দুইহাজার বাইশের বন্যা চব্বিশে রিপিট হওয়ার শঙ্কা অনেকে করছিলেন, তবে যেভাবে ঘটল, এখন একে বন্যার চেয়ে খতরনাক লাগছে দেখে! বাইশের তুলনায় চব্বিশের বারিশ এমন নয় যে এর জন্য নগরকে ডুবতে হবে, অথচ চোখের সামনে সেটি ঘটতে দেখছি! আন্ধাধুন্ধা উন্নয়নের মাশুল গুনতে যেয়ে নগরীর তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ পানিবন্দি থেকেছেন! দায়ী কে? সেটি ভাবছি এখন।
সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টির বাড়াবাড়ি নতুন নয়। চব্বিশে এখন পর্যন্ত যে-পরিমাণ বৃষ্টি ঝরেছে এর থেকে বেশি বারিপাতের অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। বাইশের কথা তুলছি না, ওটা নজিরবিহীন ছিল। বাইশ ছাড়াও নিকট অতীতে টানা দুই-তিন সপ্তাহ আকাশে জল ঝরতে দেখেছি তো! শহর অনেকটা ফাঁকা ছিল তখন। বৃষ্টির জল রাস্তাঘাট ভাসিয়ে চট করে ঘরোদোরে ঢুকে পড়েনি। নিচু এলাকা তাৎক্ষণিক জলভাসি হলেও বেশিখন দাঁড়ায়নি। দ্রুত নেমে গেছে। ছড়া-খাল-বিল-জলাশয়-হাওর আর সুরমা-কুশিয়ারা মিলেঝুলে ভারী বর্ষণের চাপটি তখন সামলে নিয়েছে। পরিস্থিতি এতদূর পাল্টেছে, কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে সব ভেসেটেসে একাকার! কার ঘাড়ে দায় চাপাবেন? নিঠুর প্রকৃতির নাকি মানুষের?
জলটানার সকল পথ আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। কায়ক্লেশে যেগুলো টিকে আছে সেগুলো আবার হরকিসিমের উৎপাত সয়ে মৃতপ্রায়। নিজেকে টানতে পারছে না, জল টানবে কী করে! জল বহনের উৎসগুলোর ওপর আমরা বড়ো বেশি অত্যাচার করি। আমাদের বিরতিহীন লোভ আর সীমাহীন অজ্ঞতাদোষে শহর আজ মরতে বসেছে। মরণ ঠেকানোর চেষ্টা কারো পক্ষ থেকে ঘটতে দেখছি না। বাঞ্চোদ সরকার এসবের থোড়াই কেয়ার করেছে এতগুলো বছর। সুতরাং যা ঘটার ছিল সেটি ঘটছে। এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে ভালো। না পারলে উদ্বাস্তু হওয়ার ক্লেশ সইতে হবে মনে হচ্ছে।
আসাম-মেঘালয়ের জলবায়ুতে একীভূত প্রাচীন জনপদের ধস ঠেকানো সুকঠিন। আপাতত ধরে নিতে হচ্ছে, চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয়ে ঘনীভূত বাষ্পকণা সম্বৎসর বিপুল জলরাশি পয়দা করবে। পাহাড়চূড়ায় মালার মতো বিদ্যমান ঝর্না থেকে পলিমাটি সঙ্গে করে খরশান জলস্রোত ভাটিপানে নামবে ফি বছর, যেমন নেমেছে দূর অথবা নিকট সময়। জলরাশির প্রবল চাপ যারা বহন করত তাদের যৎসামান্য জনপদে টিকে আছে। এলোপাথাড়ি ঘরদোর আর তার সঙ্গে জোরকদমে আগুয়ান আজব উন্নয়নের গজবে সব নিকেশ হয়েছে। জলপ্লাবনে তলিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওদিকে টেকটোনিক প্লেটে সঞ্চিত শক্তির আকস্মিক উদগীরণে শহর চোখের পলকে তছনছ হতে পারে। শঙ্কাটি নতুন নয়। জন্মের পর থেকে শুনছি। জনপদ সুরক্ষিত রাখার উদ্যোগ চোখে পড়েনি। জলপ্লাবন ও ভূকম্পনে পরিত্যক্ত হওয়ার নিয়তি রুধিবার একটি পথ কি অবশিষ্ট রেখেছি আমরা? পথ যদি খুঁজতে হয় তাহলে আস্ত শহর ভেঙে নতুন করে গড়তে হয়। সেটি সম্ভব নয়। সুতরাং পর্বত প্রমাণ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সার্কাস্টিক ডেভোলাপমেন্টের ক্যারিকেচার দেখতে হচ্ছে! বড়ো মায়ভরা শহরকে পরিত্যক্ত ভাবার দিন বোধহয় ঘনিয়ে আসছে।
নগর পরিকল্পনা জটিল বিষয়। বিস্তর মগজ খাটানোর দরকার সেখানে। নগর গড়তে হলে ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে জলবায়ু থেকে শুরু করে অজস্র বিষয় আমলে নিতে হয়। বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক মনন আর নগর পরিকল্পনাবিদের সাজেশন যথেষ্ট নয়। উনাদের মধ্যে সংবেদী মননের আভাস যদি না থাকে তাহলে সকলই গরল ভেল। মাস্টার প্লানে থাকতে হয় গভীর সংবেদনের ছাপ। লক্ষ বছরের আবর্তনে প্রকৃতি নিজ হাতে জনপদকে যেভাবে সবুজ করে তোলে, তার সঙ্গে মানব-পরিকল্পনায় তৈরি গ্রিন সিটির তফাত রয়েছে। মনে পড়ছে, সবুজায়ন মাথায় রেখে ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনি দিয়ে দেশের প্রধান সড়ক, ফাঁকা জমি আর পাহাড়-টিলা একসময় ছেয়ে ফেলা হয়েছিল। মাটির নিচ থেকে জলশোষণে বৃক্ষ দুটি খানিকটা রাক্ষুসে স্বভাবের। বছরে তিনশো মিলিমিটারের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকায় এই জাতীয় বৃক্ষ রোপণে পরিবেশবিদরা সচরাচর নিষেধ করে থাকেন। আমাদের এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ব্যাপক হওয়ার কারণে এ্যাফেক্ট প্রথম-প্রথম বোঝা যায়নি। কাঠলোভী মানুষ ফাঁকা জায়গা বুঝে দেদারসে ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনি লাগিয়েছিলেন। পরে তারা টের পেলেন, সর্বনাশের কিছু বাকি নেই! গাছ দুটির কারণে আশপাশের খেতে শাকসবজির চাষাবাদ অতটা দুরস্ত থাকছে না। পাখি ও পতঙ্গ পারলে গাছগুলো এড়িয়ে চলে। অথচ কত জাতের গাছে ঘেরাও এই বঙ্গ! পরিবেশবান্ধব এইসব গাছপালাকে অনায়াস বিবেচনায় রাখা যেত। নগর পরিকল্পনায় গ্রিন সিটির ধারণা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে যে-কারণে বিস্তর মতভেদ দেখতে পাই।
জেমস লাভলক তাঁর বইয়ে এক জাতীয় সামুদ্রিক শৈবালের (নামটি মনে পড়ছে না) কথা লিখেছিলেন। ইউরোপের কিছু দেশে সরকার বাহাদুর সবুজায়ন ও বাণিজ্য সম্ভাবনায় উজ্জ্বল শৈবালটির চাষাবাদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পাকা করেছেন শুনে লাভলকের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। কারণ আর কিছু নয়, তিনি হিসাব করে দেখছিলেন সমুদ্র-উপকূলে সহনীয় প্রাকৃতিক মাত্রার পরোয়া না করে উক্ত শৈবালের চাষাবাদে লাভের তুলনায় ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল। বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত মিথেনের আস্তরণ সৃষ্টিতে শৈবালটি গুরুতর অবদান রাখতে শুরু করবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে নাকাল বিশ্বে দাবদাহের মাত্রা তাতে আরো বৃদ্ধি পাবে। একই কারণে ক্লাউড সিডিং বা আকাশে মেঘের বীজ বপন নিয়ে ব্যাপক মতান্তর রয়েছে। দুবাই কাজটি সম্প্রতি হাতে নিয়েছিল শোনা যায়। পরিণামে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে শহর ডুবতে বসেছিল। ইন্দোনেশিয়ার সরকার ওদিকে এককাঠি সরেস। খবরের কাগজে পড়লাম, অতিরিক্ত মেঘমালায় ঘনীভূত শহর বাঁচাতে বৃষ্টিখরায় জেরবার অন্য একটি শহরে বাষ্পকণা স্থানান্তরের পাঁয়তারা করছেন তারা। ক্লাউড সিডিংয়ের তরিকাটি কেবল রিভার্স করা হয়েছে। ফলাফল নিয়ে পরিবেশবিদের কপালে ভাঁজ পড়লেও সরকারের ওসব গোনার টাইম নাই! আমাদেরও ছিল না, যবে অস্ট্রেলিয়ার জলমাটিতে সহজাত ক্যাঙ্গারুর নিত্য ব্যবহার্য ইউক্যালিপটাসকে দেশে উড়িয়ে এনেছিলাম। গাছটির চাষাবাদে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন সরকার। আকাশমনি বা একাশিয়া নিষিদ্ধ না হলেও চাষাবাদে ইদানীং ভাটা পড়তে দেখছি।
আকাশমনি গাছের সপক্ষে অনলাইন কাগজে জনৈক উদ্ভিদবিদ লম্বাচওড়া আর্টিকেল ফেঁদেছিলেন সম্প্রতি। লোভে পড়ে যারা একসময় গাছটি গণহারে বপন করেছেন তারা দেখি ভদ্রলোককে ধুয়ে দিচ্ছেন। আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস আর বেলজিয়াম গাছ লাগানোর মচ্ছব কাঠের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে আপনা থেকে হ্রাস পেয়েছে। ফেঞ্চুগঞ্জ যাওয়ার রাস্তায় এখনো কিছু টিকে আছে বোধহয়। ফার্নিচার ব্যবসার পুরাটাই মোটের ওপর স্টিল, প্লাস্টিক আর কাঠের গুঁড়া ডাম্পিং করে বানানো আসবাবপত্রে বোঝাই হয়েছে। চায়না থেকে ইমপোর্ট করলেই চলে। সেগুন টিকের মতো দামি কাঠের অসবাব কেনার ক্ষমতা রাখেন কজন? সুতরাং গ্রিন সিটি, স্মার্ট সিটি নামের গালভরা বুলি আর ছড়ার ধার ঘেঁষে গড়ে তোলা ওয়াকওয়ে শহরকে বাঁচাতে পারবে না। বাঁচাতে হলে নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনার সঙ্গে নিখাদ কমিটমেন্ট থাকা চাই। ভোটচোর সরকারের দেশে ওসবের পরোয়া কবে কে করেছে! আমাদের এখানে সবটাই তো আকবর আলী খানের ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’-র খপ্পরে যুগ-যুগ ধরে ধর্ষিত হচ্ছে। পালে পাল বেনজির-মতিউর সৃষ্টি যার একমাত্র লক্ষ্য থেকেছে সবসময়। সবকিছু সাবড়ে দিতে ওস্তাদ সরকারযন্ত্র এছাড়া কদাপি টিকতে পারেনি এখানে।
পরিস্থিতি নেতিবাচক বিধায় সিলেট সহ গোটা তল্লাটের সলিল সমাধির কুভাবনা থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল। ঈশ্বর ও পরমাপ্রকৃতি যখন ধ্বংস থেকে নতুনের অভ্যুদয় ঘটানোর সংকল্পে অটল হতে থাকেন তখন মহাপ্লাবন ও ভূকম্পন উনাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। অগাধ সলিলে চিরদিনের জন্য এক-একটি জনপদকে সমাধি দিতে প্লাবন দেখা দেয়। কিছু তার জীবাশ্মে পরিণত হয়। উতরোল সাগর নয়তো মাটির নিচে সিলেটের গুম হওয়া তাই কিমাশ্চর্য নয়। দূর অতীতে জনপদটি সাগরলগ্ন ছিল। সাগর সরে যাওয়ার অবশেষ হাওর-জলাশয়। সময় হয়েছে পুনরায় সাগরে নিরুদ্দেশ হওয়ার।
কথার কথা, সঠিক পরিকল্পনা করে যদি আগানো যায়, এখন থেকে কাজ শুরু হয়, তথাপি বকচ্ছপ সরকার-ব্যবস্থা আর বিটকেল প্রশাসনের কব্জা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পরিকল্পনার পরি আকাশে উড়বে। তাকে মাটিতে নাবতে দেখবে না জনগণ। হতাশা সঙ্গী করে প্রাচীন জনপদকে সকলে ধসে যেতে দেখব। ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’;—আমরা মরে জম্বি হতে পারি কিন্তু হুমায়ুন আজাদের অমর পঙক্তিটির মনে হচ্ছে মরণ নেই।
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
সিলেট প্লাবন ২০২২
ডেটলাইন জুন ২০২২ : প্রলয়ঙ্কর বন্যার স্মৃতি
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS