মনোবিধুর ডকু || আহমদ মিনহাজ

মনোবিধুর ডকু || আহমদ মিনহাজ

বহু দিন পর একটা মনোবিধুর ডকু দেখলাম। পৃথিবী বিচিত্র আর মানুষগুলোও তা-ই। ডকুটা যাকে নিয়ে তৈরি সেই কে. সি পাল নামের সরল অভাজন মানুষটি আজো বিশ্বাস করেন পৃথিবী মোটের ওপর স্থিতিশীল সেই কেন্দ্র যাকে ঘিরে রবি মহারাজ  ফি-বছর একবার করে একপাক ঘুরান দিয়ে আসেন। রবি মহারাজের এই বাৎসরিক চংক্রমণের প্রভাবে পৃথিবীর ঋতুবৈচিত্র্য সহ নানা ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। ওদিকে পৃথিবী মহাশয় নিজ অক্ষে ঘুরান দেন বলে দিনরাত্তির হয়, যদিও রবির প্রবল টানের চাপ সত্ত্বেও তিনি তাকে ভুলেও প্রদক্ষিণ করার কথা ভাবেন না। রবি অগত্যা কে. সি পালের অভিধানে রবিগ্রহ  বৈ দ্বিতীয় কিছু নয়। মহাভারতে যেমনটি তাকে সম্বোধন করা হয়েছিল একদিন। অ্যারিস্টটল, তাঁর মতে আংশিক সঠিক, যেহেতু তিনি সেকালে পৃথিবীকে গ্রহব্যবস্থার কেন্দ্র ভাবতে পেরেছিলেন। তবে পৃথিবীও যে নিজ অক্ষ বরাবর ঘুরান দেয়, এই ভাবনা গ্রিক মনীষার দিমাগে আসে নাই। ওদিকে কোপার্নিকাস আর গ্যালিলিও তাঁর বিচারে আংশিক ভুল। নিজেদের থিয়োরিতে রবিকে উনারা গ্রহব্যবস্থার কেন্দ্র করেছেন, যদিও সে নিছক গ্রহ মাত্র; — গতিশীল এবং সেটা ওই পৃথিবীর চারপাশ দিয়ে বছরে একবার ঘুরান দেওয়ার ফাঁদে বন্দি বলে।

হাওড়াবাসী সরল অভাজনের থিয়োরির সত্য-মিথ্যা, ঠিক-বেঠিক, সংগতি-অসংগতি বিজ্ঞানের ছকে শেষতক অবান্তর হলেও এ-রকম আরো বহু থিয়োরির মতো এই থিয়োরিও না-হয় মহাকালের জিম্মায় আপাতত তোলা থাকল! নাসাকে পত্র লেখার পর ওরা তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন, — নিউটনের থিয়োরির ওপর ভর করে মহাকাশে রকেট ছাড়তে তারা যেহেতু অসুবিধা বোধ করছেন না, আপাতত পৃথিবী ও রবি মহারাজকে ঘিরে নতুন বিবাদে না-হয় নাই-বা যাওয়া গেল। নাসাকুলের বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীকে  অগত্যা তাঁর কাছে ‘গাধা’ বলেই মনে হয়েছে। ওদের জবাবে আহত হলেও পালবাবুর লেগে থাকার দম আর রাতদিন একাকার করে পাবলিকের সঙ্গে নিজের বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণের প্রাণান্ত কসরতকে তুলে আনা এই ডকুর প্রাণভোমরা।  হয়তো পাগলামি। বহুল স্বীকৃত বা প্রতিষ্ঠিত থিয়োরিছকে লোকে ভ্রান্তি ও ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব খুঁজে পায়। হাওড়াবাসী মানুষটি হয়তো সেই ফেরে নিজ দাবির যুক্তি-তক্কোর ঝাঁপি নিয়ে কলকাতার রাস্তাঘাট চষে বেড়ান! দেয়ালে রঙ দিয়ে নিজের দাবিটাকে লেখেন। রাত জেগে কাগজে নিজের বক্তব্য সাজান। আঠা দিয়ে পুস্তিকায় কাগজগুলা জোড়েন আর সস্তাদরে সেটি বিলিও করেন। পাবলিক তামাশায় মাতে। রঙ্গ থেকে তিরস্কার সকলই জোটে কপালে। অপমান, খিস্তির সবটাই কলকাতার রাস্তায় নিজের দাবি ফেরি করা লোকটির জীবনে প্রতিদিনের ঘটনা। তাঁর তখন গ্যালিলিওর কথা মনে পড়ে। ব্রুনোকে মনে পড়ে। ওঁরাও তো একদিন ঘোর ধর্মগ্রস্ততার যুগে নতুন কথা বলতে গিয়ে লোকের সংস্কারে ঘা দিয়ে বসেছিল। ডকুনির্মাতা সেই দিকটায় আলো ফেলেছেন এবং সে-কারণে নমস্কার প্রাপ্য বটে।

বিজ্ঞানের ভাবুকতা বা তার ডিসিপ্লিনের ধারা বিচারে এই ব্রাত্য-অভাজনের খ্যাপামির মাঝে সারল্য ও অজ্ঞতা দুটোই সমানে বিরাজ করে; তথাপি নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে কলকাতা শহরের রাস্তা বা ফুটপাত, ট্রেন-ট্রাম-বাস থেকে কলেজস্ট্রিট আর ময়দানে ঘুরপাক খাওয়া একরোখামি দেখতে বসে সকল সত্য-মিথ্যা, ঠিক-বেঠিক তুচ্ছ মনে হতে থাকে। গঙ্গার ঘাটে বসে পোপ ফ্রান্সিসকে পত্র লেখার পাগলামিটা তাই বেশ মনে ধরে। পঁচাত্তর সাল থেকে কে.সি পালের ‘জিওসেন্ট্রিক’ শোম্যানশিপটা কলকাতা শহরের অযুত সব নাটকীয় ড্রামা-মেলোড্রামা-থ্রিল-সাসপেন্সকে তুচ্ছ করে আজোবধি সগৌরবে চলছে। ডকুটা এই জায়গায় পৌঁছানোর কারণে বিশেষ হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে কে.সি পাল দ্রষ্টব্য ঘটনায় মনে রস এবং ভাব দুটোই জাগান বটে! ‘লাগে রহো গুরু’ — এই কথাখানের নেপথ্যে যত রঙ্গ, বিষাদ, কৌতুক, যতেক দম, স্থৈর্য কিংবা ছিটগ্রস্ত ঘোর, বোদলেয়ারের সেই কিছু একটা নিয়ে সারাক্ষণ মাতাল হয়ে থাকার অমৃতবচন, অথবা গাঢ় কোনো মুহূর্তিক বিষাদ … এর সবটাই কে.সি পালের জন্য তোলা থাকে!  সাধারণের মধ্যে বিশেষ ও ব্যতিক্রম হওয়ার এই দমটা হচ্ছে আসল ঘটনা, যেটি হয়তো ভবিষ্যতে এভাবে আর দেখার ভাগ্য লোকের কপালে না জোটার সম্ভাবনাই অধিক।

দ্রষ্টব্য : ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলা ফের দেখতে মন চাইছিল। সঙ্গে  কমলেশ্বর মুখার্জির হাতে তৈয়ার ঋত্বিকের বায়োপিকটা দেখার মুহূর্তে এই ‘জিওসেন্ট্রিক’ অভিজ্ঞতাটা হলো। লিঙ্ক দিয়ে রাখলাম। সময়-সুযোগে পারলে দেখে নিয়েন।

‘জিওসেন্ট্রিক ম্যান’ ট্রেইলার
জিওসেন্ট্রিক ম্যান’ লিঙ্ক


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you