সুরমাসায়র পর্ব ৭ || পাপড়ি রহমান

সুরমাসায়র পর্ব ৭ || পাপড়ি রহমান

সিলেট শহরের শীত ও গরম দুইটাই খুব তীব্রতায় ভরা। আমার শরীর-মন ধীরে ধীরে সবকিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল। এমনকি আমি যে ‘বেঙ্গলি’, সেজন্য বাঁকা নজরের ঘাইগুলি — সেটাও এক সময় সয়ে গেল। (আজকের এই বয়স আর পরিপক্বতা থাকলে আরেকটা ‘লা নুই বেঙ্গলি’ লিখে ফেলা যেত!) কী আর করা? সময় সবচাইতে বড় মলম। এই মলম গভীর ক্ষতকেও ক্রমে সারিয়ে তোলে। ফলে আমিও ক্রমে সেরে উঠলাম। ‘বেঙ্গলি’ হিসেবে পাওয়া নানান রকম উপহাস আর তাচ্ছিল্যের কাঁটাগুলি বিস্মৃত হয়ে গেলাম।

ধপধপে লংক্লথ রুমালিছাট হয়ে ইশকুল-ইউনিফর্মরূপে আমার শরীরে সেঁটে বসেছে। পায়ে বাটা কোম্পানির কেডস আর শাদা মোজা। রুমালি-ফ্রকের নিচে শাদা চোস্ত পায়জামা। ছুটির দিনে আমার জুতা আম্মাই সাবান-জলে ব্রাশ দিয়ে ধুয়েমুছে চক লাগিয়ে রোদ্দুরের তলায় মেলে দেয়। চক শুকিয়ে খরখরে হয়ে গেলে জুতাজোড়া একেবারে খোলতাই হয়ে ওঠে। তখন এই জুতা পায়ে দিতে ভারি আমোদ হয়। একেবারে নতুন জুতার চেহারা। নতুন জুতার আলাদা গন্ধ থাকে। নতুন জামারও। এমনকি নতুন বইয়ের গন্ধও আমি আলাদা করে চিনতে পারি। শাদা দিস্তা কাগজের গন্ধও আমার অতি চেনা। অবশ্য সবকিছুর আলাদা গন্ধ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাও আমার কম নয়। আমি খুঁজে ফিরি বলেই হয়তো এইসব গন্ধ আবিষ্কার করা সহজ হয়ে ওঠে।

এর মাঝে অনেককিছুই দেখা হয়ে গেছে আমার। যেমন আমি দেখেছি বাদলার কালে সুরমা নদীর ফুঁসে-ওঠা। আষাঢ়-শ্রাবণের খরস্রোতা নদীর সাথে উইন্যার কালের সুরমার আকাশপাতাল তফাৎ। মরা ঢোঁড়ার পেটের মতো চিত-হয়ে-শুয়ে-থাকা নদীতে বাদলার কালে জোয়ার আসে প্রচণ্ড বেগে। ঘূর্ণায়মান স্রোত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একেবারে নদীর তলদেশে পৌঁছে যায়। সেই স্রোতের সঙ্গে পাহাড়িয়া জলধারার ঢল এসে মেশে বলে জলের বরন হয়ে ওঠে মাটিগোলা। যেন কেউ দিবারাত্র লালচে মাটির ঢিমা ছুঁড়ে ফেলতে থাকে নদীতে। আর ঢেউয়ের স্রোতের সাথে তা পলকে মিশে গিয়ে জলের রঙ দেয় পাল্টে। ফলে বাদলার সুরমার জল ঘোর মাটিবর্ণা। নদী থেকে একআঁজলা জল তুলে পান করার উপায় নাই। কে কীভাবে পান করবে ওই কাদামাটিজল? পান করলেও দাঁতের তলার বালির কিরকিরানি থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায়ই-বা কি?

উইন্যার কালে সুরমার একদম আরেক রূপ। আরেক চেহারা। বাদলার সেই ভরা রূপ-যৌবনের বেসাতি তখন শূন্য! বাজার বড়ই মন্দা। জল কমতে কমতে সুরমার দুই পাড় দীর্ঘ কাছাড় হয়ে ধুলা উড়িয়ে দেয়। তখন চারপাশ ধুলাকার আর ধুলার চাদরে ঢাকা নদীপাড়। জল একেবারে শুকিয়ে তলদেশে পৌঁছে নিস্তেজ শুয়ে থাকে। তখন এই নদীর আর যেন কোনো উচ্ছ্বাস নাই। কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই। ছোবলের অভীস্পায় তুলে-ধরা ফণা এক্ষণে নমিত। শহরজোড়া এক সুরমা নদী তখন রূপকথা। যেন এই নামে কোনোকালে কোনো নদী ছিল না এই শহরে! যেন এই সুরমার কথা আমরা কোনো বইয়ে কোনোদিন পড়িনি! যেন এই নদীর কোনো ঢেউ নাই, জলের উচ্ছ্বাস নাই। চিরকালের সুতিকা রোগীর মতো এর দেহের গড়ন। একেবারে নিস্তেজ শুয়ে-থাকা এক জলাধার! তাতে কালেভদ্রে দু-একটা লঞ্চ বা কার্গো পথ-হারানো হাঁসেদের মতো ভেসে যায়। বহু দূরে চলে গেলেও তাদের ভেঁপু শোনা যায়।

আর খেয়ানৌকার মাঝি বৈঠা টানতে টানতে হাঁপিয়ে ওঠে। তাদের হাতে পেশি ফুলে ফুলে শক্ত হয়। একবৈঠা জল তুলে ফের তা নদীতে গড়িয়ে দিতে তাদের চোয়াল হয় দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর। আর প্রত্যহের রোদ-জলে বাদামি ত্বকের জেল্লা নিস্প্রভ হয়ে ওঠে।

মাঝিদের ফুলে-ওঠা পেশি আর নিস্প্রভ ত্বক দেখতে দেখতে আমার নদী পারাপার চলে। কারণ ততদিনে আমাদের ইশকুলবাস আসা বন্ধ হয়ে গেছে। ইশকুলে যেতে হলে নৌকায় চড়তে হয়, সুরমা নদী পার হতে হয় — এতে সময় ও অর্থ দুইটারই সাশ্রয় হয়।

বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আমি ইশকুলে যাই রিকশা ও নৌকা ভাড়া শেয়ার করে। আমাদের চার বাসা পরের বুলবুলআপার সাথে। বুলবুলআপা আমার চাইতে দুইক্লাস উপরে পড়ে। আমি যাওয়ার ভাড়া দিলে সে দেয় আসার ভাড়া। রিকশাভাড়া আটআনা আর খেয়া পারাপার দশপয়সা — এই আমার খরচ। আব্বা আমাকে বলে —
কত লাগবে তোমার?
আমি নির্বিকার বলে দেই —
আটআনা দশপয়সা।
কিন্তু আব্বা আমাকে দেয় একটাকা।
চিরটাকাল আমাকে আমার খরচের চাইতে বেশি টাকা দিয়ে গেছে আব্বা। আজ মনে হয়, ছোটকাল থেকেই নিজের হাতে নিজের টাকা খরচের স্বাধীনতা থাকলে অনেক সঙ্কীর্ণতা হয়তো এড়িয়ে চলা যায়। এই পৃথিবীর আকাশে মেঘেদের মনোরম খেলা দেখে, কিছু গাছলতার নামধাম জেনেশুনেদেখে, কিছু বইপত্রের সঙ্গে শুয়েবসে থেকে কিংবা তাদের পাঠ করে আর দামাল হাওয়ার সাথে জোরে দৌড় দিয়ে অনায়াসে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়।

এ-রকম ভেবেছি বলে অঙ্কে আমি বরাবর কাঁচা থেকে গেছি। পাকা হতে চাইনি বা হওয়ার ইচ্ছেও কোনোদিন জাগে নাই। জাগলে হয়তো কিছু হিসাব ঠিকঠাক শিখে ফেলতে পারতাম। জীবনের মারাত্মক কিছু ভুল থেকে সরে থাকতে পারতাম। যা-ই হোক। অঙ্কে কাঁচা ছিলাম বলে আটআনা দশপয়সায় যে ষাটপয়সা হয় এটা ভেবেও দেখি নাই। ভাববার দরকারও পড়ে নাই। আব্বার কাছে আমার আব্দার আটআনা দশপয়সা আর আব্বার নিয়ম করে একটাকা দিয়ে যাওয়া — এ-ই তো আব্বার সাথে আমার বোঝাপড়া। আব্বা আমাকে কোনোদিন শুভঙ্করের ফাঁকিতে ফেলে নাই, আমিও আব্বাকে ফেলি নাই। শুধু আব্বাকে কেন এ জগতের কাউকেই আমি ফাঁকি দেইনি বা ফাঁকিতে ফেলতে চাইনি। তবুও জীবন কিন্তু আমাকে ফাঁকিতে ফেলবার চান্স হাতছাড়া করে নাই। অদ্ভুত এক গাণিতিক ফাঁদে খামাখাই আটকে রইলাম।

আব্বার দেয়া ওই একটাকা থেকে দুইদিনেই আমার কাছে জমে যায় আশিপয়সা।  আশিপয়সায় ইশকুলের সম্মুখে বসে থাকা প্রায় তাবৎ খানাখাদ্য আমি একটু একটু করে চেখে দেখতে পারি। আটআনা দিয়ে একটা মালাই-আইসক্রিম কিনে খেতে পারি। দশপয়সা বা পনেরো পয়সা দিয়ে ফুকল। ফুকলের দুধশাদা রঙে দুইঠোঁট মাখমাখি করে ঘুরে বেড়াতে পারি। আম্মা ফুকলকে বলে ‘মাখনা’। ওই একটাকা থেকে আমি খেতে পারি তিনকাঁটার মাথাওয়ালা সিঙ্গারা। অথবা বন্ধুদেরও কিছু টিফিন কিনে খাওয়াতে পারি। প্রতিদিন দশ বা বিশপয়সা করে খেলেও আমার কাছে কিছু টাকা জমে যায়। ওই জমে-যাওয়া টাকা দিয়ে আমি অনায়াসে কিনতে পারি নভেল। আমাদের বাড়ির প্রায় সকলেই নভেল বা গল্পের বই পড়ে কি-না! নভেল কিনতে আর সমস্যা কি? আমাদের ইশকুলগেইটের পাশেই তো রয়েছে কয়েকটা লাইব্রেরি। একদিন ওইসব লাইব্রেরি থেকেই কিনে ফেলব গুটিকয় নভেল। আর মনের সুখে পড়তে শুরু করব।

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you