ছোট থেকে বড় হওয়ার পরিক্রমায় আমরা নানাভাবে পালিত হই। আমাদের সংসারে অনেকেই থাকেন যারা মায়ের মতনই ভালোবাসেন, আদর-যত্ন করেন, আবদার রাখেন, অনেকটা মায়ের মতন। কিন্তু মনখারাপের সময়গুলোতে তারা অনেকটাই গুরুত্বহীন, তখন আমার মাকেই চাই। মা একটা ধারণা, যেখানে সকল ব্যথা আদরের পরশ পায়। মা একটি বাসস্থান যেখানে দজ্জ্বাল পৃথিবী থেকে মুখ লুকিয়ে বাঁচা যায়।
একযুগেরও বেশি মা আমাদের মাঝে নেই। দীর্ঘ সময়ে একটা লাইনও মাকে নিয়ে লিখতে পারিনি। লিখতে গেলেই চোখ ঝাপসা হয়, কিছুই দেখি না। বর্ণগুলো মায়ের চেহারার রূপ নেয়। আমার হাতেখড়ি যে মায়েরই হাতে!
যে-কোনো বিয়োগই বেদনার। জাহেদের লেখায় পড়েছিলাম — মা আদতে একটা ধারণা বা কনসেপ্ট/আইডিয়ার নাম; যার চলে যায় সে আরও পাকাপোক্ত তারে পায়, সার্বক্ষণিক। এই ধারণা ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। আমাদের মায়েরা যায় না কোথাও, সংসারেই থাকে। … বিদেশ বিভূঁইয়ে কত নতুনের সাথে দেখা, কেবল মাকে কিছুই দেখানো যায় না, খাওয়ানো যায় না। আমরা খেলেই মায়েদের খাওয়া হয় — তা-ই মা বলে গেছেন সারাজীবন। তবু আফসোস হয় তার না-থাকা নিয়ে। জানি অভিযোগ করে লাভ নেই। তাই ফিরি যাপিত জীবনে। হাসি, গাই, খাই, দাই আর নাদাইর গীত গাই। মা প্রতিদিনই প্রতিফলিত হচ্ছেন আমাদের কর্মে, ধর্মে, মর্মে।
আমার মা উনার ছোট জীবনকে বড় করতে পেরেছিলেন তাঁর কর্মে, সহমর্মিতায়, সহযোগিতায়, বন্ধুত্বে। আশির দশকে গড়ে-ওঠা ‘কিটিপার্টি’ এন্টারপ্রাইজে পরিণত হয় নব্বইর দশকে। মা ও উনার বন্ধুরা হয়ে যান নারী উদ্যোক্তা, ‘সী-বার্ড’ নামক স্বপ্নের জন্ম! দেখতে দেখতে সী-বার্ড স্কুল তার গৌরবের দুই যুগ পূর্ণ করল। মায়ের অগণিত ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ রাস্তাঘাটে মায়ের সৌজন্যে আমাদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সাধারণত আমরা বাবার পরিচয়ে পরিচিত হই, কিন্তু আমাদের দুই ভাইয়েরই সৌভাগ্য হয়েছে মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার। মা আমাকে সুর দান করেছেন। তিনি রাধারমণসংগ্রাহক ছিলেন। রাত জেগে ধামাইল গাওয়া তার নেশা ছিল।
মানুষের সাথে মিশতে পারা তার সহজাত ছিল। অসাম্প্রদায়িক হওয়ার শিক্ষা তার থেকেই পাওয়া। বললে হয়তো আরো বলা যাবে, তবে সবার মা-ই এ-রকমই, কমবেশি। মানবিক মায়ের সন্তানগুলো অমানবিক সমাজে নানা ব্যবস্থায় পাক খেতে খেতে হয়তো আর ততটা মানবিক থাকে না।
যাদের এখনও মা আছেন সঙ্গটা উপভোগ করুন, মায়ের যত্ন নিন। মা যখন থাকবেন না তখন যাতে আফসোস না হয় অনেকটা-না-করতে-পারার। আর যারা মাতৃহীন অভাগা তারা সন্তানের সাথে স্মৃতি জমিয়ে রাখুন, যখন আপনি থাকবেন না তখনও যেন সঙ্গে থাকেন সন্তানের। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজান্তরে ছড়াবে শিক্ষা, ভালোবাসা, বেঁচে থাকার প্রেরণা প্রগতির পথে।
- ১০ কবিতা || হোসনে আরা কামালী - June 26, 2025
- ঘুম ও না-ঘুমের গদ্যলেখা || ফজলুররহমান বাবুল - June 12, 2025
- অবসাদ ও অন্যান্য || জওয়াহের হোসেন - June 11, 2025
COMMENTS