তারাভরা রাতে

তারাভরা রাতে

বেদনায় ইয়াদ হবে তারে, একটি তৃণফড়িঙের ন্যায় তিরতিরে বেদনায়, মেমোরির গলিঘুঁজি মৃদুগন্ধা মাঘজোছনায় ক্যান্ডেলের আলোর মতো কুসুমোদ্ভাসিত হবে তার গলা আর গানের আভায়। বেদনার আমরা সন্তান যদি হই, স্বীকার যদি করি যে বেদনার সন্তানই বস্তুত আমরা, জীবনানন্দ বলেছিলেন যেমন কোনো-এক কবিতায় এই অভিজ্ঞানের গল্প, নিশ্চয় মানব যে যে-কোনো উল্লাসমুহূর্ত বা আনন্দক্ষণের অনতিদূরে বেদনাবাতাস চুপিচাপা থাকে বসে অপেক্ষাকামরায়। একবার বেদনার পানে তাকিয়ে এ-জীবন কেটে যায় আমাদের এই নীল নক্ষত্রতলায়। বেদনাই সঙ্গ দিয়া যায় আমাদেরে শেষতক। আনন্দ অল্পায়ু। বেদনা আবহমান, ধ্বংসে যেমন নির্মাণেও মুখ্য ভূমিকা রাখে এই বেদনা। আর কে না জানে যে বেদ থেকেই বেদনা, শাব্দিক উৎপত্তির দিক থেকে যেমন ভাবিক দিক থেকেও, আবার উল্টোটাও সমান গ্রাহ্য হবে যে বেদনারই ভিয়েনে তৈরি ত্রিভুবনের বিপুল বেদরাশি। জীবন পুষ্পশয্যা নয়, কাঁটামুকুটও নয়, জীবন আদতে এক অমল-ধবল-অমেয়-অতুল বেদনারই গান। বেদনাই নির্মাণ করে ব্যক্তিত্ব মানুষের, বেদনাই পৃথকতা আনে এক মানুষের সনে আরেক মানুষের, বেদনাই নিয়া যায় মানুষেরে পথ চেনায়ে দূরের শান্তিপারাবারে। বেদনারই নৃত্যে দ্যাখো নক্ষত্র নৃত্যরত গোটা দুনিয়ায়। বেদনাই মানুষেরে মানবিক করে রাখে। বে-লাগাম ফুর্তিফার্তা আর ফাত্রামির শেষ আছে, বেদনা অশেষ এই লিলুয়া আগুনক্ষরা নাক্ষত্রিক ভুবনে।

বেদনাগানের শিল্পী আব্দুল জব্বার লোকান্তরে গেলেন প্রকৃতিরই নিয়মে। এই যাওয়া আরও-অধিক থাকাই আসলে, থেকে-যাওয়া দেহহীন চামেলীর ন্যায় আঘ্রাণ ছড়ায়ে। এই স্ফীত প্রযুক্তির চমৎকার ও চাঞ্চল্যকর আশীর্বাদকালে, এই ইউটিউবযুগে, একজন শিল্পীর প্রস্থান তো আরও অসম্ভব বাস্তবে। বেদনায়-মনে-পড়া আব্দুল জব্বার প্রকৃত প্রস্তাবেই মৃত্যুঞ্জয়। বেদনাঘ্রাণস্ফূরিত অদ্ভুত মধু ও মদের মৌতাতানো সুরের কারুকাজ খেলা করে গেছে এই শিল্পীর আজীবনের গাওয়ায়। এমন একটা রেন্ডিশনও পাওয়া যাবে না আব্দুল জব্বারের যেখানে তিনি তিড়িংতিড়িং লাফায়েছেন গলা বাজারের গণেশ নিজের ফেভ্যরে নেবার তাগিদে। এমন হয় নাই কদাপি। কিন্তু কম তো করেন নাই গান। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক প্রচুর করলেও জব্বার মূলত মডার্ন বাংলা গানেরই শিল্পী। ট্রিবিউট জানাইতে যেয়ে এই নিবন্ধে সদ্যপ্রয়াত কণ্ঠসংগীতশিল্পী আব্দুল জব্বারের গানের ও গায়নের সানুপুঙ্খ সুলুক সন্ধান করব না, আমরা শুধু দুইটা গানের স্মৃতি নিঃশব্দচরণে এনেই বিদায় নিতে চাই।

কিন্তু শুধু বেদনাই নয়, আব্দুল জব্বারের গলায় আরও কতিপয় ফিচার অন্তর্ভুক্ত যা আসলেই ইউনিক। আছে তেজ, অদ্ভুত ছ্যাঁচা আওয়াজের তেজ, চাপা আক্রোশের শান্ত অথচ সুতীক্ষ্ণ স্ফুলিঙ্গ। ক্রোধের প্রোলোংড ও শমিত একটা আত্মস্থিত কন্টেম্প্লেটিভ টোন্যাল এফেক্ট জব্বারের কণ্ঠে যে-কৌলীন্য এনেছে এর তুলনা বাংলায় বিরল। গণ-উদ্দীপনাসঞ্চারী দেশাত্মবোধির উজ্জীবনে যে-গানগুলো কণ্ঠে এঁকেছেন জব্বার, বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে এবং পরে এই ধারার অসংখ্য গান আমরা তার গলায় সৃজিত হতে দেখে থাকব, লক্ষণীয় যে এই কিসিমের গানেও জব্বার বল্গাহারা আক্রোশ-ক্রোধ অদ্ভুত কিমিয়ায় কেমন যেন শমিত করে এনেছেন! রয়েছে একটা আলতো অভিমানের আঁচড় তার গলায়। এবং রয়েছে এক প্রগাঢ় প্রণয়ের ক্ষতসৌরভ। মনে হয় যেন অতল-ভূতলপ্লাবী বিরহজর্জর এক প্রেমিকের সমাহিত হাহাকারের চিরকালিক আর্তি চিরনবীনা বাংলার অরণ্যজংলায় আদিম আচ্ছন্নতায় ছেয়ে ফেলতে চাইছে জব্বারকণ্ঠোৎসারিত হয়ে।

যে-দুইটা গানের স্মরণে আমরা আব্দুল জব্বারের প্রয়াণদিনে এই নিবন্ধানুষ্ঠানে ব্যাপৃত হয়েছি, কিন্তু এই দুইটার বাইরে শিল্পীর আরও গান রয়েছে যেগুলো খোদ এই নিবন্ধকারের অল্পশোনা গানকর্ণেও গুঞ্জরিত সবসময়, নিশ্চয় আমরা বাংলাদেশে এই গানজোড়া না-শুনে ক্লেইম করতে পারব না কাটায়ে এসেছি বিপুলা গানের যৌবন। না, আমরা এমনটা দাবি করার মতো উদ্ভট উন্নাসিক কেউই হব না, আব্দুল জব্বারের গান শুনে বেড়ে উঠেছি আমরা বাংলাদেশ টেলিভিশনের দৌত্যে; যেমন শুনেছি আজম খান বা মাকসুদ ও জেমসের গান প্রেমে-ব্যর্থ জবুথবু পর্যুদস্ত হয়ে, একই ইমোশন নিয়া আব্দুল জব্বার বা সৈয়দ আব্দুল হাদী কি সুবীর নন্দী শুনেছি টিভিসংগীতানুষ্ঠানে এবং চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে বা বাংলাদেশ বেতারের সকালবেলাকার ঝিলিমিলি কিংবা রাত্রিনিশীথের দারাপুত্রপরিবার অনুরোধের আসরে। দেড়শ-দুইশ নয়, একজন শিল্পীর পরিচয় এক/দুইটা গানেই চিরস্থায়ী ছাপ রাখিয়া যায় একেক প্রজন্মের কাছে। এই ইম্প্রেশন অবশ্য প্রজন্ম-টু-প্রজন্ম ভ্যেরি করে, এক প্রজন্মের যদি ভালো লাগে ‘হে পৃথিবী আমার প্রশ্ন শোনো’ তবে আরেক প্রজন্মের লাগে ‘একবুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি’; এই প্রজন্মের ভালো লাগে হয়তো ‘তোমরা যাদের মানুষ বলো না’, আর-প্রজন্মের লাগে ‘হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে’ ইত্যাদি, এইটা স্বাভাবিক। তবে এমন কিছু গান থাকে অ্যাট-লিস্ট গ্রেইট শিল্পীদের যে-গানগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একই আবেগের উদ্বেলনে বাহিত হয়ে থাকে। এমন দুইটা গানের কণ্ঠজনয়িতা আব্দুল জব্বার।

https://soundcloud.com/user-369064280/tara-bhora-raate-by-abdul-jabbar

“তারাভরা রাতে তোমার কথা যে মনে পড়ে বেদনায় / এই আলোছায়াভরা মায়াঝরা জোছনায় / আমি একা জাগি, নেই তুমি কাছে হায়” … এই একটা গান আমাদেরে গ্রস্ত করে রেখে দিলো কোন-সেই পৌরাণিক কাল থেকেই যেন! ঘোর আজও অন্তর্হিত হলো না। আজও ঘনঘোর এর আবহে, এর গভীর সুষমায়, যেন প্রথম প্রণয়ের ন্যায় ব্যাখ্যাতীত অপার হইয়া আছি বসে, কিন্তু দয়াময়ের কাছে পারে যাইবার মিনতি নাই। “সেই বনতল চেয়ে দেখো আজ ছেয়ে গেছে ঝরাফুলে / ঐ রাতজাগা পাখি সাথী খুঁজে ডেকে যায়” … এইসব পঙক্তি আছে সেই আশ্চর্য ঘন গমগমে ঘোরের গানটায়।  গীতিকার আজিজুর রহমান, সিক্সটিজের একদম গোড়ার দিককার গান, সুরকার মুসলেহউদ্দিন সম্ভবত। সবেধন নীলমণি বিটিভিতে দেখে দেখে শুনে শুনে এই গান উঠেছে আমাদের গলায়। প্রেমেও পুষ্টি দিয়েছে। প্রেম ভেঙে যাবার পরে ব্যবস্থিত ও পুনর্বাসিত হতে হেল্প করেছে এই গান আমাদেরে। এবং কী জব্বর গেয়েছেন গানটা আব্দুল জব্বার! মন্দ্রকণ্ঠ তো দুনিয়ায় ম্যালা মানুষেরই আছে, কিন্তু জব্বারের কণ্ঠ ফোকরেফাঁকে চেরাই কাঠের ন্যায় চিরে বেরোনো স্বরপুঞ্জ, জব্বারের ঘোরঘনতা লা-জওয়াব! ‘তারাভরা রাতে’ শুনতে যেয়ে মনে হয় যেন পুকুরের বাঁশঝাড়ছাওয়া পানির থির বনাচ্ছন্ন সবুজ-অন্ধকার গভীর থেকে এই স্বরপঙ্খি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এই মনে-হওয়াটা পাল্টালো না বার্ধক্যে এসেও। জব্বারের এই গানের ইম্প্যাক্ট প্রিয়জনহারাদের কাছে এক, বিশেষভাবে মাতৃহারা যারা তাদের কাছে, আর প্রিয়জন নিয়া ধারাবাহিক আনন্দযজ্ঞে থাকাদের কাছে আরেক।

আরেকটা গানের কথা আমরা আলাপ করতে চেয়েছিলাম, সেইটা ‘সারেং বউ’ ম্যুভিতে দেখেছি আমরা বারবার বহুবার, ওই বিটিভিসুবাদে, এবং এই গানের শোকরগোজার না-করেই পৃথ্বীধাম হইতে বিদায় নিবেন আপনে, এমন হবার উপায় অল্পই অতীব। “ওরে নীল দরিয়া / আমায় দেরে দে ছাড়িয়া / বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায় রে / কান্দে রইয়া রইয়া” … আশ্চর্য এই সেই গান! জব্বারের আদি ও আস্লি চিজ্! পয়লাবার দেখার সময় এইটা আমরা ফারুক-কবরীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলিয়াই ভাবিয়া রাখিয়াছিলাম। অনেক পরে প্লেব্যাক ইত্যাদি হৃদয়ঙ্গম করি, আব্দুল জব্বার নামটা জানতে পারি। “কাছের মানুষ দূরে থুইয়া / মরি আমি ধড়ফড়াইয়া / দারুণ জ্বালা দিবানিশি” … কী জিনিশ! গলায় কী ছমছমে এক অচেনা এক্সটেইসি! পিকচারাইজেশনের বিশ্বেতিহাসে এই গানের কোরিয়োগ্র্যাফি শীর্ষস্থানের ধারকাছ দিয়া থাকবে বলিয়া আস্থা রাখি। “ওরে সাম্পানের নাইয়া / আমায় দে রে দে ভিড়াইয়া / বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায় রে / কান্দে রইয়া রইয়া” … তারপরে এই লাইনগুলো বুকে ভ্যাঁপসা শ্বাসরোধী সিচ্যুয়েশন তৈয়ার করিয়া যায়, “হইয়া আমি দেশান্তরী / দেশবিদেশে ভিড়াই তরী রে / নোঙর ফেলি ঘাটে-ঘাটে বন্দরে-বন্দরে / আমার মনের নোঙর পইড়া আছে হায় রে / সারেঙবাড়ির ঘরে” … এই গানটায় দমিত যৌনতার ক্রন্দন যতটা সাফল্যের সঙ্গে এসেছে, এর লিরিকে এর ম্যুভিপিকচারের মন্তাজে, এবং সর্বোপরি এর গাওয়ায়, রেন্ডিশনে, আব্দুল জব্বারের অননুকরণীয় শৈলীর গায়নে, এক-কথায় এর জুড়ি বিশ্বের কোথাও নাই।

“এই-না পথ ধইরা / আমি কত-না গেছি চইলা” … সারেঙের এই স্মৃতিঝিলিমিলি সখেদ উচ্চারণ যার কণ্ঠস্ফূরিত, মহাত্মা আব্দুল জব্বার যার নাম, তিনি বাংলা গানের পথেপ্রান্তরে থেকে যাবেন অনেক অনেক দিনরাত, থেকে যাবেন হাজার বছর ধরে হেঁটে চলা সেই সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর হয়ে বাংলায় ফেরত-আসা ভ্রামণিক কবিটির মতো। “কোথায় চলার শেষ, কত দূরে / ক্লান্ত চরণ শুধু প্রশ্ন করে” … এইবার চরণ জুড়াক। “দুঃখ কোরো না বন্ধু তোমরা যদি না পারি / আগেকার সেই সুরে সুরে গাইতে আমার গান / প্রশ্ন কোরো না হৃদয় জুড়ে এ-কোন অভিমান” … না, কোনো দুঃখ নাই, অভিযোগ নাই, যা পেয়েছি যতটা পেয়েছি তুলনা তার নাই। বিদায়, না, বাংলা গান আব্দুল জব্বারকে তার হাজার বছরের হ্যল্-অফ-ফেইমে এবার স্বাগত জানায়।

শ্রদ্ধার্ঘপ্রণেতা : মিল্টন মৃধা 

… …

মিল্টন মৃধা
Latest posts by মিল্টন মৃধা (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you