ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪ || আহমদ মিনহাজ

ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪ || আহমদ মিনহাজ

তৃতীয় প্রবাহ : জ্ঞানবৃক্ষ নূরতত্ত্ব : সুফিভাবে নূরের সুরতবিচার


আহাদ-আহমদ নিয়ে বিগত প্রবাহ যেখানে এসে থেমেছিল সেখান থেকে শুরু করতে হলে লালন সাঁইজিকে নিয়ে অগ্রসর হওয়াই সমীচীন। সাঁইজির আত্মতত্ত্ব মরমি ইহজাগতিকতায় নিজেকে উপনীত দেখে এবং পচনশীল মানবদেহ তাঁর চেতনায় নূরের ভাণ্ড রূপে ধরা দেয়! এটা সেই ভাণ্ড যেখানে আহাদ স্বয়ং নিজে তরঙ্গিত রয়েছেন বলে তিনি একিন যান। শরিয়ত থেকে মারফতে গমনের পথে লালন তাই আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানুষকে ভজনা বা অনুধ্যান করতে পারলে আহমদ নামে সম্ভাষিত নবি মোহাম্মদকে নিজের অন্তরে টের পাওয়া যায়। কারও অন্তরে নবি মূর্ত হলে ‘কেশের আড়ে’ লুকানো পাহাড় অর্থাৎ আহাদ নামে খ্যাত আল্লাহ অধিক দূরবর্তী থাকেন না। আহাদ নিকটবর্তী হওয়ায় গিট্টু বা পর্দা তখন আর জারি থাকে না! যারপরনাই আহাদে আহমদ ও আহমদে আহাদ লীলাময় হতে থাকেন, — ‘লাম-আলিফ লুকায় যেমন / মানুষে সাঁই আছে তেমন / তা নইলে কি সব নূরীগণ / আদম তনে সেজদা জানায়।’ — উৎস : নবিতত্ত্ব : গান ৩০; অখণ্ড লালনসঙ্গীত; সম্পাদনা : আবদেল মাননান; পিডিএফ সংস্করণ

লালনের এই ‘আহাদ-আহমদ’ ভেদ বিচারে আত্মতত্ত্ব-দেহতত্ত্ব আল্লাহর সিফাত বা রহস্যময় স্বরূপ সংক্রান্ত অনুধ্যান ও তাঁর জ্যোতির সাগরে শামিল হওয়ার উপায় রূপে বিশিষ্টতা পাওয়ায় আমাদের মন আবেশবিধুর হয় এবং হৃদয়ে তৃপ্তির তরঙ্গ বহে। কোরানে ব্যক্ত জাহিরি অর্থের সীমানা অতিক্রম করে গুপ্ত বা বাতেনির গহীনে লালন যেহেতু প্রবেশ করেন এবং ‘দেল কোরান’-এ তরঙ্গিত জ্যোতির সাহায্যে আল্লাহ-নবির অখণ্ড সংযোগ অনুভব যাওয়ার আওয়াজ উঠান, তখন সংগত কারণে সংসারযজ্ঞে বেফানা মানবহৃদয় খোদা চেনার উপায় রূপে তাঁর গানে ব্যক্ত কথা ও সুরে নিজেকে একাত্ম করে। গানের ছলে তিনি যেসব বচন রেখে গেছেন সেগুলোকে সাঁইজির কালাম নামে সুবাসিত করতে মানুষ তাই দুবার ভাবেনি! পরম যে-জ্যোতিকে চোখে নজর করা যায় না তার প্রতি ইমান অটল রাখার উপায় কি? — কূটপ্রশ্নটি লালন তাঁর গানের কলিতে অবিরাম প্রয়োগ করেছেন এবং উপায়টা সেখানে তাঁকে তালাশ করতে হয়েছিল। সেই তালাশের ফিকিরে ঘুরতে-ঘুরতে তিনি নবির দেখা পেয়েছিলেন। নবি তাঁর কাছে মাধ্যম রূপে হাজির হলেন, যাঁর ধ্যানে মগ্ন হতে পারলে আল্লাহর জ্যোতির কিনারা পাওয়া যায় বলে তিনি একরার যান।

লালন তাই পদবন্ধ রচনার ক্ষণে প্রতি ছত্রে ইশারা দিতে বাকি রাখেননি, — নিজের স্বরূপ বুঝাতে নবি মোহাম্মদের ‘ছায়া’ ধারণ করে স্বয়ং আল্লাহ লীলা করে গেছেন মক্কা ও সোনার মদিনায়। নবিকে মুর্শিদ বা গুরু মান্য করে যে-মানুষ ভজনা করতে জানে সে একসময় নিজের ‘দেলে’ আল্লাহ তথা আহাদ এবং আহমদ তথা মোহাম্মদকে একাকার টের পায় এবং তার মনের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। ভেদ ঘোচার কারণে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মাঝখানে বিরাজিত মিম নফি বা অবলুপ্ত হয়। এই অবলুপ্তির ফলে সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার ভিন্নতা বা পৃথকত্বের যে-বোধ এতদিন তাকে ঘুরিয়ে মেরেছে ও বিবাদের কারণ ছিল সেটা বিলোপ হয় চিরতরে।

লালনের ‘দেল কোরান’ মূলত আত্মজ্ঞানের স্মারক। যে-লোক আত্মতত্ত্বের খবর করতে পারে তার আর আসমানে তাকানোর প্রয়োজন নেই। নিজের দেহঘরে গোটা আসমান অর্থাৎ খোদার বিরাজিত থাকার ঘটনা সে নয়নভরে দেখতে পায় এবং স্বয়ং স্রষ্টার জ্যোতির অংশ রূপে বিরাজ করে ধরায়। তো সেই ‘অধর মানুষ’-কে নিজবক্ষে ধারণের ফিকিরে যারা ঘুরে তারা হলেন ‘সোনার মানুষ’। নূর তেজল্লিতে স্নাত হওয়ার কারণে আল্লাহর সঙ্গে তাদের ভেদাভেদ মুছে যায় এবং ‘সহজ মানুষ’-এ রূপান্তর ঘটে। ‘সহজ মানুষ’ আদমসুরতের চিরমৌলিক আকৃতি যার ছাঁচে আল্লাহ একদিন আদম ও হাওয়াকে সৃজন করেছিলেন। বিষয়টি উপলব্ধির খাতিরে নূরনবিরসুল তত্ত্বের মরমি বাখানে সাঁইজি তাঁর গীতে যেসব উক্তি করে গেছেন তার চুম্বকাংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন :—

সব সৃষ্টি করল যে জন তাঁরে সৃষ্টি কে করেছে। / সৃষ্টি ছাড়া কি রূপে সে সৃষ্টিকর্তা নাম ধরেছে॥ / সৃষ্টিকর্তা বলছো যারে লা শরিক হয় কেমন করে। / ভেবে দেখো পূর্বাপরে সৃষ্টি করলে শরিক আছে॥ — সিদ্ধিদেশ : গান ৮৯৫;

মকর উল্লার মকর কে বুঝতে পারে। / আপনি আল্লাহ আপনি নবি আপনি আদম নাম ধরে॥ — সাধকদেশ : গান ৭১৬;

পাবে সামান্যে কি তাঁর দেখা। / বেদে নাই যাঁর রূপরেখা॥ / সবে বলে পরম ইষ্ট কারও না হইল দৃষ্ট। / বরাতে করিল সৃষ্ট তাই লয়ে লেখাজোখা॥ / নিরাকার ব্রহ্ম হয়ে সে সদাই ফিরছে অচিন দেশে। / দোসর তার নাইকো পাশে ফেরে সে একা একা॥ — প্রবর্তদেশ : গান ৪২১;

আলিফ হে আর মিম দালেতে আহমদ নাম লেখা যায়। / মিম হরফ তাঁর নফি করে দেখ না খোদা কারে কয়॥ / আকার ছেড়ে নিরাকারে ভজলি রে আন্ধালের প্রায়। / আহাদে আহমদ হলো করলিনে তাঁর পরিচয়॥ — প্রবর্তদেশ : গান ৪১৮;

না দেখলে লেহাজ করে মুখে পড়লে কি হয়। / মনের ঘোরে কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়॥ / আহমদ নামে দেখি মিম হরফটি দেখায় নফি। / মিম গেলে সে হয় কি দেখো পড়ে সবাই॥ / আহাদ আহমদে এক লায়েক সে মর্ম পায়। / আকার ছেড়ে নিরাকারে সেজদা কে দেয়॥ — প্রবর্তদেশ : গান ৪১২;

খোদা রয় আদমে মিশে / কার জন্য মন হলি হত সেই খোদা আদমে আছে॥ / নাম দিয়া সাঁই কোথা লুকালে মুর্শিদ ধরে সাধন করলে নিকটে মেলে / আত্মরূপে কর্তা হয়ে করো তার দিশে॥ / আল্লাহ নবী আদম এই তিনে নাই কোন ভেদ আছে এক আত্মায় মিশে / দেখবি যদি হযরত নবিকে এশকেতে আছে॥ / যাঁর হয়েছে মুর্শিদের জ্ঞান উজালা সেই দেখিবে নূর তাজাল্লা / লালন বলে জ্ঞানী যারা দেখবে অনা’সে॥ — প্রবর্তদেশ : ৩৬৬;

যেদিন জ্বলে উঠবে নূর তাজেল্লা এই অধর মানুষ যাবে গো ধরা। / আল্লাহ নবি দু্ই অবতার এক নূরেতে মিলন করা॥ — নূরতত্ত্ব : গান ০৬;

আলিফ লাম মিমেতে কোরান তামাম শোধ লিখেছে। / আলিফে আল্লাহজি মিম মানে নবি লামের হয় দুই মানে / এক মানে হয় শরায় প্রচার আরেক মানে মারফতে॥ — নবিতত্ত্ব : গান ১৯;

আহাদে আহমদ এসে নবি নাম কে জানালে। / যে তনে করিল সৃষ্টি সে তন কোথায় রাখিলে॥ / আহাদ মানে পারওয়ার আহমদ নাম হলো যাঁর। / জন্মমৃত্যু হয় যদি তাঁর শরার আইন কই চলে॥ — নবিতত্ত্ব : গান ২০;

কীর্তিকর্মার খেলা কে বুঝতে পারে। / যে নিরঞ্জন সে নূর নবি নামটি ধরে॥ / গঠিতে সাঁই সয়াল সংসার একদেহে দুই দেহ হয় তাঁর। / আহাদে আহমদ নাম দেখো বিচারে॥ — নবিতত্ত্ব : গান ২৬;

নবি চিনা রসুল জানা ও দিনকানা তোর ভাগ্যে জোটে না। / আল্লাহ মোহাম্মদ নবি তিনে হয় একজনা॥ / কোথায় আল্লাহ কোথায় নবি কোথায় সে ফাতেমা বিবি। / লেহাজ করলে জানতে পারবি প্রেম করেছে এ তিনজনা॥ / যে খোদ সেই তো খোদা আকৃতি-নাম করলেন জুদা। / তাই তো হলেন মোহাম্মদা বিবির কাছে হয় দেনা॥ — নবিতত্ত্ব : গান ৩৭;

আহাদে আহমদ বর্ত / জেনে করো তাঁহার অর্থ হয় না যেন ভুল। / ফকির লালন ভেদ না বুঝে হলো নামাকূল॥ — নবিতত্ত্ব : গান ৪০;

নবি মেরাজ হতে এলেন ঘুরে। / বলেন না ভেদ কারো তরে॥ / শুনে আলী কহিছেন তখন দেখে এলেন আল্লাহ কেমন / নবি কয় ঠিক তোমার মতন করো আমল আমি বলো যারে॥ / এসে আবু বকর আল্লাহ কেমন দেখে এলে। / রূপটি কেমন দেবেন বলে নবি বলে তুমি দেখো তোমারে॥ / তারপর কহিছে ওমর কেমন আল্লাহর আকার-প্রকার। / নবি কয় ঠিক তোমার আকার আইনাল হক কোরান ফুকারে॥ / পরে জিজ্ঞাসিল ওসমানগণি আল্লাহ কেমন বলেন শুনি। / নবি কয় যেমন তুমি তেমন ঠিক পরওয়ারে॥ / নবিজি মেরাজে গিয়ে যে ভেদ তিনি এলেন নিয়ে। / নবিজি যা বুঝাইল চারজনা চার মতে প’লো লালন প’লো মহাগোলে॥ — নবিতত্ত্ব : গান ৪৪;

নবি আদম খোদ বেখোদা এ তিন কভু নাহি জুদা। / আদমে করিলে সেজদা আলেকজনা পায়॥ — নবিতত্ত্ব : গান ৪৮;

আপনি আল্লাহ আপনি নবি আপনি হন আদম সফি / অনন্ত রূপ করে ধারণ কে বোঝে তাঁর লীলার কারণ / নিরাকারে সাঁই নিরঞ্জন মুর্শিদরূপ হয় ভজনপথে॥ — নবিতত্ত্ব : গান ৫৮;

আহমদ নাম লিখিতে মিম হরফ কয় নফি করতে। / সিরাজ সাঁই কয় লালন তোকে কিঞ্চিৎ নজর দেখাই॥ — রসুলতত্ত্ব : গান ৮০;

সূত্র : অখণ্ড লালনসঙ্গীত; সম্পাদনা : আবদেল মাননান; রোদেলা প্রকাশনী; পিডিএফ সংস্করণ

সাঁইজির গানের সুদীর্ঘ উদ্ধৃতি পেশ করার উদ্দেশ্য হলো সেই অপূর্বতার খানিক দিশা পাওয়া যার জোরে লালন বঙ্গ তথা উপমহাদেশের ভাব-সাধনায় অন্যতম স্বতন্ত্র ও পরিণত ঘটনা বলে নিজের প্রমাণ রেখেছিলেন। সমগ্র ভারতবর্ষে ঈশ্বরের স্বরূপ অন্বেষণ ও ধর্মীয় সাধনার বিচিত্রগামী তরঙ্গে তিনি অবগাহন করেছেন কিন্তু কোনও তরঙ্গকে নির্ণায়ক বা অন্তিম মানদণ্ড রূপে গ্রহণ করেননি। উদ্ধৃত পদ সমূহের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণ ও নিমাই সন্ন্যাসী অর্থাৎ সম্পাদক আবদেল মাননান কৃত পর্ববিন্যাসে গোষ্ঠ, নিমাই ও নিতাইলীলায় সন্নিবেশিত গীতকলি থেকে কোনও পদ চয়ন করা হয়নি; এবং সেটা এ-কারণে, — চয়নকৃত পদে লালন নিজের ভাবতরিকাকে যেসব বিন্দুতে নির্দিষ্ট করেন তার সঙ্গে গোষ্ঠ ও নিমাইয়ে বর্ণিত পদের সবিশেষ পার্থক্য নেই। মোদ্দা কথা হলো, আল্লাহর মৌল গুণাবলী থেকে জায়মান সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর পার্থক্য ও অভিন্নতার তালাশে নেমে লালন নিজেকে ইসলাম তথা সকল ধর্মীয় চিহ্ন থেকে একপ্রকার বিযুক্ত করে নিয়েছিলেন সেই সময়। তাঁর বাচনিকতা তাই সন্তু কবীর ও বুল্লে শাহ যে-পথে একদিন গমন করেছিলেন সেই পথের ধারা মেনে প্রচলিত থেকে পৃথক থিওসফি বা ঈশ্বরতত্ত্ব রূপে নিজেকে হাজির করে!

লালনের এই থিওসফির নাভিকেন্দ্রে আত্মতত্ত্বের যে-আলো ঠিকরে বের হয় সেখানে মানুষ ও ঈশ্বর পরস্পর একীভূত গণ্য হওয়ার ফলে সৃষ্ট মানুষ বিনে খোদ স্রষ্টার বেইল মিলে না। সোজাকথা তাঁর থিওসফি বেদ-কোরান-পুরাণসহ ধর্মীয় আচার-বিচার ও উপাসনাকে রেফ্রেন্স টেক্সট রূপে পাঠ যায়; সেইসঙ্গে বাতেনি বা গুপ্তকথা ভেদের বাহানায় ওইসব টেক্সটে অর্থ-বিপর্যয় ঘটানোর পাশাপাশি সকল ধর্মীয় পরিচয় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে মরিয়া থাকে। সন্তু কবীরের মতো লালনের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে তাই গোল বাঁধে, যেহেতু তাঁরা এক অর্থে সকল ধর্মের নির্যাসকথায় বিচরণ করেন এবং অন্যদিকে কোনও ধর্মে সত্যিকারভাবে বিরাজিত থাকেন না। না-থাকার নেপথ্যে সমাজ কর্তৃক তাঁদেরকে ব্রাত্য বা প্রান্তিক গণ্য করার আর্থ-সামাজিক কার্যকারণ নিয়ে গুণীজনরা বিস্তর আলোচনা করেছেন, সুতরাং এখানে তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। তবে হ্যাঁ, আর্থ-সামাজিক কার্যকারণের ফেরে লালন, কবীর বা বুল্লে-র উপেক্ষিত ও নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা তাঁদেরকে প্রচলিত টেক্সট থেকে নিগমন নিয়ে লোকায়ত টেক্সটে স্রষ্টার অনুসন্ধানে তাড়িত করেছিল এ-কথা কবুল করা উচিত।

আত্মতত্ত্বের নৌকায় চড়ে আল্লাহ ও আল্লাহ সৃষ্ট নূরের প্রতিভাসে নূরানি মোহাম্মদ এবং মোহাম্মদের উম্মত রূপে মুসলমানের পরিবর্তে সমগ্র মানব জাতিকে নূর-ঝিলিকে একীভূত করায় তাঁদের থিওসফিকে বাউল, সুফি, মরমি ইত্যাদি প্রচলিত ধারার বাইরে পৃথক স্বীকৃতি দান করা জরুরি। শরিয়ত ও মারফতের মিলন-সংঘাত থেকে উত্থিত সুর এবং আকারে-প্রকারে যত বিচিত্র সিলসিলার ছাপ বহনের দায়ে তাঁরা বঙ্গে বাউল, পাঞ্জাবে সুফি এবং উত্তর ভারতে মরমি ইত্যাদি অভিধায় বিশিষ্ট হতে থাকেন সেইসব সিলসিলার কোনওটাই কবীর, লালন ও বুল্লে-র ইহজাগতিক মরমি চেতনাকে ঠিকঠাক ধারণ ও ব্যাখ্যা করে বলে মনে হয় না। তাঁরা হলেন বহির্গামী সুর, যাঁরা কার্যত কোনও ধর্মে এখন আর বিলং করেন কি না সন্দেহ! আল্লাহর সুলুক করতে গিয়ে তাঁদের আত্ম-অন্বেষণ শেষতক অজ্ঞেয় বা অ্যাগনস্টিক ভাবধারার সঙ্গে বরং খানিক সাদৃশ্য ধরে বলা যায়। আধ্যাত্মিকতার ছলে ইহজাগতিক চিহ্নধারী মানুষের আত্মিক ঊর্ধ্বারোহনের মাঝে নিজের মুক্তি তাঁরা খুঁজে ফিরেছেন। নূর-সন্ধানের তরিকা সেখানে তাই জীবনবাদী রূপ নিয়েছে। আল্লাহর নাগাল পেতে ধর্মীয় টেক্সট ও রিচ্যুয়ালের গোলকধাঁধায় তাঁরা ঢোকেন এবং সেখানে গমনের পর আল্লাহকে নিখোঁজ হতে দেখেন! অগত্যা মানুষকে নূর তেজল্লির স্মারক ঘোষণা দিয়ে গোলকধাঁধা থেকে নিগমন নিয়ে নেন। জালাল উদ্দিন সে-কারণে অক্লেশে এমনটি বলতে পেরেছিলেন :—

কী সুরত বানাইলে খোদা রূপ মিশায়ে আপনার, / এই সুরত দোজখে যাবে, যে বলে সে গোনাগার।। / মানব-সুরতের মাঝে, তুমিই আছ তোমার কাজে, / আদম বানাইলে কি বনলে তুমি, লীলা বোঝা হল ভার।। / মানব-দেহেতে খোদা, দম থাকতে না হবে জুদা, / কেবা আদম, কেবা খোদা, কে করিবে কার বিচার? / দেখিলাম দুনিয়া ঘুরে, দুই সুরত এক মিল না পড়ে, / লক্ষ-কোটি আকার ধরে, সাজিলে তুই নিরাকার।। — উৎস : পরমতত্ত্ব : গান; জালালগীতিকা সমগ্র (১ম খণ্ড), সম্পাদনা : যতীন সরকার, নন্দিত প্রকাশনী; পিডিএফ সংস্করণ

জালালের গানের সূত্র ধরে বলা যায়, আত্মতত্ত্বের তালাশে নিজের দেহে গমনকারী এই প্রান্তিকজনরা ততটুকু আল্লাহ-ভগবান-নবি-অবতার-আউলিয়া ভক্ত যতটুকু থাকলে বিশেষ প্রকৃতির অধিকারী ওইসব সত্তাকে দূরগামী ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে প্রমাদ জাগে না। এবং, তাঁরা সকলে সেই পরিমাণ সুফি, মরমি, বাউল অথবা বাতেনি বাতচিত ও বাহাসে কামিল যে-পরিমাণ কামিল হতে পারলে আস্তি ও নাস্তি উভয় দশায় জারি থাকা যায়। তাঁদের গানের পদবন্ধ তাই দ্বিরুক্তি ছাড়া নিজেকে ব্যক্ত করে না আর লোকে সেই চক্করে পড়ে তাঁদের ভক্তিটক্তি করে ও মিস্টিক বলে দাগায়। কার্যত তাঁরা না বিশ্বাসী না অবিশ্বাসী, তাঁরা হয়তো আত্মতত্ত্বের খবর করার ছলে ধীমান তার্কিক, যে-আসলে নিজেকে ছাড়া দ্বিতীয় কিছুতে বিশ্বাস যায়নি কখনও! বিষয়টি অবধানের জন্য উপমহাদেশের লোকের মুখে-মুখে বুল্লে শাহ-র অসম্ভব জনপ্রিয় যে-কালামটি গীত হয়ে থাকে সেখানে ব্যক্ত ভাবিকমর্ম অধমের কাঁচা হাতের ভাষান্তরে হাজির করা আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না :—

বুল্লে তার আপন চেনে না
মসজিদে বিশ্বাসী নয়
কাফেরি আচারে নেই সহবত
ভেজালের মাঝে খাঁটি কেউ নয়
বেদ-কিতাব জুড়েনি অন্তরে
মদ্যপ বিলকুল নয়
না গিয়েছে গোল্লায়
না থাকে পরিণয়ে না আছে খেদ
ভেজাল ও খাঁটিসঙ্গে সহজাত নয়
না জলের না সে জমিনের
আতশ কিংবা বায়ু নয়
বুল্লে তার আপন চেনে না
আরব বা লাহুরদেশি নয়
হিন্দুস্তানের নাগুর শহরে থাকে না
হিন্দু কিংবা পেশওয়ারি তুর্কি নয়
না করেছে পয়দা ভাগ মাযহাবের
আদম-হাওয়াকে পয়দা করেনি
নিজ নামখান নিজে রাখেনি
আওয়াল আখেরতক সত্তাকে জানে
দ্বৈততা কবুল করে না
তার চেয়ে জ্ঞানী কেউ নয়
বুল্লে শাহ নাম তবে কে পুকারে
বুল্লে তার আপন চেনে না
মূসা বা ফেরাউন নয়
আতশ কিংবা বায়ু নয়
মাসুমদের শহরে থাকে না
বুল্লে শাহ নামে তবে খাড়া থাকে কে?
বুল্লে তার আপন চেনে না।

  • উৎস : বুল্লে কি জানা ম্যায় কৌন : বুল্লে শাহ কালাম; ইংরেজি উৎস : What is Islam: The Importance of Being Islamic By Shahab Ahmed এবং Bulleh Shah’s Song: Harun Said Blog; বাংলা তরজমা : লেখককৃত

মাওলানা রুমির নিকটবর্তী পদবন্ধে বুল্লে যে-হাহাকার তৈরি করান নাম-সর্বনামের আশ্রয়ে ব্যক্ত ভাষান্তরে সে-অপূর্বতার রস বহানো কঠিন! সেই রস উপভোগে রাব্বি শেরগিলের পপুলার পাঞ্জাবি ভার্সন তো আছেই, সেইসঙ্গে পাকিস্তানী গায়ক সাইন জোহরের অপূর্ব দরদি কণ্ঠে গীতখানা শ্রবণের অনুরোধ থাকল। বাংলাভাষী কোনও কবির হাতে অনূদিত হলে হয়তো মূল ভাবের সঙ্গে আরও নিবিড় হওয়া সম্ভব হতো। সেই অক্ষমতার দায়ভার স্বীকার গিয়ে পদবন্ধটি পরিবেশনের কারণ এই কথাটি ক্লিয়ার করা, — কবীর-বুল্লে বা লালনের কাছে ভিখ মেগে যাঁরা নিরঞ্জন আল্লাহ ও তাঁর প্রবর্তিত ধর্মীয় কূটকাচালের সুরাহা খোঁজেন তাঁরা প্রকারান্তরে এই মানুষগুলাকে সেই গহ্বরে নিক্ষেপ করেন যেখান থেকে বের হওয়ার ধান্ধায় দলছুট এইসব ব্রাত্য পদকার নিজের আয়ুক্ষয় করেছিলেন। বুল্লে-র কালামে সে-ইশারা পাঠক আশা করি ধরতে পারবেন। এবং, যাঁরা মোল্লা-পুরুত নির্ধারিত আল্লাহ ও ধর্মীয় আচার-বিচারের বিরুদ্ধে জিহাদে নামার হাতিয়ার রূপে তাঁদের ব্যবহার যান, তাঁরা কার্যত মানুষগুলোর প্রতিবাদী হওয়ার ধরনকে হাস্যকর মনোপলির মাঝে গোর দিতে থাকেন।

কবীর-বুল্লে-লালনের সুরজালে ব্যক্ত প্রত্যাখ্যানকে সামাজিক শ্রেণিকরণের বিষম ফল রূপে নিঃসন্দেহে পাঠ করা যায়, কিন্তু শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে তাঁদের ব্যবহার মৌল যেসব কারণের ফেরে নিজেকে তাঁরা সমগ্র মানবজাহান থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা রূপে দেখেন, এহেন ব্যবহার তার বিলোপ সাধনে ভূমিকা রাখে। সামাজিক আচার-বিচারের সমালোচনা ও মানবতার জয়গান তাঁরা করেছেন, সহজ চিত্তে আল্লাহ-ভগবান-অবতারদের ভক্তি জানানোর ডাক দিয়ে গেছেন ইত্যাদি প্রচলিত ধারণা মিথ্যা নয়। সমাজচৈতন্যের উদয় ঘটানোর জন্য তাঁদের পদ ও জীবনসাধনা উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা রয়েছ; তথাপি মনে রাখা দরকার, মানবসমাজে তাঁরা বিলং করতে চাননি এবং গুহ্য সাধনরীতির আশ্রয়ে আল্লাহ ও তাঁর বান্দাবিরচিত সকল কাঠামো থেকে নিজেকে বিযুক্ত করতে একদিন ‘গভীর নির্জনের’ পথিক হয়েছিলেন!

সত্য কথা হলো কবীর-বুল্লে-লালনের মতো পদকার বিদ্যমান জগৎ-সংসারে সেইসব খাপছাড়া লোক যাঁদের জন্য কেউ একরত্তি জায়গা রাখেনি; কোনও আচার-বিচার-পরিষদে তাঁদের স্থান হয়নি; অগত্যা নিজের দেহ ছাড়া দ্বিতীয় উপায় ছিল না যার সুলুক তাঁরা করতে পারেন। দেহটাই একমাত্র যা হয়তো তাঁদের নিজের তাঁবে ছিল। সুতরাং তাঁরা নিজের দেহ নিয়ে ক্রমশ একলা, নিঃসঙ্গ ও সমাজবিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন সেই সময়। আল্লাহ বা তাঁর প্রেরিত অবতারের সঙ্গে মানুষের মিল-বেমিল সন্ধান ও গুণবিচার তো উসিলা মাত্র, নিজের দেহের ভিতরে প্রবেশের মাধ্যমে তাঁরা আসলে প্রত্যাখ্যান করতে মরিয়া ছিলেন দেহকে বিবিধ উপায়ে নিয়ন্ত্রণ-নির্ধারণের যেসব খেলা সংসারে জারি থাকে তার সবকিছু। যে-কারণে বুল্লে সৃষ্টির মধ্যে এমন কোনও চিহ্ন বা পরিচয় খুঁজে পাননি যাকে আশ্রয় করে তিনি খাড়া থাকতে পারেন এবং নিজেকে সফাসিধা বুল্লে বলে চিনতে পারেন। তাঁকে গ্রোগ্রাম করে ধরায় যিনি পাঠালেন তিনি যেমন কার্যত সেখানে তাঁর প্রতিপক্ষে পরিণত হন, ধরায় আসার পর বিচিত্র পন্থায় যারা তাঁর সহজাত জীবনকে নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে তারাও প্রতিপক্ষ গণ্য হতে থাকে! এ-যেন রুশোর অমর প্রবচন : ‘Man is born free, but he is everywhere in chains.’

আওয়াল থেকে আখের অবধি নিজেকে অন্যের দ্বারা প্রোগ্রামড্ বা পরাধীন অনুভব করা মানবমনে অপার যে-বেদনা জাগ্রত করে তার শিকল ছিন্ন করতে কবীর-বুল্লে-লালন চর্চিত ধারা নিজের দেহকে শেষতক ধ্বংসবিষাণ করে এবং এর অবক্ষয়ের মাধ্যমে বন্দিদশা থেকে চিরমুক্তির দিশা পেতে ব্যাকুল হয়। তাঁদের পদবন্ধ মেঘে ঢাকা বিদ্যুৎ রূপে সেই আদমসুরতের তালাশ করে যে একদিন নির্জ্ঞান মন নিয়ে আল্লাহর ‘বারামখানা’-য় বিচরণ করত এবং জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণের দোষে ‘সহজ নির্ভার’ চিত্তে সেখানে বিচরণের স্বাধীনতা হারিয়েছিল। আল্লাহর কাছে তাই ‘সহজ মানুষ’-এ ফেরত যাওয়ার আকুতি জানিয়ে লালন ভবযন্ত্রণার ইতি টানেন গানে :—

এ দেশেতে এই সুখ হলো / আবার কোথা যাই না জানি। / পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা / জনম গেল ছেঁচতে পানি।। / কার বা আমি, কেবা আমার / প্রাপ্ত বস্তু ঠিক নাই তার, / বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার / উদয় হয় না দিনমণি।। / আর কি রে এই পাপীর ভাগ্যে / দয়াল চান্দের দয়া হবে / কতদিন এই হালে যাবে / বহি এ পাপের তরণী।। / কার দোষ দিব এ ভুবনে / হীন হয়েছি ভজন-গুণে / লালন বলে, কতদিনে / পাব সাঁইর চরণ দুখানি।। — উৎস : আত্মতত্ত্ব : লালন গীতিকা : উইকি সংকলন

লালনের পদে ব্যক্ত এই আকুলতা তাই বিশেষভাবে খেয়াল করা প্রয়োজন। মনে রাখা উচিত স্রষ্টা-উপাসনার ছলে তাঁরা আসলে সমাজের মধ্যে আরেকটা সমাজ বা পৃথক ক্লান রূপে নিজেকে স্বতন্ত্র ও একলা করতে চেয়েছিলেন। ক্লান ভিত্তিক একলা থাকার ধারায় অতি-উৎসাহী মোল্লা-পুরুত থেকে শিক্ষিত নাগরিক সমাজের বাড়াবাড়ি অনুপ্রবেশ তাঁদের জন্য আপদ ছাড়া কিছু ছিল না। এই মানুষগুলো ও তাঁদের টেক্সটকে সেই নিরিখে পাঠ যাওয়া উচিত। প্রচলিত যে-সমাজের সঙ্গে তাঁদের মেরুদূরত্ব সেখানে তাঁদের যৌক্তিক করে তোলা অথবা পুনর্বাসনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকাই উত্তম। রবীন্দ্রনাথ ঘটনাটি ধরতে পেরেছিলেন বিধায় বয়স যত বেড়েছে বাউল সাধকদের সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্বে স্থিত থাকা তাঁর কাছে সংগত মনে হয়েছিল। তাঁদের সাধনা, বিশ্বাস ও জীবনাচারকে তিনি অবহেলা বা অসম্মান করেননি আবার এ-নিয়ে ভক্তির আবেশে বল্গাহারা হননি। রবি তাঁর নিজস্ব প্রয়োজন ও স্বকীয়তা বজায় রেখে তাঁদের টেক্সট ব্যবহার করেছেন কিন্তু তাঁদের একলা থাকার ধরনের ওপর নিজের ভাবনা ও মতামতের বোঝা চাপানোর চেষ্টা করেননি। এই বিবেচনাবোধ নগরজীবী লেখক-গবেষক-শিল্পী থেকে শুরু করে শ্রোতা-ভক্ত সকলের মাথায় রাখা উচিত। এখনও বঙ্গ তথা উপমহাদেশে কবীর-বুল্লে-লালন প্রবাহিত ধারায় শামিল ক্লানের অস্তিত্ব যেটুকু আছে তাকে তার মতো থাকতে দেওয়া সংগত মনে হয়; অ্যাট লিস্ট যতদিন তাঁরা সেভাবে থাকতে ও টিকতে পারবে বলে মনে হয় ততদিন।

এহেন কার্যকারণ দোষে কবীর-বুল্লে-লালনরা নূরতত্ত্বের মূল সার বা এসেন্স থেকে পৃথক সাকিনে নিগমনকারী ঘটনা। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধ যে-অবস্থান থেকে কোরান ও ইসলামের ভেদবিচারে অগ্রসর হতে চায় তার সাপেক্ষে তাঁরা গৌণ বটে! তদুপরি স্মরণ রাখা প্রয়োজন, শরিয়াশাসিত মূলধারার ইসলামের বিচারে শুধু নয়, মরমি-সুফি প্রভাবিত ইসলামেও লালন তথা সমগ্র উপমহাদেশে বাউল-সুফি-মরমিধারায় চর্চিত দেহকেন্দ্রিক সহজিয়া আত্মতত্ত্ব শেষতক ভ্রান্ত নূরবিচারে সমর্পিত এবং শিরকের পরিপোষক। আত্মিক মুক্তির সড়কে গমনাগমন সূত্রে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক তালাশে তাঁরা যে-সমীকরণে উপনীত হয়েছিলেন তার সঙ্গে ইসলামে চর্চিত নূরতত্ত্বের বিশ্বজনীন সম্পৃক্তি কতটা সে-প্রশ্ন ও সন্দেহ তাই ওঠে।

আত্মিক-উর্ধ্বারোহনের চূড়ায় উপনীত হওয়ার পর নবি মোহাম্মদ ও সমগ্র মানবজাহানের রুহানিয়াতকে মৌল প্রকৃতির অধিকারী আল্লাহর সঙ্গে অভিন্ন গণ্যকারী এই টেক্সট যেভাবে আহাদ-আহমদের মামলার নিস্পত্তি করে তার সঙ্গে কোরান তথা ইসলামি টেক্সটে জাহির কিংবা বাতেনি অবয়বে ব্যক্ত নূরতত্ত্বের নৈকট্য কি নিবিড়? কবীর-বুল্লে-লালন-জালাল উদ্দিন থেকে সমগ্র সুফি-মরমি-বাউল পরম্পরায় কতিপয় মৌলিক স্ববিরোধ তাঁদেরকে কোরান নির্ধারিত স্রষ্টার সিফাত ও মৌল স্বরূপের নিরিখে সাংঘর্ষিক এবং শিরকের সঙ্গে অভিন্ন করে, যেমন :—

স্রষ্টার নিরাকার স্বরূপ সম্পর্কে তাঁদের ভাবনা বহুলভাবে বৈদিক ও বৌদ্ধ মতবাদের প্রতিধ্বনি এবং কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোরানে আল্লাহ তাঁর সিফাত বা মৌল গুণাবলীর মধ্য দিয়ে স্বরূপে প্রকাশিত। আসমাউল হুসনা বা আল্লাহর নামবাচক বিশেষণগুলো তাঁকে বৈদিক মতবাদে ব্যক্ত নির্গুণ নিরঞ্জন ব্রহ্ম থেকে পৃথক করে। লালন ও জালালউদ্দিন বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন কিন্তু তাঁর সৃষ্টির মাঝে সাকার রূপ ধরে তিনি নিরাকার ইত্যাদি ভাববিচারে গমনের ফলে ঘটনা সেখানে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। কোরানের আল্লাহ নিজের সৃষ্টিকে সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রয়োজনে সেখানে ভূমিকা পালন করেন কিন্তু তিনি এবং তাঁর সৃষ্টি উইলিয়াম ব্ল্যাকের উরিজেনের মতোই পৃথক। একজন প্রোগ্রামার যেরকম নিজের বানানো সফটওয়্যার তদারকি করেন, এ্যাকটিভ গড রূপে সৃষ্টির সঙ্গে কোরানের আল্লাহর সম্পর্কও সেরকম। সৃষ্টি মাঝারে নিজের গুণাবলী তিনি সঞ্চারিত করেন যেন মানুষ বুঝতে পারে তার মধ্যে প্রকাশিত গুণ স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। অর্থাৎ মানুষ যদি একটি সফটওয়্যার হয় তাহলে সেই সফটওয়্যারের একজন প্রোগ্রামার রয়েছেন, যিনি তাঁর গুণাবলী সেখানে সংযোজন করেছেন। কোরানের ভাষায় এটা হচ্ছে ‘করজে হাসানা’ এবং এ বিষয়টি সম্পর্কে আমরা যথাস্থানে আলাপ করব। অন্যদিকে মানুষের মধ্যে যেসব খারাপ গুণাবলী দৃষ্ট হয় সেগুলো আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। সেগুলো হয়তো তাঁর নির্দেশ অমান্যকারী ইবলিশের কারসাজি। এই দ্বন্দ্ব প্রমাণ করে কোরান তথা সেমিটিক ঐতিহ্য থেকে জাত ধর্মে চিত্রিত স্রষ্টা অদৃশ্য উপায়ে বিরাজিত হলেও ঠিক নিরাকার নন। যে-কারণে তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক না করার উক্তি কোরানে বারবার ব্যক্ত হতে থাকে। বাউল-মরমি ধারার ভাবসাধনায় নবিভজনার তরিকায় এই মৌল বিধানের লঙ্ঘন ব্যাপক হওয়ার কারণে তা সরাসরি কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কট্টর ইসলামপন্থীরা কেন বাউলদের নাম শুনলে খেপে ওঠেন তার তল পেতে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।

বিশুদ্ধ নিরাকার হলে কোনও গঠন বা কাঠামো সম্ভব নয়। যে-কারণে বাইবেল থেকে কোরান সর্বত্র এক কথা ধ্বনিত হয়, — যখন কোনও কিছু ছিল না তখনও একজন ছিলেন! বাইবেলের ভাষায় তিনি ‘বাক্য বা উক্তি’ এবং কোরানে ‘কুন বা হও’ এই আদেশ দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারী। এই ক্ষমতার জোরে জগৎ সৃষ্টি হতে পেরেছিল। সোজা কথায় ভীষণরকম সক্রিয় এক সত্তা, যাঁর স্বরূপ মানবের বোধগম্য নয় কিন্তু সে তাঁরই সৃজন বটে। অগত্যা তিনি ইচ্ছে করলে কোনও মানবকে দর্শন দিতে পারেন আবার নাও পারেন। দেখা যদি দেন তবে কোন রূপে দেবেন সে একমাত্র তিনি ভালো জানেন। তাসাউফের বিচারে তিনি নূরের উপমান, ইসলামের অন্যান্য ঘরানার বিচারে তাঁর স্বরূপ সম্পর্কে একমাত্র তিনি নিজে সম্যক অবহিত, বড়োজোর ধারণা করা যেতে পারে কোনও এক ভাবে সৃষ্ট গঠন থেকে পৃথক গঠনে তিনি সক্রিয় ও বিদ্যমান। বাউল-মরমি গানের ভাবতরিকায় বিষয়টি কোরানসম্মত ধারায় চিত্রিত হয়নি। জালাল উদ্দিন অক্লেশে বলছেন, ‘মানব-সুরতের মাঝে, তুমিই আছ তোমার কাজে, / আদম বানাইলে কি বনলে তুমি, লীলা বোঝা হল ভার।।’ এটা পৃথক থিওসফি, যেখানে খোদা ও আদম থেকে শুরু করে বেদ-কোরান-পুরাণ সব মিলেমিশে একাকার এবং সে-কারণে ইসলামি সৃষ্টিতত্বের বরখেলাপ!

কোরান ও হাদিসে আল্লাহর অঙ্গ রয়েছে সেই পরিচয় ফুটে ওঠে। যদিও এ-নিয়ে ইসলামবেত্তাদের মাঝে তর্ক রয়েছে। এগুলো উপমার্থে কোরানে প্রযুক্ত বলে মনে করা হয়। কারণ আল্লাহ নিজে যেখানে তাঁর স্বরূপ সম্পর্কে পরিষ্কার চিত্র প্রদান করেননি সেখানে মানব অঙ্গের সদৃশ কল্পনায় তাঁকে ভাবা শিরকের শামিল। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত পন্থীদের মত অবশ্য এখানে খুবই পৃথক। তাঁরা এগুলোকে নিছক উপমা ভাবতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহর স্বরূপকে মানব বা অন্য সৃষ্টির গঠন দিয়ে বিচার করা শিরকের সমতুল্য তাতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই, কিন্তু  যেসব উপমা কোরানে ব্যক্ত হয়েছে তাতে বোঝা যায় তিনি তাঁর সৃষ্টির অনুরূপ না হলেও অন্য ভাবে স্বরূপ ধরেই বিরাজ করেন ও জগতের মাঝে নিজেকে সক্রিয় রাখেন। তবে আল্লাহর স্বরূপ যেহেতু মানুষের বোধের অগম্য এ-নিয়ে কাল্পনিক প্রতিমা নির্মাণের বাসনা মনে স্থান না দেওয়াই উত্তম। সুতরাং বাউল ও মরমিপন্থীরা যখন খোদাকে নিরাকার থেকে মানবরূপে সাকার এবং সাকার থেকে পুনরায় নিরাকারে ফেরত পাঠান সেটা কোরানে ব্যক্ত তাওহিদের সঙ্গে ঝামেলা পাকায়। ইন্টারনেট মাঝেমধ্যে খাটনি লাঘব করে। হাদিথবিডিডটকম যেমন ইমাম বুখারী লিপিবদ্ধ একটি হাদিস (দ্রষ্টব্য : ৪৮১১) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোরানের সূরায় ব্যক্ত আল্লাহর স্বরূপ সংক্রান্ত আয়াত সমূহের নমুনা পেশ করেছেন। আগ্রহী পাঠক সূরা ‘মায়িদাহ’ (৫:৬৪), ‘আর-রহমান’ (৫৫:২৭), ‘বাকারাহ’ (২:১১৫, ২৭২), ‘রূম’ (৩০:৩৮) ‘দাহর’ (৭৬:৯), ‘লাইল’ (৯২:২০), ‘ক্বলম’ (৬৮:১৬৪) ইত্যাদি আয়াতগুলো কোরান খুলে পাঠ করতে পারেন।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত পন্থীদের ভাবনা একদিক থেকে যৌক্তিক এ-কারণে যে হাদিথবিডিডটকম উল্লেখিত সূরা সমূহে আল্লাহ দেখতে কেমন সেটা ক্লিয়ার না করলেও তাঁর স্বরূপ বিষয়ে ইশারা দিয়ে যায়। সেমিটিক ধর্মের স্রষ্টা নিজের সৃষ্টি থেকে পৃথক রূপে সক্রিয় তার গণ্য প্রমাণ হচ্ছে সৃষ্টির সূচনা ও পরিণতির পরিষ্কার চিত্র নবিগণ মারফত তিনি মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন। অন্যথায় কিয়ামত, রোজ হাশরের ময়দানে শেষ বিচার, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি কাঠামোর বিবরণ দানের প্রয়োজন ছিল না। সৃষ্টির একটি যুক্তি ও উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সে-কারণে যিনি এটা প্রোগ্রাম করছেন তিনি এটা কখন এক্সপায়ারড্ হবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিয়ে দিচ্ছেন। কোরান ও ইসলামি থিওলজির সৃষ্টি বাখানে বনি আদম স্রষ্টার বিবিধ সিফাত স্বরূপ বৈশিষ্ট্য কলবে ধারণ করে ধরায় আগমন করে এবং পারিপার্শ্বিক প্রভাবে অদমের মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো কাজ করছে কি না স্রষ্টা সেটা নিরীক্ষণ করেন। একজন ডেভোলাপার যেমন যেসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে অ্যাপস তৈরি করেছে সেখানে ত্রুটি রয়েছে কি না নিশ্চিত হতে ট্রায়াল বা বেটা ভার্শন বাজারে ছাড়ে, বনি আদমও সেরূপ আল্লাহর কাছে অ্যাপস সমতুল্য। সুতরাং তাঁর তাওহিদ স্বরূপ একচ্ছত্র মালিকানাকে অন্য কিছু এমনকি প্রিয় নবির সঙ্গেও শরিক করার সুযোগ নেই, যা উপমহাদেশের বাউল-মরমি ধারায় সুলভ। স্মরণ রাখতে হয় তিনি মূসাকে দর্শন দিয়েছিলেন, মোহাম্মদ মিরাজ গমনের পর তাঁর দেখা পান, কিন্তু লালন যেভাবে সেই দেখার ছবি গানে এঁকেছেন বাস্তবে আল্লাহকে সেরকম ভাবা কোরানের বিচারে শিরক ও কুফরির শামিল।

বাউলদের ওপর মোল্লাদের গোসসার ধরন অপমানজনক হলেও কেন তাঁরা এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কিংবা বেদআত বলে বাউল উচ্ছেদের ফতোয়া জারি করেন এই বিষয়গুলো তাঁদের জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে, যা তথাকথিত শহরবাসী বাউলদরদি শিক্ষিত সমাজের হৈ-হল্লার কারণে সেভাবে তলিয়ে দেখা হয় না। মনে রাখা উচিত বাউল-মরিম ধারায় ভাবসাধনার প্রকৃতি প্রচণ্ড মানবিক ও ইহজাগতিক হওয়ার কারণে তা পৃথক এক থিওসফির জন্ম দিয়েছিল এবং তাকে সেই জায়গা থেকে সকলের নিকট স্বচ্ছ করা না গেলে ইসলাম প্রণীত তাওহিদ বিশ্বাসীর সঙ্গে বিবাদ ও লড়াই থামবার নয়। উপমহাদেশে চর্চিত সুফি-মরমি-বাউল প্রভাবিত নূরবিচারের ঐতিহ্য আরব ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে চর্চিত ঐতিহ্যের বিপরীতমুখী স্রোত সেটা স্বীকার করে মনে হয় কবীর-বুল্লে-লালনদের পাঠ যাওয়া প্রয়োজন। যে-কারণে তাঁদের নূর ভেদবিচারের ওপর ভিত্তি করে কোরানে ব্যক্ত আল্লাহ, নবি ও বান্দার পারস্পরিক সম্পর্কের ফয়সালা ‘ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক’ গণ্য হতে বাধ্য। তাঁদের ভাবের রসবিধুর স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্বকে বরং ধর্মের সঙ্গে না জুড়ে সাহিত্য রূপে পাঠ যাওয়া উত্তম। কেন উত্তম সেটা উপলব্ধির খাতিরে সোহরাওয়ার্দী বিরচিত নূরতত্ত্বে একপাক ঘুরে আসা মনে হয় কাজ দিতেও পারে। বক্ষ্যমাণ প্রবাহের প্রলম্বন পরবর্তী প্রবাহটি সেদিক পানেই গমনে ইচ্ছুক।


ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you