চতুর্থ প্রবাহ : মুমিন ও কাফিরুন : ইমানের শ্রেণিকরণ এবং রফা ও বিচ্ছেদ
মিশর-ইরাক-সিরিয়া-ইসরায়েল অবধি বিস্তৃত ভূখণ্ড থেকে ঐশী আদেশ বা ওহির মক্কায় আগমন জ্ঞান-গরিমা ও সভ্যতার দ্যুতিতে অতুল অঞ্চলগুলোর তুলনায় দীনহীন অঞ্চলে গমনও বটে! নবিত্বের গরিমা ও ঐতিহ্যের যেসব বিবরণ ইতিহাস সূত্রে পাওয়া যায় মোহাম্মদকে সেখানে কাউন্টার টেক্সট বিবেচনা করতে হয়। ওহি-বাহক জিবরাইল এই প্রথম নিজের রুট পরিবর্তন করে মক্কার হেরা গুহায় নেমে এসেছিলেন। বড়ো ঘরের কন্যা সারা আর নবি ইব্রাহিমের পুত্র ইসহাকের ধারায় আগত নবিদের কাছে যুগে-যুগে তিনি প্রেরিত হয়েছেন, এখন চিরাচরিত নিয়ম ভঙ্গ করে ইব্রাহিমের দ্বিতীয় স্ত্রী দাসী হাজেরার সন্তান ইসমাইলের ধারায় তিনি দেখা দিলেন, যে-ধারায় মোহাম্মদের পূর্বে কোনও নবির আবির্ভাব ঘটার রেওয়াজ নেই। এই সমস্ত কারণে কোরান হচ্ছে কাউন্টার টেক্সট; নবিদের কাছে ওহি নাজিল হওয়ার ইতিহাস স্বীকৃত ধারাগুলাকে দালিলিক রেফ্রেন্স হিসেবে সে যেমন অকুণ্ঠে স্বীকার যায়, অন্যদিকে দলিলকে বিকৃত বা শিরক ও পৌত্তলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত অভিযোগে বাতিলও করে।
সেমিটিক ধারায় ইতোপূর্বে অবতীর্ণ ঐশী গ্রন্থকে বিকৃত ও বাতিল গণ্যকারী কোরান প্রকারান্তরে ‘ইমান’ নামক টেক্সটকে নতুন হায়ারর্কি বা শ্রেণিকরণের মাঝে নির্দিষ্ট করেছিল। প্রথম শ্রেণিকরণ, কোরান বর্ণিত স্রষ্টায় যে-লোক ইমান রাখে ও সৎপথে জীবন নির্বাহ করে তার জন্য আখেরাতে পুরস্কার রয়েছে। দ্বিতীয় শ্রেণিকরণ, কোরান নির্ধারিত স্রষ্টায় এখনও ইমান আনেনি কিন্তু স্রষ্টা প্রেরিত ঐশী আদেশ যাবুর, তাওরাত ও ইঞ্জিল বিকৃত হওয়ার আগে যে-রূপে ছিল বলে অনুমেয় তার সঙ্গে মিল রেখে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস যায় ও সৎপথে জীবন কাটায় তার ভয়ের কারণ নেই, তাকে যথাসময়ে পুরস্কৃত করা হবে। তৃতীয়, সাবেঈন অর্থাৎ প্যাগান সম্প্রদায়ের লোক হলেও প্রতিমা উপাসনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেনি এবং স্রষ্টার একত্বে ইমান রাখে এমন লোকের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এবং চতুর্থ শ্রেণিকরণ, স্রষ্টার একত্বের বার্তা বিস্মৃত হয়ে প্রতিমা উপাসনা ও সকল প্রকার কুফরি আচার-ব্যবহারে নিমজ্জিত হওয়ার ফলে ফিতরাতে অটল নেই এমন ব্যক্তি হচ্ছে কাফির এবং জাহান্নাম ব্যতীত দ্বিতীয় কোনও জগতে তার গমনের সুযোগ নেই :—
‘নিশ্চয়ই যাহারা ইমান আনিয়াছে, যাহারা ইয়াহুদি হইয়াছে এবং খ্রিস্টান ও সাবিঈন — যাহারাই আল্লাহ ও আখিরাতে ইমান আনে ও সৎকাজ করে, তাহাদের জন্য পুরস্কার আছে তাহাদের প্রতিপালকের নিকট। তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না।’ — উৎস : বাকারাহ ২:৬২; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
শ্রেণিকরণে দ্বিতীয়টি নিয়ে মনে প্রশ্ন দানা বাঁধে, — ‘বিকৃত, প্রক্ষিপ্ত ও সংশোধিত’ ইত্যাদি অভিযোগে যাবুর, তাওরাত ও ইঞ্জিলকে কোরান যেখানে বাতিল ঘোষণা করছে সেখানে অদ্যাবধি ওইসব টেক্সটে বিরাজিত কিছু লোককে কী কারণে ইমানদার এবং বাকিদের বেইমান বা মুশরিকে ভাগ করা হয়? সূরা ‘আল-এমরান’ যেমন কিছু সংখ্যক খ্রিস্টান, ইহুদি ও সাবেঈনদের খবর করে যাঁরা আল্লাহর বিবেচনায় বিধর্মী হলেও নেক আমলের অধিকারী এবং রাত যত গভীর হয় তাঁরা এক ধ্যানে খোদার জিকিরে মত্ত হয়! নেক আমলের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণের পরিবর্তে ‘বাতিল’ বিশ্বাসে স্থিত অনুসারীদের প্রতি কোরানের সদয় মনোভাবের কারণ কি এই যে তাদের প্রশংসা করার ছলে কোরান প্রকারান্তরে নবি মোহাম্মদকে ‘দীন’ প্রতিষ্ঠার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো আপসে মিটমাট করার সুযোগ খুঁজতে বলে? ওইসব ‘ইমানদার’ লোকের কাছে নবি হয়তো বার্তাটি পাঠাতে চান, — এখনও রফা করার সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি এবং যদি সেটা ঘটে তবে আল্লাহ প্রেরিত ওহির নতুন সংশোধনী আসতেও পারে।
কোরান যে প্রচণ্ড পরিমাণে ঘটনা ও পরিস্থিতি নির্ভর ডিপ্লোম্যাটিক টেক্সট সেটা এইসব নমনীয় আচরণে অবারিত হতে থাকে! মদিনা পরবর্তী সময়ে ও মক্কা বিজয়ের পর নমনীয় এই মনোভাব আর বজায় থাকেনি এবং ইসলাম ব্যতীত অবশিষ্ট দীনকে কোরান বাতিল ঘোষণা করে। মক্কাপর্বে রূপক ও সাংকেতিকতায় ভরপুর কোরানের কাব্যিক ভাষাকাঠামোয় মদিনাপর্বের অনুশাসনমূলক বিবৃতির অনুপ্রবেশ আসমানি কিতাবকে শক্তি ও ক্ষমতার দ্যোতকে পরিণত করেছিল। ইসলাম সম্প্রসারণের সমগ্র যুগে উদারপন্থী বিদ্বান, সুফি ও মরমিয়াদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কোরানকে আর কখনও সহজ-সরল সেই বিঘোষণায় ফেরত নেওয়া সম্ভব হয়নি যা সূরা ‘কাফিরুন’ একদা সুস্পষ্ট করেছিল :—
‘বলো, ‘হে কাফিররা!
আমি তাহার ইবাদত করি না যাহার ইবাদত তোমরা করো।
এবং তোমরাও তাঁহার ইবাদতকারী নও যাঁহার ইবাদত আমি করি,
এবং আমি ইবাদতকারী নই তাহার যাহার ইবাদত তোমরা করিয়া আসিতেছ।
এবং তোমরাও তাঁহার ইবাদতকারী নও যাঁহার ইবাদত আমি করি।
‘তোমাদের দীন তোমাদের, আমার দীন আমার।’ — উৎস : কাফিরুন; ১০৯:১–৬; আল কোরান : তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
‘কাফিরুন’ মক্কা নাকি মদিনাপর্বে নাজিল হয় সে-নিয়ে যৎসামান্য মতভেদ থাকলেও ভাষিক গঠনকাঠামো ও ঘটনাবলী বিবেচনায় প্রায় সকলে এই সূরাকে মক্কা পর্বে অবতীর্ণ বলে মতামত রেখেছেন। ইসলামের উন্মেষ যুগে মসজিদুল হারামের সম্মুখে জড়ো হওয়া মক্কার গোত্রপিতাদের সঙ্গে বাতচিতের ক্ষণে মোহাম্মদ ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন।’-এর সরল বিঘোষণায় নিজের অবস্থান সেদিন পরিষ্কার করেছিলেন, যা পরে বিদায় হজের ভাষণে পুনরায় ব্যক্ত হয়েছিল। ‘কাফিরুন’-এ মোহাম্মদের মুখ-নিঃসৃত সহিষ্ণু সুর পরোক্ষভাবে আল্লাহ-সৃষ্ট জ্ঞানছকের ইবলিশকৃত সংস্করণকে প্রতিহত করার দ্বন্দ্বকে প্রকাশ্য করে! নবিকে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না কারণ বরাবরের মতো নিজেকে তিনি রিসিভার হিসেবে সেখানে দাখিল করেন। তাঁর কাজ হচ্ছে দিব্যাদেশকে জিবরাইল মারফত লবজ করা এবং প্রতি পদে সেগুলা নিয়ে যত প্রশ্ন, আপত্তি বা মতান্তর সে-সম্পর্কে বলার এখতিয়ার তিনি রাখেন যদি আল্লাহ অনুমোদন করেন। প্রশ্নের উত্তর দিতে মোহাম্মদ বাধ্য নন যতক্ষণ জিবরাইল মারফত আল্লাহ তাঁকে হুকুম করেন উত্তর দিতে। সংশয়ী যুগের বিচারে এটা হয়তো ট্রিকস যার ওপর ভর করে মোহাম্মদ সকল বিষয়ে জ্ঞাত এবং সমভাবে অজ্ঞাত রূপে নিজের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছিলেন। দোলাচলের ঝড় উঠলে তিনি আলেমুল গায়েবের ওপর সেই ভার চাপান, ‘এ সমস্ত ব্যাপারে আল্লাহ ভালো জানেন!’ আল্লাহর সর্বজ্ঞতার নিরিখে স্বয়ং নবি মোহাম্মদের ‘অজ্ঞতা’ কেন দোষণীয় হতে পারে না ‘আল-ইমরান’র ৭ নাম্বার আয়াত সেটা হয়তো ক্লিয়ার করে :—
‘তিনিই তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছেন যাহার কিছু আয়াত ‘মুহকাম’, এইগুলি কিতাবের মূল; আর অন্যগুলি ‘মুতাশাবিহ্’, যাহাদের অন্তরে সত্য-লংঘন প্রবণতা রহিয়াছে শুধু তাহারাই ফিতনা এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে মুতাশাবিহাতের অনুসরণ করে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেহ ইহার ব্যাখ্যা জানে না। আর যাহারা জ্ঞানে সুগভীর তাহারা বলে, ‘আমরা ইহা বিশ্বাস করি, সমস্তই আমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে আগত’; এবং বোধশক্তিসম্পনরা ব্যতীত অপর কেহ শিক্ষা গ্রহণ করে না।’ — উৎস : আল–ইমরান; ৩:৭; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
মুতাশাবিহাত অর্থাৎ ‘ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে’ এই অজুহাতে আল্লাহর ওপর নিজের নিরঙ্কুশ নির্ভরতা মোহাম্মদের সেই শক্তি যা প্রশ্ন বা সংশয়ের প্যাঁচ কেটে তাঁকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়। মদিনাপর্বে শক্তি অর্জনের পর তিনি নেতা হয়ে উঠেন এবং মক্কাপর্বে অবতীর্ণ ওহির সহজ সারল্য পরিহার করে ক্রমশ বিধি-বিধানে আকীর্ণ হতে থাকেন। বহুগামীতার বিকল্প একাধিক বিবাহের নিদান আসে কোরানে। শরাব পানের নেশা ও শিশুমৈথুনাবেশ ইহজগতে ফরবিডেন বলে ওহি নাজিল হওয়ার ক্ষতিপূরণ ঘটানো হয় পরজগতে শরাব পরিবেশনকারী গেলমান ও অনতিস্বচ্ছ কাচের মতো রূপসী হুর আমদানির মাধ্যমে। যুদ্ধ, সন্ধি, ক্রীতদাসের মুক্তি বা মালে গণিমতের ঘটনাগুলোও মোহাম্মদ কুশলতার সঙ্গে সামলান। একজন দূরদর্শী ও মেধাবী রাষ্ট্রনায়ক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যা করে থাকেন মোহাম্মদের জীবনে তার সকল নিদর্শন পাওয়া যায়। কোরান তাই পরজাগতিক Meta-Text-এর পাশাপাশি ইহজাগতিক পলিটিক্যাল টেক্সটও বটে! এই টেক্সট একজন তীক্ষ্ণবুদ্ধি মানবের ‘পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার’ অতুলনীয় ক্ষমতার পরিচায়ক, যা প্রমত্ত ও স্বেচ্ছাচারী আরব গোত্রগুলাকে সুশৃঙ্খল জীবনছকে চিরকালের জন্য সীমাবদ্ধ করে দিতে পেরেছিল।
ধরায় বিচরণকারী পূর্ববর্তী নবিদের সঙ্গে মোহাম্মদের পার্থক্যটা এখানেই। মূসার জীবন খরচা হয় মিশরে ফেরাউনদের ক্রীতদাসে পরিণত সেকালের ইহুদি সম্প্রদায়কে সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসার মিশনে। প্রতিশ্রুত ভূমি বা প্রমিজড ল্যান্ড যেটা আজকের ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড জুড়ে বিস্তৃত, সেখানে পৌঁছানোর ধকলে তাঁর জীবন নিভে আসে। সুতরাং ‘দশমাদেশ’ (Ten Commandments) ‘তোরাহ’র নৈতিক ভিত্তি হলেও মূসার সঙ্গে আল্লাহর কাজকারবারের বড়ো অংশ জুড়ে স্বাধীন জীবনের মন্ত্রে মিশর থেকে বেরিয়ে আসা ইহুদি সম্প্রদায়কে (আসহাব মূসা) মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার নাটকীয়তায় বাকি ঘটনা চাপা পড়ে যায়। দাউদের যাবুর মূলত সুরজালে বাঁধা সুবাসিত প্রার্থনা-সংগীত, যা একমাত্র আল্লাহর মুখাপেক্ষী হওয়া ছাড়া ধরণীতে নিজেকে রক্ষার উপায় দেখে না। ইসরায়েলবাসীর শাসক হলেও শত্রুভয়ে কাতর দাউদ ‘আকল’ খাটিয়ে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে অপেক্ষায় থাকে আল্লাহ কখন প্রতিপক্ষদের ওপর চরম আঘাত হানবেন :—
7Arise, Allah!
Save me, my God!
For you have struck all of my enemies on the cheek bone.
You have broken the teeth of the wicked. — Zabur 3:7
1Let God arise!
Let his enemies be scattered!
Let them who hate him also flee before him.
2As smoke is driven away,
So drive them away.
As wax melts before the fire,
So let the wicked perish at the presence of God. — Zabur 68:1-2;
Source: The Holy Zabur; English Translation Source: al-kitab.org;
ঈশ্বরের স্তবমুখর দেড় শতাধিক প্রার্থনা-গাথায় বিন্যাস্ত যাবুর তার সাংগীতিক মাধুর্যের গুণে সুখপাঠ্য ও শ্রবণসুখকর। হিব্রু থেকে ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষায় অনূদিত হওয়ার ক্ষণেও সেটা চাপা থাকে না। যাবুর-এ ঈশ্বরের সৃষ্টির গুণগান, ইসরায়েলে বসবাসরত সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত বিশ্বাস নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ এবং তাদের ধ্বংস কামনা অথবা সুপথে আসার আহবান ইত্যাদির সঙ্গে কোরান ও বাইবেলের বয়নকাঠামোর বিশেষ তফাত নেই :—
19Do not let those who are my enemies wrongfully rejoice over me;
Neither let them wink with the eye who hate me without a cause.
21Yes, they opened their mouth wide against me.
They said, ‘Aha! Aha! Our eye has seen it!’
22You have seen it, Allah. Do not keep silent.
Lord, do not be far from me.
23Wake up! Rise up to defend me, my God!
My Lord, contend for me! — Zabur 35:19, 21-23;
Source: The Holy Zabur; English Translation Source: al-kitab.org;
যাবুর-এ দাউদের নালিশ জানানো ও ফরিয়াদি হওয়ার ধরনের সঙ্গে কোরানে মোহাম্মদের নালিশ ও ফরিয়াদের মিল থাকলেও অ্যাক্টর রূপে তাঁর ভূমিকা সেখানে অনেকখানি প্যাসিভ। কিশোর বয়সে অমিত শক্তিধর জালুতকে (গোলিয়াথ) রণে পরাস্ত করা এবং পরবর্তীতে ইসরায়েল ও জুদাহর তৃতীয় সম্রাট রূপে আবির্ভাব ইত্যাদি ঘটনার ঘনঘটা সত্ত্বেও গীতবাদ্যে কুশল দাউদ কেন যেন সদা সন্ত্রস্ত প্যাসিভ অ্যাক্টর রূপে যাবুর-এ বিচরণ করে। কোরানে যেমন মোহাম্মদ প্রতি পদে আল্লাহর হয়ে তাঁর সম্প্রদায়কে নির্ধারণ ও তাদের করণীয় সম্পর্কে বিধিবিধান জারি করেন, সেখানে যাবুর-এ ইসরায়েলবাসীকে নিয়ে আক্ষেপের সুর চড়া হয়ে বাজে, ‘3They have all turned aside. / They have together become corrupt. / There is none who does good, no, not one.’ — Source: The Holy Zabur; English Translation Source: al-kitab.org.
ওদিকে ঐশী কিতাব বাহক মূসা ও দাউদের উত্তরসূরি ঈসা নির্জলা ইহুদি পরিচয়ে বাইবেল-এ ঘোরাফিরা করে। ইহুদি আচার-বিচারের ভুল সংশোধনের জন্য বিদ্রোহী রূপ ধারণ করলেও গায়েবি প্রক্রিয়ায় মরিয়মের গর্ভে তাঁর আবির্ভাব এবং রোমান শাসকের অধীনে বসবাসরত ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে নিজের বৈধতা প্রমাণের জটিলতায় তাঁকে শেষতক ক্রুশেই ঝুলতে হয়। ঈসা রোমান্টিক রিফরমিস্ট! তাঁর হাতে অস্ত্র বলতে বায়বীয় দিব্যেন্মাদনা আর মানবাত্মার প্রতি সুবাসিত করুণা। যে-মুজেযাগুলা সে দেখায়, দোলনায় দোল খাওয়ার সময় লোকের সঙ্গে বাতচিত করে, কুষ্ঠরোগীকে হাতের স্পর্শে সারিয়ে তোলে, খাবারে টান পড়েছে দেখে মন্ত্রবলে তা দ্বিগুণ বা অফুরন্ত হয় কিংবা ল্যাজারাসকে কবর থেকে উঠে আসতে বলে, তাঁর এই অলৌকিক কাজকারবার সাহাবাগণ কর্তৃক সৃষ্ট কিনা সে-নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন; যেভাবে বাইবেল স্বয়ং ঈসার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার বহু পরের ঘটনা এবং সেন্ট পল দ্বারা পুননির্মিত!
পূর্বসূরীদের তুলনায় মোহাম্মদ অনেক বেশি সাবধানী ও প্রখর কাণ্ডজ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। অতীত অভিজ্ঞতার নিরিখে আল্লাহ এই প্রথম তাঁর প্রতিনিধি রূপে এমন একজন নবিকে ধরায় পাঠান যাঁর জানা ছিল ইতিহাস থেকে কী করে শিক্ষা নিতে হয়। যাবুর পদে-পদে দেখায় ঘটনার ওপর দাউদের কর্তৃত্ব দূরে থাক, নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও নেই। প্রতিশ্রুত ভূমির সন্ধানে মূসার টানা চল্লিশ বছরের জার্নি ছিল ক্লান্তিকর! মিশর থেকে বহির্গত সম্প্রদায়কে ম্যানেজ করতে তাঁর ও হারুনের দম ফতুর হয় সেখানে। ঈসা তো শেখ মুজিবের উপমা! ষড়যন্ত্র টের পাওয়া সত্ত্বেও বুঝতে পারেন না সেটা কখন কোন দিক থেকে আসতে পারে! অগত্যা ষড়যন্ত্রের হোতাকে নিয়ে জীবনের শেষ নৈশভোজটি তাঁকে সারতে হয়।
কোরানের প্রতি ছত্রে মোহাম্মদ নিজেকে শত্রুদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার বার্তায় সজাগ রাখেন। ষড়যন্ত্র প্রবল হওয়ার আগে তার মুষ্কছেদনের বার্তা কোরানের পাতায় কমবেশি মিলে। মোহাম্মদ কেন বেপোরোয়া গোত্রশাসিত জীবনধারায় প্রভাবশালী এবং শেষতক অমোঘ হয়েছিলেন তার নেপথ্যে পরিস্থিতি বুঝে আচরণ ও ঘটনা সামাল দেওয়ার ক্ষুরধার মস্তিষ্ককে সম্মান দিতে হয়; আবু লাহাব থেকে আবু সুফিয়ান ও অন্য গোত্রপিতারা এহেন মস্তিষ্কের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতায় নিজের সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারেননি। বিষয়টি খোলাসা করার জন্য মোহাম্মদের অন্তঃপুরের জীবনধারার দিকে একবার তাকানো যেতে পারে।
জয়নাবকাণ্ড কোরান তথা মোহাম্মদের পক্ষ-বিপক্ষ লোকদের কাছে অন্যতম সিগনিফিকেন্ট ঘটনা রূপে স্বীকৃত। যে-দাস জায়েদকে মোহাম্মদ নিজে আজাদি দিলেন, রূপগুণ ও বংশগিরমায় অতুল জয়নাবের সঙ্গে তার বিবাহ দিলেন, এবং অসম সেই বিবাহ ভেঙে জয়নাব যখন বের হয়ে আসেন সেখানে মোহাম্মদের প্রতি নিজের দুর্বলতা তিনি গোপন রাখতে পারেননি। নবির প্রতি জয়নাবের এই সুবাসিত সম্মোহন টের পাওয়ার পর মোহাম্মদ নিজেও কম বিচলিত হননি। স্রষ্টা আল্লাহর জন্যও ঘটনাটি ব্যতিক্রম হয়ে আসে। নবিকে তিনি যে-ছকে গ্রোগ্রামিং করে ধরায় পাঠান সেখানে জয়নাবের আবির্ভাব ও নবির বিচলিত হওয়া স্বয়ং কোরানে বর্ণিত ঘটনাধারা বিবেচনায় পূর্ব-পরিকল্পনা মোতাবেক ছিল বলে একিন হয় না।
ঘটনাটি তামিল মশলা সিনেমা ‘এনথিরান বা রোবট’-এর কথা মনে উদয় হতে বাধ্য করে। ছবিতে রোবটিসিস্ট (roboticist) রজনীকান্ত তার চেহারার আদলে স্ব-নিয়ন্ত্রিত বা নিজ ‘আকল’-এ কাজকারবার সারতে পারে এমন রোবট তৈরি করে প্রেমিকা ঐশ্বরিয়াকে উপহার দেয়। অমিত শক্তিধর ও সপ্রতিভ রোবট চিট্টিকে পেয়ে ঐশ্বরিয়ার মনে খুশির অন্ত নেই! চিট্টি একাধারে তার সঙ্গী ও দেহরক্ষীতে পরিণত হয়। মারকাটারি কাজকারবারে ঐশ্বরিয়াকে সে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে এবং একসময় রূপগুণে প্রাণবন্ত রমণীর প্রতি তার মনে বিরাট প্রেমভাব জন্ম নেয়। ঐশ্বরিয়া চিট্টিকে বোঝানোর চেষ্টা করে রোবটের সঙ্গে প্রেম ও সংসার করা তার পক্ষে কী কারণে সম্ভব নয়। ঘটনাটি অবগত হওয়ার পর স্রষ্টা অর্থাৎ রজনীকান্তের সঙ্গে চিট্টির সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তামিল ছবির মারকাটারি দ্রুতলয়ের সংলাপ বিনিময়ের এক পর্যায়ে ঐশ্বরিয়ার জন্য দিওয়ানা চিট্টি বিদ্রোহ করে বসে। অতঃপর তামিল ফমূর্লা মান্য করে রজনীকান্ত নায়ক ও তার কার্বনকপি চিট্টি খলনায়কে পরিণত হয়। ঐশ্বরিয়ার বাহুডোরে ফিরতে ব্যাকুল নায়ক রজনীকান্তের ভিলেন চিট্টির সঙ্গে মারদাঙ্গায় লিপ্ত হওয়া ছাড়া বিকল্প থাকে না। ছবির অন্তে সাধের রোবটকে নিষ্ক্রিয় করে রজনীকান্ত তার প্রেমিক হওয়ার স্বাধীন ইচ্ছায় ইতি ঘটায় এবং ঐশ্বরিয়ার বাহুডোরে নিজেকে সমর্পিত করে। তামিল মশলা সিনেমার সূত্র মেনে বৃহদারণ্যক উপনিষদের বিখ্যাত সূক্ত ‘সর্বে ভবন্তু সুখিন,/সর্বে সন্তু নিরাময়া’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মেশিনের সঙ্গে প্রেম করার যন্ত্রণা থেকে নায়িকা ঐশ্বরিয়াকে পরিচালক অবশেষে মুক্তি দান করেন।
জয়নাবকাণ্ড মোহাম্মদের সত্তার নিয়ন্ত্রক আল্লাহকে ‘এনথিরান’-এর মতো বিপাকে ফেলেছিল তার প্রমাণ সূরা ‘আযহাব’-এর ছত্রে-ছত্রে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। মোহাম্মদকে তিনি স্বাধীন ও আত্ম-নিয়ন্ত্রিত এবং পাশাপাশি পরাধীন ও স্রষ্টা-নিয়ন্ত্রিত রূপে গ্রোগ্রামিং করে ধরায় পাঠিয়েছিলেন। এখন সেই ছকে জয়নাবের আকস্মিক অনুপ্রবেশ সমস্যা ঘটায়। ঘটনাটি সামাল দেওয়ার জন্য অগত্যা আল্লাহকে সক্রিয় হতে হয়েছিল। রজনীকান্তের স্টাইলে মোহাম্মদের কোডিংয়ে ভালোবাসার অনুভূতি নিষ্ক্রিয় করা আল্লাহর পরিকল্পনা বিচারে উত্তম সমাধান ছিল না। মানবীয় সহানুভূতি, দয়ামায়া ও ভালোবাসার উদাহরণ হতে নবিগণকে তিনি ধরায় পাঠান, এখন সেগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিলে মানুষের জীবনে আগমনকারী নবির প্রাসঙ্গিকতা বহাল থাকে না; সুতরাং জয়নাবকে ঘিরে যা ঘটেছিল সেটা সামাল দিতে রুহুল কুদুস অর্থাৎ জিবরাইল মারফত ওহি পাঠাতে হয়েছিল। নবির মনোবাসনা কী হেন কারণে আমআদমির মনোবাসনা থেকে পৃথক ও ক্ষেত্রবিশেষে বৈধ তার ব্যাখ্যা জনতার কাছে তাঁকে দাখিল করতে হয়েছিল। স্মরণ রাখতে হয় এই বাধ্যবাধকতা নারী-পুরুষের সহজ মেলামেশার আরব কেতায় পরিবর্তনের সূচনা করে। কালের ধারায় যেটি হিজাব ও পর্দার কঠোরতায় মুসলমান সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণকারী নারীকে অবরুদ্ধ করতে ভূমিকা রেখেছিল :—
‘আর তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করিবে এবং প্রাচীন যুগের মতো নিজেদেরকে প্রদর্শন করিয়া বেড়াইবে না। তোমরা সালাত কায়েম করিবে ও যাকাত প্রদান করিবে এবং আল্লাহ ও তাঁহার রাসুলের অনুগত থাকিবে। হে নবি-পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের হইতে অপবিত্রতা দূর করিতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করিতে।’ — আযহাব ৩৩:৩৩;
‘হে মু’মিনগণ! তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া না হইলে তোমরা আহার্য প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না করিয়া ভোজনের জন্য নবিগৃহে প্রবেশ করিও না। তবে তোমাদেরকে আহবান করিলে তোমরা প্রবেশ করিও এবং ভোজনশেষে চলিয়া যাইও; তোমরা কথাবার্তায় মশগুল হইয়া পড়িও না। কারণ তোমাদের এই আচরণ নবিকে পীড়া দেয়, সে তোমাদেরকে উঠাইয়া দিতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু আল্লাহ সত্য বলিতে সংকোচ বোধ করেন না। তোমরা তাহার পত্নীদের নিকট হইতে কিছু চাইলে পর্দার অন্তরাল হইতে চাইবে। এই বিধান তোমাদের ও তাহাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র। তোমাদের কাহারও পক্ষে আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেওয়া সংগত নয় এবং তাহার মৃত্যুর পর তাহার পত্নীদেরকে বিবাহ করা তোমাদের জন্য কখনও বৈধ নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে ইহা ঘোরতর অপরাধ।’ — আযহাব ৩৩:৫৩;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
ইসলাম ধর্মে প্রগাঢ় বিশ্বাসী লোকজনের কাছে কথাটি ইবলিশের ‘আকল’ দ্বারা প্রভাবিত মনে হতেও পারে তবু তর্কের খাতিরে মুখ ফুটে বলা উচিত, জয়নাবের সৌন্দর্য ও সপ্রতিভতা সেই সময় মোহাম্মদের জন্য যতটা প্রীতিকর ঠিক ততটাই ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল। সপ্রতিভ সৌন্দর্যে তার যে-ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পেত সেটা নয়নসুখকর হলেও পরপুরুষকে উদ্দীপ্ত বা প্রলোভিত করার উপাদান সেখানে ছিল বৈকি! এহেন প্রলোভন লোকের মনে শয়তান দ্বারা প্ররোচিত হওয়ার তাড়না সৃষ্টি করে এবং কোরান প্রণীত মানদণ্ডের বাইরে গিয়ে সেই সৌন্দর্য হস্তগত করার প্রবৃত্তি প্রবল হয়। মোহাম্মদ টের পেয়েছিলেন শলাপরার্শের জন্য তাঁর কাছে আগত লোকজন জয়নাবের সঙ্গে কথা বলার মওকা পেলে সহজে উঠতে চায় না। ঘটনাটি তাঁর জন্য বিব্রতকর ছিল। আল্লাহও বুঝতে পারছিলেন মোহাম্মদ জয়নাবের সৌন্দর্যে প্রস্ফুটিত ব্যক্তিত্ব কেবল নিজের করে পেতে ইচ্ছুক বিধায় আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটার পূর্বে এর বিহিত করা প্রয়োজন। তাঁর বুঝতে বাকি ছিল না জয়নাবের ঘটনা ডিস্টার্বিং ফ্যাক্টর-এ পরিণত হওয়ার কারণে নারীর সৌন্দর্যে ব্যক্ত রূপকে আড়ালবর্তী করার সময় ঘনিয়ে এসেছে। অন্যথায় নবির মনে জয়নাবের সপ্রতিভ সৌন্দর্যে বিকচিত ব্যক্তিত্ব হারানো নিয়ে যে-শঙ্কা ও অবসেশন জন্ম নিয়েছে তার নিরসন ঘটানো সম্ভব নয়। আজকের বিচারে এই অবসেশন হয়তো মনঃস্তাত্ত্বিক টেক্সট, লোকে যাকে বাইপোলার ব্যাধি নামে ডাকে এবং মানসিক বৈকল্যের সঙ্গে যুক্ত করে প্রেমাবেশমোহ (Obsessive love disorder) বলে দাগায়।
আবারও সিনেমার প্রসঙ্গটি টানতে হয়, — বাংলা সিনেমায় যেমনটা দেখি, হুমায়ূন ফরিদী ঋতুপর্ণাকে এই পরিমাণ ভালোবাসে শেষতক সেই ভালোবাসা বেচারির জন্য কাল হয়ে ওঠে। ফরিদীর প্রেমাবেশমোহ সন্দেহ-বাতিকে পরিণত হওয়ার ফলে ঋতুর দেহ-মন সন্দেহের উপকরণ রূপে পর্দায় আতঙ্ক ও জটিলতায় সবাক হতে থাকে। ফরিদীর এহেন মাত্রাছাড়া সন্দেহ আর যত্রতত্র অকারণ নজরদারির ঠেলায় বেচারি ঋতু নিজের দেহকে আর নিজের বলে ফিল করতে পারে না, ওটা ফরিদীর আবেশঘন সন্দেহের খোরাকে পরিণত হয় এবং ফরিদী এভাবে ভালোবাসার নামে তাকে চরম উৎপীড়ন সইতে বাধ্য করে। মহানবি কতকটা সেরকম চক্করে অভিভূত হচ্ছেন বুঝে আল্লাহ আর কালবিলম্ব করেননি। তাঁর মনে ইবলিশ কর্তৃক বারবার সিস্টেমে অবৈধ অনুপ্রবেশ বা হ্যাকিংয়ের স্মৃতি উঁকি মেরেছিল। সুতরাং ঘটনার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে নবিপত্নী থেকে ‘সম্মানজনক ব্যবধান’ বজায় রাখার নির্দেশ নিয়ে জিবরাইল মোহাম্মদকে দর্শন দিলেন; যা পরবর্তীতে মোল্লাদের সদাজাগ্রত নৈতিক শুচিবায়ের কারণে পর্দা ও হিজাবের বাধ্যবাধকতা হয়ে মুসলমান রমণীদের ঘাড়ে চেপে বসে।
মূল ঘটনা থেকে দূরবর্তী এই বাধ্যবাধকতার ঘেরটোপে উম্মূল মোমেনিন আয়েশা থেকে আম-আয়েশারা নিজের দেহে আর কখনও ফেরত যেতে পারেননি, বরং দেহকে হিজাব ও বোরকায় ফরবিডেন ভাবার অভ্যাসে শান দিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। গোত্রশাসিত জীবনে নারী-পুরুষের সহজ চলাচল ও মেলামেশায় নিষেধের প্রাচীর সৃষ্টিকারী এই ঘটনা কার্যত স্ব-নিয়ন্ত্রিত ‘আকল’কে আল্লাহনির্দিষ্ট কোডিংয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে না-পারার সমস্যা থেকে তখন উদ্ভূত হয়েছিল। আড়াল তৈরির মাধ্যমে পরপুরুষের সঙ্গে নারীর দূরত্ব বজায় রাখার বিধান ইসলাম-পূর্ববর্তী জীবনধারার সহজাত অভ্যাসে বিচ্ছেদের স্মারক হয়ে ধরায় নেমে আসে।
তো এইসব হলো ছোট-ছোট ‘কারণ’ যার চাপ থেকে ইসলামবিশ্বাসী মুসলমানদের পরে আর নিষ্কৃতি মিলেনি। কোরান ও হাদিস যদি কোনও ব্যাপারে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহলে সেটা আল্লাহর বিধান অনুসারে ঘটেছে বলে মুসলমানকে ধরে নিতে হবে, এখন তাকে যুগ-কাল-দেশাচার ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে নমনীয় ও লিগালাইজ করার অধিকার কারও নেই। সূরা ‘আল-আহযাব’ সেই বিচলন, স্ববিরোধ, টানাপোড়েন ও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দলিল হয়ে কোরানে আজও বিরাজিত :—
‘হে নবিপত্নীগণ! যে-কাজ স্পষ্টত অশ্লীল, তোমাদের মধ্যে কেহ তাহা করিলে তাহাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেওয়া হইবে এবং ইহা আল্লাহর জন্য সহজ।’ — আযহাব ৩৩:৩০;
‘হে নবি-পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমলকণ্ঠে এমনভাবে কথা বলিও না, যাহাতে অন্তরে যাহার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলিবে।’ — আযহাব ৩৩:৩২;
‘স্মরণ করো, আল্লাহ যাহাকে অনুগ্রহ করিয়াছেন এবং তুমিও যাহার প্রতি অনুগ্রহ করিয়াছ, তুমি তাহাকে বলিতেছিলে, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখো এবং আল্লাহকে ভয় করো।’ তুমি তোমার অন্তরে যাহা গোপন করিতেছ আল্লাহ তাহা প্রকাশ করিয়া দিতেছেন; তুমি লোকভয় করিতেছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত। অতঃপর যায়দ যখন যয়নবের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করিল, তখন আমি তাহাকে তোমার সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করিলাম, যাহাতে মু’মিনদের পোষ্য পুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহসূত্র ছিন্ন করিলে সেইসব রমণী’কে বিবাহ করায় মু’মিনদের কোনও বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকরী হইয়াই থাকে।’ — আযহাব ৩৩:৩৭;
‘হে নবি! আমি তোমার জন্য বৈধ করিয়াছি তোমার স্ত্রীগণকে, যাহাদের মাহর তুমি প্রদান করিয়াছ এবং বৈধ করিয়াছি ফায় হিসাবে আল্লাহ তোমাকে যাহা দান করিয়াছেন তন্মধ্য হইতে যাহারা তোমার মালিকানাধীন হইয়াছে তাহাদেরকে, এবং বিবাহের জন্য বৈধ করিয়াছি তোমার চাচার কন্যা ও ফুফুর কন্যাকে, মামার কন্যা ও খালার কন্যাকে, যাহারা তোমার সঙ্গে দেশ ত্যাগ করিয়াছে এবং কোন মু’মিন নারী নবির নিকট নিজেকে নিবেদন করিলে এবং নবি তাহাকে বিবাহ করিতে চাহিলে সেও বৈধ, — ইহা বিশেষ করিয়া তোমারই জন্য, অন্য মু’মিনদের জন্য নয়; যাহাতে তোমার কোন অসুবিধা না হয়। মু’মিনদের স্ত্রী এবং তাহাদের মালিকানাধীন দাসিগণ সম্বন্ধে যাহা নির্ধারিত করিয়াছি তাহা আমি জানি। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ — আযহাব ৩৩:৫০;
উৎস : আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
মোহাম্মদ যবে ‘স্ব-নিয়ন্ত্রিত আকল’ দ্বারা চালিত হন তখন আমজনতার সঙ্গে তাঁর প্রভেদ অনুভব করা দুষ্কর হয় এবং জয়নাবকে নিয়ে উচাটন দশায় পতিত হওয়ার ঘটনা তার সাক্ষী রূপে কোরানের পাতায় বিদ্যমান। এই বিবাহকাণ্ড মহানবির জীবনে ক্রুশিয়াল হয়ে আসে এবং হাফসা থেকে আয়েশা সকলের অশেষ আভিমান ও ক্ষোভের কারণে পরিণত হয়। আল্লাহ ও শয়তানের দ্বন্দ্ব এবং নবি নামক পবিত্রতার ধারণা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে এটা স্ক্যান্ডাল এবং আবুবকর ও উমরকে হতবুদ্ধি করে দেওয়া সেই ঘটনায় মোহাম্মদ জীবনে প্রথম এতটা বিচলিত হয়েছিলেন। ঘটনার ঝড় সামাল দেওয়ার পর অর্থাৎ অভিপ্রায় অনুসারে নবির জন্য বৈধ সম্পর্কের (দ্রষ্টব্য আয়াত ৩৩) ফিরিস্তি দান শেষে গ্রোগ্রামার আল্লাহ স্বয়ং তাঁর বৈধতার সীমারেখা টানেন ৫২ নাম্বার আয়াতে, ‘ইহার পর, তোমার জন্য কোনও নারী বৈধ নয় এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নয়, যদিও উহাদের সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধ করে; তবে তোমার অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যাপারে এই বিধান প্রযোজ্য নহে। আল্লাহ সমস্ত কিছুর উপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন।’ — উৎস : আযহাব; ৩৩:৫২; আল কোরান; তরজমা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ; পিডিএফ সংস্করণ।
এইসব কারণে কোরান একাধারে গায়েবি ও ইহজাগতিক টেক্সট। আরববিশ্বে সম্ভ্রান্ত শেখরা বিষয়টা ধরতে পারে বলে হয়তো দেদার মদ্যপান ও নারীসঙ্গের চর্চায় জারি থাকার পর কাবায় ফি-বছর তাওয়াফ সারে কিংবা জান্নাতুল বাকিতে যেন নিজের কবর হয় সে-জন্য সেখানে আগেভাগে বুকিং দিয়ে রাখে। যেহেতু সেখানে একবার কবরস্থ হতে পারলে গোর আযাব মাফ। যাই হোক, নবি মোহাম্মদের ঘটনাবহুল জীবনের এই পর্বে আপাত ইস্তফা দিয়ে আলোচনার সূত্রপাত যেখান থেকে ঘটেছিল অর্থাৎ তাঁর জীবনে কোরান ও কবিতার সাংঘর্ষিক প্রভাবের জায়গায় আরেকবার ফেরত যাওয়া প্রয়োজন।
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৫
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৪
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ৩
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ২
ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা ১
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS