাসিক চিহ্নের সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে উপমহাদেশের ক্রিকেট দর্শককে সেদিন বাধ্য করেছিল! অন্যদিকে গাঙ্গুলীর অর্বাচীন কাণ্ড ইংরেজমনে অপমানিত ও স্লেজিংয়ের শিকার হওয়ার অনুভূতি তীব্র করে তুলেছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তো এই সুযোগে প্রশ্নটি বোধহয় উঠানো যায়, — গায়েবি হতে অবতীর্ণ কোরান কি জাতীয়তা নামক এইসব গোত্রছকে হাবুডুবু খাওয়া রেষারেষির পৃথিবীতে ব্যতিক্রম হয়ে ধরায় নেমে এসেছিল সেই সময়? মানুষ মাত্র আল্লাহর সৃষ্টি এবং মরণের পর তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে ইত্যাদি ঘোষণার মধ্যে বিশ্বজনীন চিরয়াত সুর ধ্বনিত হয়েছে, কিন্তু তা-সত্ত্বেও কোরানের পাতায়-পাতায় যুগে-যুগে আগত মানব সম্প্রদায়ের যেসব ছবি পাঠক সচল হতে দেখে সেখানে তাদেরকে ছোট-বড় গোত্রে বিভক্ত এবং সারাক্ষণ দলাদলি, কামড়াকামড়ি ও ব্যভিচারে লিপ্ত অবাধ্য, অবিশ্বাসী, ভণ্ড, হিংসুক, কাঠগোঁয়ার আর ভয়ংকর হিংস্র জীব ব্যতীত অন্য কিছু ভাবা কঠিন হয়। যেন ধরাধামে তারা এসেছে যুগ-যুগ ধরে যিনি তাদেরকে এখানে পাঠান তাঁর স্রষ্টাসুলভ অনন্যতাকে অস্বীকার করে অবাধ্য থাকার জন্য! অবাধ্যতার এই পরিচয় কোরানে ইতিহাস হয়ে আছে :—
‘তোমরা কিরূপে আল্লাহকে অস্বীকার করো? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদেরকে জীবন্ত করিয়াছেন, আবার তোমাদের মৃত্যু ঘটাইবেন ও পুনরায় জীবন্ত করিবেন, পরিণামে তাঁহার দিকেই তোমাদেরকে ফিরাইয়া আনা হইবে।’ — বাকারাহ ২:২৮;
‘এবং যখন তাহাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তাহাতে ইমান আনয়ন করো, তাহারা বলে, ‘আমাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে আমরা তাহাতে বিশ্বাস করি।’…বলো, ‘যদি তোমরা মু’মিন হইতে তবে কেন তোমরা অতীতে আল্লাহর নবিগণকে হত্যা করিয়াছিলে?’ — বাকারাহ ২:৯১;
‘যাহারা ইমান আনে আল্লাহ তাহাদের অভিভাবক, তিনি তাহাদেরকে অন্ধকার হইতে বাহির করিয়া আলোকে লইয়া যান। আর যাহারা কুফরি করে তাগুত তাহাদের অভিভাবক; ইহারা তাহাদেরকে আলো হইতে অন্ধকারে লইয়া যায়। উহারাই অগ্নির অধিবাসী, সেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে।’ — বাকারাহ ২:২৫৭;
‘তাহারা কি দেখে না যে, আমি তাহাদের পূর্বে কত মানবগোষ্ঠীকে বিনাশ করিয়াছি? তাহাদেরকে দুনিয়ায় এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলাম যেমনটি তোমাদেরকেও করি নাই এবং তাহাদের উপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করিয়াছিলাম, আর তাহাদের পাদদেশে নদী প্রবাহিত করিয়াছিলাম; অতঃপর তাহাদের পাপের দরুন তাহাদেরকে বিনাশ করিয়াছি এবং তাহাদের পরে অপর মানবগোষ্ঠী সৃষ্টি করিয়াছি।’ — আনআম ৬:৬;
‘শ্রেষ্ঠ কি উহারা, না তুব্বা সম্প্রদায় ও ইহাদের পূর্ববর্তীরা? আমি উহাদেরকে ধ্বংস করিয়াছিলাম, অবশ্যই উহারা ছিল অপরাধী।’ — দুখান; ৪৪:৩৭;
‘আমি ধ্বংস করিয়াছি কত জনপদ যেইগুলির বাসিন্দা ছিল জালিম। এইসব জনপদ তাহাদের ঘরের ছাদসহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হইয়াছিল এবং কত কূপ পরিত্যক্ত হইয়াছিল ও কত সুদৃঢ় প্রাসাদও।’ — হাজ্জ ২২:৪৫;
‘আমি ধ্বংস করিয়াছিলাম ‘আদ, সামূদ ও রাস্’-এর অধিবাসীকে এবং উহাদের অন্তর্বর্তীকালের বহু সম্প্রদায়কেও।’ — ফুরকান ২৫:৩৮;
‘হে মানুষ! একটি উপমা দেওয়া হইতেছে, মনোযোগ সহকারে উহা শ্রবণ করো : তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাহাদেরকে ডাক তাহারা তো কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করিতে পারিবে না, এই উদ্দেশ্যে তাহারা সকলে একত্র হলেও। এবং মাছি যদি কিছু ছিনাইয়া লইয়া যায় তাহাদের নিকট হইতে, ইহাও তাহারা উহার নিকট হইতে উদ্ধার করিতে পারিবে না। অন্বেষক ও অন্বেষিত কতই না দুর্বল;’ — হাজ্জ ২২:৭৩;
‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছি এবং তাহার প্রবৃত্তি তাহাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তাহা আমি জানি। আমি তাহার গ্রীবাস্থিত ধমনি অপেক্ষাও নিকটতর।’ — ক্বাফ ৫০:১৬;
‘ইচ্ছা করিলে আল্লাহ তোমাদেরকে এক জাতি করিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যাহা দিয়াছেন তদদ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করিতে চান। সুতরাং সৎকর্মে তোমরা প্রতিযোগিতা করো। আল্লাহর দিকেই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর তোমরা যে-বিষয়ে মতভেদ করিতেছিলে, সে সম্বন্ধে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করিবেন।’ — মায়িদাহ ৫:৪৮;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
এক জাতির পরিবর্তে বহু জাতি ও গোত্র রূপে পৃথিবীতে মানব সম্প্রদায়ের জীবনধারা আল্লাহকে সুখী করেনি সেই ইঙ্গিত ঐশী গ্রন্থ প্রেরণ, বিকৃতির অভিযোগে পূর্বে প্রেরিত ওহির স্থলে নতুন নবি ও ওহি প্রেরণ, এবং যুগে-যুগে ধরার সকল কোণে পথপ্রদর্শক নবি পাঠানোর ঘটনায় প্রমাণিত। আল্লাহকে যদি লাভলকের ‘গাইয়া’ অর্থাৎ নিজেকে সক্রিয় ও সংরক্ষণে সক্ষম ধরিত্রীর উপমা ধরি তবে তাঁর অনন্যতা ও জীবন অন্তে তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনের সুর কখনও নমনীয় এবং সিংহভাগ সময় কঠোর ভাষায় কোরানের প্রতি ছত্রে নিনাদিত হয়েছে। ব্যাকুল সেই নিনাদের বাহক রূপে নবিকে গোত্রশাসিত জীবনধারায় অবিরত পাক খেতে আর সংঘাত ও অশিষ্ট বাক্যে আয়ুক্ষয় করতে দেখা যায়। কোরান তাই এক অর্থে যুগে-যুগে আল্লাহ প্রেরিত মানবগোত্রের একে অন্যের সঙ্গে বচসা ও সংঘাতের সচল ইতিহাস। মানব সম্প্রদায়কে নিয়ে স্রষ্টা আল্লাহর বিপাকের সূচনা স্বয়ং ইডেন বা বেহেশতের বাগানে ঘটেছিল। শয়তানের কুমন্ত্রণায় প্ররোচিত হয়ে বনি আদম ও বিবি হাওয়া নিষিদ্ধ গন্দম বৃক্ষের নিকটবর্তী হয় এবং বৃক্ষে ঝুলন্ত ফল ভক্ষণের লোভ দুজনে সংবরণ করতে পারে না, যারপরনাই আল্লাহকে বিপাকে পড়তে হয়েছিল এবং তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে ট্রান্সমিট করেন :—
‘কিন্তু শয়তান উহা হইতে তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল এবং তাহারা যেখানে ছিল সেখান হইতে তাহাদেরকে বহিষ্কার করিল। আমি বলিলাম, ‘তোমরা একে অন্যের শত্রু রূপে নামিয়া যাও, পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রহিল।’ — উৎস : বাকারাহ ২:৩৬; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
গন্দমবৃক্ষ জ্ঞানের প্রতীক, যা ভক্ষণের পর মন অতীতের ন্যায় নির্মল ও চৈতন্যবিহীন সক্রিয় পুষ্প থাকে না। পুষ্পের জানার প্রয়োজন নেই কেন সে পাপড়ি মেলে এবং জীবনঅন্তে পৌঁছানোর পর মাটিতে ঝরে। নিজের ‘রব বা এলাহি’র কাছে সে জানতে চায়নি কেন তাকে পাপড়ি মেলার পর ঝরে যেতে হয়! পুষ্পের জীবন সৃষ্টির লীলা বিবেচনায় অটোম্যাটন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় এক রোবট হচ্ছে এই পুষ্প; যে কিনা তার স্রষ্টার কাছে কখনও প্রশ্নটি করে না কী কারণে তিনি তাকে ফুল ফোটা ও ঝরার ছন্দে জগতে সক্রিয় রেখেছেন! বাইবেল ও কোরান ঘটনাটা স্পষ্ট করেনি তবে এমতো সম্ভব মনে হয়, নূর থেকে সৃষ্ট মালাইক বা ফেরেশতারা অটোম্যাটনের লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও সচেতনা ও ভেদবিচারের ক্ষমতা বা ‘আকল’ সহ আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন। অন্যথায় ইবলিশ কী কারণে মাটি থেকে সৃষ্ট আদমকে সেজদা দিতে অস্বীকার করে এবং মানুষের চিরন্তন শত্রু রূপে আদম-হাওয়ার সঙ্গে নিজে ধরায় নেমে আসে সেটা ক্লিয়ার হয় না। এমন হতেও পারে আল্লাহ হয়তো জিন, ফেরেশতা ও মানুষের মাঝে বর্গীকরণ করেছিলেন। কেন, সে-প্রসঙ্গে পরের পর্বেই বলি।
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS