মুক্তস্বরের মানুষ || সরোজ মোস্তফা

মুক্তস্বরের মানুষ || সরোজ মোস্তফা

তিনি কবি, গীতিকার, নাট্যকার, শিক্ষক এবং সংগঠক; তিনি মোহনগঞ্জের রইস মনরম। ভাটি-বাংলার মেলট্রেন ‘হাওর’ কিংবা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ থেকে নেমে স্টেশনের একটা শালিক পাখিকেও যদি জিজ্ঞেস করেন উনার নাম-সাকিন কিংবা কোন গলিতে আস্তানা, তাহলে ডানার পাখিও মনের আনন্দে লাফাতে লাফাতে উনার মাধুর্য-ছড়ানো আবাসে নিয়ে যাবে। বলছি, কংস-ধনু-ঘোড়াউৎরার পলিবিধৌত শিয়ালজানিপাড়ের মোহনগঞ্জ নামের ছোট্ট এই  ‘দ্বীপভূমি’ কবি অন্তরে যাপন করেন। কর্মে, কথায় এবং বন্ধনে কবিও হাওরপাড়ের সারলিক মানুষদের আত্মীয় করে নিয়েছেন। সময় ও সমাজকে স্বপ্ন দিয়ে, গান দিয়ে স্পর্শ করেন। কোনো কারুণ্য নয়, দুঃখের বলয় নয়; এই শহরে সুরের হারমোনিয়াম বাজিয়ে সবাইকে স্নিগ্ধ রাখেন। স্কুলশিক্ষক হয়ে সময় ও সমাজের ভেতরে তারুণিক পবিত্রতা ছড়ানোর মহৎ প্রতিজ্ঞা নিয়ে নিত্য হাঁটছেন। এই হাঁটাটায় শান্তি ও আনন্দের প্রতিজ্ঞা আছে, দায় আছে; আছে জীবনদৃষ্টি ও দার্শনিকতা। প্রজাপতির ফুল ফোটানোর মতো এ-এক নিশ্চুপ দায়িত্ব। বিখ্যাত হওয়ার বাসনায় কোনো নাগরিক জলসায় হারিয়ে যেতে চাননি; বরং প্রান্তে থেকে বাংলার লোকায়ত বোধ এবং ঐশ্বর্যকে মুক্তস্বর-এর মাধ্যমে কেন্দ্রে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।

উনার ঝোলার ভেতরে স্বপ্ন, উনার ঝোলার ভেতরে গান-কবিতা-নাটক কিংবা সবাইকে একত্রে মিলিয়ে দেয়ার সম্মিলনীপত্র। তিনি বিশ্বাস করেন, — বিভাজন নয়, মিলিয়ে দেয়ার সংস্কৃতিটাই বড়। মানুষে মানুষে মিলনের এই ধারণা থেকেই গড়ে তুলেছেন ‘মুক্তস্বর’।

‘মুক্তস্বর’ একটা পথ। তথাকথিত বিপ্লববাদী না হয়েও, ব্যানার নিয়ে রাস্তায় না দাঁড়িয়েও, কিংবা ফেইসবুকলাইভে আত্মপ্রচার না করেও সমাজকে বদলে দেয়া যায়। ‘মুক্তস্বর’ আক্ষরিক অর্থে বৃহতের মধ্যে পৌঁছানোর একটা আয়োজন; মানবজীবনকে চেনার প্রস্তুতি এবং অনুধ্যান।

‘মুক্তস্বর’ কখনোই দেখানোর সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করেনি; যাপন, ধারণ এবং চর্চায় নিরন্তর তারুণিক মানুষ হওয়ার চেষ্টাই করেছে ‘মুক্তস্বর’। ভাটি-বাংলার নির্জন পলিতে এ-এক আশ্চর্য দীপায়ন! গানে-নাটকে-কবিতায় এ-যেন মননির্মাণের পর্যাপ্ত সারস্বত-সংঘ। এই সংঘের বাতিটা দীর্ঘদিন তিনি জ্বালিয়ে রেখেছেন। রেখে যাচ্ছেন। সময়ের স্বপ্ন নিয়ে একেকটা জেনারেশন এসেছে; বাতিঘরের চারপাশে বসেছে। তারপর আলোর উত্তাপ মেখে দূরে চলে গেছেন সবাই। দূরে যাওয়া মানে বৃহতের কাছে নিজেকে চিনতে যাওয়া; মানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। বসে থাকাটা কখনোই কাম্য নয়। নিজেকে চেনার আরেক নাম ‘চরৈবেতি’।

স্থবিরতা নয়; চলার ধারণাই জীবন। ‘মুক্তস্বর’ চলার ধারণাকে যাপন করেই চারটা যুগ অতিক্রম করেছে। সেই নব্বই দশকে শুরু। কিন্তু কাজ ফুরিয়ে যায়নি; নিভে যায়নি বাতিঘর। উনি এবং উনারা বিশ্বাস করেন কেউ-না-কেউ এই ঘরের চাবি হাতে নেবেই। প্রতিদিন খোলা হবে এর তালা-দরজা-জানালা। অন্তরে সুরের রেওয়াজ হবে, আবৃত্তি হবে, নাটক হবে; শান্তি ও আনন্দের পরিসরে চেনা হবে যুক্তি-তর্কের সুন্দর পৃথিবী।

‘মুক্তস্বর’ একটা দায়িত্ব। এই দায়িত্ব নিয়ে উনি এই জনপদে দীর্ঘ সময় হাঁটছেন। বড় শহরের বড় সেলিব্রেটি হতে চাননি। অ্যাক্সিডেন্টে সার্জারির পর একটা পা ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু জীবনকে ছোট হতে দেননি। সেই ছোট পা নিয়ে নিজস্ব গতিতে হাওরপাড়ে বড় হওয়ার সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েছেন। স্বপ্নস্বচ্ছ চোখে তারুণ্যের গান রচনা করবেন বলেই তিনি হাঁটছেন। শহরের কয়েকটা জেনারেশন উনাকে তাই স্যার সম্বোধন করেন। বাংলার শিক্ষকের স্নিগ্ধ হাসি আর কথার ভেতরে অনেকেই খুঁজে পেয়েছেন স্বপ্নের মোহনা এবং জীবনের অনুভব।

‘মৌরাগ’ নামের কবির যে-আস্তানা কিংবা আশ্রম, সেখানে বিজনে তরুছায়াতলে অহঙ্কারহীন সদয়-সবুজ রেখা। প্রার্থীরা যে-যার মতো সবুজ নিয়ে ফেরেন। সেখানে, ঘাসে ঘাসে কোমলতা; সেখানে, নীল আঁখি সম স্বপ্ন, ভালোবাসা আর কবিতা ও সুরের পুনরাবৃত্তি। চারদিকে কবিতা ও গানের আয়োজনে ঠাসা এমন একটা আশ্রম কে কোথায় পাবেন! এখানে সহজ মনে হবে আলাপচারিতা, আড্ডা, উঠা-বসা, গান গাওয়া কিংবা কবিতা পাঠ। শুধু-পাঠ্যবই-সম্বল জীবনের বদলে শিক্ষার্থীর জন্য এখানে জাগ্রত রয়েছে কবিপরিবৃত বৃহত্তর সহজ জীবন। জীবন শুধু সার্টিফিকেটের ধারণা নয়; রোদ্দুরে-বৃষ্টিতে মিলিয়ে থাকার অনন্ত প্রস্তুতিই জীবন। গন্ধরাজফুলের মায়ায় এখানে দিকে দিকে সুরের শৃঙ্খলা।

সার্টিফিকেটে কবির নাম মো. রইস উদ্দীন। কবির বাবার নাম আব্দুল মন্নাফ এবং মায়ের নাম রমচান্দ বানু। বাবার নাম থকে মন আর মায়ের নাম থেকে রম মিলিয়ে হলেন মনরম। জীবননির্মিতি এই আশ্রমের নাম ‘মৌরাগ’। কবির কন্যার নাম মৌমি এবং ছেলে পরাগ। দুই সন্তানের নাম যুক্ত করে করেছেন ‘মৌরাগ’।  এই আশ্রমের সংসারফোয়ারাকে সচল রাখেন কবিপত্নী ফাতেমা পারভীন। শিক্ষার্থী এবং অনুসারী ছাড়াও আশ্রমে দীর্ঘ পথের ক্লান্তি নিয়ে আগন্তুকেরা আসেন; যত্নে, আপ্যায়নে, সামাজিকতায় কবিপত্নী সবারই খেয়াল রাখেন। মুক্তস্বরকে সচল রাখার তিনি এক নিভৃতকর্মী। কবিভবনের কোথাও দুর্বোধ্যতা নেই; সর্বত্র সুর এবং সুবোধ্যতার জলপ্রপাত।

যদি মরে যাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।
যে-ফুলের নেই কোনো ফল
যে-ফুলের গন্ধই সম্বল
যে-গন্ধের আয়ু একদিন
উতরোল রাত্রিতে বিলীন।

যেই রাত্রি তোমার দখলে
আমার সর্বস্ব দিয়ে জ্বলে।
আমার সত্তাকে করে ছাই
ফুল হয়ে যেন ঝরে যাই।

কবি অরুণকুমার সরকারের কবিতার এই অন্তরস্পর্শী কথাগুলোই যেন কবি রইস মনরমের দৃষ্টি ও জীবনাকাঙ্ক্ষা। মোহনগঞ্জের কাজিয়াটি গ্রামে ২৪ জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণের পর থেকে নিজের সত্তাকে অপরের তরে সমর্পণ করাই ছিল তাঁর অভিযাত্রা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পাঠ সমাপনান্তে শিক্ষকতা শুধু জীবিকা ছিল না; ছিল মানুষকে ধারণ এবং বোঝার অবলম্বন।

জাতীয় দৈনিকগুলোর শিশুকিশোর এবং সাহিত্য পাতায় রইসউদ্দীন নামে একসময় নিয়মিত ছড়া এবং কবিতা লিখতেন। সত্তরের দশকের পুরোটা সময় ময়মনসিংহের সকল সাহিত্যান্দোলনে যুক্ত ছিলেন। সে-সময় ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক তকবীর  এবং বাংলার চাষী  পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন লিটলম্যাগ এবং ভাঁজপত্র। কবির উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত রচনাগুলো হচ্ছে — ‘নীলকণ্ঠ নীলে’(কাব্যগ্রন্থ), ‘বাংলা ভাষা স্বপ্ন আশা’ (ছড়াগ্রন্থ), ‘ফুল ফোটার পালা, ‘সুজন শোভার পালা’ (নৃত্যনাট্য), ধাক্কা (কাব্যনাটিকা), ‘শিকড় ও ঘোলা জলে বেহুলার লাশ’ (নাটক), ‘জ্বীনের বাদশা’ (কাজী নজরুল ইসলামের রচনার নাট্যরূপ), শৈলজারঞ্জন মজুমদারের স্মৃতিতে গীতিকা ইত্যাদি।

মুক্তস্বর-এর সাংগঠনিক সম্মিলনকে তিনি মৌরাগে এনেছেন কিংবা মৌরাগের শান্তি ও আনন্দকে মুক্তস্বরের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন। জীবনযাপনে ঘর এবং বাহির সর্বত্র একই রকম থেকেছেন কবি রইস মনরম।

জীবনে ভুল থাকে; সেই ভুলে কাঞ্চনও থাকে। সারাজীবন ধরে কবি কাঞ্চনই ফোটাতে চেয়েছেন। তাঁর সাহিত্যসাধনায় অলীকতা নেই; আছে একটা নিপাট আদর্শঘটিত কর্মোদ্যম। হাওরাঞ্চলের প্রান্তিক সংস্কৃতিকে তিনি বৃহৎ বাংলায় যুক্ত করে দিয়েছেন। জগৎ-পারাবারের গুচ্ছগুচ্ছ সুর ও কথায় তারুণ্যকে পরিপূর্ণ করতে চেয়েছেন। ‘মুক্তস্বর’ মানুষ ও মানবিকতা যাপনের একটা প্রতিষ্ঠান। কবিতা বা গানের মুখোমুখি হয়ে, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাছাকাছি এসে জীবনের সত্যরূপটা জানা এবং বোঝাই মুক্তস্বর-এর পথ-পরিক্রমা।

সুরে স্নাত হলে তারুণিক মন শুদ্ধ থাকে, সেই মনে পাপ এবং অপবিত্রতা প্রবেশ করে না। মুক্তস্বর-এর চাবিটা এখন উনার হাতে। সত্তরে উপনীত হয়ে তিনি জানেন,  এই চাবি বেশি দিন বহন করতে পারবেন না। তিনি চলে গেলে উত্তরাধিকারেরা কেউ না কেউ বহন করবে মুক্তস্বর-এর চাবি। একটা চাবির পরম্পরা থাকে। সেই পরম্পরায় এগিয়ে আসবে নবীন কোনো আলোক কিংবা জাহানের মতো তরুণ কেউ। কেননা, স্বপ্ন এবং দর্শনকে তরুণেরাই বাঁচিয়ে রাখে।

দীর্ঘজীবনের সাহিত্যসাধনায় নানান পরিচয়ের মধ্যে গীতিকার পরিচয়ের রইস মনরমই শক্তিমান। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা দুইহাজারেরও বেশি। জীবনে সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন মঞ্চের সম্মান। কিন্তু আরিফুন নাহার আরিফার সুরে একজন আলোক কিংবা একজন জাহানের কণ্ঠে তাঁর কথাগুলো যখন পবিত্রতা ছড়াতে থাকে তখন শান্তিতে শিহরিত হয় উনার মন। কথা ও সুরের সেই শিহরিত শান্তির কাছেই নিজেকে সমর্পিত রেখেছেন কবি রইস মনরম। আসুন পাঠক, কবির একটি গীতিকবিতা পাঠ করি :

বাতাসের হাত ধরে গাছের পাতা নড়ে
সবুজ টিয়ে উড়াল দিয়ে কই লুকিয়ে পড়ে?

দিন চলে যায়, রাত বেড়ে যায়, ঘুম আসে না।
স্বপ্নদীঘির জলে পদ্ম হাসে না।
পদ্ম হাসে না রে জল শুকিয়ে মরে।
সবুজ টিয়ে উড়াল দিয়ে কই লুকিয়ে পড়ে …

মেঘ উড়ে যায়, বন পুড়ে যায়,বৃষ্টি ঝরে না।

আমারে কী তোমার মনে পড়ে না!
মনে পড়ে না রে মন শুকিয়ে মরে।
সবুজ টিয়ে উড়াল দিয়ে কই লুকিয়ে পড়ে …


রইস মনরম প্রণীত ও প্রকাশিত গ্রন্থনাম
*ও ময়ূর (কাব্য, ২০০৮);
*ফুল পাখি জোনাকি (শিশুকিশোর ছড়াকবিতা, ২০০৮)
*ভালোবাসার এই বৃষ্টি (কাব্য, ২০১৬)
*মেঘের কঙ্কাল (কাব্য, ২০১৬)


গানপারে সরোজ মোস্তফার লেখাপত্র

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you