চন্দ্রাবতীকথা

চন্দ্রাবতীকথা

মাটিতে পায়ের কাছে বসেছি ধুলোর মতো আমি
পৃথিবীকে চুমো খায় গানে গানে আমার বোকামি

ইনি সেই চন্দ্রাবতী নন, রামায়ণ রচিয়া যিনি বিখ্যাত হয়েছেন বাংলায়, ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ নামেই কিতাবখানি বিখ্যাত আজি, নিখিল বঙ্গে প্রথম মৌলিক ‘মহিলা-কবি’ হিশেবে স্বীকৃত হয়েছেন যিনি পরবর্তীকালে, মৈমনসিং অঞ্চলে এই কবির জন্ম ও সমাধি, শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন তার ‘পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা’ অ্যান্থোলোজিটিতে এই কবিপ্রতিভার বিশদ পরিচয় দিয়েছেন, পয়ারে এই পাখিপঙক্তিগুলো পুস্তিকা ফর্মে পয়লা ছাপা হয় ১৯৩২ সন নাগাদ, সঙ্গে দীনেশচন্দ্রের প্রাসঙ্গিক পাঠ-পাঠান্তরও পয়লা সেখানেই দৃষ্ট। সম্ভবত হুমায়ুন আজাদের কোনো-এক কবিতাবইয়ের উৎসর্জনপৃষ্ঠায় এই মহান কবির নামের আগে একটি বিশেষণ যোজিত হতে দেখব আমরা পয়লাবারের মতো, অসম্ভব উদ্ভাসনের এই বিশেষণব্যবহার আমরা আরেকবার এইখানে স্মরণ করব, ‘সন্ত’, হুমায়ুন আজাদ ‘সন্ত চন্দ্রাবতী’ সম্বোধনে ডেডিকেইট করেছিলেন সেই বই। ইয়াদ নাই বইটার নাম। যা-হোক। এই গল্পে এতটুকু ভূমিকা আপাতত।

অনেক পরের নতুন সময়ে এক চন্দ্রাবতীকে দেখেছি আমরা, আমাদেরই জীবৎকালে, গানের সন্ত যিনি, তিরাশি বছর আয়ুর ভিতরে এই চন্দ্রাবতী জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মোটামুটি সত্তর বছর বলা চলে একটানা গানে মগ্নচৈতন্য রয়ে গিয়েছেন, ঘরোয়া আসরেই ছিল তার উড়াল মূলত, মঞ্চে বেশ গাইলেও স্টুডিয়োরেকর্ডে যান নাই সেভাবে, এই কিসিমে একটানা এত বছর গানের সঙ্গ করে যাওয়া পাইকারি কি খুচরা গানবণিকের কারবার না, আধুনিক করতালিতৃষ্ণ সংগীতনক্ষত্ররাজির নিরুদ্যম নখরামি দিয়া আমাদের এই গানসন্ত চন্দ্রাবতীকে মেহসুস করা যাবে না। গানের দমেই তিনি নিঃশ্বাস নিয়েছেন নিত্য। সত্তর বছর একটানা গানে একনিষ্ঠ। লোকসংগীতের চিরায়ত সঞ্চিতার এক সত্য সন্ত তিনি। সিলেটের গানসাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে গত ছয়/সাত দশক ধরে একআধটুকু সংশ্রব ছিল যাদের, তারা তাকে জেনেছেন নানাবিধ সূত্রে। কেবল পুরাতনী লোকবাংলা গানবাজনার আকর বললে সেভাবে এই সন্তকে চেনানো যাবে না, লাইফস্টেটমেন্ট এবং লিভিং দিয়েই ইনি মিউজিক-সেইন্ট। সংগীতসন্ত। ধুমধাড়াক্কা বাংলাদেশী ফিউশনপ্রমত্তা গানবাণিজ্যস্রোতে একজনই তিনি সন্ত চন্দ্রাবতী। ঠিক যেমন আরেকজন, বহু বহু আগের কালের, মনসাদেবীর ভাসানগায়ক কবি বংশীদাস ভট্টাচার্য্যদুহিতা রামায়ণকার কবি চন্দ্রাবতী, ‘মলুয়া’ পালাকার কবি চন্দ্রাবতী, দীনেশচন্দ্র সেন যাকে ‘বিখ্যাত মহিলা-কবি’ হিশেবে বেঙ্গলকে চেনায়েছেন তার গীতিকাসংগ্রহে, যে-কবি পালাশৈলীতে রচেছেন সংস্কৃত-অগ্রাহ্য-করা প্রাকৃতজনের সোজাসাপ্টা বাংলা রামায়ণ। পথিকৃৎ কবি তিনি, সন্ত চন্দ্রাবতী।

যিনি এই নিবন্ধাখ্যায়িকার কেন্দ্রচরিত্র, সন্ত সম্বোধন করছি আমরা যারে এইখানে, পূর্ণনামে তিনি চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ। তার সারাজীবনের সাধনা, সাধারণ্যে একাগ্র ভজনা, গানাবাজানা প্রভৃতি নিয়া আমরা এই নিবন্ধে এক্ষণে কথা পাড়ব না। আমরা তাকে শুধু স্মরণ করব। ভণিতাবিহীন স্মরণ করব শুধু। অতঃপর ক্ষান্ত হব। স্মরণ করব আমরা তার আশ্চর্য সান্নিধ্য। স্মরণ করব আমরা তার পাখির পাখনার মতো পলকা আর পর্বতছায়ার মতো সুস্থায়ী ইম্প্রেশন-রেখে-যাওয়া সাহচর্য শুধু। সুরেলা সান্নিধ্য। সংগীতের সাহচর্য। দূর থেকে কেউ, অথবা কাছে থেকে, চন্দ্রাবতীকিরণ পেয়েছে এই অঞ্চলে লাস্ট চার দশকে বেড়ে-ওঠা গানানুরাগী বিভিন্ন প্রজন্ম। শুধু স্মরণ করব আমরা এই তথ্যকণিকাটুকু।

সুমন সম্ভবত সেকন্ড টাইম বাংলাদেশট্যুরে এসে, সেইটা নাইন্টিজের শেষপাদের ঘটনা, দেখা পেয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামালের। একটা গান লিখেছিলেন ফিরে যেয়ে, তখনও কবীর সুমন হন নাই তিনি, ছিলেন তখনও পৈতৃক পদবীধারী, সেই সুমন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘সুফিয়া কামাল’ শীর্ষক অদ্ভুত আবেগের ভারী স্নিগ্ধ ও মধুর লিরিকের এক গান, যেখানে ছিল “ওই তো লক্ষ ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি দামাল / সবুজ দ্বীপের মতো মাঝখানে সুফিয়া কামাল”, এই গানেই মিলবে একজায়গায় এই লাইনদ্বয় —  “মাটিতে পায়ের কাছে বসেছি ধুলোর মতো আমি / পৃথিবীকে চুমো খায় গানে গানে আমার বোকামি”, সিলেটের সর্বত্র ও সর্বজনে একনিঃশ্বাসে মাসিমা ডাকেই যিনি জীবন গুজরিয়ে গেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্মান্তরের ভিড়বাট্টায় হাসিস্মিত প্রশ্রয় বিলিয়ে, তারা জানবেন, সুমনের গানে এই দুইলাইনের যাথার্থ্য সম্যক টের পেয়েছেন তারাই প্রকৃত। “বোকারাই ভালোবাসে গান বাঁধে গান গেয়ে মরে / এবার মরলে আমি জন্মাব আপনার ঘরে”, এই পঙক্তিনিচয় ছিল সুমনের সেই গানে যেনবা ক্লাইমেক্সের অন্তে ক্যাথার্সিস। চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ তথা মাসিমার আঁচলসংলগ্ন হয়েছেন যারা, ব্যস্তত্রস্ত উড়াতাড়ার দৈনন্দিনে বেশি-একটা সাক্ষাৎ-মুলাকাৎ হয়েছেও বলা যাবে না, কালেভদ্রে একআধবার হয়েছে হয়তোবা, তাদের কাছে এই গানপঙক্তির ইনার মিনিং নিয়া আকালের অনুসন্ধিৎসা চালাইবার জরুরৎ আপাতত অদরকার।

চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ “সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর chandrabati roy bormonবাবা সহদেব বর্মণ, মা মুক্তারানি বর্মণ। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি সকলের বড়। তেরো বছর বয়সে সরকারি কর্মকর্তা ভারতচন্দ্র রায়বর্মণের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বৈবাহিক সূত্রে সিলেট শহরে আসা। সেই থেকে এ শহরেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু। পিতার বাড়িতে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত এবং স্বামীর বাড়িতে এসে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে রেডিও পাকিস্তানের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তাঁর গান গাওয়া শুরু। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ টেলিভিশনে লোকসংগীত পরিবেশন করেন।”  তথ্যপুঞ্জ গ্রহণ করছি একটা দারুণ সুন্দর একফর্মা পুস্তিকা থেকে। এই পুস্তিকাটি সিলেট থেকে ছেপে বের করেছে ‘একুশে বাংলা’ পাব্লিশার, চন্দ্রাবতীপ্রয়াণের অব্যবহিত পরের বছরে, ২০১৫ সনে। এত অনবদ্য গল্পচ্ছলে লৌকিক-লোকায়তিক বাংলা গানের আকর উঠে এসেছে এই ইন্টার্ভিয়্যুভিত্তিক পুস্তিকায়, সুমনকুমার দাশের সঞ্চালনোদযোগ ও গ্রন্থনায়, এই পুস্তিকাটি বিরাট বপু না-হলেও গভীরগামী। ‘চন্দ্রাবতী রায়বর্মণের সঙ্গে’ শিরোনামে এই বই বিচিত্রস্রোতা আবহমান বাংলা গানের এক ঝর্ণাসানুদেশে নিয়ে যায় আমাদেরে।

এসব বড় কথা নয় যে একজন চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ জীবনে স্টেজে কেমন নৈপুণ্য দেখায়েছেন বা নানাবিধ গুণীজনার কাছ থেকে অ্যাক্লেইম পেয়েছেন কয়টা, বড় কথা হচ্ছে একজন চন্দ্রাবতী জীবনের সচেতন সত্তর বছর টানা গান গেয়েছেন সুরের সৌহার্দ্য ছড়ায়ে; এবং ‘খাতা দেখে’ নয় সেই গাওয়া, “খাতা দেখে গান গেও না / উল্টে পাতা যেতেও পারে / পাতাটাতা উল্টে গেলে / হোঁচট খাবে বারেবারে” — চন্দ্রাবতী জীবনে ক্লেশ সয়েছেন বহু, হোঁচট খেয়েছেন বহুবার নিশ্চয় জীবনেরই নিয়মে, গান গাইতে যেয়ে একবারও হোঁচট খাইতে দেখি নাই আমরা তারে। কেননা খাতা দেখে মেকানিক্যাল গাওয়ায় তাকে দেখা যায়নি কখনোই। হৃদয়স্থ ছিল তার গাওয়া গানসমস্ত।

চন্দ্রাবতী রায়বর্মণ মূলত রাধারমণের গান যথা-আদব মূলানুগ রেখে স্বকীয় গায়নধাঁচ ও দরদ যুক্ত করে গাইবার জন্যই বিশেষ কদর লভে গেছেন আমৃত্যু সমুজদারদের কাছে। যদিও অন্যান্য বহু ধারার লোকায়ত গান ও লুপ্তপ্রায় কৃষ্টিচিহ্নের ব্যাপারে তিনি ছিলেন জীবন্ত তথ্যসঞ্চিতার মতো; বহু পুরাতনী চিরায়ত লোকগানধারা সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পেরেছি আমরা তার কাছ থেকে। এইসবের নজির মিলবে সুমনকুমারের প্রোক্ত গ্রন্থনায়। চন্দ্রাবতীর শিল্পীজীবনের দর্শন ও তৎপরতা জানতে চাইলে এই ক্ষীণতনু পুস্তিকাটির জুড়ি আমরা আপাতত দেখছি না।

রায়বর্মণ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে পশ্চিমবঙ্গের সংগীতশিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ রেকর্ডসের অডিয়ো সংকলন থেকে। মৌসুমীর ফিল্ডওয়ার্কগুলো সংগীতভাবুকদের কাছে এরই মধ্যে রিলায়েবল রিসোর্স হয়ে উঠেছে। এই শিল্পী এবং তার টিম মিলে তাদের ওয়েবসাইটে যে-কাজগুলো করে চলেছেন, মূলত ইংরেজি ভাষামাধ্যমে, গোটা গানদুনিয়ার জন্য মুক্ত হাওয়াবাতাসের পরিসর তৈরি করে দেবার প্রতিশ্রুতি ইতোমধ্যে রেখেছে। চন্দ্রাবতীর অদ্ভুত পৌরাণিক ঘ্রাণের কণ্ঠ ও কথামালা আস্বাদন করতে চাইলে ট্র্যাভেলিং আর্কাইভ ওয়েবক্ষেত্রে আগ্রহীরা ঘুরাণ্টি দিয়া আসতে পারেন। এছাড়া ব্যক্তিগত সংগ্রহে অনেকেই চন্দ্রাবতীর কথা-গান-গল্প গ্রহণ, ধারণ ও নিশ্চয় সংরক্ষণ করে রেখেছেন; এইসবের ট্র্যান্সক্রিপ্টেড উপস্থাপন এবং সর্বজনের উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার এখন দরকার। এবং সুমনকুমার দাশের এই পুস্তিকা, ‘চন্দ্রাবতী রায়বর্মণের সঙ্গে’, গানের বা সাহিত্যের কোনো ওয়েবক্ষেত্রে আপ্লোড করিয়া রাখা গেলে ব্যাপারটা লোকহিতকর হতো।

মোদ্দা ব্যাপার হচ্ছে মায়া। ভালোবাসা নয়, প্রেম নয়, মায়া শুধু। মমতা। মাসিমা ডাকের এই শিল্পী জীবনভর এক মায়ার আবহ উনার চারপাশে রেখেছেন ছড়িয়ে। একান্তই সিলেট অঞ্চলে এই শব্দটা ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ইউজুয়্যাল কনোটেশনের বাইরে এক অসাধারণ দ্যোতনায়। প্রেম-ভালোবাসা-মমতামিশ্রিত এক অতুলনীয় পরিস্থিতি। আমাদের ঠাম্মা-দাদিমাদের মধ্যে এই মায়ার বাতাস আমরা পেয়েছি ইয়াদ হবে। চন্দ্রাবতীর সান্নিধ্যনৈকট্য থেকে একশতিরিশ গজ দূরে থেকেও যদি তার গান বা আলাপচারিতা শুনিয়া থাকেন, মনে হবে যেন আপনি স্বীয় জননী/পিতামাতামহীর ক্রোড়ের ওমে রয়েছেন। ঘুঘুপৈখের বুকের কবোষ্ণ ওম। প্রয়াত ম্যুভিনির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পর্কে মেমোরিচারণ করতে যেয়ে সুচিত্রা সেনের নাতনি রাইমা সেন যে-কথাগুলো বলেছিলেন, সেই কথাগুলো চন্দ্রাবতী মাসিমা সম্পর্কেও স্মর্তব্য। রাইমা বলেছিলেন, ঋতুদাকে কখনোই পুরুষ বা নারী নয়, এই দ্বিকোটিক দ্বিধা আমাদের মধ্যে খেলা করলেও ঋতুদার সান্নিধ্যে এলে কেবল মনে হতো নিজের ঠাকুমার ওমে আছি, ঠিক সেই ঘ্রাণ এবং সেই আলো তার ব্যক্তিত্বে। চন্দ্রাবতীর মধ্যেও তা-ই। ঠিক যেমন আমাদের মায়ের, মাতামহী-পিতামহীর, আমাদের মাতৃতুল্যা খালা-ফুপুদের মধ্যে।

কিছু মায়া তো রহিয়াই যায়, যেমন গল্পে কমলকুমারের তেমনি জীবনেও, আমাদের জীবনে মায়া রহিয়া যায় বলিয়াই আমরা জানি যে মৃত্যুতেই নিঃশেষ নয় কিচ্ছুটি, দৃঢ়ভাবে কেউ কেউ আঁকড়ে রেখে এই ধারণা পালনপোষণের মধ্য দিয়া বাড়াইয়া তুলি যে মৃত্যুর পরেই প্রকৃত বেঁচে ওঠা মানুষের। আমাদের অনেকের কাছেই স্মৃতিজীবন অনেক কার্যকর স্মৃতিবিনাশী রিয়্যালিটিবিকট ভবসংসারে। এই স্মৃতিবিজ্ঞানেরই ভিন্ন নাম গান। চন্দ্রাবতীর গানজীবন নদীর ন্যায় শেষহীন।

প্রতিবেদনপ্রণেতা : সুবিনয় ইসলাম 

… …

সুবিনয় ইসলাম
Latest posts by সুবিনয় ইসলাম (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you